বত্রিশ সিংহাসন/৪
চন্দ্রকলা চতুর্থ পুত্তলিকা
কহিতে লাগিল হে রাজন, তুমি কেন এত ত্বরিতাঃ- করণ হইয়াছ, কিঞ্চিৎ কাল ধৈর্য্যাবলম্বন পূর্ব্বক শ্রবণ কর, আমি তােমাকে রাজা বিক্রমাদিত্যের বদান্যতার এক বিবরণ বলি।
এক দিবস রাজা বিক্রমাদিত্য সভায় বসিয়া আছেন এমত সময়ে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ আসিয়া বলিল মহা- রাজ আমি যেরূপ উপদেশ দিতেছি তদনুসারে যদি কেহ নূতন আলয় নির্মাণ করিয়া তাহাতে বাস করে তাহা হইলে অতিশয় সুখী ও যশস্বী হইতে পারে। রাজা জিজ্ঞাসা করিলেন কিরূপ বল দেখি। বিপ্র কহিল ভুল লগ্নে গৃহ গ্রন্থন আরম্ভ করাইতে হইবে, এবং যে কাল পর্যন্ত ঐ লগ্নের স্থিতি সে কাল পর্যন্ত কর্ম্মকারকেরা কর্ম্ম করিবে, তুলা লগ্ন অতীত হইলে কর্মে ক্ষান্ত দিবেক, পুনৰ্বার ঐ লগ্ন উপস্থিত হইলে কর্ম্ম করিবে। এই প্রকার কেবল তুলা লগ্নে গৃহ নির্মিত হইলে গৃহস্থের ভাণ্ডার ধনে পরিপূর্ণ হয় এবং তাহার আলয়ে লক্ষ্মী সদা বিরাজমান থাকেন।
রাজা বিক্রমাদিত্য এই কথায় মহাহৃষ্ট হইয়া তখনি মন্ত্রীকে আজ্ঞা করিলেন উত্তম স্থান দেখিয়া তুলা লগ্নে এক অট্টালিকা নিৰ্মাণ কর। মন্ত্রী রাজানুসারে নদীর সম্ম,খস্থিত এক ভূখণ্ড মনােনীত করিয়া তুলা লগ্নে গৃহের ভিত্তি খনন করাইলেন। পরে নানা দেশ হইতে নানা জাতীয় শিল্প নৈপুণ্য দক্ষ মনুষ্য আনিয়া যে যে শিল্প বিদ্যায় পারগ। তাহাকে সেই কর্মে নিযুক্ত করিলেন। তাহারা অশেষ গুণ প্রকাশ পূর্ব্বক কেহ রজত কেহ স্বর্ণ কেহ লোহ ও কেহ কাষ্ঠের কর্ম করিয়া এক অপূৰ্ব অট্টালিকা নির্মাণ করিল, এবং তাহার স্থানে স্থানে অমূল্য রত্ন সংযোগ করিল, তদ্ভিন্ন দ্বারা সকলের শোভা বর্ধনাথ প্রত্যেক দ্বারে দুই দুই নীলকান্ত মণি সংলগ্ন করিল। সুতরাং অট্টালিকা এমত মনােহর সুন্দর ও সুদৃশ্য হইল যে তৎসদৃশ কখন কাহার নেত্র-গােচর হয় নাই। অট্টালিকা প্রস্তুত হইলে মন্ত্রী রাজার নিকটে সংবাদ দিলে না রাজা গৃহ দর্শনার্থ গমন করিলেন, এবং তৎসমভিব্যাহারে এক অতি দীন ব্রাহ্মণও চলিল। অনন্তর যখন রাজা অট্টালিকা অবলােকন করেন তখন ঐ ব্রাহ্মণ কৌতুক ভাবে হাস্য করিতে করিতে কহিল যদি আমি এই অট্টালিকা পাই তবে এখানে থাকিয়া সদানন্দে কাল যাপন করি, আর কুটীরে কখন যাই না। এই কথা শ্রবণ মাত্র রাজা কোন চিন্তা না করিয়া তৎক্ষণাৎ গঙ্গাজল ও তুলসী-পত্র আনাইয়া ঐ অট্টালিকা ব্রাহ্মএকে উৎসর্গ করিয়া দিলেন। ব্রাহ্মণ, সুধাপানে তৃপ্ত চকোরের ন্যায় অট্টালিকা পাইয়া আনন্দ-সাগরে মগ্ন। হইল, এবং আপন ভিক্ষাধার ও বস্ত্রাদি আনিয়। সে রাত্রি ঐ অট্টালিকাতে বাস করিল।
