আশা

মস্ত যে-সব কাণ্ড করি, শক্ত তেমন নয়;
জগৎ-হিতের তরে ফিরি বিশ্বজগৎময়।
সঙ্গীর ভিড় বেড়ে চলে; অনেক লেখা-পড়া,
অনেক ভাষায় বকাবকি, অনেক ভাঙা গড়া।
ক্রমে ক্রমে জাল গেঁথে যায়, গিঁঠের পরে গিঁঠ,
মহল পরে মহল উঠে, ইঁটের পরে ইঁট।
কীর্ত্তিরে কেউ ভালো বলে, মন্দ বলে কেহ,
বিশ্বাসে কেউ কাছে আসে, কেউ করে সন্দেহ।
কিছু খাঁটি, কিছু ভেজাল, মশ্‌লা যেমন জোটে,
মোটের পরে একটা কিছু হ’য়ে ওঠেই ওঠে॥

কিন্তু যে-সব ছোটো আশা করুণ অতিশয়,
সহজ বটে শুন্‌তে লাগে, মোটেই সহজ নয়।
এক টুকু সুখ গানের সুরে ফুলের গন্ধে মেশা,
গাছের ছায়ায়-স্বপ্ন দেখা অবকাশের নেশা,
মনে ভাবি চাইলে পাবো; যখন তা’রে চাহি,
তখন দেখি চঞ্চলা সে কোনখানেই নাহি।
অরূপ অকূল বাষ্পমাঝে বিধি কোমর বেঁধে
আকাশটারে কাঁপিয়ে যখন সৃষ্টি দিলেন ফেঁদে,
আদ্যযুগের খাটুনিতে পাহাড় হ’লো উচ্চ,
লক্ষযুগের স্বপ্নে পেলেন প্রথম ফুলের গুচ্ছ॥

বহুদিন মনে ছিলো আশা
ধরণীর এক কোণে
রহিব আপন মনে;
ধন নয়, মান নয়, একটুকু বাসা
ক’রেছিনু আশা।
গাছটির স্নিগ্ধ ছায়া, নদীটির ধারা,
ঘরে-আনা গোধূলিতে সন্ধ্যাটির তারা,
চামেলির গন্ধটুকু জানালার ধারে,
ভোরের প্রথম আলো জলের ওপারে।
তাহারে জড়ায়ে ঘিরে
ভরিয়া তুলিব ধীরে
জীবনের ক’দিনের কাঁদা আর হাসা;
ধন নয়, মান নয়, এইটুকু বাসা
ক’রেছিনু আশা॥

বহুদিন মনে ছিলো আশা
অন্তরের ধ্যানখানি
লভিবে সম্পূর্ণ বাণী;
ধন নয়, মান নয়, আপনার ভাষা
ক’রেছিনু আশা।
মেঘে মেঘে এঁকে যায় অস্তগামী রবি
কল্পনার শেষ রঙে সমাপ্তির ছবি,

আপন স্বপন-লোক আলোকে ছায়ায়
রঙে রসে রচি’ দিব’ তেমনি মায়ায়।
তাহারে জড়ায়ে ঘিরে
ভরিয়া তুলিব ধীরে
জীবনের ক’দিনের কাঁদা আর হাসা।
ধন নয়, মান নয়, ধেয়ানের ভাষা
ক’রেছিনু আশা॥

বহুদিন মনে ছিলো’ আশা
প্রাণের গভীর, ক্ষুধা
পাবে তা’র শেষ সুধা;
ধন নয়, মান নয়, কিছু ভালোবাসা
ক’রেছিনু আশা।
হৃদয়ের সুর দিয়ে নামটুকু ডাকা,
অকারণে কাছে এসে হাতে হাত রাখা,
দূরে গেলে একা ব’সে মনে মনে ভাবা,
কাছে এলে দুই চোখে কথা-ভরা আভা।
তাহারে জড়ায়ে ঘিরে
ভরিয়া তুলিবে ধীরে
জীবনের ক’দিনের কাঁদা আর হাসা।
ধন নয়, মান নয়, কিছু ভালোবাসা
ক’রেছিনু আশা॥


আণ্ডেস্ জাহাজ, ১৯ অক্টোবর, ১৯২৪।