বত্রিশ সিংহাসন/১৮
রূপরেখা অষ্টাদশ পুত্তলিকা
কহিল মহারাজ এ কি করিতেছ, প্রথমে আমার এক বাক্য শ্রবণ কর তৎপরে যাহা বাঞ্ছা করিও। রাজা ‘বলিলেন কি বলিতে চাহ। পুত্তলিকা বলিল।
এক দিবস দুই সন্ন্যাসীতে কোন বিষয়ে বিবাদ হইয়াছিল। তাহাতে কেহ কাহাকে পরাস্ত করিতে না পারিয়া, পরিশেষে রাজা বিক্রমাদিত্যের সভাতে উপস্থিত হইয়া বলিলেন মহারাজ আমাদের কোন বিষয়ে সংশয় জন্মিয়াছে, আপনি তাহার মীমাংসা করিয়া দেউন, আমরা তজ্জন্য আপনার স্থানে আসিয়ছি। রাজা জিজ্ঞাসিলেন তোমাদের কি বিবাদ। এক জন কহিল আমি এই কহিতেছি মন প্রধান, জ্ঞান আত্মা ও ইন্দ্রিয়গণ তাহার অধীন। মায়। মোহ পাপ পুণ্য প্রভৃতি সকল কর্ম মন হইতে উদ্ভব হয়, সুতরাং মন সকলের মূল। মনুষ্য কেবল কায়ের ভূপতি, অঙ্গ সকল তাহার আজ্ঞাকারী, কিন্তু তাহারা মনের ইচ্ছানুযায়ী কর্ম করে। দ্বিতীয় সন্ন্যাসী কহিল মহারাজ আমি বলিতেছি জ্ঞান শরীরের রাজা, মন তাহার আজ্ঞাকারী, যেহেতু মন কোন কুকর্মে প্রবৃত্ত হইলে জ্ঞান তাহাকে নিবৃত্ত করিতে পারে। ইন্দ্রিয় সকল মনের বশবর্ত্তী, মন তাহাদিগকে যে পথে চালায় তাহারা সেই পথে চলে। কিন্তু জ্ঞান সকলের প্রধান, মন কুপথগামী হইলে তাহাকে নিবারণ করে, এবং পঞ্চ ইন্দ্রিয় জ্ঞানের বশীভূত থাকে, জ্ঞানদ্বারা ইন্দ্রিয়ের বিকার দূর হইলে মনুষ্যের কোন ভয় ভাবনা থাকেনা, এবং অনায়াসে যোেগ সিদ্ধ হইতে পারে।
রাজা বিক্রমাদিত্য উভয়ের বাক্য শ্রবণ করিয়া তাহাদিগকে বলিলেন তোমাদের বিবাদের আমূল বুঝিলাম, তোমরা কিঞ্চিৎ অপেক্ষা কর, আমি বিবেচনা করিয়া, ইহার উত্তর দিতেছি। কিয়ৎকাল পরে রাজা তাহাদিগকে বলিলেন, হে জিতেন্দ্রিয় যোগীন্দ্র এই মনুষ্যদেহ, অগ্নি জলবায়ু ও মৃত্তিকাতে নির্মিত, এই শরীরের প্রধান কর্মকর্তা মন, তাহার মতানুযায়ী হইয়া চলিলে শরীর অনায়াসেই বিনাশ প্রাপ্ত হইতে পারে। কিন্তু জ্ঞানকে অধিক বলবান বলিতে হইবে, কেননা তাহাতে মনের বিকার জন্মিতে দেয় না, সুতরাং যে মনুষ্য জ্ঞানবান, তাহার শরীর নষ্ট হইতে পায় না। পৃথিবীতে জ্ঞানবান, ব্যক্তিই অমর। যোগী যে পর্যন্ত জ্ঞানদ্বারা সনকে বশীভূত করিতে সমর্থ না হয় সে পর্যন্ত তাহার যোগ সিদ্ধ হয় না।
