পোকা-মাকড়/ষষ্ঠ শাখার প্রাণী/ঝিল্লীপক্ষ পতঙ্গ/পিঁপ্‌ড়েদের গোরু

পিঁপ্‌ড়েদের গোরু

 আমরা গরু পুষি এবং ঘাস খড় খাওয়াইয়া তাহাদিগকে যত্ন করি; তার পরে তাহারা বাচ্চা প্রসব করিয়া আমাদিগকে দুধ দেয়। পিঁপ্‌ড়েরা দুধ খাইবার জন্য গরুর মত করিয়া এক রকম প্রাণী পোষে—কথাটা আশ্চর্য্য হইলেও সম্পূর্ণ সত্য। নাল্‌সো ও ডেঁয়ো পিঁপ্‌ড়েদেরই গরু-পোষা স্বভাব বেশি দেখা যায়।

 বর্ষার এবং শীতের শেষে যে সবুজ রঙের ছোট পোকা প্রদীপের চারিদিকে ঘুরিয়া বেড়ায়, তোমরা তাহা বোধ হয় দেখিয়াছ। কপি গোলাপ শশা মূলা প্রভৃতি গাছের পাতাতে এই জাতীয় অনেক পোকা দেখা যায়। ইহাদের সকলেরি রঙ যে সবুজ হয়, তাহা নয়। এই জাতীয় মেটে ও কালো রঙের পোকাও দেখা যায়। অনেক জায়গায় এই পোকাকে জাব-পোকা বলে। নাল্‌সো পিঁপ্‌ড়েরা প্রায়ই জাব-পোকার ডিম আানিয়া বাসায় পালন করে। আমরা যেমন গোরু পালন করি, ঠিক সেই রকম যত্নেই উহারা পোকা পালন করে। ডিম যাহাতে নষ্ট না হয়, ডিম ফুটিলে বাচ্চারা যাহাতে প্রচুর খাবার পায় এবং বাহির হইতে শত্রু আসিয়া যাহাতে ডিম নষ্ট না করে—এই সকল বিষয়ে পিঁপ্‌ড়েদের খুব নজর থাকে। তাহারা কিসের জন্য এত যত্ন ও চেষ্টা করিয়া পোকা পোষে, তাহা বোধ হয় তোমরা এখনো বুঝিতে পার নাই। আমরা গোরুদিগকে খাওয়াইয়া যেমন ভাঁড়ে-ভাঁড়ে দুধ আদায় করিয়া লই, পিঁপ্‌ড়েরাও ঐ-সব পোকাদের কাছ হইতে মধুর মত মিষ্ট এক রকম রস আদায় করিয়া লয়।

 এখানে পিঁপ্‌ড়েদের গোরুর একটা বড় ছবি দিলাম।

চিত্র ৪৯
পিঁপ্‌ড়েদের গোরু।

কিন্তু ইহাদের প্রকৃত আকার এত ছোট যে, দশ বারোটিকে পর পর না সাজাইলে এক ইঞ্চি জায়গা জোড়া যায় না। ইহাদের সকলের ডানা গজায় না এবং পাগুলিও খুব লম্বা হয় না। এজন্য তাড়াতাড়ি চলা-ফেরা করিতে পারে না। গাছের রসই ইহাদের প্রধান খাদ্য। তাই যে গাছে পিঁপ্‌ড়ের গোরু বেশি থাকে, সেই গাছ প্রায়ই মরিয়া যায়।

 এখানে যে পোকাটির ছবি দিলাম, তাহার পিছনে নলের মত দুইটি অংশ দেখিতে পাইবে। এই দুইটি মধুর নল।

চিত্র ৫০—পিঁপ্‌ড়েরা মিষ্টরস খাইতেছে।

গোরুর বাঁটে যেমন আপনা হইতেই অনেক দুধ জন্মে, পিঁপ্‌ড়েদের গোরুর দেহের ঐ দুইটি নলে সেই রকমে আপনিই অনেক মধু জমা হয়। ফাল্গুন-চৈত্র মাসে আমগাছের পাতায় কখনো কখনো এক রকম চক্‌চকে মধু লাগিয়া থাকিতে দেখা যায়। এই মধুও এক রকম পতঙ্গের শরীরে হইতে বাহির হয়। আমগাছের তলায় গেলে, এক রকম ছোট পোকাকে চড়বড় শব্দ করিয়া এক পাতা হইতে লাফাইয়া অন্য পাতায় যাইতে দেখা যায়। এক-একটি আমগাছে বোধ হয়, লক্ষ লক্ষ পোকা থাকে। এইগুলিই শরীর হইতে মধু বাহির করিয়া গাছের পাতায় লাগায়। ইহারাও পিঁপ্‌ড়েদের গোরুজাতীয় প্রাণী। তোমরা যদি পরীক্ষা কর, তবে দেখিতে পাইবে,—যে গাছে এই পোকা বেশি থাকে, সেখানে নানাজাতীয় পিঁপ্‌ড়েও দিবারাত্রি ঘুরিয়া বেড়ায়।

 দুধ সংগ্রহ করিতে হইলে আমরা গোরুকে দুহিয়া থাকি। পিঁপ্‌ড়েরা জাব-পোকার মধু সংগ্রহ করিবার সময়ে বড় মজা করে। মধু খাইবার ইচ্ছা হইলেই তাহারা লম্বা শুঁয়ো দিয়া পোকাদের লেজের কাছে সুড়সুড়ি দিতে আরম্ভ করে। ইহাতে পোকাদের শরীর হইতে বিন্দু বিন্দু মধু বাহির হইতে থাকে। পিঁপ্‌ড়েরা তাহাই পরমানন্দে চাটিয়া খাইতে থাকে। সুতরাং দেখা যাইতেছে, পিঁপ্‌ড়েরা যে পোকাগুলিকে গোরুর মত পোষে তাহা নয়, আমরা যেমন গোরুর দুধ দুহিয়া লই, উহারাও সেই রকমে মধু দুহিয়া লয়।

 নাল্‌সো-পিঁপ্‌ড়েরা জাব-পোকাগুলিকে অতি যত্নে পালন করে। যাহাতে সেগুলি পলাইতে না পারে, তাহার জন্য জাল বুনিয়া খোঁয়াড় তৈয়ারি করে। কখনো কখনো নিজেদের বাসাতেওে পোকাগুলিকে আট্‌কাইয়া রাখে। এই গোরু লইয়া এক দল পিঁপ্‌ড়ের সহিত আর এক দলের প্রায়ই লড়াই বাধিয়া যায়।