বরেন্দ্র রন্ধন/ত্রয়োদশ অধ্যায়
ত্রয়োদশ অধ্যায়।।
চাট্নি
চাট্নি প্রধানতঃ দুই প্রকারর (ক) অম্লস্বাদ বর্জ্জিত এবং (খ) অম্লস্বাদ বিশিষ্ট। শেষোক্ত চাট্নি আবার প্রধানতঃ দুই প্রকার, (১) ‘সাদাসিধা এবং (২) ‘ঝাল’। অম্লস্বাদ বর্জ্জিত চাট্নিকে “মরিচ-বাটা’ বলে এবং অম্ল“স্বাদবিশিষ্ট চাট্নিকে শুধু ‘চাট্নি’ বলে।
ক। মরিচ-বাটা
আম বা অগ্নি-পক্ব কন্দ-মূল-ফলাদি বাটিয়া (পিষিয়া) তৎসহ নুণ, কাঁচা লঙ্কা বাটা, গন্ধদ্রব্য (যদ্যপি উহা স্বয়ং বাসযুক্ত না হয়), সরিষা বাটা এবং তৈল মিশাইয়া লইলে এই চাট্নি প্রস্তুত হইল।
পূর্ব্ববঙ্গে এই চাট্নির বিশেষ প্রচলন এবং তথাতে ইহাকে ‘মরিচ-বাটা’ বলিয়া থাকে। ইহা ভাতের সহিত মাখিয়া খাইতে হয়। কোন কোন মরিচ-বাটা ঠিক চড়চড়ীর ন্যায়ই পাক করিয়া প্রস্তুত করিতে হয়। আবার কোনও মরিচ-বাটা কেবল মশল্লাদি উপকরণেই প্রস্তুত হইয়া থাকে। অনেক ক্ষেত্রে নারিকেল কুড়িয়া বাটিয়া লইয়া মরিচ-বাটার সহিত মিশান হইয়া থাকে।
১৬৫। মানের মরিচ-বাটা
কাঁচা মান বিশেষতঃ ‘গিরি-মানের’ ডাঁটার নীচের দিক হইতে আঙ্গুল চারেক মত লইয়া ছুলিয়া লইয়া পাটায় মিহি করিয়া বাট। মানের তলার দিকটা লইলে মুখ ধরিরে সুতরাং তাহা বাদ দিবে। ঝুনা-নারিকেল কুড়িয়া বাটিয়া লও। মান বাটা ও নারিকেল বাটা সম পরিমাণ একত্রে মিশাও। নুণ, একটু চিনি, কাঁচা লঙ্কা বাটা ও সরিষা বাটা মিশাও। সমস্তটা তেল দিয়া চপ্চপে করিয়া মাখিয়া লও।
১৬৬। মিঠা কুমড়ার বীচির শাঁসের মরিচ-বাটা
মিঠা বা বিলাতী কুমড়ার বীচি খুঁটিয়া শাঁস বাহির করিয়া লও। পাটায় বাট। ঝুনা নারিকেল কুড়িয়া বাট। উভয় সমপরিমাণে লইয়া একত্রে মিশাও। নুণ, একটু চিনি, কাঁচা লঙ্কা বাটা, সরিষা বাটা মিশাও। সমস্তটা তেল দিয়া মাখিয়া লও।
‘গাঙ্গ-মথুরা’ বা ‘দস্তাল’ কচুর পাতা বাটিয়া লইয়া তাহার সহিত নারিকেলকুড়া বাটা মিশাইয়া এই প্রকারে মরিচ-বাটা প্রস্তুত কর।
১৬৭। খারকোল বা খান-কচু পাতার মরিচ বাটা
‘খারকোল’ বা ‘খান’ কচুর পাতা পাটা বাটিয়া লও। ধনিয়া পাতা বা পার্শ্লীশাকের পাতা বাটিয়া ইহার সহিত মিশাও। উত্তপ্ত তেলে কালজিরা ফোড়ন দিয়া এই মিশ্রিত পাতা বাটা ছাড়। আংসাও। নুণ, কাঁচা লঙ্কা বাটা ও সরিষা বাটা মিশাও। নাড়িয়া চাড়িয়া নামাও।
ফুল কোবির পাতা, ‘খামা’ কচুর ডাগুর (ডেগো) প্রভৃতিরও এই প্রকারে মরিচ-বাটা প্রস্তুত করিবে।
১৬৮। ধনিয়া পাতার মরিচ-বাটা
