বত্রিশ সিংহাসন/২২
অনুপরেখা দ্বাবিংশ পুত্তলিকা
কহিল হে রাজন, তুমি সিংহাসনােপবেশনের বাসনা পরিত্যাগ কর, এবং আমি যাহা কহি তাহা শুন।
এক দিবস রাজা বিক্রমাদিত্য সভারূঢ় হইয়া মন্ত্রী- কে জিজ্ঞাসা করিলেন কর্ম্মের দ্বারা মনুষ্যের জ্ঞানােৎ- পত্তি হয়, কি, মাতা পিতার উপদেশানুসারে হইয়া থাকে। মন্ত্রী কহিলেন মহারাজ মনুষ্য পূৰ্বজন্মে যেমন কর্ম্ম করে পরমেশ্বর সেই প্রকার তাহার ফল দেন, তদ- মুসারে বিদ্যা হয়, মাতা পিতার শিক্ষাতে হয় না। তিনি আরও বলিলেন মনুষ্য মনুষ্যকে কি শিখাইতে পারে, যদি তাহা হইত তবে সকলেই পণ্ডিত হইতে পারিত, ফলতঃ পূর্ব্ব জন্মের সুকৃতি ভিন্ন কখন বিদ্যা হয় না। বিধাতা যাহার অদৃষ্টে যাহা লিখিয়াছেন, মনুষ্যের সাধ্য নাই তাহার বিপরীত করে। রাজা বলিলেন মন্ত্রী তুমি এ কি কথা কহিতেছ, সন্তান ভূমিষ্ঠ হইলেই মাতা পিতার উপদেশানুসারে চলে, এবং তাহাদের যে প্রকার ব্যবহারাদি দেখে সেই প্রকার শিখে, ইহাতে পূর্ব জন্মের ফল কি আছে। বালকগণকে যাহা শিখান যায় তাহাই শিখে, আর যেমন সংসর্গে বাস করে সেই প্রকার বুদ্ধিও হয়। মন্ত্রী বলিলেন ধর্মাবতার আমি আপনার কথায় বিতণ্ডা করিতে পারি না, কিন্তু আপনি বিবেচনা করিয়া দেখুন অদৃষ্টানুসারে মনুষ্যের ফলভোগ হইয়া থাকে। রাজা কহিলেন ইহার পরীক্ষা করা কর্তব্য।
তদনন্তর রাজা নরাগম্য এক নিবিড় অরণ্য মধ্যে এক গৃহ নির্মাণ করিতে আজ্ঞা দিলেন। পরে তাহা প্রস্তুত হইলে, তাহার এক পুত্র জন্মিল। ঐ পুত্র মাতৃ গর্ভ হইতে ভূমিষ্ঠ হইবা মাত্র তিনি তাহাকে ঐ স্থানে প্রেরণ করিলেন, এবং তাহার রক্ষার্থ এক ধাত্রী নিযুক্ত করিলেন, সে জন্মান্ধা ও বধিরা এবং বাক শক্তি রহিতা, কোন কথা কহিতে পারিত না, কেবল বালককে দুগ্ধপান করাইত। ইহার কিছু কাল পরে মন্ত্রীর এক পুত্র জন্মিল, এবং রাজপুরোহিতের ও নগরপালের দুই পুত্র হইল। ইহাদিগকেও রাজা সেই প্রকার জন্মান্ধা বধিরা বচনশক্তিরহিতা ধাত্রী দিয়া, সেই অরণ্য গৃহে প্রেরণ করিলেন। বালকেরা ঐ স্থানে থাকিয়া ধাত্রীদিগের স্তন পানে প্রাণ ধারণ পূর্বক প্রবন্ধমান হইতে লাগিল। ঐ গৃহের দুই ক্রোশ অন্তর পর্যন্ত এমত প্রহরী রহিল যে, মনুষ্যশব্দ দূরে থাকুক ঢাক ঢোলের শব্দও তথায় প্রবেশ করিতে পারিত না।
