বরেন্দ্র রন্ধন/চতুর্দ্দশ অধ্যায়



চতুর্দ্দশ অধ্যায়॥

আচার ও কাসুন্দি

 কন্দ-মূল-ফলাদি লবণাক্ত এবং স্বয়ং অম্লম্বাদবিশিষ্ট না হইলে অম্লস্বাদ বিশিষ্ট করিয়া নুণ, তেল, (সির্কা) প্রভৃতি কোন এক প্রকার পচন নিবারক সেব্য পদার্থে ডুবাইয়া রৌদ্র-পঙ্ক করিয়া লইলে ‘আচার’ প্রস্তুত হইবে।

 সাধারণতঃ নুণ ও অম্লরস ব্যতীত আচারে হলুদ, কাঁচা লঙ্কা, কালজিরা ও মৌরি মশল্লারূপে ব্যবহৃত হয়। অনেক ক্ষেত্রে তৎসহ সরিষা এবং আদা মিশান হইয়া থাকে। (এবং সির্কায় রক্ষিত আচারে রশুনও সংযোগ করা হইয়া থাকে।) আচারে পেঁয়াজ ব্যবহৃত হয় না, সম্ভবতঃ পেঁয়াজে জলীয় ভাগ অধিক আছে বলিয়া দেওয়া যায় না। আচারে সাধারণতঃ আর অপর কোন মশল্লা বা ঝালের গুঁড়া দেওয়া যায় না। ‘ঝালের’ গুঁড়ার ব্যবহার কাসুন্দিতেই পর্য্যাপ্ত পরিমাণে হইয়া থাকে। কোন কোন ক্ষেত্রে কন্দ-মূল-ফলাদি অগ্নি-পক্ব করিয়া লইবার প্রয়োজন হয়।

 ভাল করিয়া রাখিতে পারিলে আচার অনেক দিন থাকে। এই নিমিত্ত যে পাত্রে, যে গৃহে আচার রক্ষিত হইবে এবং যে উপাদানে উহা প্রস্তুত হইবে এবং যদ্দ্বারা উহা নাড়াচাড়া করিতে হইবে তাহা সমস্ত যতদূর সম্ভব সুপরিষ্কৃত হওয়া নিতান্ত আবশ্যক। বিশেষতঃ কাসুন্দি সম্বন্ধে পরিচ্ছন্নতা বিশেষ ভাবে আবশ্যক।

 পচন নিবারক পদার্থ ভেদে আচারের প্রকার-ভেদ করা যাইতে পারে। আমি এখানে সচরাচর প্রচলিত তিন প্রকার আচারের বিষয় লিখিলাম;— (ক) নিমকী-আচার, (খ) তৈল-কাচার এবং (গ) সৈর্ক্ক আচার। এবং ইহা সেওয়ায় কাসুন্দিকে (ঘ) ঝাল-আচার বলা যাইতে পারে।

ক। নিমকী আচার

১৯৪। আমচূণা

 (ক) ডাগর দেখিয়া কাঁচা আম লও। এমন আম বাছিয়া লইবে যাহার কুঞার (বীচির) উপরের খোলা সবে দঢ়াইতে সুরু হইয়াছে। ছুল। কুঞা ফেলিয়া দিয়া শাঁস ফলা ফলা করিয়া কুটিয়া লও। অমনি অথবা নুণ মাখিয়া রৌদ্রে দাও। কয়েক দিবস ধরিয়া রৌদ্র খাওয়াইলে যখন বেশ শুষ্ক হইবে তখন ‘পাকান’ হাঁড়িতে ভরিয়া শুষ্ক ঘরে উঠাইয়া রাখ। ইহাকে সাধারণতঃ ‘আমসী’ কহে।

 (খ) উপরিলিখিত বিধানে কাঁচা আম রৌদ্রে উত্তমরূপে শুকাইয়া ঢেঁকিতে কুটিয়া চালুনীতে চালিয়া লও। ইহাকে সাধারণতঃ ‘আমচুর’ কহে। ইচ্ছা করিলে ইহার সহিত নিম্নলিখিত ভাজা ঝালের গুঁড়া মিশাইয়া লইতে পার। শুক্না লঙ্কা, ধনিয়া, জিরা-মরিচ, তেজপাত, কালজিরা ও লবঙ্গ আন্দাজ মত পরিমাণে লইয়া কাট-খোলায় ভাজিয়া গুঁড়া করিয়া লও। চালুনীতে চাল। আমচূর্ণের সহিত মিশাও। অতঃপর সুপরিষ্কত ‘পাকান’ হাঁড়ীতে ভরিয়া ‘সরা’ চাপা দিয়া হাঁড়ীর মুখ উত্তমরূপে বন্ধ করিয়া শুষ্ক ঘরে উঠাইয়া রাখ। ইহাকে ‘ঝাল-আমচুর’ বলা যায়।

 দ্রষ্টব্য—এই ‘ঝাল-আমচূরের’ সহিত ১৫৮ পৃষ্ঠায় লিখিত বারাণসের ‘আমচুর’ তুলনীয়।

 যে সকল কন্দ-মূল-ফলাদি স্বয়ং অম্লস্বাদ বিশিষ্ট নহে, তাহার সহিত আমচুর মিশাইয়া অম্লস্বাদ যুক্ত করিয়া আচারাদি প্রস্তুত হইয়া থাকে। ব্যাঞ্জনাদিতে ও সূপে আমচুর মিশাইয়া তাহাও অম্লস্বাদ বিশিষ্ট করা যায়।

১৯৫। কুলচুর

 (ক) আমচুরের ন্যায় কুলচুর প্রস্তুত হইতে পারে। সুপক্ব টোপাকুল উত্তমরূপে রৌদ্রে শুকাও। ঢেঁকিতে কুটিয়া চালুনীতে ছাঁকিয়া লও। অতঃপর ভাজা ঝালের গুঁড়া ও নুণ, হলুদ মিশাইয়া সুপরিষ্কৃত পাকান হাঁড়িতে উত্তমরূপে মুখ বন্ধ করিয়া শুষ্ক ঘরে উঠাইয়া রাখ।