রাজার এই উত্তর শুনিয়া উভয় সন্ন্যাসী সন্তুষ্ট হইলেন, এবং তন্মধ্যে জন রাজাকে একখান খড়ি দিয়া কহিলেন মহারাজ এই খড়িতে দিবসে যে প্রতিকৃতি লিখিবেন তাহা রজনীতে প্রত্যক্ষ পরিদৃশ্যমান মূর্তিমান জীব হইবে। ইহা বলিয়া যোগীদ্বয় প্রস্থান করিলেন। দ্ভ
রাজা খড়ির অদ্ভুত গুণের কথা শুনিয়া মনে মনে চিন্তা করিতে লাগিলেন কি প্রকারে ইহার পরীক্ষা। হইবে। তৎপরে একটা গৃহে তাবদিবস বসিয়া ভিত্তিতে নানা প্রকার মূর্তি অঙ্কন করিলেন, অর্থাৎ কৃষ্ণ, সরস্বতী ও আর আর অনেক দেবতার মূর্তি লিখিলেন। রাত্রে এই সকল দেবতা মূর্তিমান হইয়া জয়ধ্বনি করিয়া উঠিলেন এবং পরপর কথোপকথন করিতে লাগিলেন। রাজা দেখিয়া বিমোহিত হইলেন, কিন্তু ত্রাস প্রযুক্ত কোন কথা কহিলেন না। রজনী প্রভাত হইলে দেবগণ অন্তর্ধান হইলেন। পুত্তলী সকল ভিত্তিতে যেমন চিত্রিত হইয়া ছিল সেই প্রকার রহিল। রাজা দিবাভাগে পুনর্ব্বার সেই ভিত্তির আর এক ভাগে মাতঙ্গ তুরঙ্গ শকট রথ ও সৈন্য ইত্যাদি নানা মূত্তি লিখিলেন। নিশামুখে ঐ সকল সেনা ও পশু জীবন প্রাপ্ত হইল। রাজা তাহা দেখিয়া অত্যন্ত আহলাদিত হইলেন, এবং মনে করিতে লাগিলেন যোগী আমাকে কি অমূল্য সামগ্রী দিয়া গিয়াছেন। নিশা অবসান হইলে ঐ মত্তি সকল নির্জীব হইল। তৃতীয় দিবসে রাজা, গন্ধর্ব্ব ও অসরা গণের মূর্তি লিখিলেন, এবং তাহাদের হস্তে মৃদঙ্গ বীণা রবাব তানপুরা মোচঙ্গ সেতার পিনাক বাসুরি করতাল প্রভৃতি নানা বাদ্যযন্ত্র দিলেন। রাত্রিযোগে ঐ সকল গন্ধর্ব্ব জীবিত হইয়া সঙ্গীত শাস্ত্রানুসারে সঙ্গীতারম্ভ করিল, এবং বাদ্য-যন্ত্রাদির বাদ্য হইতে লাগিল। অপ্সরাগণ নৃত্য ও নানা কৌতুক করিতে লাগিল।
রাজা প্রত্যহ এই প্রকার দিবাভাগে চিত্রাঙ্কন এবং রাত্রিযোগে তাহাদের ক্রীড়াদি দর্শন করিতেন। রাজকার্য্যও করিতেন না, অন্তঃপুরেও যাইতেন না। রাজ মহিষীগণ তাহার কারণ অবধারণে অক্ষম হইয়া আক্ষেপ পূর্ব্বক পরপর এইরূপ কহিতে লাগিলেন, রাজা আমাদিগকে ত্যাগ করিয়া কেবল বাহিরে থাকেন ইহার কারণ কি। আমরা অনেক দিন অনেক যাতনা পাইলাম, এইক্ষণে তদ্বিরহে আর প্রাণধারণ করিতে পারিনা। এবম্প্রকার বিলাপ করিয়া মহিষীগণ নিশাযোগে শিবিকাররাহণে তাহার নিকটে গিয়া করপুটে কহিলেন মহারাজ আমাদের কি অপরাধ হইয়াছে যে আপনি আমাদিগের প্রতি একবারে এমত নির্দয় হইয়াছেন। রাজা হাস্য করিয়া