সত্যবতী সপ্তদশ পুত্তলিকা

 কহিল হে ভোজরাজ অবধান কর।

 এক দিবস রাজা বিক্রমাদিত্যের সভাতে স্বর্গীয় শোভা হইয়াছে, অর্থাৎ কোন স্থানে গন্ধর্ব্বগণ নৃত্য গান করিতেছে, কোন স্থানে স্তুতিপাঠকেরা রজার গুণ কীর্ত্তন করিতেছে, কোন স্থানে ব্রাহ্মণেরা বেদপাঠ করিতেছেন, কোন স্থানে মল্লগণ মল্লযুদ্ধে নিযুক্ত হইয়াছে, স্থানান্তরে শীকারীগণ নানা জন্তু লইয়া দণ্ডায়মান আছে। এমত সময়ে তিনি সর্বসমক্ষে প্রস্তাব করিলেন। যিনি স্বর্গের রাজা ইন্দ্র তিনি মর্ত্যলোকের মর্ম্ম অবগত আছেন এবং মত লোকেরা ও তাঁহার বৃত্তান্ত অবগত আছে। কিন্তু পাতালের রাজা কে, তিনি কোন স্থানে থাকেন, আমরা তাঁহার কোন বৃত্তান্ত জানিনা, তোমরা বলিতে পার। ইহা শুনিয়া পণ্ডিত গণের মধ্যে এক জন কহিলেন শেষ নাগ পাতালধিপতি, তাহার মহিষী সকল পদ্মিনী, তিনি শোক সন্তাপ কখন জানেন না, সদা আনন্দে রাজ্য করেন। ফলতঃ তিনি যে প্রকার সুখী সংসারে তল্য সুখী আর নাই।

 পাতালেশ্বরের এই বিবরণ শ্রবণ করিয়া রাজা বিক্রমাদিত্য তাহার সহিত সন্দর্শনের আকাঙ্ক্ষী হইলেন, এবং বেতালকে আহ্বান করিয়া আজ্ঞা করিলেন আমাকে পাতাল পুরীতে লইয়া চল। বেতাল আজ্ঞামাত্র তাঁহাকে পাতালে লইয়া চলিল, এবং দুর হইতে রাজার বাটী দেখাইয়া দিয়া বিদায় হইল। রাজা পুরীর সম্মুখে যাইয়া দেখিলেন তাহা কাঞ্চনময়, নানা রত্নে ভূষিত, এবং তাহার জ্যোতিঃ এমত দীপ্তিকর যে তাহাতে দিবা রাত্রি প্রভেদ হয় না। ঐ পুরীর সকল দ্বারে প্রস্ফুটিত পদ্মপুষ্প ঝুলিতেছে, এবং সকল গৃহে সর্ব্বদা আনন্দধ্বনি হইতেছে।

 রাজা ভয় ও উল্লাসের সহিত দ্বারে উপস্থিত হইয়া বিনয়পূর্ব্বক দ্বারপালদিগকে বলিলেন তোমরা রাজার নিকটে গিয়া সংবাদ দাও ভূলোক হইতে এক রাজা তাহাকে দর্শন করিতে আসিয়াছেন। এই কথায় এক জন দ্বারী রাজাকে সংবাদ দিতে গেল। রাজা বিক্রমাদিত্য দ্বারে দণ্ডায়মান থাকিয়া মনে মনে কহিতে লাগিলেন আমি এপর্যন্ত আসিয়াছি এই আমার পরম ভাগ্য। তিনি চতুর্দিক হইতে রাম ও কৃষ্ণধ্বনি এবং রাজমন্দির হইতে বেদধ্বনি শুনিতে লাগিলেন।

