বত্রিশ সিংহাসন/১০
প্রেমবতী দশম পুত্তলিকা
হাস্য করিতে করিতে কহিল মহারাজ প্রথমে আমার এক কথা শ্রবণ কর, তাহার পর সিংহাসনে বসিও। রাজা বলিলেন কি বলিবে বল, শুনিতেছি। ইহা বলিয়া রাজা সিংহাসন সমীপে উপবিষ্ট হইলেন। পুত্তলিকা বলিতে লাগিল।
এক দিবস বসন্ত কালে রাজা বিক্রমাদিত্য আপন উপবনে বসিয়া সঙ্গীত শ্রবণ করিতে ছিলেন, এমত সময়ে বিরহব্যথাকুলিত এক পুরুষ, সমীপে উপস্থিত হইয়া তাহার পদানত হইয়া কহিল, স্বামিন, আমি অনেক ক্লেশ পাইয়া এইক্ষণে আপনকার শরণ লইলাম, আমার দুঃখ দূর করুন। ঐ ব্যক্তি শােকে এমত শীর্ণ-কলেবর হইয়াছিল যে তাহার শরীরে কিছুমাত্র শােণিত ছিলনা, এবং চক্ষের জ্যোতির বিলক্ষণ বৈলক্ষণ জন্মিয়াছিল। আর, অন্ন জল পরিত্যাগ করিয়াও কোন রূপে প্রকৃতিস্থ হইতে পারে নাই। রাজা ঐ বিরহীর এইরূপ করুণ বচনে দয়ার্দ্রচিত্ত হইয়া তৎক্ষণাৎ গীত শ্রবণে বিশ্রাম করিলেন। এবং তাহাকে অত্যন্ত অধৈর্য্য দেখিয়া তাহার ধৈর্য্য সম্পাদনের জন্য নানা প্রকার যত্ন করিলেন, কিন্তু সে তাহাতে কেবল রােদন করিতে লাগিল। রাজা বলিলেন তুমি কেন অধীর হইতেছ, মনঃ স্থির করিয়া আমাকে সবিশেষ বল, কোন ব্যক্তির জন্য এমত শােকাকুলিত হইয়াছ, এবং এখানে আসিবার অভিপ্রায়ইবা কি। এই জিজ্ঞাসায় ঐ ব্যক্তি এক দীর্ঘ নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিল,কলিঙ্গ দেশে আমার বসতি, আমি অতি নির্বোধ মতিহীন। আমাকে কোন তপস্বী বলিয়াছিলেন, কোন স্থানে এক পরম সুন্দরী রাজকন্যা আছে, সে সাক্ষাৎ কামদেবের কামিনী, এবং ততুল্যা ত্রিভুবন-মােহিনী ত্রিলােকের মধ্যে আর নাই। আমি এই ত্রিভুবন-মােহিনীর উদ্দেশে গমন করিয়া ছিলাম, কিন্তু তাহার আশায় নিরাশ হইয়া আসিয়াছি। ঐ ভুবন-মােহিনীর জন্য লক্ষ লক্ষ ভূপতি ভস্মীভূত হইতেছেন। রাজা জিজ্ঞাসিলেন তাহারা কি রূপে ভস্ম হইতেছেন। বিরহী কহিল ঐ রাজকন্যার জনক এক কটাহে ঘূত উত্তপ্ত করিয়া রাখিয়াছেন, এবং এই প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন ঐ প্রত্বলিত-ঘূত-কটাহে অবগাহন করিয়া যিনি জীবিতবান উঠিবেন তাহাকে কন্যা সম্প্রদান করিবেন। রাজকন্যার পাণিগ্রহণাভিলাষে লক্ষ লক্ষ ভূপতি তথায় যাইতেছেন, কেহবা সেই কটাহ দর্শনে নিরাশ হইয়া ফিরিয়া আসিতেছেন, কেহবা কন্যা-লাভের উৎকট আকাঙ্ক্ষায় উত্তপ্ত কটাহে পড়িয়া প্রাণ ত্যাগ করিতেছেন। আমি এই ব্যাপার দেখিয়া চমৎকৃত হইয়া আসিয়াছি, এবং ঘেক্ষণ অবধি রাজকন্যার রূপ লাবণ্য অবলােকন করিআছি সেইক্ষণ অবধি হতবুদ্ধি হইয়া, তাহার প্রেমে আপনাকে এই দুরবস্থাগ্রস্ত করিয়াছি। রাজা বলিলেন অদ্য তুমি এই স্থানে অবস্থান কর, কল্য দুই জনে তথায় গমন করিব, এবং যাহাতে তুমি ঐ কন্যা প্রাপ্ত হও তাহা করিব।
