পোকা-মাকড়/প্রাণীদের দেহের বৃদ্ধি

প্রাণীদের দেহের বৃদ্ধি

 ছেলেবেলায় যখন তোমাদেরি মত ছোটো ছিলাম, তখন কেবলি মনে হইত—বাগানে ঐ যে ছোটো চারা গাছটি পুঁতিয়াছিলাম এবং খাঁচায় ঐ যে পাখীর বাচ্চাটি রাখিয়া যত্ন করিতেছিলাম,—দুই মাস পরে তাহারা এত বড় হইল কেন? মনের এই প্রশ্নটির উত্তর তখন কাহারো কাছে পাই নাই,—হয় ত কাহাকে জিজ্ঞাসা করিতেও সাহস হয় নাই। তোমাদের মধ্যে কাহারো কাহারো মনে হয় ত এই রকম প্রশ্ন উপস্থিত হয়। তাই কোন্ কোন্ সামগ্রী দিয়া প্রাণীদের শরীর গড়া হইয়াছে, এবং দিনে দিনে তাহারা কি প্রকারে বাড়ে তাহার একটু পরিচয় দিব।

 মাটি দিয়া পুতুল গড়া হয়, ইট কাঠ চূণ বালি দিয়া ঘর-বাড়ী গাঁথা হয়। যে জিনিস দিয়া গাছপালা এবং প্রাণীদের দেহ প্রস্তুত, তাহাকে কোষ বলে। ইট কাঠের আকৃতি হাতে নাড়িয়া চাড়িয়া এবং চোখে দেখিয়া আমরা সহজে জানিতে পারি। কিন্তু প্রাণীদের শরীরের কোষ এত ছোটো যে, তাহা খালি-চোখে দেখা যায় না; দেখিতে হইলে খুব বড় অণুবীক্ষণ যন্ত্রের দরকার হয়। তোমরা হয় ত মনে করিতেছ, কোষগুলির আকার ইটের মত চৌকা রকমের, না হয় ভাঁটার মত গোল; কিন্তু তাহা নয়। দেহের সকল জায়গার কোষের আকৃতি একই রকম হয় না। চৌকা লম্বা গোল চেপ্‌টা সকল রকমের কোষই প্রাণীর শরীরে আছে। মানুষের গায়ের

১ম চিত্র।

মাংসপেশীর কোষ অণুবীক্ষণ যন্ত্রে কি রকম দেখায়, এখানে তাহার একটা ছবি দিলাম। দেখ, এই কোষ লম্বা। তার পরের ছবিটি প্রাণীর লিভার অর্থাৎ যকৃতের কোষের আকৃতি। যকৃতের কোষগুলি যেন মৌমাছির চাকের এক একটা কুঠারি। কোষের আকৃতি কত বিচিত্র হয়, ছবি দুইটি দেখিলেই তোমরা বুঝিতে পারিবে।

 ছবির প্রত্যেক কোষের মধ্যে তোমরা এক একটি কালো বিন্দু দেখিতে পাইবে,—ইহাকে কোষসামগ্রী বলে। কিন্তু ইহাই কোষের একমাত্র বস্তু নয়। ঐ জিনিসটাকে ঘিরিয়া আর একটি বস্তু থাকে, ইহাকে জীব-সামগ্রী বলে। প্রাণী ও গাছপালার শরীরে ইহাই সজীব দ্রব্য। যাহা আমাদের খুব আদরের ও কাজের জিনিস, তাহাকে আমরা অনেক যত্ন করিয়া রাখি; সর্ব্বদা ভয় হয়, পাছে তাহা নষ্ট হইয়া যায়। প্রাণীর দেহের সেই ছোটো কোষের ভিতরকার কোষ-সামগ্রী এবং জীব-সামগ্রীর মত আদরের দ্রব্য আর নাই। এইগুলিই প্রাণীকে বাঁচাইয়া রাখে। তাই যাহাতে হঠাৎ নষ্ট না হয়, তাহার জন্য ঐ দুইটি জিনিসের চারিদিক্ প্রায়ই খুব মজবুত প্রাচীর দিয়া ঘেরা থাকে। ছোটো কৌটার মধ্যে যেমন তোমরা সোনার আংটি সাবধানে রাখিয়া দাও, কোষ-সামগ্রী কোষের প্রাচীরের মধ্যে ঠিক সেই প্রকার সাবধানে থাকে। এই ব্যবস্থায় বাহিরের আঘাত কোষের ভিতরকার আসল জিনিসটাকে নষ্ট করিতে পারে না। আমরা কোষের যে নানা আকৃতির ছবি দিয়াছি, তাহা কোষ-প্রাচীরেরই ছবি। কোষ-সামগ্রী অতি ছোটো এবং তরল জিনিসের মত। আমিবা প্রভৃতি এক-কোষ প্রাণীর কোষে কিন্তু কোষ-প্রাচীর দেখা যায় না।