 পচন নিবারণ জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে কুলচুরে তৈল সংযোগ করিয়া মাখিয়া তাল পাকাইয়া উঠাইয়া রাখা হইয়া থাকে। অতএব কুলচুরকে ঝাল আচার শ্রেণীর অন্তর্গতও বলা চলে।

 (খ) শুষ্ক পাকা টোপা কুল চুর্ণ করতঃ ছাঁকিয়া রাখ। গুড় বা চিনি কড়াতে জ্বালে উঠাও। গলিয়া তরল হইলে তাহাতে কুলচুর্ণ ছাড়। নাড়। গাঢ় হইলে নামাইয়া ছোট ছোট পিষ্টকাকারে গড়িয়া হাঁড়িতে উঠাইয়া রাখ। ইহা দুধের সহিত খাওয়া চলে।

১৯৬। লেবুর আচার বা ‘জারক-লেবু’

 (ক) সুপক্ব দেখিয়া পাতি লেবু লও। পাতি লেবুরই ভাল আচার হয়। একটি পাথরের চেৎরা ‘খাদায়’ রাখিয়া উপরে প্রচুর পরিমাণে সুপরিষ্কৃত নুণ ছড়াইয়া দিয়া রৌদ্রে দাও। কয়েক দিবস রৌদ্র খাওয়াইয়া বেশ রৌদ্রপক্ব হইলে পাকান হাঁড়িতে ভরিয়া উঠাইয়া রাখ। লেবুর গাত্র হইতে একরূপ তৈল (লেবু তৈল) বাহির হইয়া এই আচারকে তৈলাক্ত করিবে।

 (খ) সুপক্ব পাতিলেবু লইয়া পাথরের পাটায় ঘষ। ঘষিয়া ঘষিয়া লেবুর খোসা অনেকখানি পাৎলা হইয়া গেলে একটি পাথরের চেৎরা খাদায় রাখিয়া উপরে প্রচুর পরিমাণে সুপরিষ্কৃত নুণ ছড়াইয়া দাও। কয়েক দিন রৌদ্র-পক্ব করতঃ হাঁড়িতে ভরিয়া উঠাইয়া রাখ। এই জারক-লেবু বেশ মোলায়েম হয়।

১৯৭। আদার আচার

 আদা ভুনা ভুনা বা চাকা চাকা করিয়া কুট। একটি চেৎরা পাথরের খাদায় রাখিয়া উপরে লেবুর রস ঢালিয়া দাও। ইহাতে আদা অম্লস্বাদ বিশিষ্ট হইবে। অতঃপর যথেষ্ট সুপরিষ্কৃত নুণ, সুপক্ব ‘কাঁচা’ লঙ্কা কুচি ও কিছু কালজিরা উপরে ছড়াইয়া দাও। উত্তমরূপে রৌদ্র-পক্ব কর। একটু তৈল মিশাইতে পার। হাঁড়ি করিয়া উঠাইয়া রাখ।

খ। তৈল-আচার

১৯৮। গোটা আমের আচার

 বেশ ডাগর দেখিয়া কাঁচা আম লও। যে কাঁচা আমের আঁটি দঢ়াইয়াছে অর্থাৎ কুঞার উপরে ছাল গজাইয়া খোল বাঁধিয়াছে অথচ পাকে নাই সেইরূপ কাঁচা আমের দ্বারাই উত্তম আচার হইবে। এতদপেক্ষা কচি আম লইলে তাহার আচার অধিক দিন স্থায়ী হইবে না এবং তাহার স্বাদও কষো হইবে।

 বোঁটার দিকে বাধাইয়া রাখিয়া আমগুলি চিরিয়া দ্বিখণ্ডিত কর। খোলার ভিতর হইতে কুঞা বাহির করিয়া ফেল। খোলা শাঁসের সহিত যাহা সংলগ্ন থাকিবে তাহা এবং চোঁচা ছুলিয়া ফেলিতে হইবে না।

 এক্ষণে একটি বাঁশের সূচল খিল লইয়া আমগুলির গায়ে সর্ব্বত্র বিঁধিয়া বিঁধিয়া দাও। এই সময় উপরে সুপরিষ্কৃত নুণ ছড়াইয়া দিবে। এই প্রক্রিয়াতে নুণ আমের শাঁসের ভিতরে প্রবেশ করিতে পারিবে। অতঃপর আমগুলি একটি চেৎরী পাথরের খাদায় করিয়া রৌদ্রে দাও। দুই এক দিবস রৌদ্র-পক্ব হইয়া আমের জলীয় অংশ কতকটা শুকাইয়া আমগুলি কুঁচকাইয়া গেলে, লইয়া ভিতরে নিম্নলিখিত কাঁচা গোটা মশল্লা আন্দাজ মত পরিমাণে পুর;—নুণ, হলুদ গুঁড়া, কালজিরা, মৌরি, সরিষার গুঁড়া (আধ কচড়া) এবং প্রতি আমে একটি হিসাবে বড় সুপক্ব কাঁচা লঙ্কা। ভিতরে মশল্লা ভরা হইলে আমগুলি বদ্ধ করিয়া এক একটি বাঁশের সরু খিল প্রতি আমের গায়ে এড়োভাবে এপার ওপার করিয়া ফুঁড়িয়া আমগুলি আটকাইয়া দাও। এক্ষণে একটি সুপরিষ্কৃত হাঁড়িতে খাঁটি সরিষার তেল লইয়া ঐ তেলের মধ্যে আমগুলি ডুবাইয়া রৌদ্রে দাও। তেল এতটা লইতে হইবে যাহাতে স্বচ্ছন্দে আমগুলি তাহার মধ্যে ডুবিয়া থাকিতে পারে। উত্তম রূপে কয়েকদিন ধরিয়া রৌদ্র-পক্ব করিয়া সুপরিচ্ছন্ন শুষ্ক ঘরে উঠাইয় রাখ। মধ্যে মধ্যে অবসর মত রৌদ্রে দিবে।

