পোকা-মাকড়/প্রাণীদের উন্নতি
প্রাণীদের উন্নতি
যে কথাগুলি বলিলাম, বোধ হয় তাহা তোমরা ভালো করিয়া বুঝিলে না। একটা উদাহরণ দেওয়া যাউক। পরীক্ষার ফল বাহির হইলে তোমাদের স্কুলে পুরস্কার দেওয়া হয়। ক্লাসে ছেলে অনেক, সকলেই পুরস্কার পাইবার জন্য পরিশ্রম করে। শেষে তোমাদের মধ্যে যে তিন চারিটি ছেলে পরীক্ষায় সকলকে হারাইয়া বেশি নম্বর রাখে, তাহারাই পুরস্কার পায়। মনে কর, তোমাদের স্কুলের নিয়ম হইল,—ভালো-মন্দ প্রত্যেক ছেলেই পুরস্কার পাইবে এবং লোকে সকলকেই আদর করিবে। এই অবস্থায় তোমরা কি করিবে, ভাবিয়া দেখ দেখি। তখন তোমরা কেহই পরীক্ষায় ভালো হইবার জন্য চেষ্টা করিবে না; তোমাদের মনে হইবে, যখন সকলেই সমান পুরস্কার ও সমান আদর পাইতেছে, তখন মিছামিছি খাটিয়া কষ্ট পাই কেন?
আর একটা উদাহরণ দেওয়া যাউক। চুপ করিয়া ঘরে বসিয়া থাকিলে মানুষ জীবনে সুখ পায় না। সকলকেই খাটিয়া টাকাকড়ি মানসম্ভ্রম ও বিদ্যাজ্ঞান উপার্জ্জন করিতে হয়—যে যত বুদ্ধি করিয়া খাটিতে পারে, সে জীবনে ততই সুখী হয়। মনে কর, পৃথিবীটা এমন হইয়া গেল, যেন, লোকজনের খাওয়া-দাওয়া ও সুখভোগের ভাবনা থাকিল না—যখন যেটি দরকার তাহা ভগবানের আদেশে হাতের গোড়ায় ও মুখের উপরে আসিতে লাগিল। তখন পৃথিবীর এই লোকগুলা কি করিবে, বলিতে পার কি? ঘুমাইয়া, গড়াগড়ি দিয়া, হাঁই তুলিয়াই জীবন কাটাইবে না কি? তখন কলকারখানা ট্রাম্-রেলওয়ে, স্কুল-কলেজ, সকলি বন্ধ হইয়া যাইবে। এই অবস্থায় মানুষ একেবারে মাটি হইয়া যাইবে, তখন দুই পা চলিয়া বেড়াইতে বা একটু নড়িয়া বসিতেও তাহাদের কষ্ট হইবে।
সুতরাং বুঝা যাইতেছে, যে-সকল জিনিস পাইলে মানুষ সুখে স্বচ্ছন্দে জীবন কাটাইতে পারে এবং মনের সুখ পাইতে পারে, তাহা সহজে হাতের গোড়ায় পাওয়া যায় না। এই জন্যই লোকে যত্ন করিয়া লেখাপড়া শিখে, জ্ঞানবুদ্ধির উন্নতি করে। তাহার পর যে দেশের লোক পরিশ্রম ও বুদ্ধির বলে, শিল্পের বলে এবং টাকার জোরে বড় হয়, সেই দেশই পৃথিবীতে সম্মান পায়।
মানুষের সম্বন্ধে এতক্ষণ যাহা বলিলাম, ছোটো প্রাণীদের সম্বন্ধেও ঠিক সেই কথা বলা চলে। পৃথিবীর উপরে যে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি পোকা-মাকড় চলিয়া ফিরিয়া বেড়াইতেছে, তাহাদিগকেও মানুষের মত চেষ্টা করিয়া খাবার জোগাড় করিতে হয়। বলবান্ শত্রুরা যখন তাহাদিগকে আক্রমণ করে, তখন