পোকা-মাকড়/প্রাণীদের শ্রেণীবিভাগ
প্রাণীদের শ্রেণীবিভাগ
সংসারের জিনিস-পত্র ঠিক গুছাইয়া না রাখিলে, কোনোটাই কাজের সময়ে হাতের গোড়ায় পাওয়া যায় না। তখন বড় মুস্কিলে পড়িতে হয়। মনে কর, যেন তোমাদের রান্নাঘরের হাতাবেড়ি, ভাণ্ডার ঘরের চাল-দালের পাত্র, শুইবার ঘরের বিছানা-বালিশ এবং পড়িবার ঘরের কাগজ-পত্র, সকলি এলোমেলো করিয়া একটি ঘরে গাদা করিয়া রাখা হইয়াছে। এই অবস্থায় কোনো একটা জিনিস খুঁজিতে গেলে অনেক সময় কাটিয়া যায়। বামুন ঠাকুর হাঁড়িকুঁড়ি চাল-দাল হাতের গোড়ায় না পাইয়া তখন চীৎকার আারম্ভ করে,—ঠিক সময়ে খাওয়া হয় না। পড়ার বই খুঁজিতে গেলে সমস্ত সকালটা কাটিয়া যায়,—তোমাদের পড়া তৈয়ারি হয় না। ঘুমাইবার সময়ে বালিশ কম্বল খুঁজিয়া পাওয়া যায় না,—তখন হয় ত ঘরের মেজের উপরে শুইয়াই রাত্রি কাটাইতে হয়। জিনিস-পত্র গুছাইয়া না রাখার এমনই বিপদ। তোমাদের বাড়ীতে কতগুলি বই আছে, তাহা জানি না। হয় ত দুই তিনটা আল্মারিতে সংস্কৃত, বাংলা ও ইংরাজি ভাষার গল্পের বই, ব্যাকরণ, অভিধান কত কি আছে। এই সকল বই তোমরা যদি থাকে-থাকে আল্মারিতে সাজাইয়া না রাখ, তাহা হইলে কোনো একখানি বই খুঁজিতে গেলে গোলযোগে পড়িতে হয় না কি? তখন একখানি সংস্কৃতের বই বাহির করিতে গেলে, হয় ত এক ঘণ্টা খুঁজিয়া মরিতে হইবে এবং শেষে অঙ্কের বইয়ের কাছে সেখানির সন্ধান পাইবে।
এই পৃথিবীতে নানা রকমের প্রাণী আছে। কাহারো দু’খানা পা, কাহারো চারিখানা পা, কাহারো কাহারো আবার ছ’খানা, আটখানা এবং একশতখানা পা; কাহারো আবার পা নাই, তাহারা বুকে হাঁটিয়া চলে। কেহ উড়িয়া বেড়ায়, কেহ জলে ডুব দিয়া চলাফেরা করে; কাহারো শরীরে হাড় নাই, কাহারো শরীর আবার হাড়ের মত শক্ত আবরণে ঢাকা। কাজেই, যাঁহারা প্রাণীদের শরীরের এবং তাহাদের জীবনের কথা জানিতে চাহেন, হাজার হাজার রকমের প্রাণীদের মধ্যে পড়িয়া তাঁহাদিগকে দিশাহারা হইতে হয়। তাই কাজের সুবিধার জন্য আমরা যেমন ঘরকন্নার জিনিসপত্র ও আল্মারির খাতাপত্র রকমে রকমে সাজাইয়া রাখি, পণ্ডিতেরাও সেই প্রকারে শরীরের গঠন প্রভৃতি অনুসারে সমস্ত প্রাণীকে কয়েকটি বড় বড় দলে ভাগ করেন। কিন্তু এই রকমে ভাগ করিয়াই তাঁহারা নিশ্চিন্ত থাকেন না। ইহার পরেও প্রত্যেক দলের প্রাণীদের শরীরের ছোটোখাটো প্রভেদ এবং চলা-ফেরা খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদির খুঁটিনাটি পার্থক্য জানিয়া লইয়া, তাঁহারা প্রত্যেক বড় বড় দলের প্রাণীগুলিকে আরো ছোটো ছোটো দলে ভাগ করেন।
একটা উদাহরণ দিলে প্রাণীদের বিভাগের কথা তোমরা ভালো করিয়া বুঝিবে।
মনে কর,—আমরা গোরুর শ্রেণী-বিভাগ করিতেছি। দেখিলেই বুঝা যায়, গোরুর দেহে শিরদাঁড়া অর্থাৎ মেরুদণ্ড আছে; সুতরাং গোরু যে, মেরুদণ্ডী প্রাণী তাহা সহজেই স্থির হইয়া যায়। কিন্তু কেবল গোরুই মেরুদণ্ডী প্রাণী নয়,—সাপ, ব্যাঙ্, মাছ, বানর, মানুষ সকলের মেরুদণ্ড আছে। কাজেই গোরু যাহাতে সাপ ব্যাঙের দলে না পড়ে, তাহা দেখা প্রয়োজন হয়। এই জন্য ইহার জীবনের কাজ-কর্ম্ম ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ভালো করিয়া দেখিতে হয়। গোরুর দেহ লোমে ঢাকা থাকে; ইহারা সাপ বা ব্যাঙের মত ডিম প্রসব না করিয়া শাবক প্রসব করে, এবং শাবকগুলিকে স্তনের দুধ খাওয়াইয়া বড় করে। অনুসন্ধান করিলে গোরুর এই সকল ব্যাপার আমাদের নজরে পড়িয়া যায়। সুতরাং গোরুকে স্তন্যপায়ী প্রাণী বলা যাইতে পারে,—কাজেই ইহা মেরুদণ্ডীদের গণের স্তন্যপায়ী শ্রেণীর প্রাণী হইয়া দাঁড়ায়।