 পটোল, করিলা (উচ্ছে), করলা প্রভৃতির এই প্রকারে বোঁটা ফেলিয়া বোঁটার নিকট বাধাইয়া রাখিয়া দুই ফাঁক করিয়া চিরিয়া ভিতর হইতে বীচি বাহির করিয়া ফেলিয়া গোটা মশল্লা পুরিয়া দিয়া তেলে ডুবাইয়া রৌদ্র-পক্ব করিয়া আচার প্রস্তুত কর। কেবল এগুলি স্বয়ং অম্লস্বাদ বিশিষ্ট নহে বলিয়া গোটা মশল্লার সহিত আমচুর মিশাইয়া ভিতরে পুর দিবে।

১৯৯। কোটা আমের আচার

 ডাগর দেখিয়া কাঁচা আম লইয়া খোসা ছুলিয়া ফেল। খোলার উপর হইতে শাঁসটুকু ফলা ফলা করিয়া কুটিয়া লও। খোলা মায় কুঞা ফেলিয়া দাও। অতঃপর নুণ, হলুদ, কালজিরা, মৌরী, সরিষা এবং কাঁচা লঙ্কা মিশাও। কালজিরা, মৌরী এবং সরিষা আধ কচড়া করিয়া গুঁড়াইয়া লইবে এবং কাঁচা লঙ্কা পিষিয়া লইবে। একটি বড় চেৎরা পাথরের খাদায় করিয়া রৌদ্রে দাও। কিছু শুষ্ক হইলে তেল দিয়া চপ্‌চপে, করিয়া মাখ। বুট ইচ্ছা করিলে মিশাইতেও পার কিন্তু বাদ দিতে পার। পুনঃ রৌদ্র খাওয়াও। বেশ রৌদ্র-পক্ব হইলে সুপরিষ্কৃত হাঁড়িতে ভরিয়া সুপরিচ্ছন্ন শুষ্ক ঘরে উঠাইয়া রাখ।

 আদা, করিলা (উচ্ছে), করলা প্রভৃতিও এইরূপে ফলা ফলা করিয়া কুটিয়া বীচি ফেলিয়া দিয়া আচার প্রস্তুত করিতে পার। কেবল তাহাদের সহিত কিছু আমচুর মিশাইয়া অম্লস্বাদ বিশিষ্ট করিয়া লইবে।

 এই আচার পাক করিয়াও তৈয়ার করা যায়। তেলে শুক্না লঙ্কা, কালজিরা, মেথি ও মৌরী ফোড়ন দিয়া কোটা আম ছাড়। আংসাও। নুণ, হলুদ দিয়া ঢাকিয়া দাও। কাঁচা লঙ্কা (চিরিয়া) ছাড়। আম মোলায়েম হইলে আধ কচড়া সরিষার গুঁড়া দিয়া নাড়িয়া চাড়িয়াই নামাও। এই রাঁধা আঁচারে জলস্পর্শ হয় না বলিয়া অধিক দিন স্থায়ী হইবে তবে তেলে ডুবাইয়া রাখিতে হইবে।

২০০। কোটা আমের আচার—বৈদেশিক)

 কাঁচা কোটা আম ৴১ একসের, নুণ ৴৵৹ দুই ছটাক, হলুদ ৴৹ এক ছটাক, শুক্না লঙ্কা ৴৵৹ দুই ছটাক, আদা ৴৵৹ দুই ছটাক, রশুন ৴৵৹ দুই ছটাক, সরিষার তেল ৴১ এক সের লও। লঙ্কা, আদা ও রশুন সির্কায় (ভিনিগারে) বাটিয়া লও।

 নুণ হলুদ ও বাটা মশলাগুলি দ্বারা আম মাখ। রৌদ্রে দাও। দুই এক দিবস শুকাইয়া তৈল দিয়া চপচপে করিয়া মাখ। পুনঃ রৌদ্রে দাও। উত্তমরূপে রৌদ্র-পক্ব হইলে সুপরিষ্কৃত হাঁড়ি বা কাচের ‘জারে’ করিয়া উঠাইয়া রাখ।

২০১। পেষা আমের আচার—(বৈদেশিক)

 কাঁচা আম ছুলিয়া কুটিয়া শুকাইয়া ৴১ এক সের লও। পাটায় মিহি করিয়া পেষ। তাহার সহিত বীচি ছাড়ান পাকা তেঁতুল ৴৷৷৹ আধ সের, নুণ ৴৵৹ দুই ছটাক, হলুদ গুঁড়া ৴৹ এক ছটাক, শুক্না লঙ্কা ৴৵৹ দুই ছটাক, আদা ৴৵৹ দুই ছটাক, রশুন ৴৵৹ দুই ছটাক এবং চিনি ৴৹ এক ছটাক মিশাও। লঙ্কা, আদা ও রশুন সির্কায় (ভিনিগারে) বাটিয়া লইবে। অতঃপরএক সের সরিষার তেল ঢালিয়া দিয়া সমস্ত উত্তমরূপে চট্‌কাইয়া মাখিবে। একটি পাথরের খাদায় করিয়া রৌদ্রে দাও। উত্তমরূপে রৌদ্র পক্ব হইলে সুপরিস্কৃত হাঁড়ি বা কাচের ‘জারে’ করিয়া উঠাইয়া রাখ।

 তেঁতুল বীচি ছাড়াইয়া অল্প জলে ভিজাইয়া রাখিয়া ঘন গোলা করিয়া কাপড়ে ছাঁকিয়া লইবে। কোটা আমগুলি এক বা দুই দিবস রৌদ্রে শুকাইটায় পিষিয়া লইবে, অর্থাৎ যতটা সম্ভব জলীয় ভাগ কমাইয়া লইয়া পিষিবে। নাটোরের ভূতপূর্ব S. D. O.র পত্নী মিসেস্ মেকাট্রিচের নিকট আমার স্ত্রী ইহা শিখিয়াছিলেন।

 এই আচারকে এঙ্গলো-ইণ্ডিয়গণ ‘কাসুন্দি’ বলিয়া থাকেন, কিন্তু ইহার সহিত কাসুন্দির বিশেষ সম্পর্ক দেখা যায় না; পরন্তু ইহার সহিত সরিষার সংশ্রব না থাকাতে এবং ইহা তেলে ডুবান থাকাতে ইহা সর্ব্বতোভাবে আচার শ্রেণীর অন্তর্গত বটে। সম্ভবতঃ ভুলক্রমে ইহাকে ‘আচার’ না বলিয়া ‘কাসুন্দি’ বলা হইয়া থাকে।

