বত্রিশ সিংহাসন/১৫
অনুপবতী পঞ্চদশ পুত্তলিকা
কহিল, হে ভােজরাজ, রাজা বিক্রমাদিত্যের যে রূপজ্ঞান ও যে সকল গুণ ছিল, তাহা অত্যাশ্চর্য, আমি তাহা বলিতে ইচ্ছা করি, কিন্তু পাছে যােগ বর্ণনা না হয় এই আশঙ্কা হইতেছে। রাজা বলিলেন সে জন্য চিন্তা নাই তুমি বল। পুত্তলিকা কহিল তবে মনেযােগ পূর্ব্বক শ্রবণ কর।
এক দিবস রাজা বিক্রমাদিত্য সভায় বসিয়া আছেন ইতিমধ্যে কোন স্থান হইতে এক ব্রাহ্মণ আসিয়া তাহার নিকটে চারিটী শ্লোক, পাঠ করিলেন, তাহার অর্থ এই, মিত্রদ্রোহী ও বিশ্বাসঘাতক ব্যক্তি যাবৎ চন্দ্র সুর্য্য থাকিবেন তাবৎ নরক ভােগ করিবে। রাজা শ্লোক শ্রবণে সন্তুষ্ট হইয়া ব্রাহ্মণকে সমুচিত পুরস্কার প্রদান পূর্বক কহিলেন ইহার তাৎপর্যার্থ ব্যাখ্যা করিয়া দ্বামাকে বল। ব্রাহ্মণ বলিতে লাগিলেন।
কোন দেশে এক নির্বোধ রাজা ছিলেন, তাঁহার এক মহিষী ছিল, রাজা তাহাকে অত্যন্ত ভাল বাসিতেন, মুহূর্ত্তেকের নিমিত্ত দৃষ্টির অন্তরালে রাখিতেন, যখন রাজকর্ম্ম করিতেন তখনও সিংহাসনে আপন পাশ্বে বসাইয়া রাখিতেন। মৃগয়া গমনকালে আপনি এক অশ্বে আরোহণ পূর্বক রাণীকে আর এক অশ্বে লইয়া যাইতেন। শয়ন ভোজনাদিও একত্রেই হইত। মন্ত্রী রাজাকে এই প্রকার স্ত্রীপরতন্ত্র দেখিয়া এক দিবস বলিলেন মহারাজ যদি কিঙ্করের অপরাধ মার্জনার আজ্ঞা হয় তবে আমি এক নিবেদন করি। রাজা বলিলেন কি বলিবে বল। মন্ত্রী কহিলেন রাণীকে সর্ব্বদা নিকটে রাখা কাপুরুষের কর্ম্ম, ইহাতে রাজকুলের অমর্য্যাদা হয়, এবং আর আর নৃপতিগণ পরিহাস করিয়া বলেন রাণী আপনাকে বশীভূত করিয়াছেন। অতএব আমার নিবেদন, যদি মহিষী আপনার অতিশয় প্রেয়সীই হয়েন তবে তাহার এক প্রতিমূর্ত্তি চিত্রিত করাইয়া নিকটে রাখুন। হইলে কেহ নিন্দা করিবেক না।
এই পরামর্শ রাজার মনোনীত হইল, অতএব ভখানি মন্ত্রীকে আজ্ঞা করিলেন এক জন চিত্রকর। আনাও। তাহাতে মন্ত্রী এক জন চিত্রকর আনয়ন করাইলেন। ঐ চিত্রকর জ্যোতিষ ও চিত্র বিদ্যাতে অতিপণ্ডিত ছিলেন। চিত্রকর উপস্থিত হইলে রাজ। তাহাকে কহিলেন হে চিত্রকর তুমি আমাকে রাজমহিষীর একখান চিত্রপট প্রস্তুত করিয়া দাও। আমি তাহা সর্ব্বদা সম্মুখে রাখিব। চিত্রকর নতশির হইয়া বলিলেন যে আজ্ঞা, আমি চিত্রপট লিখিয়া দিব। তদনন্তর রাজার স্থানে বিদায় হইয়া বাটীতে আসিয়া চিত্র প্রস্তুত করিতে আরম্ভ করিলেন, এবং কয়েক দিবস শ্রম করিয়া ঐ চিত্র এমত উত্তমরূপে, প্রস্তুত করিলেন যে রাণীকে ইন্দ্রের অরা হইতেও অধিক মনোহারিণী জ্ঞান হইতে লাগিল, অথচ রাণীর যে অঙ্গ যে প্রকার ছিল তাহা অবিকল সেইরূপ হইল।