কিন্তু এই বিভাগকেই শেষ বিভাগ করিলে চলে না। যাহাদের মেরুদণ্ড আছে, আবার যাহারা স্তনের দুধ খাওয়াইয়া শাবকদিগকে বাঁচায়, এইরকম প্রাণী গোরু ছাড়া আরো অনেক আছে। মানুষ, বানর, শূকর, বাঘ, ভালুক সকলেই এই রকম প্রাণী; সুতরাং গোরুর জীবনের আরো কিছু কিছু বিষয় জানিয়া তাহাকে মানুষ, বানর, বাঘ, ভালুক ইত্যাদি হইতে পৃথক্ করা দরকার। গোরুরা কি রকমে খায় এবং কি রকমে খাদ্য চিবায়, মনে করিয়া দেখ। একগাদা টাটকা ঘাস সম্মুখে রাখিলে গোরু তাহা পাঁচ মিনিটে খাইয়া শেষ করে, কিন্তু ইহাতে ঘাসগুলি পেটে যায় না। পেটের ভিতরে পাক-যন্ত্রের কাছে যে একটা থলি থাকে, উহা প্রথমে সেখানে জমা হয়। পরে গাছের ছায়ায় বা গোয়াল-ঘরে শুইয়া যখন গোরুরা ঝিমাইতে থাকে, তখন সেই ঘাসই আবার তাহাদের মুখে আসিয়া উপস্থিত হয়। তখন, উহারা সেই ঘাস অনেকক্ষণ ভালো করিয়া চিবাইয়া গিলিয়া ফেলে। এই রকমে দ্বিতীয়বার চিবাইয়া গিলিলে, খাদ্য পাকযন্ত্রে অর্থাৎ পেটে পৌঁছে। এই প্রকার দ্বিতীয়বার চিবানোকে “জাবর-কাটা” বলে,—ভালো কথায় তাহাকেই “রোমন্থন” করা বলা হয়। সুতরাং গোরু রোমন্থক প্রাণীদের বর্গে (Order) পড়ে। এই বর্গের প্রাণীদের পায়ের খুর জোড়া নয়। ঘোড়ার খুর জোড়া,—তাহারা গোরুদের মত জাবর কাটায় না,—তাহারা যাহা খায় তাহা একবারে গিলিয়া পাকযন্ত্রে লইয়া যায়।
যাহা হউক, দেখা গেল—গোরু মেরুদণ্ডী, স্তন্যপায়ী এবং রোমন্থক প্রাণী। কিন্তু এই রকম ভাগ করাতেও গোরুর পরিচয় সম্পূর্ণ হয় না,—কারণ উট, হরিণ, মহিষ প্রভৃতি জন্তুরাও গোরুদের মত দুইবার গিলিয়া খায়। কাজেই উট ও হরিণের সঙ্গে গোরুদের গোলযোগ বাধার সম্ভাবনা থাকে। সুতরাং আরো কোনো নূতন পরিচয়ে গোরুকে ঐ সকল জন্তু হইতে পৃথক্ করা দরকার। এইরূপ স্থলে জীবতত্ত্ববিদ্গণ প্রাণীদিগকে এক একটা বিশেষ নাম দিয়া এই কাজটি শেষ করেন। তাঁহারা গোরুকে বৃষগোষ্ঠীর (Bos) অন্তর্গত করেন। এই রকমে প্রাণি-বিভাগে গোরুর সহিত আর কোনো জানোয়ারের মিল থাকিতে পারে না।
সুতরাং আমরা যে-রকমে গোরুর স্থান নির্দ্দেশ করিলাম, সেই অনুসারে গোরুরা মেরুদণ্ডীদের গণের স্তন্যপায়ীদের শ্রেণীতে পড়িল। তার পরে খাদ্য দুইবার গিলিয়া খায় বলিয়া ইহারা রোমন্থক প্রাণীদের বর্গে গেল এবং অন্য রোমন্থক প্রাণী হইতে পৃথক্ করিবার জন্য তাহাদিগকে শেষে বৃষ-জাতিতে ফেলা হইল।
কেবল গোরু নয়, সকল প্রাণীকেই বৈজ্ঞানিকেরা এই রকমে শরীরের মোটামুটি গড়ন দেখিয়া প্রথমে বড় বড় শাখায় ভাগ করেন। তার পরে তাহাদের চালচলন ও দেহের ভিতরকার কাজ খোঁজ করিয়া, সেইগুলিকেই আরো কতকগুলি ছোটো ছোটো দলে ফেলেন। ইহাতে প্রাণীদিগকে চিনিয়া লইয়া তাহাদের জীবনের সকল বিষয় সন্ধান করার সুবিধা হয়।
আমরা প্রাণীদের ছোটো দলগুলির কথা বলিব না। পৃথিবীর সমস্ত পোকা-মাকড়কে কয়েকটি প্রধান শাখায় ভাগ করা হইয়াছে, তাহাদেরি অল্প পরিচয় দিব এবং সেই সকল শাখার যে প্রাণীদের সহিত তোমাদের জানাশুনা আছে, তাহাদের জীবনের কথা বলিব।