জোর দেখাইয়া বা কৌশল করিয়া আত্মরক্ষা করিতে হয়। তা-ছাড়া সন্তানদিগকে বাঁচাইয়া রাখিবার জন্য চেষ্টা করিতে হয় এবং মাথা গুঁজিবার মত বাসা না থাকিলে নিরাপদ জায়গায় বাসা প্রস্তুত করিতে হয়। তোমাদের ঘরের কোণে বা বাগানের গাছের ডালে মাকড়সারা কত কষ্ট করিয়া জাল বুনে, তাহা অবশ্যই দেখিয়াছ। ক্ষুধা লাগিলেই যদি মোটা মোটা মাছি ও পোকা আসিয়া মাকড়সার কাছে ধরা দিত, তাহা হইলে কোনো মাকড়সা কি জাল পাতিয়া মাছি ধরিতে যাইত? কিন্তু কোনো মাছিই মাকড়সার কাছে ধরা দিতে চায় না; তাই তাহারা মাকড়সা দেখিলেই কৌশলে পলাইয়া যায় এবং মাকড়সারা আরো কৌশল খাটাইয়া জালের ফাঁদ পাতে, ও সেই ফাঁদে মাছিদিগকে ফেলিয়া খাবারের জোগাড় করে।
ইহা হইতে তোমরা বুঝিতে পারিবে, মাকড়সার জাল বুনিবার কৌশল এবং মাছির সতর্কভাবে চলাফেরার অভ্যাস, পরস্পরকে হারাইয়া দিবার চেষ্টা হইতে জন্মিয়াছে। ইহা যেন তোমাদের ক্রিকেট খেলা। তুমি চাও, তুমি যাহাতে “আউট্” না হও, আর তোমার বন্ধু চায়, তোমাকে “আউট্” করিতে। দুই দশ দিন এই প্রকারে খেলা করিতে করিতে তুমি “বল্” মারিবার কৌশল এমন সুন্দর শিখিয়া যাও যে, কেহ তোমাকে সহজে “আউট” করিতে পারে না; সঙ্গে সঙ্গে তোমার বন্ধুও “বল্” দিবার এমন কৌশল শিখিয়া যায় যে, সে একজন পাকা “বোলার” হইয়া দাঁড়ায়।
যাহা হউক, আমরা মাকড়সা ও মাছি সম্বন্ধে যে কথা বলিলাম, পৃথিবীর অনেক প্রাণীর সম্বন্ধেই সেই কথা বলা খাটে। শত্রুকে হারাইয়া নিজের ও সন্তানদের জীবন রক্ষা করিতে হইবে বলিয়াই উঁচু গাছের পাতার আড়ালে পাখীরা ক্রমে এমন বাসা বাঁধিতে শিখিয়াছে। শত্রুদের সঙ্গে লড়াই করিয়া বাঁচিয়া থাকিবার জন্যই শামুক ও কচ্ছপের শরীর কঠিন আবরণে ঢাকা থাকে এবং ছুঁচোর গায়ে এমন বিশ্রী দুর্গন্ধ মাখানো থাকে। আবার আর এক দিকে দেখ,—বড় বড় প্রাণীদিগকে মারিয়া আহার করিবার জন্য বাঘ ভালুক ও সিংহের মুখে এমন ধারালো দাঁত এবং থাবায় এমন ছুঁচ্লো নখের সৃষ্টি হইয়াছে।
কেবল শত্রুর হাত হইতে রক্ষা পাইবার জন্য এবং খাবার সংগ্রহের জন্যই যে, প্রাণীরা এইরকম বিচিত্র আকার পাইয়াছে, তাহা নয়। বাসের জায়গা লইয়া কাড়াকাড়ি আরম্ভ হইলে অনেকে দেহের পরিবর্ত্তন করিয়া ধীরে ধীরে নানা জাতিতে পরিণত হইয়াছে। গ্রামে বসতি বেশি হইলে বা সেখানে চোর ডাকাতের উৎপাত ঘটিলে লোকে কি করে, তোমরা অবশ্যই জান। তখন