এই চিত্র প্রস্তুত হইলে চিত্রকর তাহা রাজসমীপে প্রেরণ করিলেন। রাজা অবলোকন করিয়া অত্যন্তু সন্তুষ্ট হইলেন। তিনি দেখিলেন ছাঁচে ঢালিলে যেমত হয়, নখ অবধি মস্তক পর্য্যন্ত সেইরূপ উত্তম হইআছে। কিন্তু জানু দৃষ্টি করিয়া দেখিলেন ঐস্থানে একটা তিল আছে। তাহাতে অন্তঃকরণে এইরূপ সন্দেহ উপস্থিত হইল যে, রাণীর জানুদেশে তিল আছে এব্যক্তি কি প্রকারে দেখিতে পাইল, অবশ্য রাণীর সহিত ইহার সন্দর্শনাদি আছে, তাহা না হইলে কি প্রকারে দেখিতে পাইবে। অতএব কুপিত হইয়া মন্ত্রীকে বলিলেন চিত্রকরকে পুনর্ব্বার ডাকাও। মন্ত্রী আজ্ঞামাত্র তাহাকে ডাকিতে পাঠাইলেন। চিত্রকর মনে করিলেন রাজা তুষ্ট হইয়াছেন, বুঝি পুরস্কার দিবেন এইজন্য আহ্বান করিয়াছেন। পরে চিত্রকর রাজার সম্মুখে উপস্থিত হইলে, রাজা ঘাতক পুরুষকে বলিলেন ইহার মস্তক ছেদন পূর্ব্বক হার দুই চক্ষুঃ বাহির করিয়া আমার নিকটে লইয়া আইস।
এই আজ্ঞা পাইয়া ঘাতক পুরুষ চিত্রকরকে বধ্য ভূমিতে লইয়া চলিল। মন্ত্রী মনে মনে কহিলেন, এমত মূখ রাজা আমি কোথাও দেখি নাই। বিদ্বান, লোক অপরাধী হইলে তাহাকে নির্বাসন করা যায়, পূর্ব্বাপর এইপ্রকার প্রথা প্রথিত আছে, তাহাদের প্রাণদণ্ড করা যায়না। কিন্তু এই রাজার মুখ অমৃতময় এবং অন্তর বিষে পরিপূর্ণ, ইহার কথার সহিত কর্ম্মের ঐক্য নাই। মন্ত্রী মনে মনে এই প্রকার অনেক চিন্তা করিতে লাগিলেন, কিন্তু ভয় প্রযুক্ত রাজাকে কোন কথা বলিতে পারিলেন না। পরে ঘাতক পুরুষের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গিয়া তাহাকে কহিলেন তুমি এই নিরপরাধী ব্যক্তিকে বধ করিও না, ইহাকে পরিত্যাগ কর, এবং মৃগ বধ করিয়া তাহার চক্ষু ঃ রাজাকে দেখাও। ঘাতক পুরুষ মন্ত্রীর বাক্যানুসারে একটা হরিণ বধ করিয়া তাহার চক্ষুঃ রাজার নিকটে লইয়াগিয়া বলিল মহারাজ চিত্রকরের নয়ন আনয়ন করিয়াছি। রাজা আজ্ঞা করিলেন ফেলিয়া দাও। চিত্রকর মন্ত্রীর বাটীতে অতি গোপনে থাকিল।
কিয়দিদবস পরে ঐ রাজার পুত্র মৃগয়ার্থে গমন করিয়া এক ঘোর অরণ্যে প্রবিষ্ট হইলেন, এবং তথায় একটা ভীষণমূর্ত্তি বৃহৎ ব্যাঘ্র দেখিয়া মহাভীত হইয়া তুরঙ্গ পরিত্যাগ পূর্বক এক বৃক্ষে আরোহণ করিলেন। পকিন্তু উঠিয়া দেখিলেন বৃক্ষের উপর একটা ঋক্ষ বসিয়া আছে। তদবলোকনে আরো ভীত হইয়া কম্পান্বিত কলেবর হইলেন, সুতরাং বৃক্ষ হইতে ভূমিতে পতিত হইবার উপক্রম হইল তাহা দেখিয়া ভালক কহিল হে কুমার তুমি ভয় করিওনা, আমি তোমাকে ভক্ষণ করিব না, তুমি আমার শরণাগত হইয়াছ, অতএব আমি তোমাকে জীবন দান করিলাম, তুমি স্বচ্ছন্দে এখানে বসিয়া থাক। এই কথা শুনিয়া রাজপুত্রের সাহস হইল, বৃক্ষ হইতে পতিত হইলেন না।
