সাধারণ মেয়ে

আমি অন্তঃপুরের মেয়ে,
চিনবে না আমাকে।
তোমার শেষ গল্পের বইটি পড়েচি, শরৎবাবু,
“বাসি ফুলের মালা।”—
তোমার নায়িকা এলোকেশীর মরণদশা ধরেছিল
পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে।
পঁচিশ বছর বয়সের সঙ্গে ছিল তার রেশারেশি,
দেখলেম, তুমি মহদাশয় বটে,
জিতিয়ে দিলে তাকে।

নিজের কথা বলি।
বয়স আমার অল্প।
একজনের মন ছুঁয়েছিল
আমার এই কাঁচা বয়সের মায়া।

তাই জেনে পুলক লাগত আমার দেহে,—
ভুলে গিয়েছিলেম, অত্যন্ত সাধারণ মেয়ে আমি।
আমার মতো এমন আছে হাজার হাজার মেয়ে
অল্প বয়সের মন্ত্র তাদের যৌবনে।

তোমাকে দোহাই দিই
একটি সাধারণ মেয়ের গল্প লেখো তুমি।
বড়ো দুঃখ তার।
তারো স্বভাবের গভীরে
অসাধারণ যদি কিছু তলিয়ে থাকে কোথাও,
কেমন করে প্রমাণ করবে সে,
এমন ক-জন মেলে যারা তা ধরতে পারে।
কাঁচাবয়সের জাদু লাগে ওদের চোখে,
মন যায় না সত্যের খোঁজে,
আমরা বিকিয়ে যাই মরীচিকার দামে।

কথাটা কেন উঠল তা বলি।
মনে করো তার নাম নরেশ।
সে বলেছিল কেউ তার চোখে পড়েনি আমার মতো।
এত বড়ো কথাটা বিশ্বাস করব-যে সাহস হয় না,—
না করব-যে এমন জোর কই।

একদিন সে গেল বিলেতে।
চিঠিপত্র পাই কখনো বা।
মনে মনে ভাবি, রাম রাম, এত মেয়েও আছে সে দেশে,
এত তাদের ঠেলাঠেলি ভিড়।

আর তারা কি সবাই অসামান্য,
এত বুদ্ধি, এত উজ্জ্বলতা।
আর তারা সবাই কি আবিষ্কার করেচে এক নরেশ সেনকে
স্বদেশে যার পরিচয় চাপা ছিল দশের মধ্যে।


গেল মেল-এর চিঠিতে লিখেচে
লিজির সঙ্গে গিয়েছিল সমুদ্রে নাইতে।
বাঙালী কবির কবিতা ক-লাইন দিয়েচে তুলে,
সেই যেখানে ঊর্ধ্বশী উঠচে সমুদ্র থেকে।
তার পরে বালির পরে বসল পাশাপাশি,—
সামনে দুলচে নীল সমুদ্রের ঢেউ,
আকাশে ছড়ানো নির্ম্মল সূর্য্যালোক।
লিজি তাকে খুব আস্তে আস্তে বল্‌লে,
“এই সেদিন তুমি এসেচ, দুদিন পরে যাবে চলে,
ঝিনুকের দুটি খোলা,
মাঝখানটুকু ভরা থাক্‌
একটি নিরেট অশ্রুবিন্দু দিয়ে,—
দুর্লভ মূল্যহীন।”
কথা বলবার কী অসামান্য ভঙ্গী
সেই সঙ্গে নরেশ লিখেচে
“কথাগুলি যদি বানানো হয় দোষ কী,
কিন্তু চমৎকার,—
হীরে-বসানো সোনার ফুল কি সত্য, তবুও কি সত্য নয়?”
বুঝতেই পারচ,
একটা তুলনার সঙ্কেত ওর চিঠিতে অদৃশ্য কাঁটার মতো