এই প্রকার দ্বাদশ বৎসর অতীত হইলে এক দিবস পুরোহিতের ভার্য্যা ভর্তাকে কহিলেন এক যুগ পূর্ণ হইল আমি পুত্রের মুখাবলোকন করিলাম না। যদি হঠাৎ পরলোক গমন করি তবে তাহাকে আর দেখিতে পাইব না। অতএব তুমি রাজার স্থানে যাইয়া বল, মহারাজ দ্বাদশ বৎসর উত্তীর্ণ হইল আমি পুত্রের মখাবলোকন করি নাই। এইক্ষণে আমার অভিলাষ হইয়াছে তাহাকে গৃহাদি সমর্পণ করিয়া দণ্ডগ্রহণ পূর্ব্বক তপস্যা করি। ব্রাহ্মণীর পরামর্শে ব্রাহ্মণ রাজার সন্নিধানে গমন করিলে, রাজা তাহাকে প্রণিপাত পূর্ব্বক কুশলাদি জিজ্ঞাসা করিলেন। ব্রাহ্মণ আশীর্ব্বাদ করিয়া বলিলেন মহারাজ আপনার কৃপাতে সকল মঙ্গল, কিন্তু আমি এক মানস করিয়া মহারাজের সমীপে আসিয়াছি। রাজা বলিলেন কি মানস। ব্রাহ্মণ তখন সকল বৃত্তান্ত কহিলেন। তাহাতে রাজা মন্ত্রীকে আজ্ঞা করিলেন। চারি বালককে অরণ্য গৃহ হইতে আনয়ন কর।
মন্ত্রী এই আজ্ঞা পাইয়া প্রথমত রাজকুমারকে আনয়ন করিলেন। রাজনন্দনের নখ ও কেশ অত্যন্ত বদ্ধিত এবং তাবৎ শরীর মলিন ও ম্লেচ্ছাকার হইয়াছিল। এই অবস্থাতে তাহাকে রাজার সম্মুখে উপস্থিত করিলে, রাজা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, হে নন্দন, তুমি এত দিন কোথায় ছিলে, এবং এখন কোথা হইতে আসিতেছ, তোমার কুশল বল। রাজকুমার হাস্য করিয়া বলিলেন মহারাজের কৃপাতে আমার সকল কুশল, বিশেষতঃ অদ্য অধিক কুশলের দিবস উপস্থিত হইয়াছে, কেননা আপনার চরণ দর্শন করিলাম। ইহা শুনিয়া রাজা হৃষ্টান্তঃকরণে মন্ত্রীর প্রতি দৃষ্টিপাত করিলেন। মন্ত্রী কৃতাঞ্জলি হইয়া কহিলেন মহারাজ এ সকল ব্যাপার জন্মান্তরীয় কর্ম্মের ফল মানিতে হইবে।
তদনন্তর রাজা মন্ত্রিপুত্রকে আনয়ন করাইলেন। মন্ত্রিতনয় রাজার সম্মুখে উপস্থিত হইলে, রাজ। দেখিলেন তাহার ভয়ানক মূর্তি, অর্থাৎ ভাল্লুকের ন্যায় নখ ও কেশ বৃদ্ধি হইয়াছে। মন্ত্রিনন্দন অভিবাদন পূর্ব্বক রাজার সম্মুখে দাণ্ডাইলে রাজা জিজ্ঞাসা করিলেন তোমার কুশল সংবাদ কহ, তুমি কোথায় ছিলে এবং কোন স্থান হইতে আগমন করিতেছ। মন্ত্রিপুত্র কহিলেন আমার জন্মগ্রহণমাত্রে আপনি আমাকে নির্বান্ধব নিকেতনে রাখিয়া ছিলেন। জল পাত্র জলপূর্ণ হইলে জলমগ্ন হয় ইহা সকলেই জানে। মনুষ্যগণ জানিতেছে দিন যাইতেছে, এবং দিনও জানিতেছে। সয্য যাইতেছে। সংসারের এই ব্যবহার, ইহাতে কুশলের বিষয় কি আছে। রাজা, মন্ত্রিপুত্রের এই অদ্ভুত বাক্য শুনিয়া, মন্ত্রীকে কহিলেন ইহাকে এই কথা কে শিখাইল, তুমি আমাকে যে কথা বলিয়াছিলে তাহা প্রকৃত, পূর্ব্ব জন্মের কর্মেরই এই সকল ফল বলিতে হইবে।