অনন্তর দিবাবসান হইলে ভাল্লুক কহিল এক্ষণে রজনী আগত, কিন্তু এই যে ব্যাঘ্র বসিয়া আছে এ আমাদের উভয়ের শত্রু, আমরা একবারে উভয়ে নিদ্রিত হইলে সে আমাদিগকে নষ্ট করিবার চেষ্টা অতএব আমরা এক এক জন দুই দুই প্রহর কাল করিয়া জাগিয়া থাকি, তাহা হইলে সে আমাদিগকে নষ্ট করিতে পারিবে না। রাজপুত্র বলিলেন এ পরামর্শ উত্তম। ভাল্লুক বলিল তবে আমি প্রথমার্ধ রাত্রি জাগরণ করি তুমি নিদ্রা যাও, পরে তুমি জাগিয়া থাকিবে আমি নিদ্রা যাইব। এই পরামর্শ করিয়া রাজপুত্র শয়ন করিলেন। ভাল্লক জাগৃত থাকিল।
রাজপুত্র নিদ্রাভিভূত হইলে ব্যাঘ্র ঋক্ষকে কহিল অহে ঋক্ষ তুমি অজ্ঞানের কর্ম্ম করিও না। আমরা উভয়ে বনবাসী, এবং মনুষ্য আমাদের উভয়ের শত্রু, করিবে। অতএব এই ব্যক্তিকে রক্ষা করিয়া কেন বিষবৃক্ষ রোপণ করিতেছ। ইহাকে বৃক্ষ হইতে নীচে ফেলিয়া দাও, আমি ভক্ষণ করি, তুমিও আসিয়া ইহার কিয়দংশ মাংস ভোজন কর। আমার বাক্য অবহেলন করি ও না, মণি হস্ত হইতে পড়িলে কখন পুনর্ব্বার হস্তে উঠিয়া আইসে না। তুমি নিদ্রাগত হইলে ঐ ব্যক্তি নিশ্চয়। তোমাকে সংহার করিবে। অতএব আমি যাহা কহিলাম তাহা কর, নতুবা শত্রুবিনাশের এমত সময় আর পাইবেন, পরে মনস্তাপ করিতে হইবে।
ভাল্লুক কহিল অরে অজ্ঞান ব্যাঘ্র বিশ্বাসঘাতকতা অতি অকর্ত্তব্য কর্ম্ম, যে ব্যক্তি আমাদের শরণ লায় তাহাকে নষ্ট করা কোন প্রকারে উচিত নহে। নৃপতিবধ, বৃক্ষচ্ছেদন, গুরু সমীপে মিথ্যা কথন ও কানন দাহন মহাপাপ বটে, কিন্তু সকল অপেক্ষা বিশ্বাসঘাতকতা গুরুতর পাপ, ইহার প্রায়শ্চিত্ত নাই। এই ব্যক্তি আমার শরণ লইয়াছে, অতএব ইহাকে ভক্ষণ করিলাম, তাহাতে কি ক্ষতি। ব্যাঘ্র কুপিত হইয়া বলিল তবে তুমি থাক, আমি তোমাকেও জীবদ্দশায় যাইতে দিবনা। এই প্রকার কথোপকথনে প্রায় রাত্রি দুই প্রহর হইল। তৎপরে রাজনন্দন নিদ্রা হইতে উঠিয়া বসিলেন। ভাল্লুক শয়ন করিল।
ঋক্ষ নিদ্রিত হইলে ব্যাঘ্র রাজপুত্রকে কহিল হে রাজকুমার তুমি অবশ্যই জান, নদী নখী শৃঙ্গী নারী ও অস্ত্রধারী এবং রাজপুরুষকে কখন বিশ্বাস করা কর্তব্য নহে। অতএব তুমি মনোভ্রমে ভাল্লুককে কখন বিশ্বাস করিও না। এ নিদ্রা হইতে উঠিয়া তোমাকে ভক্ষণ করিবে, এ কথা আমাকে এখনি বলিতেছিল, অতএব তাহা না হইতেই তুমি ঐ ঋক্ষকে বৃক্ষ হইতে ফেলিয়া দাও, আমি উহাকে ভক্ষণ করিয়া প্রস্থান করি, তাহার পরে তুমিও স্বচ্ছন্দে গৃহে