আমার বুকের কাছে বিঁধিয়ে দিয়ে জানায়-
আমি অত্যন্ত সাধারণ মেয়ে।
মূল্যবানকে পূরো মূল্য চুকিয়ে দিই
এমন ধন নেই আমার হাতে।
ওগো না হয় তাই হোলো,
না হয় ঋণীই রইলেম চিরজীবন।
পায়ে পড়ি তোমার, একটা গল্প লেখো তুমি, শরৎবাবু,
নিতান্ত সাধারণ মেয়ের গল্প,—
যে দুর্ভাগিনীকে দূরের থেকে পাল্লা দিতে হয়
অন্তত পাঁচ সাতজন অসামান্যার সঙ্গে-
অর্থাৎ সপ্তরথিনীর মার।
বুঝে নিয়েচি আমার কপাল ভেঙেচে,
হার হয়েছে আমার।
কিন্তু তুমি যার কথা লিখবে,
তাকে জিতিয়ে দিয়ো আমার হয়ে,
পড়তে পড়তে বুক যেন ওঠে ফুলে।
ফুল চন্দন পড়ুক তোমার কলমের মুখে।


তাকে নাম দিয়ো মালতী।
ঐ নামটা আমার।
ধরা পড়বার ভয় নেই;
এমন অনেক মালতী আছে বাংলাদেশে,
তারা সবাই সামান্য মেয়ে,
তারা ফরাসী জর্ম্মান জানে না,
কাঁদতে জানে।

কী করে জিতিয়ে দেবে।
উচ্চ তোমার মন, তোমার লেখনী মহীয়সী।
তুমি হয়তো ওকে নিয়ে যাবে আগের পথে,
দুঃখের চরমে, শকুন্তলার মতো।
দয়া কোরো আমাকে।
নেমে এসো আমার সমতলে।
বিছানায় শুয়ে শুয়ে রাত্রির অন্ধকারে
দেবতার কাছে যে অসম্ভব বর মাগি -
সে বর আমি পাব না,
কিন্তু পায় যেন তোমার নায়িকা।
রাখ না কেন নরেশকে সাতবছর লণ্ডনে,
বারে বারে ফেল করুক তার পরীক্ষায়,
আদরে থাক্ আপন উপাসিকা-মণ্ডলীতে।
ইতিমধ্যে মালতী পাস করুক এম, এ,
কলকাতা বিদ্যালয়ে,
গণিতে হোক প্রথম, তোমার কলমের এক আঁচড়ে।
কিন্তু ঐখানেই যদি থামো
তোমার সাহিত্য-সম্রাট নামে পড়বে কলঙ্ক।
আমার দশা যাই হোক
খাটো কোরো না তোমার কল্পনা।
তুমি তো কৃপণ নও বিধাতার মতো।
মেয়েটাকে দাও পাঠিয়ে য়ুরোপে।
সেখানে যারা জ্ঞানী যারা বিদ্বান যারা বীর,
যারা কবি যারা শিল্পী যারা রাজা,
দল বেঁধে আসুক ওর চারদিকে।
জ্যোতির্বিদের মতো আবিষ্কার করুক ওকে,
শুধু বিদুষী বলে নয়, নারী বলে।

ওর মধ্যে যে বিশ্ববিজয়ী জাদু আছে
ধরা পড়ুক তার রহস্য, মূঢ়ের দেশে নয়,
যে দেশে আছে সমজদার, আছে দরদী,
আছে ইংরেজ, জর্ম্মান, ফরাসী।
মালতীর সম্মানের জন্য সভা ডাকা হোক্ না,—
বড়ো বড়ো নামজাদার সভা।
মনে করা যাক্ সেখানে বর্ষণ হচ্চে মুষলধারে চাটুবাক্য,
মাঝখান দিয়ে সে চলেচে অবহেলায়-
ঢেউয়ের উপর দিয়ে যেন পালের নৌকো।
ওর চোখ দেখে ওরা করচে কানাকানি,
সবাই বলচে, ভারতবর্ষের সজল মেঘ আর উজ্জ্বল রৌদ্র
মিলেচে ওর মোহিনী দৃষ্টিতে।
(এইখানে জনান্তিকে বলে রাখি,
সৃষ্টিকর্ত্তার প্রসাদ সত্যই আছে আমার চোখে।
বলতে হোলো নিজের মুখেই,
এখনো কোনো য়ুরোপীয় রসজ্ঞের
সাক্ষাৎ ঘটেনি কপালে।)
নরেশ এসে দাঁড়াক সেই কোণে,
আর তার সেই অসামান্য মেয়ের দল।
আর তার পরে?
তার পরে আমার নটে শাকটি মুড়োলো,
স্বপ্ন আমার ফুরোলো।
হায়রে সামান্য মেয়ে
বিধাতার শক্তির অপব্যয়॥

২৯ শ্রাবণ, ১৩৩৯