বত্রিশ সিংহাসন/১১
পরমাবতী একাদশ পুত্তলিকা
হাস্য করিয়া কহিল মহারাজ প্রথমে আমার বাক্য শ্রবণ কর, পশ্চাৎ সিংহাসনে পাদনিক্ষেপ করিও।
এক দিবস রাজা বিক্রমাদিত্য উজ্জয়িনী নগরে গমন করিয়া সঙ্গীগণকে বিদায় দিয়া রাত্রে একাকী শয়ন করিয়া আছেন, এমত সময়ে শুনিলেন উত্তরাংশে এক স্ত্রীলােক ক্রন্দন করিতে করিতে উচ্চস্বরে এই কথা বলিতেছে, “এমত কেহ দয়ালু আছে আমাকে এই পাপীর হস্ত হইতে উদ্ধার করিয়া আমার প্রাণ দান করে,,। এবং, মরিলাম মরিলাম বলিয়া, মধ্যে মধ্যে চীৎকার ধ্বনি করিয়া উঠিতেছে। রাজা ঐ ক্রন্দন এবং চীৎকার ধ্বনি শ্রৰণ করিয়া অসি চর্ম্ম গ্রহণ পূর্ব্বক ক্রন্দন লক্ষ্য করিয়া অন্ধকারে একাকী গমন করিলেন। রাজা যখন বন প্রবেশ করিলেন তখন ঐ নারী পুনর্ব্বার সেই প্রকার চীৎকার করিয়া উঠিল। রাজা তাহার নিকটবর্তী হইয়া দেখিলেন, এক যক্ষ এক নারীকে বলাৎকার করলােদ্যত হইয়া প্রহার করিতেছে। রাজা তাহা দেখিয়া যক্ষকে বলিলেন রে পাপিষ্ঠ এই অবলাকে কেন প্রহার করিতেছিস, তাের কি নরকের ভয় নাই। রাজার বাক্যে মনোেযােগ না করিয়া যক্ষ পুনর্ব্বার নারীকে প্রহার করিতে লাগিল। রাজা বলিলেন অরে দুরাত্মন তুই এই নারীকে এক্ষণেই পরিত্যাগ কর, নতুবা আমি তােক সংহার করিব। যক্ষ, রাজার সম্মুখ মুখীন হইয়া বলিল তুই কে এত রাত্রে এখানে আসিয়াছিস, তাের মরণ নিকটবর্তী হইয়াছে, তুই এখনি প্রস্থান কর, নতুবা আমি তােকে ভক্ষণ করিব। এই কথায় রাজা কোপে জ্বলদগ্নিবৎ হইয়া কোষ হইতে অসি আকর্ষণ পূর্ব্বক যক্ষকে লক্ষ্য করিয়া এমত আঘাত করিলেন যে একবারে তাহার মস্তক শরীর হইতে স্বতন্ত্র হইয়া পড়িল। কিন্তু তাহার ছিন্ন মস্তক ও দেহ হইতে তখনি দুই বীর উৎপন্ন হইল। উৎপন্ন হইয়াই তাহারা রাজার সঙ্গে সংগ্রাম আরম্ভ করিল। রাজা বলে কৌশলে এক জনকে সংহার করিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় জন তাবৎ রাত্রি তাহার সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া প্রভাতে প্রস্থান করিল।
যক্ষ প্রস্থান করিলে রাজা নারীকে কহিলেন এখন আর শঙ্কা নাই, আমার সঙ্গে আইস, দৈত্য পলায়ন করিয়াছে আর আসিবেক না। নারী দীর্ঘ নিশ্বাস পরিত্যাগ পূর্ব্বক কহিল হে জননাথ আমি সপ্তদ্বীপ পৃথিবীর মধ্যে যেখানে থাকিব সেই খান হইতেই যক্ষ আমাকে লইয়া যাইবে। যক্ষের বিনাশ না হইলে আমার পরিত্রাণ নাই, তাহার কারণ এই, যক্ষের শরীর মধ্যে এক মােহিনী আছে, তাহার বলে সে সকল স্থানে গমন করিতে পারে, এবং ঐ মােহিনী এমত মায়া জানে যে দৈত্য মরিলে তাহার শব হইতে আর চাবি দৈত্য উদ্ভব করিতে পারে।
এ কথা শুনিয়া রাজা বন মধ্যে লুক্কায়িত ভাবে থাকিলেন। ক্ষণ কাল পরে। যক্ষ পুনর্ব্বার আসিয়া নারীকে পূৰ্বরূপ প্রহার আরম্ভ করিল, নারী চীৎকার করিতে লাগিল। তখন ভূপতি প্রচ্ছন্ন স্থান হইতে প্রকাশিত হইয়া পুনর্ব্বার যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলেন, যুদ্ধ করিতে করিতে যক্ষের সম্মুখবর্তী হইয়া তাহাকে এমত খঘাত করিলেন যে তাহার মস্তক দেহ হইতে ছিন্ন হইয়া পড়িল। ঐ সময়ে মোহিনী তাহার দেহ হইতে নির্গত হইয়া অমৃতানয়না প্রস্থান করিল। রাজা। তাল বেতালকে আজ্ঞা করিলেন মোহিনীর গমনাবরোধ কর। আজ্ঞামাত্র তাল বেতাল তাহার