সুন্দরবতী ষোড়শ পুত্তলিকা।

কহিল মহারাজ আমি এক বৃত্তান্ত বলি শ্রবণ কর।

 উজ্জয়িনী নগরে এক ধনবন্ত বণিক ছিলেন। তিনি নানা প্রকার বাণিজ্য কার্য্য করিতেন। এমত দাতা ছিলেন যে, কোন প্রার্থক তাহার স্থানে গমন করিলে রিক্ত হস্তে ফিরিত না। ঐ বণিকের রত্নসেন নামে এক পুত্র ছিলেন। তিনি অতিরূপবান ও বিদ্বান ছিলেন, মাতা পিতাকে অত্যন্ত ভক্তি করিতেন। পরে তাহার বিবাহের উপযুক্ত বয়স হইলে, বণিক কন্যা অন্বেষণ জন্য দেশদেশান্তরে ঘটক প্রেরণ করিলেন। তাহাদিগকে কহিয়াদিলেন অতিরূপবতী কন্যা দেখিয়া সম্বন্ধ করিবে, তাহা হইলে তোমাদিগকে বহু পুরস্কার দিব।

 ঘটকগণ নানা দেশে ভ্রমণ করিতে লাগিলেন। তন্মধ্যে এক জন শুনিলেন সমুদ্র পারে এক ধনাঢ্য বণিকের এক পরম সুন্দরী দুহিতা আছে, তাহার বিবাহার্থে পাত্রান্বেষণ হইতেছে। ইহা শুনিয়া তিনি পোতারোহণে সমুদ্রপারে যাত্রা করিলেন। বণিকের গৃহে উপস্থিত হইয়া তাহাকে সকল সমাচার কহিলেন। বণিক বলিলেন আমার কন্যার বিবাহ জন্য একটা বড় দুর্ভাবনা ছিল, কিন্তু পরমেশ্বরপ্রসাদাৎ আমি ঘরে বসিয়াই তাহার পাত্র প্রাপ্ত হইলাম। তদনন্তর তিনি বণিকপুত্রের সহিত কন্যার সম্বন্ধ স্থির করিয়া ঘটককে কহিলেন তুমি কিয়দিবস এই স্থানে আমি আপন পুরোহিতকে তোমার অবস্থান কর। সঙ্গে দিব, তিনি যাইয়া পাত্রকে টিকা দিয়া আসিবেন। আর তুমিও আমার কন্যাকে দেখিয়া যাও, আপন প্রভুকে গিয়া কহিবে কন্যাকে স্বচক্ষে দেখিয়া আসিআছি। এই কথায় ঘটক কিয়দিবস তথায় থাকিলেন, এবং কন্যাকে দেখিলেন। পরে কন্যাকত্তার পুরোহিতকে সঙ্গে লইয়া উজ্জয়িনী নগরে যাত্রা করিলেন। বণিক পুরোহিতকে বলিয়া দিলেন পাত্রকে টিকা দিয়া শীঘ্র প্রত্যাগমন করিবে।

 ঘটক পরমানন্দে পুরোহিতসমভিব্যাহারে নৌকা যোগে যাত্রা করিলেন। কিয়দিবস পরে উজ্জয়িনী নগরে উপনীত হইয়া বণিককে সকল সংবাদ কহিলেন। বণিক কন্যাকত্তার পুরোহিতের সম্মুখে আপন পুত্রকে আনিয়া দেখাইলেন। পুরোহিত তাহাকে দেখিয়া ললাটে তিলক দিলেন। পরে বিবাহের দিবস ধার্য্য করিয়া বলিলেন অমুক দিবসে বিবাহ হইবে, আপনি বিবাহের উদ্যোগ করিয়া শীত্র বর লইয়া আসুন, আমি গিয়া বিবাহের আয়োজন করাই। ইহা বলিয়া পুরোহিত বিদায় হইলেন, এবং সমুদ্র পার হইয়া স্বদেশে প্রত্যাগমন পূর্ব্বক সাধুসমীপে সবিশেষ সমস্ত বৃত্তান্ত নিবেদন করিলেন। বণিক তাহা শুনিয়া বিবাহের দ্রব্যাদি প্রস্তুত করিতে লাগিলেন।

 এদিকে বরকর্ত্তা বিবাহের আয়োজন করিতে লাগিলেন। তাঁহার বাটীতে নহবত ও নাগারা খানা বসিল, এবং নানা প্রকার মঙ্গলাচরণ, নৃত্যগীত ও রাগরঙ্গ হইতে লাগিল। যে সকল আত্মীয় কুটুম্বগণ বর লইয়া যাইবেন তাহাদিগকে নূতন বসন দান করিলেন। নগরস্থ তাবৎ লোককে নিমন্ত্রণ করিয়া নিত্য নিত্য নানাবিধ আহারাদি করাইতে লাগিলেন। এই প্রকার বিবাহের পূর্ব্বকত্তব্য কৌলিক ও মাঙ্গলিক কর্ম্ম সকল সম্পন্ন করিতে অনেক দিন লাগিল। তাহাতে বিবাহের অবধারিত দিবস অতিনিকটবর্তী হইল। ফলতঃ এমত কাল রহিল না যে সমদ্র পারে গিয়া নিদ্ধারিত দিবসে বিবাহ সম্পন্ন হয়।