২০২। কাঁটালের আচার

 ডাগর দেখিয়া কাঁচা কাঁটাল লও। খোসা ছুলিয়া ফেলিয়া অপেক্ষাকৃত বড় বড় খণ্ডে কুট। কাঁটাল লম্বালধি ভাবে মাঝখান দিয়া চিরিয়া লইয়া তৎপর ঐ চেরা ‘মুষলার’ সহিত বাধাইয়া রাখিয়া কাঁটাল খগুলি কুটিয়া লইবে। মুষলার সহিত বাধাইয়া না রাখিলে খণ্ডগুলি শেষ পর্যন্ত এড়িয়া আউলিয়া যাইবে।

 এক্ষণে কাঁটাল খণ্ডগুলি মেটে হাঁড়িতে করিয়া তেঁতুল ও বুটের সহিত একত্রে জলে সিদ্ধ কর। সিদ্ধ হইলে একখানা ডালায় সমস্ত ঢালিয়া জল ঝরাইয়া ফেল। জল ঝরিয়া কাঁটাল খণ্ড ও বুটগুলি উত্তমরূপে শুষ্ক হইলে তাহাতে নুণ, হলুদ, কালজিরা, মৌরী, সরিষা এবং শুক্না লঙ্কা মাখ। কালজিরা, মৌরি ও সরিষা আধ কচড়া করিয়া গুড়া করিয়া যাইবে, এবং লঙ্কা বাটিয়া দিবে। তেলে ডুবাও। কয়েক দিবস ধরিয়া রৌদ্র খাওয়াইয়া সুপরিষ্কৃত হাঁড়িতে করিয়া পরিচ্ছন্ন শুষ্ক ঘরে উঠাইয়া রাখ।

২০৩। হরিফলের (নোড়ের) আচার

 ডাগর হরিফল ধুইয়া মুছিয়া একটি চেৎরা পাথরের খাদায় রাখ। উপরে পরিষ্কার নুণ ছড়াইয়া দিয়া রৌদ্রে দাও। শুকাইয়া আসিলে তেলে ডুবাও। পুনঃ রৌদ্র খাওয়াও। হাঁড়ি করিয়া উঠাইয়া রাখ। ইহাতে আর অপর কোনও মশল্লা দিতে হয় না। ডাগর করঞ্জার আচারও এই প্রকারে করিবে। তবে করঞ্জাগুলি বাধাইয়া রাখিয়া চিরিয়া ভিতর হইতে বীচি বাহির করিয়া ফেলিবে।

 আমলকী, জলপাই প্রভৃতি অম্লস্বাদ বিশিষ্ট নাতি বৃহৎ ফলের আচারও এই প্রকারে করিবে, তবে সেগুলির সকল গাত্র একটি সূচল বাঁশের খিলের দ্বারা বিঁধিয়া বিঁধিয়া দিয়া ভিতরে নুণ প্রবেশ করিবার ব্যবস্থা করিবে।

২০৪। লঙ্কার আচার

 (ক) বড় টোপা দেখিয়া সুপক্ব ‘কাঁচা’ লঙ্কা লও। দুই এক দিবস তেলে ডুবাইয়া রাখিয়া একটু নরম করিয়া লও। আবশ্যক বোধ না করিলে তেলে ডুবাইরে না। লম্বালম্বি ভাবে এক পার্শ্বে চিরিয়া ভিতর হইতে ‘শীষ’ (placenta) ও বীচি বাহির করিয়া ফেল। নুণ, হলুদ, কালজিরা, মৌরি, সরিষা, আমচুর একত্রে মিশাইয়া ভিতরে ভরিয়া দাও। কালজিরা, মৌরি ও সরিষা আধ কচড়া করিয়া বাটিয়া লইবে। এক একটি বাঁশের সরু খিল ফুঁডিয়া প্রত্যেক লঙ্কার ফাটাল আটকাইয়া লাও। দুই এক দিবস রৌদ্র খাওয়াইয়া তেলে ডুবাও। পুনঃ রৌদ্র-পক্ব করিয়া উঠাইয়া রাখ।

 (খ) বড় টোপা সুপক্ব ‘কাঁচা’ লঙ্কা লইয়া সাবধানে বোঁটাটি টানিয়া উঠাইয়া ফেল। এমন করিয়া উঠাইবে যাহাতে ভিতর হইতে ‘শীষ’টাও ঐ সঙ্গে উঠিয়া আসে অথচ লঙ্কাটি কোনও স্থানে ফাটিয়া না যায়। প্রয়োজন হইলে লঙ্কা দুই এক দিবস তেলে ডুবাইয়া নরম করিয়া লইতে পার এক্ষণে ঐ ছিদ্র পথে শলা প্রবেশ করিয়া দিয়া ভিতর হইতে বীচিগুলি বাহির করিয়া ফেল। অতঃপর ঐ ছিদ্র পথে উপরি লিখিত মশল্লা বা শুধু ঝাল-আমচুর তেল দিয়া মাখিয়া লইয়া ভরিয়া দিয়া ছিদ্রমুখে পুনঃ বোঁটাটি (শষটুকু ছিঁড়িয়া ফেলিয়া) লাগাইয়া দাও। দুই-এক দিবস রৌদ্র খাওয়াইয়া তেলে ডুবাও। পুনঃ রৌদ্র-পক্ব করিয়া হাঁড়িতে ভরিয়া উঠাইয়া রাখ।

গ। সৈর্ক্ক-আচার (বৈদেশিক)

২০৫। ফলা আমের ভিনিগার চাট্‌নি (কাশ্মীরী)

 কাঁচা-আম ছুলিয়া মিহি ফলা করিয়া কুটিয়া ৴৪ চারি সের, নুণ৴ ৷৹ আধ সের চিনি ৴২ দুই সের, শুক্না লঙ্কা ৴৵১০ আড়াই বা তিন ছটাক, আদা ৴৵৹ তিন ছটাক, রশুন ৴৶৹ দুই ছটাক লও। ইহা ছাড়া কিসমিস ৴১ এক সের, বাদাম (খোলা ছাড়ান) ৴ ৷৹ আধ সের এবং উত্তম ভিনিগার (সির্কা) বড় দুই বা মাঝারী চারি বোতল লও।