শুধু ধনিয়া পাতা বা পার্শ্লীপাতা লইয়া পাটায় বাট। নুণ, কাঁচা লঙ্কা বাটা ও সরিষা বাটা মিশাও। উপরে সরিষার তেল ঢালিয়া দিয়া চপচপে করিয়া মাখ।
১৬৯। শুক্না লঙ্কার মরিচ-বাটা
শুক্না লঙ্কা কাট-খোলায় ভাজিয়া বা পোড়াইয়া গুঁড়া করিয়া লও। কালজিরা আধ কচড়া করিয়া বাটিয়া তৎসহ মিশাও। নুণ মিশাও। উপরে সরিষার তেল ঢালিয়া দিয়া চপচপে করিয়া মাখ।
খ (১)—সাদাসিধা চাট্নি
আম বা অগ্নি-পক্ব কন্দ-মূল-ফলাদি বা আমিষাদি বাটিয়া বা খণ্ড খণ্ড করিয়া তৎসহ নুণ, চিনি, কাঁচা লঙ্কা বাটা, অম্লরস (যদ্যপি ঐ কন্দ-মূলাদি স্বয়ং অম্ল-স্বাদযুক্ত না হয়), তৈল এবং গন্ধক (যদি ঐ কন্দ-মূলাদি স্বয়ং বাসযুক্ত না হয়) মিশাইয়া লইলেই সাদাসিধা অম্ল-চাট্নি প্রস্তুত হইবে।
সাধারণতঃ তেঁতুল গোলা, আমচুনা বাটা, লেবুর রস, দহি এবং সির্কা (ভিনিগার) মিশাইয়া চাট্নি অম্ল স্বাদ বিশিষ্ট করা হয়। এবং উগ্র অথচ প্রসাদ গুণ বিশিষ্ট পত্র যথা, পুদিনা পাতা, ধনিয়া পাতা, পার্শ্লী শাকের পাতা এবং শলুপ শাকের পাতা প্রভৃতি এবং কন্দ যথা, পেঁয়াজ, আদা প্রভৃতি যোগে এই চাটনি অনুবাসিত করা হয়। কদাচিৎ ইহাতে সরিষা বাটাও মিশান হইয়া থাকে। কিন্তু কদাপি ইহাতে ‘ঝাল’ বা ‘সজের গুঁড়া’ মিশান হয় না। বৈদেশিক ‘সালাদ’ এই প্রকারে প্রস্তুত করা যাইতে পারে। এই চাট্নির সহিত অনেক সময় নারিকেল-কুড়া বাটা মিশান হইয়া থাকে।
১৭০। আমের মোল-জল
সদ্য প্রস্ফুটিত আমের মুকুলের দ্বারাই চাট্নি প্রভৃতি প্রস্তুত হইয়া থাকে, পুরাতন মুকুলে, বিশেষতঃ আমের গুটী বাঁধিলে, চাট্নি প্রভৃতি প্রস্তুত সুবিধা জনক হয় না।
পাকা তেঁতুল পাৎলা করিয়া জলে গুলিয়া ছাঁকিয়া লও। নুণ, চিনি, কাঁচা লঙ্কা বাটা ও কিঞ্চিৎ তেল তৎসহ মিশাও। অতঃপর আমের মুকুল মিশাইয়া মুকুলগুলি ধীরে ধীরে হাতে কচলাইয়া উহার সুবাস চাট্নিতে সংক্রমিত কর। অমনি অথবা নেক্ড়ায় ছাঁকিয়া লইয়া খাও। ইহা জলের ন্যায় তরল হইবে। গ্রীষ্মে ইহা সুন্দর তৃষ্ণা নিবারক পানীয়।
১৭১। কাঁচা আম পোড়ার চাট্নি
কাঁচা আম উনানে ছাইয়ের উপর ফেলিয়া পোড়াইয়া বা জলে সিদ্ধ করিয়া লও। উপর হইতে পোড়া খোসা ফেলিয়া দিয়া আঁটির উপর হইতে নরম শাঁসটুকু উঠাইয়া লইয়া চটকাইয়া লও। নুণ, চিনি, কাঁচা লঙ্কা বাটা মিশাও। কিছু তেল ঢালিয়া দিয়া সমস্ত উত্তমরূপে মাখ। ন্যাকড়ায় ছাঁকিয়া লও।
কাঁচা তেঁতুলের এই প্রকারে চাট্নি করিবে।
১৭২। আম-চুনার চাট্নি
