পোকা-মাকড়/ষষ্ঠ শাখার প্রাণী/ঝিল্লীপক্ষ পতঙ্গ/বাংলা দেশের পিঁপ্ড়ে
বাংলা দেশের পিঁপ্ড়ে
আমরা যে-সব পিঁপ্ড়ে দেখিতে পাই তাহাদের মধ্যে মোটামুটি,—(১) ডেঁয়ে (২) সুড়সুড়ে বা ধাওয়া (৩) কাঠ-পিঁপ্ড়ে বা মেঝেল (৪) লাল-পিঁপ্ড়ে—এই চারি জাতি দেখা যায়।
ডেঁয়েদের দাঁত খুব বড় ও ধারালো কিন্তু হুল থাকে না। কাঠ-পিঁপ্ড়ের হুল ও দাঁত দুইই আছে,—ইহারা ভয়ানক বিষাক্ত। ধাওয়া বা সুড়সুড়ে পিঁপ্ড়েরা বড় ভালোমানুষ। তাহাদের দাঁত বড় নয় এবং হুলও থাকে না।
তোমরা জিঁয়ে এবং লাল ক্ষুদে পিঁপ্ড়ে নিশ্চয়ই দেখিয়াছ। ইহারা ভয়ানক রাগী ও বিষাক্ত। ডেঁয়ে, কাঠ-পিঁপ্ড়ে এবং সুড়সুড়ে পিঁপ্ড়েরা প্রায়ই একা একা ঘুরিয়া বেড়ায়, কিন্তু জিঁয়ে ও ক্ষুদে পিঁপ্ড়েরা তাহা করে না। ইহার দল বাঁধিয়া চলা-ফেরা করে। জ্যান্ত কেঁচো বা আধমরা ফড়িং শিকার করিবার জন্য যখন জিঁয়েরাা সার বাঁধিয়া চলে তখন মনে হয় যেন, তাহারা যুদ্ধ করিতে চলিয়াছে। শিকারের সময়ে সত্যই ইহারা যুদ্ধ-সজ্জা করিয়া চলে। সম্মুখে সৈনিক ও দূতেরা থাকে। তাহারা একটু আগাইয়া গিয়া কোথায় শিকার আছে বা কোথায় বিপদের সম্ভাবনা তাহা জানিয়া লয় এবং সেই খবর দলের পিঁপ্ড়েদের জানায়।
রান্নাঘরে ও ভাঁড়ারঘরে জিঁয়েদের উৎপাত বেশি। হাঁড়ির ভিতরকার ভাজা মাছ পর্য্যন্ত ইহারা খাইয়া ফেলে। ইহাদের অত্যাচার হইতে উদ্ধার পাইবার জন্য বাড়ীর মেয়েরা দুই একটা পিঁপ্ড়েকে আধ্মরা করিয়া মাটিতে ফেলিয়া রাখেন। কয়েক মিনিটেই দলের দুই চারিটি পিঁপ্ড়ে সেখানে আসিয়া দাঁড়ায় এবং শুঁয়ো দিয়া আহত পিঁপ্ড়েকে পরীক্ষা করে। যখন দেখে সঙ্গীরা সত্যই মৃতপ্রায়, তখন তাহারা ভয় পাইয়া গর্ত্তের সকল পিঁপ্ড়েদের বিপদের কথা জানায়। ইহার পরে অনেকক্ষণ কোনো পিঁপ্ড়েই গর্ত্তের বাহিরে আসে না।
রাঙী পিঁপ্ড়ে তোমরা দেখ নাই কি? ইহারা জিঁয়েদের চেয়ে ছোট, কিন্তু কম কামড়ায় না। ইহারাও একা চলে না। বর্ষাকালে দিনের বেলায় যদি একটা কেঁচো গর্ত্তের উপরে উঠে, তবে রাঙীর দল তাহাকে আক্রমণ করিয়া খাইয়া ফেলে বা খণ্ড খণ্ড করিয়া বাসায় টানিয়া লইয়া যায়। ইহারা জিঁয়েদের মত মাটির উপরে চলিতে ভালবাসে না; মাটির তলায় সুড়ঙ্গ করিয়া সারি বাঁধিয়া চলে এবং মাঝে মাঝে উপরে উঠিবার পথ রাখে। বৃষ্টির পরে ইহারা বাসার ভিতর হইতে অনেক মাটি তুলিয়া গর্ত্তের মুখে আল্ বাঁধে।