 লঙ্কা, আদা রশুন কিছু ভিনিগার যোগে পাটায় পিষিয়া লও বা সূক্ষ্মভাবে কুচাইয়া লও। বাদাম জলে ভিজাইয়া রাখিয়া খোসা ছড়াইয়া কুচাইয়া লও। কিসমিস জলে পরিষ্কার করিয়া ধুইয়া বোঁটা ও বীচি ফেলিয়া লও।

 এক্ষণে একটি এলুমিনিয়ম বা পাথর কলাই করা লোহার হাঁড়িতে ভিনিগার ঢালিয়া তাহাতে আম্রখণ্ডগুলি ছাড়িয়া জ্বাল দিয়া সিদ্ধ কর। আম মোলায়েম হইলে নামাইয়া সমুদায় মশল্লা ও অনুষঙ্গগুলি মিশাও। হাঁড়ি পুনঃ জ্বালে চড়াইয়া নাড়িয়া চাড়িয়া নামাইয়া লও। একটি বড় পাথরের থালায় বা চীনামাটির ‘বোলে’ ঢালিয়া ঠাণ্ডা হইতে দাও। অবশেষে কয়েক দিন রৌদ্র খাওয়াইয়া একটি কাচের ‘জারে’ ভরিয়া মুখ বন্ধ করিয়া উঠাইয়া রাখ। মধ্যে মধ্যে রৌদ্র খাওয়াইবে।

 ডাগর করঞ্জা, সোহারা, খুর্ম্মা, নোড় প্রভৃতির এই প্রকারে কাশ্মারা চাট্‌নি হইতে পারে। মিসেস্ টেম্পল রাইটের Baker and Cook বহির recipe হইতে আমার স্ত্রী ইহা শিখিয়াছিলেন। নামে চাট্‌নি হইলেও ইহা প্রকৃত পক্ষে ‘আচার’ পর্য্যায় ভুক্ত বটে।

২০৬। টোপাকুলের ভিনিগার চাট্‌নি

 পাকা টোপা কুল (বোর) লইয়া বোটা ছাড়াইয়া রৌদ্রে শুকাও। একটি এলুমিনিয়াম বা পাথর কলাই করা লোহার হাঁড়ি করিয়া ভিনিগার জ্বালে উঠাইয়া দাও। লঙ্কা বাটা, আদা বাটা, রশুন বাটা ছাড়। ফুটিলে টোপা কুল বা বোর গুলি ছাড়। নুণ ও চিনি দাও। বোর গুলি ভিনিগার চুবিয়া লইয়া টোপা হইয়া উঠিলে নামাও। কয়েক দিবস রৌদ্র খাওয়াইয়া পরিষ্কৃত কাচের ‘জারে’ করিয়া উঠাইয়া রাখ।

২০৭। টোমেটো সস

 সিন্দুর বর্ণ দেখিয়া উত্তম সুপক্ব টোমেটো লও। দুই কাঁক করিয়া কাটিয়া একটি বড় পাথর কলাই করা ডেক্‌চীতে ফেল। ডেক্‌চী জ্বালে উঠাইয়া ধীরে ধীরে জ্বাল দাও। ঢাকিয়া দাও। তাপে টোমেটোগুলি গলিয়া গিয়া প্রচুর জল বাহির হইবে। সুসিদ্ধ হলে নামাইয়া ন্যাকড়ায় বা অন্যবিধ মিহি ছাকনায় ছাঁকিয়া ‘দর’ টুকু লও। এক্ষণে ৴১ এক সের টোমেটোর দরে (রসে) ৴ ৷৹ এক পোয়া হিসাবে ভিনিগার (সির্কা) মিশাইয়া পুনঃ জ্বালে চড়াও। ফুটিলে নুণ, চিনি, শুক্না লঙ্কা বাটা, আদা বাটা ও রশুন বাটা মিশাও। এই মশল্লাগুলি সেরকড়া ৴৵৹ দুই ছটাক হিসাবে প্রত্যেকটি লইবে। লঙ্কা, আদা ও রশুন পূর্ব্বে ভিনিগার দিয়া বাটিয়া লইলেই ভাল হয়।

 সমস্ত বেশ করিয়া নাড়িয়া চাড়িয়া মিশাও। দর আবশ্যকানুযায়ী ঘন হইলে নামাও। ঠাণ্ডা কর। কয়েকদিন ধরিয়া রৌদ্রে দিয়া রৌদ্রপক্ব করিয়া বোতলে ভরিয়া মুখ বন্ধ করিয়া উঠাইয়া রাখ।

২৮। পিক্‌ল্

 (ক) ফুলকোবি, কলাইশুটি, পেঁয়াজ, শিম, কচি শশা প্রভৃতি নাতি বৃহৎ খণ্ডে কুটিয়া নুণ মাখ। দুই এক দিবস রৌদ্রে শুকাইয়া লইয়া ভিনিগারে ডুবাও। গোটা কাঁচা লঙ্কা, আদাচাকা ও রশুন মিশাও। পরিষ্কৃত কাচের ‘জারে’ ভরিয়া কয়েক দিবস ধরিয়া রৌদ্র খাওয়াইয়া রৌদ্রপক্ব কর।

 (খ) কাঁচা বাটা বা ভাজা গুঁড়া ঝাল, নুণ, হলুদ, আদা বাটা এবং রশুন বাটা ভিনিগারের সহিত মিশাইয়া তাহাতে ফুলকোবি প্রভৃতি ডুবাইয়া রৌদ্র-পক্ব করিয়া লইলে ঝাল-পিক্‌ল্ প্রস্তুত হইবে।