কেশাকর্ষণ পর্ব্বক তাহাকে রাজার সম্মুখে আনিল। জিজ্ঞাস! করিলেন হে মৃগনয়নি, গজগামিনি, চন্দ্রবদনি, তোমার হাস্যে কুন্দপুষ্প বৃষ্টি হইতেছে, তোমার সুগন্ধে অন্ধ হইয়া ভ্রমরগণ ভ্রমণ করিতেছে, তুমি যক্ষের উদরে কি প্রকারে ছিলে, আমাকে বল। মোহিনী বলিল মহারাজ আমি পূর্বে স্বর্গবাসিনী ছিলাম, কিন্তু ভ্রমক্রমে শিবের কোন আজ্ঞা অবহেলন করিয়াছিলাম, তাহাতে শিব অসন্তুষ্ট হইয়া আমাকে এই পাপীর হস্তে অর্পণ করিয়াছেন। এই যক্ষ মহাদেবের অনেক সেবা করিয়াছিল, এই জন্য মহাদেব ইহার প্রতি সদয় হইয়া ইহা করিয়াছেন। যক্ষ আমাকে পাইয়া উদর মধ্যে রাখিয়াছিল, তদবধি আমার নাম মোহিনী হইআছে। আমার প্রতি শিবের আজ্ঞা আছে এই যক্ষের সেবা করিতে হইবে, এই জন্য আমি ইহার আজ্ঞাকারিণী হইয়াছি। আপনার বেতাল আমাকে আনিয়াছে সেই জন্য আমি আসিয়াছি, নতুবা আপনি আমাকে ধরিয়া রাখিতে পারিতেন না। রাজা বলিলেল এইক্ষণে তোমার কি অভিলাষ। মোহিনী কহিল তুমি রাজাধিপতি, সকলের পূজ্য, অতএব তােমার সেবাতে নিযুক্ত থাকিবার অভিলাষ করি। ইহা শুনিয়া রাজা বিক্রমাদিত্য তাহাকে গন্ধর্ব বিধানে বিবাহ করিলেন।
পরে, যে নারীকে যক্ষ আক্রমণ করিয়াছিল তাহার পরিচয় জিজ্ঞাসা করিলেন। নারী বলিল মহারাজ সমুদ্র মধ্যে ব্রহ্মপুরী নামে এক দ্বীপ আছে, তাহাকে সিংহলদ্বীপ বলে। আমি তথাকার এক ব্রাহ্মণের কন্যা। এক দিবস সহচরীসমভিব্যাহারে এক সরােবরে স্নান করিতে গিয়াছিলাম। ঐ সরােবর বৃক্ষাদিতে এমত আবৃত যে সূর্য্যেরও মুখ দর্শন হয় না। মান পূজা করিয়া গৃহে আসিব এমত সময়ে এই দৈত্য আমাকে ধরিল। দৈত্য ধর্ম্মজ্ঞান রহিত, আমি কুমারী ধর্ম্মভয়ে ভীত হইয়া ইহার ইচ্ছানুবর্ত্তিনী হই নাই, এজন্য আমাকে তদবধি যন্ত্রণা দিতেছে। তুমি রাজা, আমার ধর্ম ও কুল রক্ষা করিলে, পৃথিবীতে তােমার অতিশয় যশঃ হইবে, আমি আশীৰ্বাদ করি তোমার সহস্র বর্ষ পরমায়ু হউক, আর তােমার এমত পরাক্রম হউক যে কেহ কখন তােমাকে পরাজয় করিতে না পারে। এইরূপ অনেক আশীৰ্বাদ করিলে, রাজা তাহাকে কন্যা সম্বােধন করিলেন। পরে ঐ কন্যাকে ও মােহিনীকে সিংহাসনে বসাইয়া বেতালকে আজ্ঞা করিলেন আমাদিগকে রাজধানীতে লইয়া চল। আজ্ঞামাত্র বেতাল তাহাকে রাজধানীতে লইয়া আসিল। রাজা রাজধানীতে উপনীত হইয়া মন্ত্রীকে আজ্ঞা করিলেন একটা সকুলােদ্ভব জ্ঞানবান, ব্রাহ্মণকুমার অন্বেষণ করিয়া আন। মন্ত্রী অন্বেষণ করিয়া মার্কণ্ডেয় নামে পরম সুন্দর এক ব্রাহ্মণকুমারকে আনিয়া উপস্থিত করিলেন। রাজা ঐ বিপ্রনন্দনকে কহিলেন আমার নিকট এক ব্রাহ্মণকন্যা আছেন, আমি তােমাকে ঐ কন্যা সম্প্রদান করিতে বাঞ্ছা করি, যদি তুমি তাহার পাণিগ্রহণে সম্মত হও, বল, তাহার আয়ােজন করি। বিপ্রতনয় সম্মতি প্রকাশ করিলেন। পরে রাজা বিবাহের উদ্যোগ করিয়া বস্ত্রালঙ্কার দিয়া কন্যাদান করিলেন, এবং ব্রাহ্মণকুমারকে লক্ষ মদ্রা যৌতুক দিলেন। অতএব হে ভােজরাজ তুমি কি বিবেচনায় তাঁহার সিংহাসনে উপবেশন করিতে বাসনা কর। তুমি গুণগ্রাহক বট, কিন্তু রাজা বিক্রমাদিত্যের যেমন ধর্ম্মজ্ঞান ও সাহস ছিল, তােমার সে প্রকার নাই, তােমার এই সিংহাসনে বসিবার বাসনা বিফল।
ইহা শুনিয়া ভােজরাজ কোন উত্তর করিলেন না। পরদিন যখন পুনর্ব্বার সিংহাসননাপবেশন করিতে আগমন করিলেন তখন,