গমন করিবে। রাজপুত্র ব্যাঘ্রের কথা শুনিয়া ভাবিলেন একথা সত্যই হইবে। অতএব ভূত ভবিষ্যৎ বিবেচনা না করিয়া তখনি ভালককে ঠেলা মারিলেন, কিন্তু তাহাতে তাহার নিদ্রা ভঙ্গ হওয়াতে দুই হস্তে বৃক্ষশাখা ধরিয়া রহিল নীচে পড়িল না। পরে সে রাজপুত্রকে কহিল অরে পাপিষ্ঠ তোমার বাক্যে বিশ্বাস করিয়া আমি তোমার প্রাণ রক্ষা করিলাম, কিন্তু তুমি অজ্ঞানের ন্যায় আপন সত্য পালন না করিয়া আমার প্রাণ নাশে উদ্যত হইয়া ছিলে, কালের বিচিত্র গতি। আমি যদি এখন তোমাকে ধরিয়া আহার করি তবে তোমাকে কে রক্ষা করে। এই কথায় রাজপুত্র কাষ্ঠবৎ হইলেন, এবং মনে করিলেন ভালুক এখনি আমাকে নষ্ট করিবে। কিন্তু সে তাহা করিলনা। রাত্রি প্রভাত হইলে ব্যাঘ্র তথা হইতে প্রস্থান করিল। ঋক্ষ তখন রাজপুত্রের কর্ণমূলে মূত্রত্যাগ করিয়া দিল, আর বলিল তোমার প্রাণবধ করিলে কি হইবে, তোমার রক্ষাকর্তা কেহই নাই, অতএব তোমাকে ছাড়িয়া দিলাম ইহা বলিয়া ভাল্লুক প্রস্থান করিল।
রাজপুত্র তদবধি উন্মত্ত হইলেন এবং তখন তাহার আর কোন কথা কহিবার শক্তি রহিল না। কেবল সসেমিরা সসেমিরা এই কথা বলিতে বলিতে নগরে আসিলেন। রাজা পুত্রের তাদৃশ দশা দর্শন করিয়া বিষাদ সমুদ্রে মগ্ন হইলেন, মহিষীগণ হাহাকার শব্দে রোদন করিতে লাগিলেন এবং বলিলেন হায়, বিধাতা কেন এমন বিড়ম্বন করিলেন। কেহ কেহ অনুমান করিলেন রাজপুত্রকে কেহ যাদু মন্ত্রে অভিভূত করিয়াছে। তাহাতে রাজা মন্ত্রীকে আজ্ঞা করিলেন নগরের মধ্যে যে সকল গুণী জ্ঞানী ও চিকিৎসক আছে তাহাদিগকে আনাইয়া পুত্রের চিকিৎসা করাও। মন্ত্রী নগরস্থ সমস্ত বৈদ্য ও বিজ্ঞ লোক দিগকে আনাইলেন। তাহারা তন্ত্র মন্ত্র যে যাহা জানিতেন তাহা প্রয়োগ করিলেন, কিন্তু তাহাতে কোন উপকার দর্শিল না।
যখন এই সকল লোক রাজপুত্রকে আরোগ্য করিবার আশা ত্যাগ করিল, তখন মন্ত্রী রাজাকে বলিলেন মহারাজ আমার এক পুত্রবধূ আছেন, তিনি অতি গুণবতী। যদি আজ্ঞা হয় তাহাকে আনয়ন করি, তিনি দেখিলে পরমেশ্বরের কৃপায় কুমার। অবশ্য আরোগ্য হইতে পারিবেন। রাজা জিজ্ঞাসা করিলেন তোমার পুত্রবধূ কিপ্রকার চিকিৎসা করেন। মন্ত্রী বলিলেন, তিনি এক যোগীর শিষ্য, যোগীর। স্থানে নানা প্রকার মন্ত্র শিক্ষা করিয়াছেন। ইহা শুনিয়া রাজা তাহাকে আনয়নার্থে আজ্ঞা দিলেন। মন্ত্রী স্বীয় ভবনে গিয়া চিত্রকরকে সমুদায় বৃত্তান্ত জানাইলেন, আর বলিলেন আমি রাজাকে এই প্রকার বলিয়া আসিয়াছি, তুমি নারীবেশ ধারণ করিয়া আমার সঙ্গে আইস। চিত্রকর তাহাতে সম্মত হইয়া স্ত্রী বেশে মন্ত্রী