তদনন্তর রাজা নগরপালের পুত্রকে ডাকাইলেন। সে আসিয়া রাজাকে প্রণাম পর্ব্বক করপুটে দণ্ডায়- মান হইলে, রাজা তাহাকেও সেই প্রকার প্রশ্ন করিলেন। নগররক্ষকের নন্দন কহিল হে পৃথীনাথ আমরা দিবা- রাত্র নগর রক্ষা করি, তথাপি দস্যুবৃত্তি নিবৃত্তি হয় না, ইহাতে সর্ব্বদা দুনামগ্রস্ত হইতে হয়। বিনাপরাধে অপরাধীর ফল হইলে কি প্রকারে কুশল বলিতে পারি।
পরিশেষে রাজা বিপ্রনন্দনকে আনয়ন করাইলেন। ব্রাহ্মণকুমার রাজার সম্মুখে আসিলে, রাজা তাহাকে প্রণাম করিলেন। ব্রাহ্মণতনয় রাজাকে শ্লোক পাঠ পর্ব্বক আশীর্ব্বাদ করিলেন। তদনন্তর রাজা তাহার কুশলাদি জিজ্ঞাসা করিলে, বিপ্রনন্দন কহিলেন মহা- রাজ আমার কুশল জিজ্ঞাসা করিতেছেন, কিন্তু আমা- দিগের পরমায়ু দিনদিন ক্ষয় হইতেছে। মনুষ্য চিরজীবী হইলেই কুশল বলা যাইতে পারে, কিন্তু জীবন মৃত্যু আ- মাদের সঙ্গে সঙ্গেই রহিয়াছে, অতএব কুশলের বিষয় কি। চারি বালকের এইরূপ অপরূপ কথা বার্তা শুনিয়া রাজা মন্ত্রীকে কহিলেন তােমার কথাই যথার্থ। পড়া- ইলেই পণ্ডিত হয় না, পূর্ব জন্মের কর্ম্মবশতঃ পাণ্ডিত্য জন্মে। ইহা বলিয়া, মন্ত্রীর প্রতি সন্তোষের চিহ্রস্বরূপ তাহাকে প্রধানমন্ত্রিত্ব প্রদান করিয়া, সকল রাজকার্যের ভারার্পণ করিলেন। পরে, যে চারি বালককে অরণ্য গৃহে রাখিয়াছিলেন তাহাদের বিবাহ দেওয়াইলেন, এবং তাহাদিগের সংসারযাত্রা নির্বাহ জন্য অনেক বিত্ত সম্পত্তি প্রদান করিলেন।
এতাবৎ বর্ণন করিয়া পুত্তলিকা কহিল, হে ভোজরাজ, কলিযুগে এমত ধর্মাত্মা সত্যপ্রিয় জিতেন্দ্রিয় মনুষ্য কোথায়। যে ব্যক্তি এমত পণ্ডিত, জ্ঞানবান, ও ঐশ্বর্যশালী হইয়া আপনার বিদ্যা বা পরাক্রমের গৌরবে গতি না হন, এবং আপন বাক্যের দৃঢ়তা না করিয়া, কেহ কোন কথা বলিলে তাহার পরীক্ষা এবং বিচার করেন, তাহাকে অবশ্যই সদগুণান্বিত বলিয়া ব্যাখ্যা করা যাইতে পারে। হে ভোজরাজ তুমি এমত গুণশালী নহ, অতএব কি প্রকারে সিংহাসনারোহণ করিতে চাহ, এ দুরাশ পরিত্যাগ কর।
রাজা এই কথায় বিমর্শযুক্ত হইয়া তথা হইতে গাত্রোত্থান পূর্ব্বক অন্তঃপুরে প্রস্থান করিলেন। রাত্রে শয়ন করিয়া ভাবিতে লাগিলেন আমার কুগ্রহে এই সকল ক্লেশ দিতেছে, আমার অদৃষ্টের দোষ কবে খণ্ডিবে এবং সিংহাসনারোহণ করিয়া আমি কবে চরিতার্থ এই প্রকার চিন্তাতে নিশাবসান হইল। প্রত্যুষে রাজা সভায় আসিয়া পুনর্বার সিংহাসনারোহণে উদ্যত হইলে,