 দ্বারী পাতালেশ্বরের সম্মুখে প্রণতিপুরঃসর দণ্ডাযমান হইলে, তিনি তাহার প্রতি দৃষ্টিপাত করিলেন। দ্বারপাল বলিল, মহারাজ মর্ত্যলোক হইতে এক মনুষ্য আসিয়া দ্বারে দণ্ডায়মান আছেন, তাহার মানস আপনাকে দর্শন করেন। পাতলাধিপতি এই কথা শ্রবণমাত্র গাত্রোত্থান পূর্ব্বক দ্বার দেশে আসিলেন। রাজা বিক্রমাদিত্য তাঁহাকে দর্শন করিয়া অষ্টাঙ্গে প্রণাম করিলেন। পাতালপতি সহাস্য বদনে আশীর্ব্বাদ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন তোমার নাম কি, কোথা হইতে আসিয়াছ। রাজা বিক্রমাদিত্য কৃতাঞ্জলিপুটে বলিলেন, স্বামিন, আমার নাম বিক্রমাদিত্য, আমি মত্ত লোকের রাজা, আমার অভিলাষ ছিল আপনার চরণ দর্শন করি, এক্ষণে সে অভিলাষ পূর্ণ হইল। ইহাতে আমার কোটি যজ্ঞের ফল এবং চতুঃষষ্টি তীর্থে অবগাহনের পুণ্য হইল।  পাতালেশ্বর বিক্রমাদিত্যের নাম শ্রবণমাত্র। তাহাকে আলিঙ্গন করিয়া হস্ত ধারণ পূর্ব্বক স্বীয় সভাতে লইয়া গেলেন, এবং উত্তমাসনে উপবেশন করাইয়া কুশলাদি জিজ্ঞাসা করিলেন। রাজা বলিলেন মহারাজের দর্শনে আমার সমস্ত মঙ্গল। পাতালেশ্বর বলিলেন এখানে আসিতে পথে তোমার অনেক কষ্ট হইয়া থাকিবে। বিক্রমাদিত্য বলিলেন হে নাগরাজ আপনার দর্শনে আমার সকল দুঃখ দূর হইয়াছে। তদনন্তর নাগরাজ রাজা বিক্রমাদিত্যের অবস্থানের নিমিত্ত এক উত্তম স্থান এবং সেবার্থ পরিচারক নিয়োজিত করিয়া, তাহাদিগকে অজ্ঞা করিলেন তোমরা আমার যেপ্রকার সেবা করিয়া থাক ইহার তদপেক্ষা অধিক সেবা করিও। রাজা বিক্রমাদিত্য এই প্রকারে কয়েক দিবস থাকিলেন, তৎপরে কৃতাঞ্জলি হইয়া বলিলেন। হে পাতালেশ্বর অনুমতি হইলে আমি বিদায় হই এবং স্বদেশে গমন করিয়া আপনকার গুণানুবাদ করি। শেষ নাগ হাস্য করিয়া বলিলেন যদি তুমি। স্বদেশ গমন করিবে তবে কিঞ্চিৎ স্মরণসাধন বস্তু লইয়া যাও। ইহা বলিয়া চারিটী রত্ন তাহার হস্তে দিয়া কহিলেন, এই চারি রত্নের চারি গুণ। এক রত্নের গুণ এই, ইহার স্থানে যে রত্ন ও অলঙ্কারাদি চাহিবে তাহা তৎক্ষণাৎ প্রাপ্ত হইবে। দ্বিতীয় রত্নের স্থানে হস্তী অশ্ব শিবিকা যাহা যখন প্রার্থনা করিবে তখনি তাহা পাইবে। তৃতীয় রত্নের গুণ এই, ইহার স্থানে যখন যে অর্থের প্রয়োজন হয় চাহিবামাত্র পাইবে। চতুর্থ রত্ন হইতে পরমার্থ ও সৎকর্ম সাধনের যে কামনা করিবে তাহা পূর্ণ হইবে। চারি রত্নের এই চারি গুণের কথা শ্রবণ করিয়া রাজা বিক্রমাদিত্য বদ্ধাঞ্জলি হইয়া বলিলেন, স্বামিন, আমি আপনার অসীম গুণের কি ব্যাখ্যা করিব, আমাকে চিরজীত কিঙ্কর ভাবিয়া স্মরণে রাখিবেন।

 এই প্রকার স্তুতিবাদের পর, রাজা বিক্রমাদিত্য বিদায় হইয়া বেতালের স্কন্ধারোহণে স্বীয় রাজধানীতে যাত্রা করিলেন। রাজধানীর এক ক্রোশ ব্যবধান থাকিতে বেতালের স্কন্ধ হইতে অবতরণ করিয়া পদব্রজে গমন করিতে লাগিলেন। কিয়দ্র গমন করিলে, এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ তাহাকে দেখিয়া বলিলেন আমি অদ্য অনাহারে আছি, আমাকে কিঞ্চিৎ ভিক্ষা দাও। রাজা মনে মনে কহিলেন এই ব্রাহ্মণকে একটী রত্ন দিই। ইহা ভাবিয়া তাহাকে কহিলেন হে ভূদেব আমার স্থানে চারিটী রত্ন আছে, ঐ চারি রত্নের এই এই গুণ, ইহার মধ্যে যে রত্নের অভিলাষ হয় লও। ব্রাহ্মণ চারি রত্নের চারি গুণের কথা শুনিয়া কেন, রত্ন লইবেন তাহা স্থির করিতে পারিলেন না, কহিলেন আমি গৃহ হইতে আসিয়া যাহা গ্রহীতব্য হয় নিবেদন। করিতেছি। ইহা কহিয়া বিপ্র গৃহে গমন করিলেন। রাজা তাহার প্রত্যাগমনপ্রতীক্ষায় তথায় দণ্ডায়মান থাকিলেন।