সমভিব্যাহারে শিবিকারোহণে গমন করিলেন। রাজপুরে উপনীত হইলে রাজাজ্ঞায় রাজপুরীস্থ লোকেরা তাহাকে যত্নপূর্ব্বক যবনিকার মধ্যে বসাইল। রাজা রাজপুত্র ও মন্ত্রী তাহার বহির্ভাগে উপবিষ্ট হইলেন। অনন্তর ছদ্মবেশী চিত্রকর রাজপুত্রকে উত্তমাসনে উপবেশন করাইতে বলিলেন। তাহা হইলে পর চিত্রকর রাজপুত্রকে কহিলেন আমি তোমাকে যাহা কহি তাহা মনোেযোগ পূর্ব্বক শ্রবণ কর। বিভীষণ বড় শূর বীর ছিলেন, কিন্তু তিনি আপন ভ্রাতার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা প্রকাশ পূর্ব্বক, রামচন্দ্রের সহিত মিলিয়া আপন ভ্রাতার রাজ্য নষ্ট এবং আপন কুলক্ষয় করিয়াছিলেন। এই লজ্জায় তিনি এক বৎসর মস্তক উত্তোলন করেন নাই, এবং পরিশেষে আপন কর্মের প্রতিফলও পাইয়াছিলেন। ভস্মসুর নামে এক দৈত্য মহাদেবের অনেক তপস্যা করিয়াছিল, তাহাতে মহাদেব প্রসন্ন হইয়া তাহাকে বর দিয়াছিলেন। কিন্তু তাহার পর, সে তজ্জায়া পার্বতীর হরণাভিলাষী হয়। ইহার ফল তখনি পাইল, অর্থাৎ মহাদেবের কোপানলে ভস্ম হইল। অতএব হে যুবরাজ তুমি মিত্রদ্রোহী ও বিশ্বাসঘাতকের কর্ম্ম কেন করিলে। তুমি বনমধ্যে ঋক্ষকে বৃক্ষ হইতে কেন নিক্ষেপ করিতে উদ্যত হইয়াছিলে, সে তোমার উপকার ভিন্ন অপকার করে নাই, তুমি তাহার বিপরীত কেন করিলে। ফলতঃ এইরূপ দুষ্কর্ম করণে তোমার অপরাধ নাই, তুমি যেমন পিতার সন্তান তদুপযুক্ত কর্ম্ম করিয়াছ, ক্ষেত্রে যেপ্রকার বীজ বপন হয় সেই প্রকার ফলই উৎপন্ন হইয়া থাকে। যাহা হউক, তুমি এক্ষণে ক্ষিপ্ত হইয়া কেবল বারম্বার, স সে মি রা, এই চারি। বর্ণের উচ্চারণ করিতেছ, অতএব আমি এক এক মন্ত্র পড়ি, তুমি ঐ ঐ মন্ত্রের আদ্য বর্ণ পরিত্যাগ কর। এই বলিয়া চিত্রকর এক শ্লোক পাঠ করিলেন। তাহ এই,
১। সদ্ভাব প্রতিপন্নানা বঞ্চনে কা বিদগ্ধতা।
বিশ্বাসেনাঙ্কসুপ্তানাং বিনাশে কি পৌরুষ।
২। সেতুবন্ধে সমুদ্রস্য গঙ্গাসাগরসঙ্গমে।
ব্রহ্মহা মুচ্যতে পাপী মিত্রদ্রোহী ন মুচ্যতে॥
২ (অর্থ, সমুদ্রের সেতুবন্ধে ও গঙ্গাসাগরসঙ্গমে যাত্রা করিলে ব্রহ্মহত্যা-পাপীও মুক্ত হয়, কিন্তু মিত্রদ্রোহী কুত্রাপি মুক্ত হয় না)। এই মন্ত্র পাঠে রাজপুত্র এই মন্ত্রের আদ্য বর্ণ সে ত্যাগ করিয়া কেবল মি রা এই বর্ণদ্বয় উচ্চারণ করিতে লাগিলেন। চিত্রকর তৃতীয় মন্ত্রপাঠ করিলেন। যথা,
৩। মিত্রদ্রোহী কৃতঘশ্চ যে চ বিশ্বাসঘাতকাঃ।
তে নর নরকং যান্তি যাবচ্চন্দ্রদিবাকরৌ॥