ঘ। কাসুন্দি

 ঝাল, নুণ ও অম্ল (এবং মধুর) স্বাদ বিশিষ্ট সরিষার গুঁড়াকে কাসুন্দি কহে।

 সুতরাং সরিষার গুঁড়াই কাসুন্দির বিশেষত্ব। আচারেও সরিষার গুঁড়া ব্যবহৃত হয় কিন্তু সে গৌণভাবে। কাসুন্দিতে সরিষা গুঁড়ার সহিত ভাজা ‘ঝালের’ বা ‘সজের’ গুঁড়া প্রযুক্ত হয়, কিন্তু আচারে ঝালের গুঁড়ার বদলে কালজিরা এবং মৌরিই ব্যবহার্য্য এবং ক্ষেত্র বিশেষে তৎসহ আদা (এবং রশুন)ও মিশান হইয়া থাকে। আচারে কাঁচা লঙ্কা ব্যবহার্য্য, কাসুন্দিতে আদৌ তাহা হয় না,—(ভাজা) শুক্না লঙ্কাই ব্যবহার হইয়া থাকে। তৈলাদি পচন নিবারক পদার্থে ডুবাইয়া আচার রক্ষিত হয়, কাসুন্দির পচন নিবারক প্রণালী স্বতন্ত্র। কাসুন্দিতে জল উত্তমরূপে ফুটাইয়া জীবানু-শূন্য (Sterilized) করিয়া লইয়া তাহাতে সরিষার ও ‘বার-সজের’ গুঁড়া গুলি লওয়া হয়। তবে অবশ্য অনেক কাসুন্দি তৈলেই সংরক্ষিত হইয়া থাকে এবং প্রধান বা আম-কাসুন্দিও যখন পুরাতন হইতে থাকে তখন তাহাতে তৈল ঢালিয়া পচন হইতে রক্ষা করা হইয়া থাকে। তেঁতুল-কাসুন্দি ও মান-কাসুন্দিকে আবার তেঁতুল বা মানের আচারও বলা হইয়া থাকে। ফলতঃ এই সকল পার্থক্য ও সাদৃশ্য পর্যালোচনা করিলে কাসুন্দিকে ঝাল-আচার বলা যাইতে পারে।

২০৯। আম-কাসুন্দি

 গ্রীষ্মারম্ভে আম যখন কচি অবস্থায় থাকে শুভদিন দেখিয়া (শুক্লপক্ষে) তখন এই কাসুন্দি উঠান হইয়া থাকে। আমাদের বাটীতে বৈশাখমাসে অক্ষর তৃতীয়ার দিবস কাসুন্দি ‘উঠান’ আরম্ভ হইয়া থাকে। সকল গৃহে কাসুন্দি উঠান হয় না, যাহার গৃহে কাসুন্দি উঠান প্রথা আছে কেবল তাহার গৃহেই উঠান হইয়া থাকে। আবার কোন কোন গৃহে ইহা আংশিক ভাবে উঠান হইয়া থাকে। বিশেষ সুচীতা সহকারে ইহা অনুষ্ঠেয়। ইহার উপাদান ও পানি বিশেষভাবে নির্ম্মল হওয়া আবশ্যক এবং যে ঘরে ইহা রক্ষিত হইবে তাহাও বিশেষভাবে পরিচ্ছন্ন ও শুষ্ক হওয়া আবশ্যক। এরূপ পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ব্যবস্থা না করিলে কাসুন্দি অচিরাৎ পচিয়া নষ্ট হইয়া যায়।

 বৈশাখ মাসে অক্ষয় তৃতীয়ার দিবসে আমাদের বাড়ীতে কাসুন্দি যে নিয়মে ‘উঠানের’ প্রথা আছে নিম্নে তাহা বিবৃত হইল।

 যতদূর সম্ভব উৎকৃষ্ট ও টাট্‌কা সরিষা (৷৹ দশ সের পরিমিত) সংগ্রহ করিয়া ঝাড়িয়া বাছিয়া লও। অতঃপর স্নানান্তে নূতন পরিষ্কৃত বস্ত্র পরিয়া সুচী হইয়া নূতন ধামায় বা ডালায় করিয়া ঐ সরিষা লইয় পুকুরে যাইয়া জলে ধোও। ধামায় পাঁচটা সিন্দুর ফোটা দিবে এবং নয় গাছি দুর্ব্বা, নয়টি ধান্য, পাঁচখানা শুক্না হলুদ ও পাঁচটি সপল্লব কাঁচা আম ধামায় দিবে। পরিষ্কৃত খোলা গোময়লিপ্ত বা ষাণ-বাঁধান জমীতে বা পরিষ্কৃত পাটী বিছাইয়া তদুপরি ঐ ধৌত সরিষা ‘নাড়িয়া’ শুকাইতে দাও। এদিকে একটা নুতন বড় হাঁড়িতে করিয়া পরিষ্কার জল আধ মণ জ্বালে উঠাও। বহুক্ষণ ধরিয়া এই জল সিদ্ধ কর। যখন জল ‘মরিয়া’ অর্দ্ধেক মাত্র অবশিষ্ট থাকিবে তখন জল ঠিক হইয়াছে অর্থাৎ সম্পূর্ণরূপে জীবানু বর্জ্জিত হইয়াছে বুঝিতে হইবে। এই জল সিদ্ধ করা ব্যাপারটি এই নিমিত্ত সময় ও ব্যয় সাধ্য হইলেও অত্যাবশ্যক। এই জল সিদ্ধ প্রক্রিয়াকে ‘মৌ-জ্বাল’ দেওয়া কহে। আধমণ জল সিদ্ধ করিয়া যে ৷৹ দশ সের জল অবশিষ্ট থাকিবে তাহা পাঁচটা নূতন হাঁড়িতে সমপরিমাণে বিভাগ করিয়া রাখ।

 ওদিকে ধৌত সরিষা সম্পূর্ণ শুষ্ক হইলে ঐ পাঁচখানা শুক্না হলুদ সমেত ঢেঁকিতে কুট। বলা বাহুল্য ঢেঁকির মুষল ও গড় সুপরিচ্ছন্ন হওয়া আবশ্যক। সরিষা কুটিবার প্রারম্ভে পাঁচটি সিন্দুর ফোঁটা দিয়া টেকিকে বরণ করা হইয়া থাকে এবং সরিষা কুটিবার সময় ঘন ঘন উলু-জোকার দেওয়া হইয়া থাকে। সরিষা ধোবার সময়ও উলু-জোকার দেওয়া হইয়া থাকে। ইহা সেওয়ায় সরিষা কুটিবার সময় কাসুন্দি যাহাতে দীর্ঘকাল স্থায়ী হয় তাহা কামনা করিয়া বিবিধ ছন্দে স্তুতী-মন্ত্র পাঠ করা হইয়া থাকে।