 ব্রাহ্মণ গৃহে গিয়া আপন ভার্য্যা পুত্র ও পুত্রবধূকে সমস্ত বিবরণ কহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন এই চারি রত্নের। মধ্যে কোন, রত্ন গ্রহণ করি। ব্রাহ্মণী বলিলেন যে রত্নে ধনােৎপত্তি হয় তাহা গ্রহণ কর, তাহা হইলে সকল কর্ম্ম সিদ্ধ হইবে। কেননা ধন হইতে ধর্ম্ম, জ্ঞান, পুণ্য, দান সকলি হইতে পারে। অন্য রত্নের প্রয়োজন নাই। নন্দন বলিলেন হস্তী অশ্ব না হইলে সংসারের শােভা হয় না, ইহারা মনুষ্যের সন্মানবদ্ধনকারী এবং জীবনযাত্রার প্রয়ােজনীয়, কেননা ইহা দেখিয়া সকলে নম্র হয়, এবং দুর্জনেরাও ভয় করে। অতএব সংসারের শােভাবদ্ধনকারী রত্ন গ্রহণ কর। শােভা বিনা কেবল অর্থে জীবনের কি ফল। পুত্রবধূ বলিলেন যে রত্ন হইতে অলঙ্কারাদি লাভ হয় তাহা গ্রহণ করা কত্তব, কেননা তাহা স্ত্রীলােকের অঙ্গভূষণ, এবং তদ্বারা নারীগণ অপসরাতুল্য হয়, পতিহীনা নারীও তাহা পরিধান করিলে অতি সুন্দরী হয়। এবং তাহা বিপদের সম্পদ, যেহেতু বিপদকালে বিক্রয় করিলে। অনেক অর্থ পাওয়া যায়, ফলতঃ তদ্বারা সকলি হইতে পারিবে। স্বামী বাতুল হইয়াছেন, শাশুড়ী ঠাকুরাণীও বিবেচনারহিত, আপনি জ্ঞানবান,। অতএব আমি যে রত্নের কথা বললাম তাহা লইয়া আসুন, তাহাতে সকল কর্মই সিদ্ধ হইবে। বিপ্র বলিলেন তোমরা সকলেই উন্মত্ত হইয়াছ। ধর্ম্ম ব্যতীত সকলি মিথ্যা, কেননা ধর্ম্ম হইতে মনুষ্যের রাজ্যলাভ যশোলাভ এবং সকল কর্ম সিদ্ধ হয়। ধর্ম মনুষ্যের পরম সম্পদ, তাহা হইতে অধিকমূল্য বস্তু পৃথিবীতে আর নাই। দেখ, বলিরাজা ধর্ম্ম কর্ম্ম দ্বারা পাতালে রাজ্য প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। ধর্ম্ম দ্বারা ইন্দ্র স্বর্গের ইন্দ্রত্ব পাইয়াছেন। ধর্ম্ম দ্বারা এই অনিত্য শরীর অমর এবং ভববন্ধন মোন হয়। অতএব আমি ধর্ম্ম পথ ত্যাগ করিব না, ধর্ম্মপ্রদায়ী রত্ন গ্রহণ করিব, ইহাতে যাহা হয় হইবে।

 এই প্রকারে চারি জনেই এক এক রত্নের প্রশংসা করিল। কাহার সঙ্গে কাহারো ঐক্য হইল না। তাহাতে ব্রাহ্মণ বিমর্ষ হইয়া রাজার নিকটে গিয়া সমস্ত বিবরণ বর্ণনপূর্ব্বক কহিলেন মহারাজ আমি গৃহে গিয়া ছিলাম, কিন্তু কিছুই স্থির করিতে পারিলাম না, আমাদের চারি জনের চারি প্রকার ইচ্ছা, অতএব আপনি এখানে দাণ্ডাইয়া আর কত ক্লেশ পাইবেন। রাজা বলিলেন যদি তোমাদের চারি জনের চারি অভিলাষ হইয়া থাকে তজ্জন্য চিন্তা কি, আমি এই চারি রত্নই দিতেছি তোমরা চারি জনে লইবে, কেহ ক্ষুন্ন হইবেন। ইহা বলিয়া রাজা তাহাকে চারি রত্ব প্রদান করিলেন। ব্রাহ্মণ মহা আলাদিত হইয়া রাজাকে আশীর্বাদ করিতে করিতে গৃহে প্রস্থান করিলেন।

 অতএব হে ভোজরাজ, দেখ, রাজা বিক্রমাদিত্য এই অমূল্য রত্ন দান করিতে কিছুমাত্র কুণ্ঠিত হইলেন। এই কলিকালে এমত দাতা কে আছে। অতএব যিনি রাজা বিক্রমাদিত্যের তুল্য দান করিতে পারিবেন তিনি এই সিংহাসনে উপবেশন করিবেন, তদ্ভিন্ন যিনি ইহাতে পদোত্তোলন করিবেন তাহার নরক বাস। হইবেক। তুমি ব্যগ্র হইওনা, ধৈর্যশালী হও, এবং রাজা বিক্রমাদিত্যের বীরত্ব ও বদন্যতার আর আর বৃত্তান্ত শ্রবণ কর।

 ভোজরাজ পুত্তলিকার এই বাক্য প্রবণ করিয়া সে দিবস সিংহাসনারোহণে ক্ষান্ত হইলেন। পর দিবস প্রত্যুষে স্নান পূজা সমাপন করিয়া মন্ত্রীগণ সমভিব্যাহারে আগমন পূর্বক সিংহাসনোপবেশন জন্য চরণেত্তোলন করিলে,