কাঁচা অথচ ডাগর আমের খোসা ছাড়াইয়া খণ্ড খণ্ড করিয়া কুটিয়া রোদে উত্তমরূপে শুকাইয়া লইলে ‘আমচুনা’ বা ‘আমসী’ প্রস্তুত হইবে।
আমসী জলে ভিজাইয়া রাখ। নরম হইলে পাটায় বাটিয়া লও। নুণ, চিনি, কাঁচা লঙ্কা বাটা, ধনিয়া পাতা, পুদিনা পাতা বা পার্শ্লী পাতা বাটা এবং তৈল মিশাও। আমসীর সহিত নারিকেল বাটা মিশাইলে স্বাদ আরও উত্তম হইবে।
১৭৩। পাকা তেঁতুলের চাট্নি
পাকা তেঁতুল জলে ভিজাইয়া রাখিয়া গোলা প্রস্তুত কর। বীচি ও সিটাদি উঠাইয়া ফেলিয়া দাও। নুণ, চিনি, কাঁচা লঙ্কা বাটা, ধনিয়া পাতা, পুদিনা পাতা বা পার্শ্লী পাতা বাটা অথবা আমাদা বা পেঁয়াজ বা সামান্য রশুন বাটা এবং তেল মিশাও। নেকড়ায় ছাঁকিয়া লও।
১৭৪। কামরাঙ্গার চাট্নি
পাকা কামরাঙ্গা নুণ, চিনি, কাঁচা লঙ্কা এবং কিঞ্চিৎ হিঙ্গের সহিত একত্রে বা পৃথক ভাবে বাটিয়া মিশাইয়া লও। একটু তেল মিশাও।
ডাগর করঞ্জা, কাঁচা আম, চুকা-পালঙ্গ শাক, আনারস প্রভৃতি এবং মূলা, আদা, আনাজি কলা, মান প্রভৃতি কাটিয়া লইয়া তদ্দ্বারা এই প্রকারে চাটনি প্রস্তুত কর। মূলা পাটায় বাটিবার পরিবর্ত্তে ‘বিড়ালীর’ সাহায্যে কুড়িয়া লইলে সুবিধা হয়। মূলাদির সহিত আমচুর মিশাইয়া অম্ল-স্বাদ করিবে।
১৭৫। বাতাবী লেবুর চাট্নি
উত্তম পাকা বাতাবী লেবু ছুলিয়া কোয়া হইতে শাঁস বাহির করিয়া লও। নুণ, চিনি, কাঁচালঙ্কা বাটা (বা মিহি কুচি) ও তেল মিশাইয় মাখিয়া লও।
বাতাবী লেবু আলগোছে ছাড়াইবে ও আলগোছে মাখিবে নচেৎ তিত স্বাদ বিশিষ্ট হইবে।
ইহার বৈদেশিক ‘সালাদ’ প্রস্তুত করিতে হইলে কাঁচালঙ্কার পরিবর্তে গোল-মরিচের গুঁড়া দিবে এবং সরিষার তেলের পরিবর্ত্তে সালাদ অয়েল দিবে।
১৭৬। ক’থবেলের চাট্নি
পাকা ক’থ বেল ভাঙ্গিয়া ভিতরের শাঁস বাহির করিয়া লও। নুণ, চিনি, কাঁচালঙ্কা বাটা দিয়া চটকাইয়া মাখ। নেকড়ায় ছাঁকিয়া লও। একটু সরিষার তেল মিশাও। চিনি একটু অধিক পরিমাণে দিবে। কেহ কেহ ছাঁকিয়াই এই চাটনি খাওয়া পছন্দ করেন। এই চাটনি তিন চারি দিবস অবিকৃত অবস্থায় থাকে।
পাকা ব’রের দরের এই প্রকারে চাট্নি প্রস্তুত হইতে পারে।
১৭৭। শশার চাট্নি
শশার খোসা ছুলিয়া চাকা চাকা বা কুচি কুচি করিয়া কুট। নুণ, কাঁচা লঙ্কা কুচি, কিঞ্চিৎ তৈল ও কিঞ্চিৎ লেবুর রস চিপিয়া দিয়া মাখ।
শশার ইংরাজী ‘সালাদ’ প্রস্তুত করিতে কাঁচা লঙ্কার পরিবর্ত্তে গোল মরিচের গুঁড়া, তেলের বদলে সুইট অয়েল এবং লেবুর রসের পরিবর্ত্তে অল্প ভিনিগার দেয়। শশা চাকার সহিত অনেক সময়ে পাকা টোমেটো চাকা, সিদ্ধ গোল আলু চাকা ও শক্ত সিদ্ধ পক্ষীডিম্ব চাকা ও পেঁয়াজ চাকা মিশাইয়াও চাটনি বা সালাদ প্রস্তুত করা হইয়া থাকে।