 সরিষা কুটা শেষ হইলে তাহা সুপরিচ্ছন্ন চালুনীতে (আটা-চালায়) ছাঁকিয়া লও। ‘ফাকী’ যাহা বাহির হইবে তাহা লইয়া ঐ পাচ হাঁড়িতে বিভক্ত সিদ্ধ জলে ক্রমে ঢাল এবং বাঁশের ‘তলাশীর’ (বাতা) দ্বারা নাড়িয়া নাড়িয়া মিশাও। এইরূপে জমে সমস্ত সরিষা গুঁড়ার ‘ফাকী’টুকু ঐ জলের সহিত মিশাও। সরিষা গুঁড়া মিশান পর জল ঠাণ্ডা হইলে হাঁড়ীর মুখে সরা চাপা দিবে।

 এই সরিষা গোলা যেন বিশেষ গাঢ় না হয়—তলাশীর গায়ে জড়াইয়া যায় এমত তরল মত থাকে, অথচ ‘জলো’ গোছও না হয়। আন্দাজ মত নুণ ও এক পোয়া টেক হলুদ গুঁড়া মিশাও।

 অতঃপর সরিষা গোলাকে সরিষা গুঁড়ার ‘মলিখা’ ও উক্ত কাঁচা আমের কিঞ্চিৎ অংশ দ্বারা ‘সাধ দিয়া’ তাহাতে নিম্নলিখিত ভাজা ঝালের গুঁড়া মিশাও। এই ‘ঝাল’ অথবা যাহাকে কাসুন্দি উঠানের পরিভাষায় ‘বার-সজ’ কহে তাহা লইয়া কাট-খোলায় ভাজ। ঢেঁকিতে কুটিয়া গুঁড়া কর। চালুনীতে ছাক। ফাকী যাহা বাহির হইবে লইয়া সরিষা গোলার সহিত মিশাও। মিশ্রন কালে ‘তলাশী’ দ্বারা নাড়িয়া নাড়িয়া উত্তমরূপে মিশাইবে। ঝালের আন্দাজ কাসুন্দি চাখিয়া স্থির করিবে।

 অতঃপর পূর্বোক্ত পাঁচটি কাঁচা আমের সহিত আরও কিছু কাঁচা আম ছুলিয়া কাটিয়া কুঞা ফেলিয়া লও। ঢেঁকিতে অল্প কুটিয়া থেঁৎলাইয়া কাসুন্দিতে মিশাও। এরূপ আন্দাজে আম মিশাইবে যাহাতে কাসুন্দির স্বাদ ঈষদম্ল হয়।

 এইবারে আম বা ঝাল-কাসুন্দি প্রস্তুত সমাধা হইল। এক্ষণে এই কাসুন্দি কয়েক দিবস ধরিয়া রৌদ্র-পক্ব করিয়া খাও। বিশেষ সুচীতা সহকারে পরিচ্ছন্ন শুষ্ক ঘরে কাসুন্দি উঠাইয়া রাখিবে, তবেই অনেকদিন অবিকৃত থাকিবে। কমে পুরাতন হইয়া যখন কাসুন্দিতে ‘ছাতা’ পড়িবার উপক্রম হইবে, তখন সরিষার তৈল মিশাইয়া পচন হইতে রক্ষা করিবে।

 বারসজের গুঁড়া—বরেন্দ্র ধনিয়াকে সাধারণতঃ ‘সজ’ বলিয়া থাকে। এই হেতু ধনিয়াদি অপরাপর সমধর্ম্মাপন্ন মশল্লাকেও কাসুন্দি উঠানের পরিভাষাতে ‘সজ’ বলা হয়। এই সজের সংখ্যা যে ঠিক বার তাহা নহে। ব্যক্তিগত রুচি এবং স্থলগত সুলভতা অনুসারে সজের সংখ্যা কমি বেশী হইয়া থাকে। আমাদের বাটীতে যে যে মশল্লায় বার-সজ পূরণ কর হয় তাহা এই:—(১) ধনিয়া ৴ ৷৹ এক পোয়া, (২) জিয়া ৴ ৷৹ এক পোয়া, (৩) গোলমরিচ ৴ ৷৹ এক পোয়া, (৪) পিপুল ১ তোলা, ৫) শুক্নালঙ্কা ৴১ এক সের, (৬) তেজপাত ৴৵৹ আধ পোয়া, (৭) রাঁধনী ৴৹ এক ছটাক, (৮) শলুপ শাকের বীজ ৴৵৹ আধ পোয়া, (৯) মৌরী ৴ ৷৹ এক পোয়া, (১০) কালজিরা ১ তোলা, (১১) মেথি ১ তোলা, (১২) জবাইন ৴৹ এক ছটাক, (১৩) বড় এলাচী ৴৹ এক ছটাক, (১৪) গুজরতী বা ছোট এলাচী ৴৹ এক ছটাক, (১৫) লবঙ্গ আধ ছটাক (১৬) দারুচিনি ৴ এক ছটাক, (১৭) জৈত্রী আধ তোলা এবং (১৮)জায়ফল ২টি হিসাবে ৷৹ দশ সের সরিষার গুঁড়ায় লওয়া হয়।

 এই সমস্ত মশল্লা লিখিত হিসাবে লইয়া ঝাড়িয়া বাছিয়া কাট-খোলায় ভাজ। ঢেঁকিতে মিহি করিয়া কুট। চালনীতে (আটা চালায়) চালিয়া ফাকী টুকু লও। চালুনীতে একবার চালিয়া লইলে ফাকী সম্পূর্ণ বাহির হয় না বলিয়া চালুনীতে অবশিষ্ট ‘মলিখা’ টুকু লইয়া পুনঃ ঢেঁকিতে কুটিয়া পুনঃ চালিয়া লইতে হয়। তথাপি শেষ পর্যন্ত কিছু ‘মলিখা’ অবশিষ্ট থাকিয়া যায়। সজের গুঁড়ার এই অবশিষ্ট মলিখার সহিত সরিষার গুঁড়ার অবশিষ্ট মলিখা মিশাইয়া ‘ফুল-কাসুন্দি’ প্রস্তুত করা হয়।