 ইহাতে বরকত্তা ও আর আর কুটুম্বের অতিশয় চিন্তাকুলিত হইলেন। বিবাহের দিবস অতি নিকট হইয়াছে, ঐ দিনে ঐ লগ্নে কি প্রকারে বিবাহ হইবেক, তৎকালে এই ভাবনাই প্রবল হইয়া উঠিল, আর আর আমোদ প্রসোদ কিছুই রহিলনা।

 বণিক নিরুপায় হইয়া, লগ্ন ভ্রষ্ট হইবার আশস্কায় বিমর্ষ ভাবে আছেন, এমত সময়ে কোন ব্যক্তি তাঁহাকে কহিল যদি প্রজাপতির নির্বন্ধ থাকে তবে অবশ্যই নির্ধারিত লগ্নে বর কন্যার বিবাহ হইবেক, আমি তাহার এক পরামর্শ কহিতেছি তুমি তাহার চেষ্টা দেখ, পরমেশ্বরের কৃপাতে তাহা সিদ্ধ হইতে পারে। বণিক ব্যগ্রতা পূর্ব্বক কহিলেন হে ভ্রাতঃ ভগবান, লজ্জা নিবারণের কর্ত্তা। এক্ষণে যাহাতে আমার কর্ম পণ্ড না হয় তাহার পরামর্শ বল। ঐ ব্যক্তি কহিল কিয়দিবস হইল, এক সূত্রধর এক চতুদ্দোল নির্মাণ করিয়া রাজা বিক্রমাদিত্যকে দিয়াছিল। ঐ চতুর্দোলের গুণ এই, তাহাতে উপবেশন করিয়া যেখানে ইচ্ছা তৎক্ষণাৎ গমন করা যায়। রাজা এই চমৎকার গুণের কথা শুনিয়া সুত্রধরকে দুই লক্ষ মুদ্রা দিয়া তাহা গ্রহণ করিয়াছেন। ঐ চতুর্দোল এক্ষণে তাহার ভাণ্ডারে আছে, তুমি রাজার স্থানে তাহা প্রার্থনা করিয়া লও। তাহা হইলে অনায়াসে তোমার কর্ম্ম সিদ্ধ হইবে।

 বণিক এই পরামর্শে পরমাহলদিত হইয়া তৎক্ষণাৎ রাজসদনে গমন করিলেন, এবং রাজদ্বারে উপস্থিত হইয়া দ্বারীকে কহিলেন রাজাকে সংবাদ দাও, আমি তাঁহার নিকট কোন কথা নিবেদন করিব। দ্বারপাল ভূপালকে সংবাদ না দিয়া অগ্রে মন্ত্রীর নিকট সম্বাদ কহিল। মন্ত্রী তাহাকে স্বসমীপে আনয়ন করাইলে, বণিক তাহাকে দণ্ডবৎ হইয়া প্রণাম করিলেন। তদনস্তর বহু বিনয় পুৱঃসর কহিলেন আমি মহারাজকে দর্শন করিবার জন্য আসিয়াছি, আমার এক বিপদ উপস্থিত। মন্ত্রী কহিলেন রাজা অন্তঃপুরে আছেন। বণিক এ কথায় ব্যগ্র চিত্ত হইয়া কহিলেন আমার এক গুরুতর প্রার্থনা ছিল। আমার পুত্রের বিবাহের চারি দিবস কাল অবশিষ্ট আছে, কিন্তু সমুদ্রপারে অনেক দূর যাইতে হইবে। ইহার মধ্যে কন্যাকর্ত্তার ভবনে উপস্থিত হইতে না পারিলে লগ্ন ভ্রষ্ট হইবে, এবং আমি সকলের হাস্যাস্পদ হইব। মন্ত্রী এই কথা শুনিয়া অন্তঃপুরে প্রবেশ পূর্বক রাজাকে সকল বৃত্তান্ত কহিলেন। রাজা তাহা শ্রবণ মাত্র আজ্ঞা দিলেন ভাণ্ডার হইতে চতুর্দোল আনাইয়া বণিককে দাও, এবং তাহার পুত্রের বিবাহে যে যে দ্রব্যের আবশ্যক হয় তাহ দেওয়াও, কোন প্রকারে শুভ কর্মের বিঘ না হয়। মন্ত্রী রাজাজ্ঞানুসারে সাধুকে চতুর্দোল আনয়ন করাইয়া দিলেন, এবং বলিলেন যদি আর কোন দ্রব্যের আবশ্যক হয়, কহ, দেওয়া যাইবে। বণিক বলিলেন মহারাজের কৃপাতে আমার সকলি আছে, কেবল এই চতুর্দোলের প্রয়োজন ছিল, তাহা পাইলাম এখন আপনার অনুগ্রহে সকল কর্ম সিদ্ধ হইবে।