১৭৮। টোমেটোর চাট্নি
টোমেটো চাকা চাকা বা কুচি কুচি করিয়া কুট। একখানা পাথর বা চীনা মাটির রেকাবের উপর রাখিয়া রেকাবের একধার উচা করিয়া ধরিয়া টোমেটোর অতিরিক্ত রস ঝরাইয়া ফেল। নুণ, একটু চিনি, কাঁচালঙ্কা কুচি (মিহি), পেঁয়াজ বাটা (বা মিহি কুচি,) লেবুর রস ও একটু তেল মিশাও। মাখিয়া লও।
১৭৯। দস্তাল কচুর ডাগুরের চাট্নি
‘দস্তাল’ কচুর পাতা ও ডাগুর কুচি কুচি করিয়া কাট। তেঁতুল গোলা, আকের গুঁড়, পুদিনা পাতা কুচি, কাঁচা লঙ্কা কুচি বা বাটা, একটু নুণ ও একটু তৈল দিয়া মাখ।
৮০। নারিকেলের চাট্নি
ঝুনা নারিকেল কুড়িয়া পাটায় পুনঃ মিহি করিয়া বাটিয়া লও। নুণ, চিনি, কাঁচালঙ্কা বাটা, লেবুর রস এবং ধনিয়া পাতা, পুদিনা পাতা বা পার্শ্লী পাতা বাটা মিশাও। মাখিয়া লও। সরিষা বাটাও মিশাইতে পার।
নারিকেল কুড়া বাটিলেই তাহা হইতে যথেষ্ট তেল বাহির হইবে সুতরাং আর সরিষার তেল মিশাইবার প্রয়োজন হইবে না।
১৮১। আলুর চাট্নি বা সালাদ (বৈদেশিক)
আলু সিদ্ধ করিয়া খোসা ছুলিয়া পুরু চাকা চাকা করিয়া কুট। নুণ একটু চিনি, রাইসরিষার গুঁড়া, গোলমরিচের গুঁড়া একত্রে মিশাও। কিছু সুইট অয়েল ঢালিয়া দিয়া সমস্ত বেশ করিয়া মিশাও। একটু ভিনিগার (সির্কা) ঢালিয়া দাও। উত্তমরূপে ফেটাও। সমস্তটা বেশ মিশিয়া গেলে সিদ্ধ আলুর উপর ঢালিয়া দাও। আলগোছে ঝাঁকাইয়া আলুর সহিত মাখিয়া লও। আলগোছে ঝাঁকাইয়া না মাখিলে সিদ্ধ আলু ভাঙ্গিয়া যাইবে।
সুইট অয়েল ও সির্কার পরিবর্ত্তে সরিষার তেল ও লেবুর রসের _রাও কাজ চলিতে পারে।
সিদ্ধ ফুলকোবি, সিদ্ধ বিট, কাঁচা শশা, সিদ্ধ মটর শুঁটি প্রভৃতিরও এই প্রকারে চাট্নি প্রস্তুত হইতে পারে।
১৮২। লেটুস সালাদ (বৈদেশিক)
‘লেটুস’ কোবির পাতা (টাট্কা ও কোমল দেখিয়া পাতা বাছিয়া লইবে) টুকরা টুকরা করিয়া কাট বা ছেঁড়। নুণ, একটু চিনি, রাইসরিষার গুঁড়া, গোলমরিচের গুঁড়া একত্রে মিশাও। কিছু সুইট বা সালাদ অয়েল (তেল) ঢালিয়া দিয়া সমস্ত বেশ করিয়া মাড়িয়া মিশাও। এক্ষণে একটু সির্কা (ভিনিগার) ঢালিয়া দাও। উত্তমরূপে ফোটাও। সমস্তটা বেশ মিশিয়া গেলে লেটুস পাতার উপর ঢালিয়া দাও। আলগোছে মাখিয়া লও। এতৎসহ টোমেটো চাকা, সিদ্ধ বিট চাক', শক্ত সিদ্ধ পক্ষীডিম্ব চাকা, সিদ্ধ চিঙ্গড়ী মাছ, সিদ্ধ ইলিশ বা ভেটকী মাছ প্রভৃতি মিশাইতে পার।