অনন্তর ব্রাহ্মণ সায়ং সন্ধ্যাদি করিয়া প্রথম প্রহর রাত্রে পরমানন্দে পর্য্যঙ্কে শয়ন করিয়াছে এমত সময়ে রাজলক্ষ্মী তাহার সম্মুখে আসিয়া হাস্য মুখে বলিলেন বৎস তুমি বল, আমি তােমার গৃহ মণি মুক্তাদি বিবিধ রত্নে পরিপূর্ণ করি। ব্রাহ্মণ লক্ষ্মীদেবীকে উপদেবী জ্ঞান করিয়া আতঙ্কে মৃতকল্প হইয়া রহিল, কমলা তখন চলিয়া গেলেন। পরে দ্বিতীয় প্রহর রজনীতে পুনর্ব্বার আসিয়া বলিলেন অরে অজ্ঞান ব্রাহ্মণ আমাকে বল আমি কোথায় রত্ন বর্ষণ করি। ব্রাহ্মণ তখনও কোন উত্তর করিল না, এবং ভয় ও চিন্তাতে সমস্ত রাত্রি অজ্ঞানাভিভূত থাকিল, প্রত্যুষে গাত্রোত্থান করিয়া মলিন বদনে রাজ সদনে গমন করিল। রাজা তাহার অপ্রসন্ন বদন দর্শনে হাস্য করিতেলাগিলেন, এবং জিজ্ঞাসা করিলেন কল্য তােমাকে প্রফুল দেখিয়া ছিলাম, অদ্য এমত হইয়াছ কেন। ব্রাহ্মণ কহিল মহারাজ আমার দুঃখের কথা কি নিবেদন করিব, আপনি পরােপকারী ও পর-হিতৈযী, এবং পূর্ব্বকালে কর্ণ যেরূপ দাতা ছিলেন এ কালে আপনিও সেইরূপ আমার প্রতি যথেষ্ট দাতৃত্ব প্রকাশ করিয়া ছিলেন। কিন্তু ঐ অট্টালিকাতে প্রেতিনী বা পিশাচী বাস করে, সে আমাকে সমস্ত রাত্রির মধ্যে একবার নয়ন মুদিত করিতে দেয় নাই। আপনকার প্রতাপেই হউক বা আমার সন্তানের ভাগ্যেই হউক কোন প্রকারে প্রাণে প্রাণে বাঁচিয়া আসিয়াছি, বরঞ্চ ভিক্ষা করিয়া উদর ভরণ করিব সেও সহস্র গুণে সুখকর, কিন্তু প্রান্তেও আর তথায় যাইবনা। রাজা এ কথা শুনিয়া হাস্য করিতে লাগিলেন, পরে মন্ত্রীকে আজ্ঞা করিলেন অট্টালিকা নির্মাণে যত টাকা ব্যয় হইয়াছে ইহার মূল্য স্বরূপ তত টাকা ব্রাহ্মণকে দাও। রাজাজ্ঞায় মন্ত্রী গণনা করিয়া তত টাকা ব্রাহ্মণকে দিলেন। ব্রাহ্মণ তাহা শকটপূর্ণ করিয়া লইয়া গেল।
অনন্তর রাজা বিক্রমাদিত্য এক দিবস ঐ ভবনে শুভ ক্ষণে গমন করিয়া সন্ধ্যার সময় একাকী বসিয়া কোন বিষয় চিন্তা করিতেছেন এমত সময়ে রাজলক্ষ্মী তথায় আগমন পূর্বক তাহার সম্মুখে দণ্ডায়মান হইয়া কহিলেন হে নর-শ্রেষ্ঠ তােমার ধর্মকে ধন্যবাদ করি। ইহা বলিয়া কমলা অন্তর্হিত হইলেন। তদনন্তর রাজা শয়ন করিলেন। পরে তৃতীয় প্রহর রাত্রির সময় রাজলক্ষ্মী পুনর্ব্বার আসিয়া রাজার সম্মুখে দণ্ডায়মান হইয়া কহিলেন মহারাজ আমি কোথায় বর্ষণ করিব। রাজা কহিলেন আমার শয়নের পালঙ্ক ত্যাগ করিয়া যথা ইচ্ছা বর্ষণ কর। তদনন্তর তাবগরে স্বর্ণবৃষ্টি হইল। পরদিবস রাজা শয্যা হইতে গাত্রোথান করিয়া দেখিলেন চতুর্দিকে স্বর্ণ বৃষ্টি হইয়াছে। তাহাতে মনে মনে বিবেচনা করিলেন প্রজাদিগের ধন-কষ্ট নিমিত্ত এক দুর্ভাবনা ছিল এইক্ষণে তাহা দূর হইল, অতএব কিছু কাল সুখে কাল যাপন করিতে পারিব। তদনন্তর মন্ত্রী আসিয়া নিবেদন করিলেন মহারাজ সমুদয় নগরে স্বর্ণবর্ষণ হইয়াছে, অতএব যেরূপ আজ্ঞা করেন তাহা করি। রাজা কহিলেন নগরে ডিণ্ডিম প্রচার করিয়া দাও, যাহার সীমাতে যত স্বর্ণ পড়িয়াছে সে তাহা লয় এবং কেহ কাহার প্রতি অত্যাচার না করে। রাজার এই আজ্ঞাপ্রাপ্তে প্রজাগণ স্বস্ব গৃহ স্বর্ণে পরিপূর্ণ করিল।
পুত্তলিকা এই আখ্যায়িকা সমাপন করিয়া ভােজরাজকে কহিল, রাজা বিক্রমাদিত্য এই রূপ দাতা ও প্রজার হিতকারী ছিলেন। অতএব তােমার কি গুণ আছে যে তাহার সিংহাসনে বসিতে বাঞ্ছ। কর। পুত্তলীর এই বাক্যে রাজা ক্রোধাভিষিক্ত হইলেন, এবং শুভ লগ্নও অতীত হইল। সুতরাং সিংহাসনোপবেশন হইলনা। পর দিবস রাজা পুনৰ্বার আসিয়া সিংহাসনারােহণার্থে পাদ প্রসারণ করিলে