 এখন প্রাণীদের শরীর কি রকমে বৃদ্ধি পায়, তাহা বলিব। পরীক্ষা করিয়া দেখা গিয়াছে, প্রাণিদেহের কোষ-সামগ্রী যখন পুষ্ট হইয়া পড়ে, তখন তাহা একটি কোষের মধ্যে আটক থাকিতে চায় না। এই অবস্থায় তাহা আপনা হইতেই দুই ভাগে ভাগ হইয়া পড়ে। এই রকমে গোড়ার একটি কোষ দুইটি হইয়া দাঁড়ায় এবং পরে সেই দুইটি কোষই বড় হইয়া চারিটি হয়। প্রাণীরা যতদিন সবল থাকে, ততদিন এই প্রকার নূতন নূতন কোষ জন্মে। কাজেই, প্রাণীর দেহের বৃদ্ধি হইতে থাকে। নূতন ইট কাঠ জুড়িলে যেমন ছোটো ঘর বড় হয়, দেহে নূতন নূতন কোষ জড় হইলে ঠিক সেই রকমেই দেহ বড় হইয়া পড়ে। কিন্তু এই রকম নূতন কোয-সৃষ্টির একটা সীমা আছে। তাই প্রাণী বা গাছপালার দেহ কিছু দিন বাড়িয়াই আর বাড়ে না। ঐ রকম কোষ-সৃষ্টি যদি বুড়া বয়স পর্য্যন্তই চলিত তোমরা তাহা হইলে একটা ছোটো পোকাকে হাতীর মত বড় হইতে দেখিতে।

 অতি সংক্ষেপে তোমাদিগকে দেহের বৃদ্ধির কথা বলিলাম। কিন্তু প্রাণিদেহের বৃদ্ধির ইহাই কারণ। মাতার গর্ভে যখন সন্তান জন্মে এবং ডিম হইতে যখন শাবকের সৃষ্টি হইতে থাকে তখনো গোড়ার একটি কোষই নিজেকে ভাডিয়া চুরিয়া ঐ প্রকারেই কোটি কোটি নূতন কোষের উৎপত্তি করে। শেষে সেইগুলিই পৃথক্ হইয়া গিয়া সন্তানের হাড় রক্ত মাংস ইত্যাদির সৃষ্টি করে।

 কোষ-সামগ্রী কোন্ কোন্ পদার্থ দিয়া প্রস্তুত তাহা জানা গিয়াছে। তাহা কি প্রকারে পুষ্ট হয়, কোন্ শক্তিতে তাহা আপনা হইতেই ভাঙিয়া চুরিয়া পৃথক্ কোষের সৃষ্টি করে, এই সকল বিষয়ে বড় বড় পণ্ডিতেরা বড় বড় কথা বলিয়াছেন; কিন্তু ঠিক ব্যাপারটি কি তাহা আজও স্পষ্ট জানা যায় নাই। তা-ছাড়া গাছপালা ও প্রাণীরা পূর্ণ আকার পাইলে, তাহাদের দেহে কেন আর নূতন কোষের সৃষ্টি হয় না, তাহাও ভালো করিয়া জানা যায় নাই। এই সকল শক্ত বিষয়ের কোনো কথা তোমাদিগকে এখন বলিব না। তোমরা বড় হইয়া যখন জীবতত্ত্বসম্বন্ধে বড় বড় বই পড়িবে, তখন এই সম্বন্ধে অনেক খবর পাইবে।