বলিলেন, হে সুন্দরীগণ, তোমরা এখানে কি নিমিত্ত আসিয়াছ, তোমাদিগের বদনেন্দু কেন মলিন হইয়াছে। রাজমহিষীগণ নতমস্তক হইয়া কহিলেন, স্বামিন, আমাদের দুঃখের কথা কি জিজ্ঞাসা করেন, যদি অনুমতি করেন প্রকাশ করিয়া বলিতে পারি। রাজা বলিলেন বল। তাহাতে মধুরভাষিণী এক চতুর। রাণী কহিলেন মহারাজ আমরা অবলা বালা, কখন কোন যন্ত্রণ জানি না, আপনার আশ্রয়ে সদা সুখে কালযাপন করিয়াছি। সম্প্রতি আপনকার অদর্শন রূপ অনলে অহরহ দগ্ধ হইতেছি। আমাদিগের এই যন্ত্রণা দূর কর। আমরা আর সহ করিতে পারিনা। আর এক রাণী কহিলেন আপনি অঙ্গীকার করিয়াছিলেন আমাদিগকে কখন পরিত্যাগ করিবেন না। অতএব আমাদিগকে কি প্রকারে বিস্মৃত হইয়া আছেন, আমরা আপনাকে না দেখিয়া জীবনূত হইয়াছি।
রাণীরা এইপ্রকার অনেক বিলাপ করিতে লাগিলেন। কিন্তু রাজা মূর্তিগণের ক্রীড়া দর্শনে মোহিত থাকিলেন। নিশাবসানে মূর্তি সকল ম্রিয়মান হইল। তখন রাণীগণ পুনর্ব্বার কহিলেন মহারাজ যেপর্য্যন্ত আপনি আমাদিগকে পরিত্যাগ করিয়াছেন সে পর্যন্ত এই স্থান আপনার অন্তঃপুর হইয়াছে। কিন্তু আমরা আপনার আশ্রিত, আশ্রিত জনের ক্লেশ দিলে পাপভাগী হইতে হইবে। রাজা হাস্য করিয়া বলিলেন তোমরা কেন এত চিন্তা করিতেছ, তোমাদের কি প্রার্থনা আমাকে বল। রাজমহিষীগণ বলিলেন মহারাজ যদি আমরা প্রার্থনা করিলে প্রার্থিত বস্তু পাই তবে প্রার্থনা করি। রাজা বলিলেন যাহা চাহিবে তাহা দিব। মহিষীগণ বলিলেন মহারাজের হস্তে যে খড়িখান আছে তাহা আমাদিগকে দিতে আজ্ঞা হউক। রাজা ঐ খড়িখান তৎক্ষণাৎ তাহাদিগকে দিলেন। রাণীগণ খড়ি লইয়া অন্তঃপুরে প্রবেশ করিলেন, আর কখন তাহা রাজাকে দেখাইলেন না। রাজাও তাহাদের প্রতি পূর্ব্ববৎ সকরুণ হইলেন, এবং রীতিমত রাজ্যকার্য্য করিতে লাগিলেন।
রূপরেখা কহিল দেখ, রাজা বিক্রমাদিত্য এমত অমূল্য দ্রব্য একবারে পরিত্যাগ করিতে কিছুমাত্র বিলম্ব করিলেন না, তোমার এমত গুণ কোথায়। তোমার এমত দ্রব্য থাকিলে তুমি কদাচ তাহা দিতে পারিতে অতএব তুমি সিংহাসনে বসিবার বাসনা ত্যাগ কর, তুমি এ সিংহাসনের যোগ্য নহ।
এই সকল কথায় সে দিবসেও সিংহাসনারোহণ করা হইলনা, রাজা অন্তঃপুরে গমন করিলেন। দিবস প্রত্যুষে প্রাতঃকৃত্যাদি করিয়া পুনর্ব্বার সভায় আসিয়া সিংহাসন সমীপে দণ্ডায়মান হইলে,