এই রূপ আশ্বাস প্রদানপূর্ব্বক রাজা তাহাকে স্নান ভােজনাদি করাইয়া সে দিবস আপনার আলয়ে রাখিলেন। নিশামুখে সঙ্গীতনিপুণ। নারীদিগকে আজ্ঞা করিলেন, তাহারা আপন আপন গুণপনা প্রকাশ করে। রাজাজ্ঞায়, সঙ্গীতবিজ্ঞ পরম সুন্দরী নর্তকীগণ রাজসভায় নৃত্য গীত আরম্ভ করিল। রাজা বিরহীকে কহিলেন এই নর্তকী গণের মধ্যে যাহাকে তােমার অভিলাষ হয় লইয়া এখানে সুখে কাল যাপন কর, আর সে রাজকন্যার চিন্তা করিও না। বিরহী কহিল মহারাজ সিংহ যদিও সপ্তাহ উপবাস করে তথাপি তৃণাহার করে না। আমি ঐ রাজকন্যার প্রেমাকাঙ্ক্ষী, তদ্ভিন্ন অন্য কাহার প্রত্যাশী নহি।
সুমধুর সংগীত শ্রবণে সমস্ত শৰ্বরী অতীত হইল। প্রভাতে রাজা স্নান পূজা করিয়া তাল বেতালকে স্মরণ করিলেন। তাহারা উপস্থিত হইলে, রাজা বলিলেন এই প্রেমিক ব্যক্তি যেখানে বলেন সেইখানে লইয়া চল। সে ব্যক্তি স্বয়ম্বর নগরের নাম কহিল। পরে রাজা তাহাকে আপন সিংহাসনে উপবেশন করাইয়া, তাল বেতালকে ঐস্থানে লইয়া যাইতে আজ্ঞা করিলেন। বীরদ্বয় আজ্ঞামাত্র সিংহাসন লইয়া শূন্যে উঠিল, এবং নিমিষের মধ্যে সেই নগরে উপস্থিত হইল। রাজা উপনীত হইয়া দেখিলেন বাদ্যধ্বনি ও মঙ্গলাচার হইতেছে, এবং রাজকন্যা পুষ্পমাল্য হস্তে ভ্রমণ করিতেছেন। যে সকল রাজনন্দন ঐ কামিনীর কামনায় আসিয়াছেন, তাহারা সকলে দণ্ডায়মান রহিয়াছেন, কাহারো সাহস হইতেছে না যে ঐ কটাহে ঝাপ দেন। যিনি প্রাণের আশা পরিত্যাগ করিয়া কটাহে পতিত হইতেছেন তিনি তখনি দগ্ধ হইয়া যাইতেছেন।
এতাবদবলােকনে রাজা রাজকন্যার নিকটে যাইয়া কিয়ৎক্ষণ তাহাকে নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। তাহার দেবতুল্য রূপ দর্শনে বিমােহিত হইয়া কহিলেন যাহার গর্ভে এ কন্যা জন্ম গ্রহণ করিয়াছে সে ধন্য। মনুষ্যের কথা কি কহিব এই কন্যাকে দেখিয়া দেবগণ মুগ্ধ হয়েন। ইহা বলিয়া রাজা তাল বেতালকে আহ্বান পূর্ব্বক কহিলেন, আমি এই কটাহে মগ্ন হইতেছি, তােমরা সতর্ক থাক। ইহা বলিয়া রাজা কটাহে ঝাপ দিলেন, এবং তৎক্ষণাৎ দগ্ধ হইলেন। বেতাল অবিলম্বে অমৃত আনয়ন করিয়া তাহার প্রাণ দান করিল। রাজা রাম নাম উচ্চারণ পূর্ব্বক গাত্রোধান করিলেন। ইহা দেখিয়া উপস্থিত ব্রাহ্মণ গণ জয়ধ্বনি করিয়া উঠিলেন। আর আর নৃপতিগণ বিস্ময়াপন্ন হইয়া কহিতে লাগিলেন