 ‘সজের’ গুঁড়ার সহিত ‘ঝালের’ গুঁড়ার পার্থক্য—ঝালের গুঁড়ায় গোল এ-মরিচ অথবা একত্রে জিরা-মরিচকে খ্যতঃ ‘ঝাল’ কহে এবং ধনিয়া আদি তৎসহ গৌণ ভাবে মিশান হইয়া থাকে। সজের বা বার-সজের গুঁড়ায় ধনিয়াদিকে মুখ্য স্থান অধিকার করাইয়া জিরা-মরিচকে নিম্নস্থান বা তদন্তর্গত করিয়া দেওয়া হইয়া থাকে। আম-কাসুন্দি প্রস্তুতের সময় ছাড়া সাধারণতঃ বার-সজের গুঁড়া প্রস্তুত না করিয়া সংক্ষেপে তদর্দ্ধেক পরিমিত ‘সজের’ বা ‘ঝালের’ গুঁড়ার দ্বারাই অপরাপর কাসুন্দি প্রস্তুত সম্পন্ন করা হয়। যথা-(১) লঙ্কা, (২) জিরা, (৩) মরিচ, (৪) তেজপাত, ৫) ধনিয়া, (৬) কালজিরা, (৭) লবঙ্গ। ইহাদের পরিমাণ উপরোক্ত বার সজের মশলার হিসাবের অনুপাতে লইবে।

২১০। ফুল-কাসুন্দি

 আমকাসুন্দি প্রস্তুতের সময় কুটা সরিষা, এবং ভাজা বার-সজের গুঁড়ার অবশিষ্ট ‘মলিখা’ এবং তৎসহ নুণ ও হলুদ মিশাইয়া লইলেই ‘ফুল কাসুন্দি’ প্রস্তুত হইবে। ইহাকে অনুস্বাদ বিশিষ্ট করিতে ইচ্ছা হইলে এতৎসহ আরও আমচুর মিশাইবে।

 এই ‘ফুল-কাসুন্দি’ ফোড়ন দিয়া পবদা মাছের ‘কাসুন্দ-পোড়া’ ঝোল অতি উপদেয় হয়। মোটা মাছের শুকতেও ইহা ফোড়ন দেওয়া হইয়া থাকে।

২১১। তেঁতুল-কাসুন্দি

 তেঁতুল জলে গুলিয়া ছাঁকিয়া লও। নুণ ও হলুদ মিশাইয়া রৌদ্রে দাও। গোলা বেশ ঘন হইয়া আসিলে সরিষার গুঁড়া ও ভাজা বার-সজের বা সংক্ষেপে সজের বা ঝালের গুঁড়া মিশাও। তেঁতুল অধিক অম্ল বিধায় একটু চিনি বা গুড় মিশাও। উত্তমরূপে চট্‌কাইয়া মাখ। অতঃপর পচন নিবারণ জন্য কিছু তেল মিশাও। কয়েক দিবস রৌদ্র খাওয়াইয়া হাঁড়িতে করিয়া উঠাইয়া রাখ। এই এবং পরবর্ত্তী কাসুন্দি তাদৃশ সুচীতা সহকারে প্রস্তুত হয় না সুতরাং ইহার সহিত তৈল না মিশাইলে ইহা শীঘ্র পচিয়া নষ্ট হইয়া যাইবে।

২১২। ছড়া-তেঁতুলের ঝাল-আচার

 সুপক্ব ছড়া-তেঁতুল লইয়া উপরের খোলা ছাড়াইয়া ফেল। সাবধান যেন ভিতরের শাঁস আস্ত থাকে। নুণ ও ভাজা ঝালের গুঁড়া, (সরিষার গুঁড়া) ও অল্প তৈলে মাখিয়া উহা তেঁতুলছড়ার গায়ে লাগাইয়া দিয়া তেঁতুল রোদে দাও। তৈলাদি তেঁতুলের গায়ে বসিয়া গেলে পুনঃ ঐ মশল্লা মিশ্রিত তৈল মাখ। পুনঃ রোদে দাও। অবশেষে উত্তমরূপে রৌদ্র-পক্ব হইয়া যখন তেঁতুল আর তৈল টানিবে না বুঝিবে তখন হাঁড়ি করিয়া উঠাইয়া রাখ।

২১৩। মান-কাসুন্দি।

 মানের তলার দিকটা বাদ দিয়া গোড়ার দিকটা লইয়া ফালি ফালি করিয়া কুট। রৌদ্রে শুকাও। উত্তমরূপে শুকাইলে ঢেঁকিতে কুটিয়া লও। তেঁতুল গোলার সহিত মাখ। নুণ, হলুদ, সরিষার গুঁড়া, ভাজা বারসজের বা সংক্ষেপে সজের বা ঝালের গুঁড়া এবং গুড় বা চিনি মিশাও। চট্‌কাইয়া মাখ। তৈল মিশাও। কয়েক দিবস রৌদ্র খাওয়াইয়া রৌদ্র-পক্ব করিয়া হাঁড়ি করিয়া উঠাইয়া রাখ। ইহাকে কেহ কেহ মানের আচারও বলেন। আচার ও কাসুন্দি এখানে যেন পরস্পর এক হইয়া গিয়াছে। প্রকৃতপক্ষে ‘কাসুন্দিকে’ ‘ঝাল-আচার’ বলা যাইতে পারে।

২১৪। বোর বা টোপা কুল-কাসুন্দি।

 সুপক্ব বোর (টোপা কুল) লইয়া ধুইয়া পরিষ্কার করিয়া চট্‌কাও। নেকড়ায় ছাঁকিয়া শাঁসটুকু লও। নুণ হলুদ মাখিয়া এক দিবস রৌদ্রে শুকাইয়া লও। সরিষার গুঁড়া, ভাজা বার-সজের বা সংক্ষেপে সজের বা ঝালের গুঁড়া এবং গুড় বা চিনি মিশাও। উত্তমরূপে মাখ। তৈল মিশাও। কয়েক দিন ধরিয়া রৌদ্র খাওয়াইয়া রৌদ্র-পক্ব করিয়া হাঁড়ি করিয়া উঠাইয়া রাখ।

সমাপ্ত