৩ (অর্থ, মিত্রদ্রোহী, কৃতঘ এবং বিশ্বাসঘাতক ইহারা, যত কাল চন্দ্র সূর্য্য থাকিবেন তত কাল নরকে বাস করিবেক)। এই মন্ত্রপাঠে রাজনন্দন এই মন্ত্রের প্রথম বর্ণ মি ত্যাগ করিয়া কেবল রা এই বর্ণ উচ্চরণ করিতে লাগিলেন। চিত্রকর আর এক মন্ত্র পাঠ করিলেন। যথা,
৪। রাজাসি রাজপুত্রোইসি যদি কল্যাণমিচ্ছসি।
দেহি দানং দরিদ্রেতভা দেবতারাধনং কুরু॥
৪ (অর্থ, তুমি নিজে রাজা এবং রাজার পুত্র, যদি কল্যাণ ইচ্ছা হয়, দরিদ্রদিগকে দান কর এবং দেবতারাধনা কর)। এই মন্ত্রপাঠে রাজতনয় রা ত্যাগ করিয়া অন্যান্য বাক্যালাপ করিতে লাগিলে এবং তখন উহার জ্ঞানোদয় হইল, উন্মাদ রোগ আর থাকিল না।
রাজা পুত্রের রোগশান্তি দেখিয়া অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইলেন, এবং চিত্রকরকে মন্ত্রীর পুত্রবধূ বিবেচনায় বলিলেন হে সুন্দরি তুমি কুলের বধূ, বনের জন্তুকে কি প্রকারে জানিতে পারিলে বল। চিত্রকর কহিল আমি বিদ্যাভ্যাস জন্য যে গুরুর নিকটে যাইতাম তাহার যথেষ্ট সেবা করিতাম। তাহাতে তিনি আমার প্রতি প্রসন্ন হইয়া আমাকে এক মন্ত্র দিয়াছিলেন, ঐ মন্ত্র সাধন করিয়া আমি দেবীর অনুগৃহীত হইয়াছি, দেবী আমার অন্তঃকরণে সদা বিরাজমান। আছেন। অতএব আমি রাণীর জানুদেশে তিলের কথা যাহার কৃপায় জানিয়াছিলাম তাহারই কৃপায় বন্য ভালুকের বৃত্তান্ত জানিতে পারিয়াছি।
এই কথা শুনিয়া রাজা অতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন, এবং তৎক্ষণাৎ যবনিকা স্থানান্তর করিয়া চিত্রকরকে কহিলেন তুমি যথার্থ সরস্বতীর বরপুত্র, আমি এই ক্ষণে তোমার গুণ জানিতে পারিলাম। ইহা বলিয়া তখনি তাহাকে অসীম সম্পত্তি প্রদান পূর্ব্বক আপনার মন্ত্রিত্ব পদে নিযুক্ত করিলেন।
এই বৃত্তান্ত বলিয়া ব্রাহ্মণ কহিলেন মহারাজ এই চারি মন্ত্রই চারি শ্লোক, এবং এই তাহার তাৎপর্য্য। রাজা বিক্রমাদিত্য শুনিয়া ব্রাহ্মণকে আরো তাধিক পারিতোষিক প্রদান পূর্বক বিদায় করিলেন।
পুত্তলিকা বলিল হে ভোজরাজ তোমার এমত বদান্যতা কোথায়, রাজা বিক্রমাদিত্যের তুল্য সদ্গুনাম্বিত ও দাতা কে আছে। আমি তোমাকে তাঁহার গুণের বিবরণ কহিলাম। এক্ষণে তুমি এই সিংহাসনোপবেশনের উপযুক্ত পাত্র কি না বিবেচনা কর।
এই সকল কথা বার্তায় মে দিবসের লগ্ন অতীত হইল, সুতরাং ভোজরাজ অন্তঃপুরে গেলেন। দিবস প্রত্যুষে পুনর্বার স্নান পূজাদি করিয়া সিংহাসনের সম্মুখে আসিয়া মন্ত্রীকে কহিলেন সিংহাসনারোহণে আমার নিতান্ত বাসনা হইয়াছে। মন্ত্রী কহিলেন মহারাজ আপনি সিংহাসনে বসিবেন সে উত্তম কথা, কিন্তু তাহা হইলে এই সকল পুত্তলিকা রোদন করিয়া প্রাণ ত্যাগ করিবে। রাজা যখন এই কথায় কোন উত্তর করিলেন না, তখন,