পোকা-মাকড়/ষষ্ঠ শাখার প্রাণী/ঝিল্লীপক্ষ পতঙ্গ/মৌমাছি
মৌমাছি
এইবার তোমাদিগকে মৌমাছির কথা বলিব। ইহারা বোল্তা-জাতীয় পতঙ্গ। বোল্তাদের মত ইহাদের চারিখানি ডানা, ছয়খানি পা, মাথার উপরে তিনটা ছোট চোখ, এবং দুই পাশে দুইটা বড় চোখ আছে। কিন্তু ইহাদের মুখ ঠিক বোল্তাদের মুখের মত নয় এবং গায়ের রঙ্ বোল্তার রঙের মত উজ্জ্বল নয়।
এখানে মৌমাছির মুখের একটা ছবি দিলাম। দেখ,
চিত্র ৪২—মৌমাছির মুখ।
মুখে এক জোড়া দাঁত আছে। ইহা দিয়া মৌমাছিরা কাটাকুটির ও চিবাইবার কাজ চালায়। ইহার নীচে যে আঙুলের মত অংশ রহিয়াছে তাহা দিয়া ইহারা খাবার আঁক্ড়াইয়া ধরে। সকলের নীচে শুঁড়ের মত জিনিসটা ইহাদের জিভ্। মৌমাছির ওষ্ঠ লম্বা হইয়া এই জিভের সৃষ্টি করিয়াছে। সুতরাং দেখা যাইতেছে, বোল্তার মুখের চেয়ে মৌমাছির মুখ কতকটা উন্নত। ইহাদের মাজা বোল্তার মাজার মত সরু নয়।
মৌমাছির সর্ব্বাঙ্গ—বিশেষতঃ পেটের তলার আগা-গোড়া বুরুসের মত ছোট লোমে ঢাকা থাকে। ফুলে মধু খাইতে বসিলে ঐ লোম দিয়া উহারা ফুলের রেণু সংগ্রহ করে। কুকুর ও ঘোড়া ছাই-গাদা ও ধূলায় গড়াগড়ি দিয়া কি-রকমে গায়ে ধূলামাটি মাখে, তোমরা তাহা নিশ্চয়ই দেখিয়াছ। মৌমাছিরা সুন্দর ফুল দেখিলেই ফুলের কেশরের উপর পড়িয়া লুটাপুটি খায়। ইহাতে উহাদের গায়ে ফুলের রেণু ধূলার মত আট্কাইয়া যায়। কিন্তু কুকুর যেমন গা-ঝাড়া দিয়া ধূলা ফেলিয়া দেয়, মৌমাছিরা তাহা করে না। মাথার চুলে ধূলা-বালি বা কাটাকুটা লাগিলে আমরা তাহা বুরুস বা চিরুণী দিয়া ঝাড়িয়া ফেলি। উহারাও সেই রকমে পায়ের-গায়ে-লাগানো চিরুণীর মত কাঁটাগুলি দিয়া সর্ব্বাঙ্গের রেণু ঝাড়িতে আরম্ভ করে, কিন্তু সেগুলিকে ফেলিয়া দেয় না। যেমন এক একটু রেণু জড় হয়, তেমনি তাহারা উহা মুখের মধ্যে জমা করিতে আরম্ভ করে এবং শেষে মুখের লালার সহিত মিশাইয়া তাহা দিয়া ছোট ছোট বড়ি পাকাইতে সুরু করে। বড়ি তৈয়ারি হইলে তাহা আর মুখে রাখে না। মুখ হইতে তাহা প্রথমে সম্মুখের পায়ে, তার পরে মাঝের পায়ে এবং শেষে পিছনের পায়ে চালান করে। এই পা দুটির মাঝামাঝি অংশে লোমে-ঢাকা কৌটার মত দুইটি খাঁজ কাটা থাকে। মৌমাছিরা পিছনের পা হইতে রেণুর বড়িগুলিকে ঐ কৌটায় জড় করিতে আরম্ভ করে।
ফুলের রেণুর বড়ি পাকাইয়া মৌমাছিরা কি করে, তাহা বোধ হয় তোমরা জান না। উহাই মৌমাছির বাচ্চাদের প্রধান খাদ্য। আমরা ভাত ডাল দুধ খাইয়া বাঁচিয়া থাকি। মৌমাছির বাচ্চারা ফুলের রেণু না খাইলে বাঁচে না। ফুলের রেণুর বড়ির সঙ্গে একটু মধু এবং একটু জল মিশাইয়া মৌমাছিরা বাচ্চাদের জন্য উপাদেয় খাদ্য তৈয়ার করে। দেখ—ইহারা কত সৌখীন্ প্রাণী। ভালো খাবার ভিন্ন অন্য কিছু ইহাদের মুখে ভালোই লাগে না। ইহাদের খাওয়া দাওয়ার আরো অনেক কথা তোমরা পরে জানিতে পারিবে।
এখানে মৌমাছির পিছনের পায়ের একটা ছবি দিলাম।
চিত্র ৪৩—মৌমাছির পিছনের পা।
ছবি দেখিলেই বুঝিবে, ফুলের রেণু রাখিবার জন্য পায়ে কেমন সুন্দর কৌটা রহিয়াছে! মৌমাছির সম্মুখের বা মাঝের পায়ে এই রকম কৌটা থাকে না।
বোল্তার মধ্যে যেমন স্ত্রী, পুরুষ এবং কর্ম্মী এই তিন রকমের পতঙ্গ দেখা যায়, মৌমাছির মধ্যেও ঐ রকম তিনটি পৃথক্ জাতি আছে। এই তিন জাতি প্রাণী একই চাকে বাস করিলেও তাহাদের চেহারা সম্পূর্ণ ভিন্ন রকমের।
আমরা এখানে কর্ম্মী মাছির ছবি দিলাম। স্ত্রী ও পুরুষ
চিত্র ৪৪—কর্ম্মী মৌমাছি।
মৌমাছির মুখে লম্বা জিভ্ থাকে না। ইহাদের কেহই মধু সংগ্রহ করিতে বাহির হয় না, এজন্য লম্বা জিভের দরকারও থাকে না। স্ত্রী-মাছিরা একটু লম্বা এবং তাহাদের গায়ের রঙ বেশ উজ্জ্বল, কিন্তু ডানা লম্বা নয়। পুরুষদের শরীর বেশ মোটা ও তাহাদের গায়ে লোমের পরিমাণ যেন বেশি। স্ত্রী ও পুরুষের লেজে হুল থাকে না। স্ত্রীদের লেজে হুলের মত যে একটা অংশ থাকে, তাহা দিয়া উহারা ডিম পাড়ে। মাথায় কিরকমে চোখ লাগানো আছে তাহা দেখিয়াও পুরুষ-স্ত্রী ও কর্ম্মী মৌ-মাছিদের চিনিয়া লওয়া যায়। পুরুষের বড় চোখ দুটি প্রায় গায়ে-গায়ে মাথার খুব উপর দিকে থাকে। কর্ম্মী ও স্ত্রী মাছির চোখ মাথার এত উপর দিকে থাকে না।