আবার শুধু চিঙ্গড়ী, ভেটকী রা ইলিশ প্রভৃতি মাছ জলে বা তাপে সিদ্ধ করিয়া লইয়াও উপরুক্ত বিধানে সালাদ প্রস্তুত করিতে পার। অথবা আমাদের দেশীয় বিধানে গোলমরিচের গুঁড়ার পরিবর্ত্তে কাঁচালঙ্কা বাটা, এবং সির্কার পরিবর্তে লেবুর রস বা তেঁতুল গোলা দিয়াও এই চাট্নি প্রস্তুত করিতে পার।
১৮৩। দহির চাট্নি
দহির মধ্যে একটু জল মিশাইয়া অপেক্ষাকৃত পাৎলা করিয়া গুলিয়া লও। নুণ, চিনি, কাঁচালঙ্কা বাটা বা কুচি, ধনিয়া পাতা বাটা বা কুচি মিশাও। বেশ করিয়া ঘোলাইয়া মিশাইয়া লইবে। অমনি বা নেক্ড়ায় ছাঁকিয়া লইয়া খাও। অবশ্য ধনিয়া পাতার পরিবর্ত্তে পুদিনা বা পার্শ্লী পাতা ব্যবহার করিতে পার। লাফা বেগুণ ডুমা ডুমা করিয়া কুটিয়া ঘৃতে বা তেলে ভাজিয়া লইয়া এই চাট্নির মধ্যে ছাড়িয়া খাইতে পার।
১৮৪। লাউর রায়তা
লাউ মিহি করিয়া কুটিয়া একটু ভাপ দিয়া জল গালিয়া ফেলিয়া লও। নুণ, একটু চিনি, কাঁচালঙ্কা বাটা, রাইসরিষা বাটা এবং দহি দিয়া একত্রে মাখ। একটু তেল মিশাইয়া লও।
ফুলকোবি, সালগম, গাজর, মূলা প্রভৃতিরও এই প্রকারে ‘রাওতা’ করিবে।
১৮৫। সাদাসিধা দহি-মাছ
একটি অপেক্ষাকৃত বড় (কাল) পাথরের ‘খাদায়’ বা মৃৎপাত্রে দহি লইয়া অল্প জল মিশাইয়া অপেক্ষাকৃত তরল কর। নুণ, কাঁচা লঙ্কা বাটা, (হলুদ বা জাফরাণ) রাই সরিষা বাটা ও তেল ইহার সহিত উত্তমরূপে মিশাও।
এক্ষণে ইলিশ মাছ খণ্ড খণ্ড করিয়া কুটিয়া জলে সিদ্ধ করিয়া বা তেলে ভাজিয়া তুলিয়াই উত্তপ্ত অবস্থাতে ঐ দহিতে ডুবাও। দুই তিন ঘণ্টা মত ঢাকিয়া রাখিয়া পরে খাও। আগুনে একটু ফুটাইয়া লইতে পারিল উত্তম হয়, কিন্তু সাবধান যেন দহি ফাটিয়া না যায়।
আইড়, সিলঙ্গাদি, কই ও চিঙড়ী প্রভৃতি মাছর এই প্রকারে সাদাসিধা ‘দহি-মাছ’ প্রস্তুত করিতে পায়। উল্লিখিত মাছের সালাদের সহিত তুলনীয়।
১৮৬। সাদাসিধা দহি-বড়া
একটি অপেক্ষাকৃত বড় (ফল) পাথরের ‘খাদাতে’ বা মৃৎপাত্রে দহি লইয়া অল্প জল মিশাইয়া অপেক্ষাকৃত তরল কর। নুণ, চিনি, একটু তেল, কাঁচা লঙ্কা বাটা, (হলুদ বা জাফরাণ) ও রাই সরিষা বাটা দহিতে উত্তমরূপে গুলিয়া মিশাইয়া লও। ওদিকে মাষকলাইর ডাইলের খোসা উঠাইয়া ফেলিয়া জলে ভিজাইয়া রাখ। ঘণ্টা তিনেক পরে পাটায় মিহি করিয়া বাটিয়া লও। নুণ, মৌরীর গুঁড়া ও হিঙ্গ মিশাইয়া উত্তমরূপে ফেনাও। ফেনাইবার কালে একটু তেল মিশাইয়া ফেনাইবে তাহা হইলে ফেনান ভাল হইবে। তেল পূর্ব্বে একটু গরম করিয়া তাহাতে এক ডেল হিঙ্গ ফেলিয়া গলাইয়া লইয়া ঐ তেল মিশাইলে একযোগে হিঙ্গ ও তেল উভয়ই মিশান হইবে।