এ কোন রাজা, প্রথমতঃ দগ্ধ হইলেন, পরক্ষণেই জীবিত হইয়া উঠিলেন, ইনি দেবতা হইবেন, কখন মনুষ্য নহেন। প্রতিজ্ঞা পূর্ণ হইলে রাজকন্যা বিক্রমাদিত্যেরনিকটে আসিয়া তাহার গলদেশে মাল্য প্রদান করিতে উদ্যত হইলেন। রাজা বিরহীকে প্রদর্শন করিয়া বলিলেন আমি ইহার জন্য কটাহে পতিত ও দগ্ধ। হইয়াছিলাম, অতএব ইহাকেই বরণ কর। রাজকন্যা তাহাই করিলেন। পরে কন্যাকা কন্যার বিবাহের আয়ােজন করিতে লাগিলেন, প্রতিবেশিনী নারী ও রাণীগণ মাঙ্গলিক ক্রিয়াতে নিযুক্ত হইল। তাহার পর কন্যাকর্ত্তা বিরহীর সহিত কন্যার বিবাহ দিয়া, নানারত্নবিভূষিত হস্তী অশ্ব শিবিকা ও নানাবিধ বহুমূল্য দ্রব্যাদি এবং যৌতুক স্বরূপ অর্ধেক রাজ্য ও অনেক দাস দাসী প্রদান করিলেন। বিরহী এতাবৎ অবলােকনে অতিশয় আহলাদিত হইল।
বিবাহ নিৰ্বাহ হইলে রাজা বিক্রমাদিত্য কন্যাদাতার নিকট বিদায় চাহিলেন। কন্যাকর্ত্তা তৈজসাদি। তাবৎ দ্রব্য সমভিব্যাহারে দিয়া তাহাকে বলিলেন, তুমি গমন কর, কিন্তু আমার প্রতি স্নেহ রাখিও, আমার এমত শক্তি নাই যে তােমার গুণ বর্ণন করি, তুমি যেরূপ বীরত্ব প্রকাশ করিলে ঈদৃশ বীরত্ব কখন চক্ষে দেখি। নাই এবং কর্ণেও শুনি নাই। এই কলিকালে তুমি অবশ্য কোন অবতার হইবে। আমার একমাত্র জিহ্বা তােমার কত প্রশংসা করিব। আমার এক মাত্র মস্তক, লক্ষ মস্তক কাটিয়া দিলেও তােমার গুণের পুরস্কার হয় না। আমি যে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলাম। তােমার প্রসাদাৎ তাহা পূর্ণ হইল, আমার এমত আশা ছিলনা যে এই প্রতিজ্ঞা কখন রক্ষা হইবে।
রাজকন্যা কৃতাঞ্জলিপুটে রাজাকে বলিলেন মহারাজ আপনি আমার অসীম দুঃখ মােচন করিলেন। আমার পিতা প্রতিজ্ঞারূঢ় হইয়া এমত কুকর্ম্ম করিয়া ছিলেন যে তিনিও নরকগামী হইতেন এবং আমিও চিরকাল অবিবাহিতা থাকিতাম, যেহেতু আপনি আগমন না করিলে কদাপি এই অসম্ভব প্রতিজ্ঞা রক্ষা হইত না।
বিক্রমাদিত্যের মাহাত্ম্য বর্ণন করিয়া প্রেমবতী পুত্তলী কহিল মহারাজ, রাজা বিক্রমাদিত্য এই প্রকারে প্রাণ পর্য্যন্ত পণ করিয়া যে পরম রূপবতী কন্যা প্রাপ্ত হইলেন তাহা অনায়াসে ঐ বিরহীকে দিলেন, তাহাতে কিছুমাত্র ভার জ্ঞান বা কষ্ট বােধ করিলেন না। তুমি বিদ্যোৎসাহী বট, কিন্তু তােমার এতাদৃশী জিতেন্দ্রিয়তা এবং পরােপকারিতাশক্তি কোথায়। অতএব তুমি কি প্রকারে এই সিংহাসনে আরােহণ করিতে বাঞ্ছা কর।
এই কথা শুনিয়া ভােজরাজ লজ্জায় অধােবদল হইলেন, সিংহাসনােপবেশন করিতে পারিলেন না। পরদিবস পুনৰ্বার উপবেশনের উপক্রম করিলে,