তোমরা গাছের লাল-পিঁপ্ড়ে নিশ্চয়ই দেখিয়াছ। এই পিঁপ্ড়েদের কেহ লাসা কেহ-বা নাল্সো বলে। বাগানের কলা পেঁপে আম প্রভৃতি বড় বড় গাছেই ইহাদের প্রধান আড্ডা। সাধারণ পিঁপ্ড়ের চেয়ে ইহারা আকারে বড়, পা ও শুঁয়ো বেশ লম্বা। বুক ও লেজের জোড়ে কেবল একটি ‘বল’ অর্থাৎ পিণ্ড আছে। ইহাদের লেজে হুল্ নাই। কিন্তু দাঁত সাঁড়াসির মত জোরালো। তোমরা যদি কোনো নাল্সো পিঁপ্ড়েকে বিরক্ত কর, তবে সে শুঁয়ো উঁচু করিয়া তোমাকে কামড়াইতে আসিবে। কামড়াইলে মনে হয় যেন কামড়ের জায়গাটা আগুনে পুড়িয়া গেল। ইহারা দাঁত দিয়া কামড়াইয়া কামড়ের জায়গায় একরকম পাত্লা জিনিস ঢালিয়া দেয়। ইহাই তাহাদের বিষ। লেজের দিকে একটা ছিদ্রে বিষ থাকে। কিন্তু ইহা মারাত্মক বিষ নয়। গায়ে লাগিলে কিছুক্ষণ খুব কষ্ট দেয়, তার পরে জ্বালা-যন্ত্রণা কমিয়া যায়।
নাল্সো-পিঁপ্ড়ের বাসা হয় ত তোমরা বাগানের গাছপালায় দেখিয়াছ। গাছের যে-সকল সরু ডালে বেশি পাতা থাকে, তাহারি কতকগুলি তাজা পাতা মাকড়সার জালের মত সূতা দিয়া জড়াইয়া ইহারা বাসা বাঁধে। পাতাগুলি কিছুদিন বেশ তাজা থাকে, কিন্তু পরে শুকাইয়া যায়। এই রকম পাতার ঘরে নাল্সো-পিঁপ্ড়েরা ডিম, বাচ্চা ও খাবার বোঝাই করিয়া বাস করে। যদি বাসার কাছে কোনো গোলযোগ হয়, তবে তাহারা দলে-দলে ঘর হইতে বাহির হইয়া লড়াই করিবার জন্য প্রস্তুত হয় এবং সারে সারে দাঁড়াইয়া শুঁয়ো নাড়িতে থাকে।
নাল্সো-পিঁপ্ড়েরা কি রকমে বাসা বাঁধে তাহা বোধ হয় তোমরা জান না। ইহা বড়ই মজার। দাঁত দিয়া ধরিয়া ইহারা প্রথমে কতকগুলি কচি পাতাকে বাঁকাইয়া ফেলে। কিন্তু তাজা পাতাকে একবার বাঁকাইলে তাহা বেশি ক্ষণ বাঁকিয়া থাকে না; একটু পরেই আবার সোজা হইয়া উঠে। কাজেই এই সকল পাতা দিয়া স্থায়ী রকম ঘর প্রস্তুত করিতে হইলে, সেগুলিকে কিছু দিয়া বাঁধিয়া রাখিতে হয়। মাকড়সা বা গুঁটিপোকারা যেমন শরীরের লালা দিয়া সূতা প্রস্তুত করিতে পারে, এই পোকারা তাহা পারে না। কিন্তু ইহাদের বাচ্চারা এক রকম সূতা তৈয়ার করিতে পারে। পিঁপ্ড়েরা পুত্তলি-অবস্থায় এই সূতায় সর্ব্ব শরীর ঢাকিয়া ঘুম দেয়। যাহা হউক, নাল্সো পিঁপ্ড়েরা বাসার পাতাগুলিকে সূতা দিয়া বাঁধিয়া রাখিবার জন্য তাহাদের বাচ্চাদের সাহায্য লয়। ঘর বাঁধিবার সময়ে কর্ম্মী পিঁপ্ড়েরা এক-একটা বাচ্চা মুখে করিয়া বাঁকানো পাতার কাছে লইয়া যায়। বাচ্চারা মুখ হইতে লালা বাহির করিয়া যেমন সরু সূতা প্রস্তুত করিতে থাকে, তেমনি অপর কর্ম্মী পিঁপ্ড়েরা সেই সূতা দিয়া পাতাগুলিকে বেশ শক্ত করিয়া জড়াইয়া ফেলে। নাল্সো-পিঁপ্ড়েরা কেমন ফাঁকি দিয়া ঘর বাঁধে, একবার ভাবিয়া দেখ। এমন ফন্দি মানুষের মাথাতেও হঠাৎ আসে না।
নাল্সো-পিঁপ্ড়েরা সর্ব্বভুক্ প্রাণী। শুঁয়ো-পোকা, ফড়িং, গোবরে-পোকা, প্রজাপতি প্রভৃতি সকল রকম ছোট প্রাণী শিকার করিয়া ইহারা বাসায় আনে এবং তার পরে পরমানন্দে সেগুলি সকলে ভাগ করিয়া আহার করে। আমাদের বাড়ীতে ভাণ্ডার ঘর আছে। এই ঘরে আমরা কেবল খাবার জিনিস জড় করিয়া রাখি। নাল্সো-পিঁপ্ড়েরা খাবার রাখিবার জন্য গাছের পাতা দিয়া ভাণ্ডার ঘর তৈয়ার করে। এই ঘরে তাহারা বাস করে না, খাবার জিনিস রাখিয়া ঘরের চারিদিকে পাহারা দেয়।