এক্ষণে উত্তপ্ত তেলে এই ফেনান ডাইল বড়া ভাজিয়া তাহা উত্তপ্ত অবস্থাতেই ঐ দহি গোলতে ছাড়। ঘণ্টা দুই তিন মত পরে খাও
খ (২)-ঝাল-চাটনি
অগ্নিপক্ব কন্দ-মূল-ফলাদি বা আমিষাদি খণ্ড খণ্ড করিয়া তৎসহ নুণ, হলুদ, কাঁচা ঝাল বাটা বা ভাজা ঝালের গুঁড়া, গন্ধদ্রব্য, অম্লরস এবং তৈল মিশাইয়া লইলে ‘ঝাল’-চাট্নি প্রস্তুত হইল।
‘ঝাল’ বলিতে বলা বাহুল্য প্রধানতঃ জিরা-মরিচ বুঝাইবে এবং তৎসহ আরও শুক্নালঙ্কা, ধনিয়া, তেজপাত, কালজিরা এবং লবঙ্গ বর্তমান অধ্যায়ে বুঝিতে হইবে। এইগুলি হয় জল দিয়া মিহি করিয়া পাটায় রাটিয়া লইয়া বাটা-ঝাল রূপে ঝাল-চাটনিতে মিশাইবে, অথবা জিরা-মরিচ, শুক্না লঙ্কা, ধনিয়া, তেজপাতা, কালজিরা এবং লবঙ্গ একত্র বা পৃথক্ পৃথক্ কাট-খোলায় ভাজিয়া লইয়া শুক্না অবস্থায় পাটায় গুঁড়া করিয়া ঝাল চাট্নিতে মিশাইরে। কাঁচালঙ্কা বা কাঁচা সরিষা বাটা এই ঝাল চাট্নিতে মিশাইবে না। তবে রাইসরিষা এবং কৃষ্ণ-তিল কাট খোলায় ভাজিয়া গুঁড়া করিয়া লইয়া বানারস অঞ্চলে অনেক সময় মিশান হইয়া থাকে। গন্ধদ্রব্য মধ্যে হিঙ বা রশুন এবং আদা দ্বারা ঝাল-চাট্নি অনুবাসিত করা হয়। অপিচ ‘ঝালের’ গন্ধেও ইহা বিলক্ষণ অনুবাসিত হইয়া থাকে। লেবুররস আমচূণা, তেঁতুল গোলা ও দধি সাধারণতঃ ইহাতে অম্লরস রূপে দেওয়া হয়।
ঝাল-চাট্নিতে ব্যবহার্য্য কন্দ-মূলাদি সাধারণতঃ স্বয়ং অম্নস্বাদ বিশিষ্ট বা স্বয়ং বাসিত হয় না, এবং উহা অগ্নি-পক্ব অবস্থা ছাড়া আম অবস্থাতেও লওয়া হয় না।
১৮৭। আলুর ঝাল-চাট্নি (বারানসী)
লঙ্কা, জিরা, মরিচ, তিল (কৃষ্ণ) ও রাই সরিষা এক সাথে বা পৃথক্ পৃথক্ কাট-খোলায় ভাজিয়া পাটায় পিষিয়া গুঁড়া করিয়া লও। তিলের ভাগ কিছু বেশী লইবে।
নুণ, হলুদ ও ঐ ভাজা মশল্লার গুঁড়া এবং সরিষার তেল (একটু চপচপে করিয়া) একত্রে মাখিয়া লও। একটু লেবুর রস চিপিয়া মিশাও। ইচ্ছা করিলে তেল পুর্ব্বে একটা বাটিতে করিয়া আগুনে তাতাইয়া তাহাতে এক ডেলা হিঙ্গ ছাড়িয়া গলাইয়া লইবে। (সাবধান, তেল অধিক তপ্ত হইলে তাতে হিঙ্গ ছাড়িলে তাহা ভাজা হইয়া যাইবে—গলিবে না।)
উপরি লিখিত মিশ্রিত মশল্লা শুধুও চাটনি রূপে ব্যবহৃত হইতে পারে। অথবা তাহার সহিত আলু, ফুলকোবি, মূলা, সালগম, গাজর, লাউ, শশা প্রভৃতি মধ্যে যে কোন একটি লইয়া সিদ্ধ করিয়া ডুম ডুমা বা চাকা চাকা করিয়া কুটিয়া মিশাইয়া চাটনি প্রস্তুত করিতে পার।