 ইহা কহিয়। সাধু চতুর্দোল লইয়া আপন আলয়ে গেলেন, এবং বিবাহের এক দিবস থাকিতে ঘটক ও পুত্র সমভিব্যাহারে চতুর্দোলে উপবিষ্ট হইয়া মুহূর্তেকের মধ্যে কন্যাকর্ত্তার ভবনে উপস্থিত হইলেন। তথায় দেখিলেন সমস্ত নগরে মঙ্গলাচার হইতেছে, এবং সকলে বর আসিবার অপেক্ষায় পথ নিরীক্ষণ করিতেছেন। পাত্র উপনীত হইলে সকলে তাহাকে সমাদর পূর্ব্বক পূর্ব্ব সুসজ্জিত এক স্বতন্ত্র বাটীতে বসাইলেন। কন্যাকর্ত্তা বরকর্ভার যথোচিত সম্মান করিলেন, কিন্তু কেবল তাহাদের তিন জন মাত্র দেখিয়া মনে মনে আক্ষেপ করিয়া জিজ্ঞাসিলেন আপনি এ ভাবে আসিয়াছেন, ইহার কারণ কি। বরকত্তা সমুদায় বিস্তারিত বিবরণ বলিলেন। অনন্তর কন্যাকর্ত্তা স্বীয় কর্মাধ্যক্ষকে বলিলেন কল্য বিবাহ হইবে অদ্য তাহার সকল আয়োজন করিয়া রাখ, কোন বিষয়ে লোক-নিন্দা না হয়। অধ্যক্ষ সকল প্রস্তুত করিল। পরদিবস বরকর্তা বর লইয়া অতি সমারোহে বিবাহ দিতে গেলেন। এবং বিবাহ হইলে পর কন্যাকর্তা হস্তী অশ্ব শিবিকা ও রত্নালঙ্কার এবং আর আর নানা প্রকার দ্রব্য দান করিলেন।

 বরকত্তা এই সকল দ্রব্যাদি গ্রহণ পূর্বক পোতারোহণে স্বদেশে যাত্রা করিলেন। কিছু দিন বিলম্বে আপন আলয়ে উপনীত হইয়া ঘটককে উত্তম রূপে বিদায় করিলেন। পরে নানাবিধ বসন ভূষণ ও আর আর নানাজাতীয় উত্তম উত্তম দ্রব্য থালাতে সাজাইয়া চারিট। উত্তম অশ্ব লইয়া রাজাকে উপঢৌকন দিতে গেলেন। রাজা যে খটা দিয়াছিলেন তাহাও প্রত্যপণ করণার্থ সঙ্গে লইলেন। পরে রাজার সম্মুখে উপস্থিত হইয়া রাজাকে ভেট দিয়া বলিলেন মহারাজ আপনার পুণ্য প্রতাপে আমার শুভ কর্ম্ম উত্তম রূপে সম্পন্ন হইয়াছে। সম্প্রতি সেই চতুর্দোল আনিয়াছি গ্রহণ করিতে আজ্ঞা হউক। রাজা হাস্থ্য করিয়া বলিলেন আমি যে দ্রব্য একবার দান করি তাহা কখন পুলগ্রহণ করিনা, অতএব এই খট্টা তোমাকে একবারে দিয়াছি তাহা পুনর্ব্বার লইব না। ইহা কহিয়া রাজা, বণিক যে সকল দ্রব্য ভেট আনিয়াছিল তাহা, এবং নিজ ভাণ্ডার হইতে এক লক্ষ মুদ্রা আনাইয়া তাহার পুত্রকে যৌতুক দিলেন। বণিক তাহাতে অতিশয় আলাদিত হইয়া গৃহে আসিলেন।

 এই বৃত্তান্ত বলিয়া পুত্তলিকা কহিল হে ভোেজরাজ দেবরাজও বিক্রমাদিত্যের তুল্য ঐশ্বর্যশালী হইতে পারেন নাই। তুমি কিসের মধ্যে আছ, তুমি এত উচ্চ আশা করিওনা। এই সকল কথায় সে দিবসের শুভ ক্ষণও অতীত হইল। রাজা অন্তঃপুরে গিয়া কোন প্রকারে রজনী বঞ্চন করিলেন। নিশাবসান হইলে সিংহাসনোপবেশন মানসে যখন পুনর্ব্বার উপস্থিত হইলেন, তখন,