লোকে গ্রাম ছাড়িয়া নদীর ধারে মাঠের মধ্যে নূতন বাড়ী-ঘর নির্ম্মাণ করিতে আরম্ভ করে। ক্রমে দূরদূরান্তর হইতে আরো লোকজন আসিয়া সেখানে বাড়ী করে। ইহাতে এক নূতন গ্রামের পত্তন হইয়া যায়। ছোটো প্রাণীদের মধ্যে বাসস্থানের এই প্রকার নড়াচড়া যে কত দেখা যায়, তাহা বলিয়া শেষ করা যায় না। জলেই প্রথম প্রাণীর জন্ম হইয়াছিল। তার পরে সমুদ্রের ও নদীর জল এককালে যখন প্রাণীতে প্রাণীতে পরিপূর্ণ হইয়া পড়িয়াছিল, তখন জলের প্রাণী ডাঙায় আসিয়া বাস করিতে আরম্ভ করিয়াছিল। শামুক গুগ্লি জলের প্রাণী, যখন তাহারা নানা কারণে জলে টিঁকিয়া থাকিতে পারিল না, তখন তাহাদেরি মধ্যে কতকগুলি ডাঙায় আসিয়া সুখে স্বচ্ছন্দে বাস করিতে আরম্ভ করিল এবং সঙ্গে সঙ্গে তাহাদের দেহেরও অনেক পরিবর্ত্তন হইতে লাগিল। আমরা এখন যে সকল ডাঙার শামুক দেখিতে পাই, তাহারা জলের শামুকদেরই জ্ঞাতি। আবার ডাঙায় থাকিয়া আত্মরক্ষা করা যাহাদের কঠিন হইয়াছিল, তখন তাহারা স্থলের প্রাণী হইয়াও জলে আশ্রয় লইয়াছিল। তিমি মাছ ইহাদের একটা উদাহরণ। ইহারা গোড়ায় স্থলচর প্রাণী ছিল। যাহাদের জলে বা স্থলে কোনোখানেই থাকার সুবিধা হইল না,—তাহারা উভচর হইয়া দাঁড়াইল। ব্যাঙ্, কচ্ছপ এবং আরো অনেক প্রাণী উভচর। ইহারা সুবিধামত কখনো জলে এবং কখনো স্থলে বাস করিয়া বাঁচিয়া আছে। যে সকল দুর্ব্বল প্রাণীর উপরে শত্রুর উৎপাত বেশি ছিল, তাহারা জলের উপরে বা ডাঙায় প্রকাশ্যভাবে বাস করিতে পারে নাই,—সমুদ্রের পাঁকের তলায় কিংবা অন্ধকার পর্ব্বতের গুহায় আশ্রয় লইয়া বাস করিতে আরম্ভ করিয়াছিল। এই সকল প্রাণীর সন্তান-সন্ততি এখন অনেক আছে,—সমুদ্রের উপরকার জলে বা ডাঙায় তাহারা বেড়াইতে পারে না,—সূর্য্যের আলো তাহাদের সহ্যই হয় না।
এপর্য্যন্ত যাহা বলিলাম তাহা হইতে তোমরা বোধ হয় বুঝিয়াছ,—জগদীশ্বর যে কোটি কোটি প্রাণীর জন্ম দিয়া জলে স্থলে আকাশে ছাড়িয়া দিয়াছেন, তাহারা দলে দলে মরিয়া নির্ব্বংশ হউক, ইহা তাঁহার উদ্দেশ্য নয়। স্থান লইয়া, খাদ্য লইয়া ও আবাস লইয়া পরস্পরের মধ্যে কাটাকাটি মারামারি চলুক, এবং সকলে এই লড়াইয়ে যোগ দিয়া পরস্পরকে উন্নত করুক, এবং যাহারা এই লড়াইয়ে যোগ দিবার অনুপযুক্ত, কেবল তাহারাই মরুক্—ইহাই তাঁহার অভিপ্রায়। এই লড়াইয়ে যোগ দিয়া কিছুকাল জিতিয়াছিল বলিয়াই, পিপীলিকা ও মৌমাছিরা এত বুদ্ধিমান্।