১৮৮। পাঁটার মেটের ঝাল-চাটনি
পাঁঠার মেটে ঘৃতে ভাজিয়া রাখ। শুক্না লঙ্কা, ধনিয়া, জিরা-মরিচ গুঁড়া ও তেজপাত কালজিরা একসাথে কাঠখোলায় ভাজিয়া লইয়া পাটায় পিষিয়া মিহি করিয়া গুঁড়া কর। অতঃপর নুণ, হলুদ, একটু চিনি, রশুন বাটা, তেঁতুল গোলা ও ঐ ভাজা ঝালের গুঁড়া লইয়া মেটের সহিত মিশাও। উপরে তেল ঢালিয়া দিয়া একটু চপচপে গোছ করিয়া মাখিয়া লও। দুই তিন দিবস রৌদ্র-পক্ব করিয়া মজিলে খাও। তেঁতুল গোলার পরিবর্ত্তে ভিনিগার (সির্কা) দিলে ভাল হয়।
১৮৯। হরিণ মাংসের ঝাল-চাট্নি
হরিণ বা মেষ মাংস অপেক্ষাকৃত বড় ডুমাকারে কুট। ঘৃতে ভাজিয়া তোল। শুক্না লঙ্কা, ধনিয়া, জিরা-মরিচ, তেজপাত, কালজিরা ও লবঙ্গ এক সাথে কাট-খোলায় ভাজিয়া লইয়া পাটায় মিহি করিয়া বাটিয়া গুঁড়া করিয়া লও। অতঃপর নুণ, হলুদ, একটু চিনি, তেঁতুল গোলা, রশুন বাটা ও ঐ ভাজা ঝালের গুঁড়া লইয়া মাংসের সহিত মিশাও। উপরে তেল ঢালিয়া দিয়া একটু চপ্চপে গোছ করিয়া সব একত্রে মাখ। দুই তিন দিবস রৌদ্র-পক্ব করিয়া পরে খাও। তেঁতুল গোলার পরিবর্ত্তে ভিনিগার (সির্কা) দিলে ভাল হয়।
১৯০। বাটা ঝালের দহি-বড়া
দহি-বড়া পশ্চিমাঞ্চলের, বিশেষতঃ বারানসের, একটি প্রসিদ্ধ চাট্নি। ইহা তথাতে ধনী-গৃহে প্রস্তুত হয়, গৃহস্থ-গৃহে প্রস্তুত হয়, দোকানে কিনিতে পাওয়া যায়, এমন কি ইহা (সন্ধ্যার প্রাক্কালে) রাস্তায় রাস্তায় ফেরি করিয়া বিক্রয় হইয়া থাকে। বাঙ্গালা দেশেও ইহার চলন বিরল নহে তবে ইহা বারানস হইতে আমদানী কিনা জানি না।
মাষকলাইর খোসা উঠাইয়া ফেলিয়া ভিজাইয়া রাখ। ঘণ্টা তিনেক মত পরে পাটায় মিহি করিয়া বাটিয়া লও। নুণ, শুক্না লঙ্কা বাটা, মৌরীর গুঁড়া এবং হিঙ্গ মিশাইয়া উত্তমরূপে ফেনাও। ফেনাইবার পূর্ব্বে একটু তেল মিশাইয়া ফেনাইবে তাহা হইলে ফেনান ভাল হইবে। এই তেল পূর্ব্বে একটু তাতাইয়া লইয়া তাতে হিঙ্গ এক ডেলা ফেলিয়া গলাইয়া লইবে, তাহা হইলে হিঙ্গ ও তেল একযোগে উভয়ই মিশান হইবে।
পাঠক পাঠিক লক্ষ্য করিবেন, মাষকলাই ডাইল বাটিয়া ফেনাইবার সময় তাহাতে তৈল-সংযোগ করিলে তবে ফেনান উৎকৃষ্ট হইয়া থাকে, পক্ষান্তরে মটর বা খেঁসারীর ডাইল বাটিয়া ফেনাইবার সময় তাহাতে তৈল সংস্পর্ষ হইলেই তাহা ছাক্ড়া ছাক্ড়া হইয়া ‘নঠাইয়া’ যায়—আর তাহা ফেনান যায় না।
এক্ষণে এই ফেনান মাষকলাইর গোলা উত্তপ্ত তেলে বা ঘৃতে ছাড়িয়া বড়া ভাজ এবং উঠাইয়া তৎক্ষণাৎ গরম গরম নিম্নলিখিত মত মশল্লা সংযুক্ত দধিতে ডুবাও। ঠাণ্ডা করিয়া দধিতে ফেলিলে দধির রস সম্যকরূপে বড়ার ভিতর প্রবেশ করিবে না। ঘণ্টা তিনেক মত ঢাকিয়া রাখিয়া খাও। অধিকক্ষণ রাখিয়া খাইলে দহি টকিয়া যাইবে এবং বড়াগুলিও অধিক রসিয়া এড়া এড়া ঢীলা ঢীলা হইয়া যাইবে।
একটি অপেক্ষাকৃত বড় (কাল) পাথরের ‘খাদায়’ বা মৃৎপাত্রে বড়ার আন্দাজে দহি লইয়া অল্প জল মিশাইয়া অপেক্ষাকৃত তরল কর। নুণ, চিনি, (হলুদ), শুক্না লঙ্কা বাটা, জিরা-মরিচ বাটা, আদা বাটা ও অল্প তেল মিশাও। বেশ করিয়া নাড়িয়া মিশাইবে। নুণ ও চিনির পরিমাণের বেশী কমী করিয়া দহি-বড়া আবশ্যক মত নোণতা বা মিষ্ট স্বাদ বিশিষ্ট করিবে। মিষ্ট বড়ায় হলুদ দিবে না এবং ঝালের পরিমাণও কম করিবে।
১৯১। ভাজা ঝালের দহি-বড়া
ভাজা ঝালের দহি-বড়ার দহির সহিত কাঁচা বাটা ঝাল না মিশাইয়া শুক্না লঙ্কা, জিরা, মরিচ, ধনিয়া, তেজপাত ও লবঙ্গ এক সাথে বা পৃথক্ পৃথক্ কাট-খোলায় ভাজিয়া লইয়া তাহা পাটাতে পিষিয়া তাহা শুক্না গুঁড়া করতঃ (হলুদ ও) রাই-সরিষার গুঁড়ার সহিত দহি-গোলার সহিত মিলাইবে। নুণ ও চিনি অবশ্য পৃথক্ মিশাইতে হইবে। মষবড়া ভাজিয়া এই গোলায় ফেল।
১৯২। বাটা ঝালের দহিমাছ
ঠিক বাটা ঝালের দহি-বড়ার ন্যায়ই দহি-মাছ প্রস্তুত করিবে। দহি গোল। ঠিক দহি-বড়ার দহি-গোলার ন্যায়ই প্রস্তুত করিবে, কেবল ডাইলের বড়ার পরিবর্তে মৎস্য খণ্ড খণ্ড করিয়া কুটিয়া জলে সিদ্ধ করিয়া বা ঘৃতে বা তৈলে ভাজিয়া উত্তপ্ত অবস্থাতেই দহি-গোলাতে ফেলিবে। তিন ঘণ্টা মত ঢাকিয়া রাখিয়া পরে খাইবে।
রুই মাছের গাদা ও কই প্রভৃতি মাছ ভাজিয়া দধি গোলাতে ফেলিবে কিন্তু রুই মাছের পেটি, আইড়, সিলঙ, বোয়াল, সুর, চাঁদা, ভেটকী,চিঙড়ী প্রভৃতি মাছ জলে সিদ্ধ করিয়া লইয়া ফেলিবে। দহি গোলাতে চিনি দিবে না।
১৯৩। ভাজা ঝালের দহি-মাছ
ইহাও ভাজা ঝালের দহি-বড়ার ন্যায়ই ঠিক প্রস্তুত করিবে, এবং ঘণ্টা তিনেক মত ঢাকিয়া রাখিয়া পরে খাইবে। ইহাতেও অবশ্য ডাইলের বড়ার পরিবর্তে মৎস্য তেলে বা ঘৃতে ভাজিয়া বা জলে সিদ্ধ করিয়া উত্তপ্ত অবস্থাতে দহি-গোলাতে ফেলিতে হইবে।
রুই মাছের গাদা এবং কই প্রভৃতি মাছ ভাজিয়া দহি-গোলাতে ছাড়িরে এবং রুই মাছের পেটি, আইড়, সিঙ বোয়াল, সুর, চাঁদা, ভেটকী, চিঙড়ী প্রভৃতি মাছ জলে সিদ্ধ করিয়া লইয়া দহি-গোলাতে ফেলিবে। দহি-গোলাতে অবশ্য চিনি দিবে না।