বরেন্দ্র রন্ধন/দ্বাদশ অধ্যায়

দ্বাদশ অধ্যায়।

অম্বল—(টক)

 ফল, আনাজ বা মৎস্যাদি তেলে সরিষা (গোটা বা গুঁড়া) ফোড়ন দিয়া আংসাইয়া তেঁতুলাদির গোলায়, অথবা ফল, আনাজাদি স্বয়ং অম্লস্বাদ বিশিষ্ট হইলে, শুধু জলে, নুণ, (হলুদ) ও মিষ্টরস সহ সিদ্ধ করতঃ রসাল রাখিয়া নামাইলে ‘অম্বল’ বা ‘টক’ প্রস্তুত হইল।

 অনেক ক্ষেত্রে ফোড়নের পরে তেলে তেঁতুলাদির গোলা ছাড়িয়া তাহা ফুটিলে পরে তাহাতে কষান ফল, আনাজ বা মৎস্যাদি ছাড়া হইয়া থাকে। বরেন্দ্রে অম্বলে ইহার বেশী আর সচরাচর কিছু করা হয় না। তবে ক্ষেত্র বিশেষে সরিষার সহিত লঙ্কা (কাঁচা বা শুকনা), তেজপাত এবং মেথি বা কালজিরা ফোড়ন দেওয়া হইয়া থাকে। আমিষ টকেই সাধারণতঃ এই লঙ্কা, মেথি ফোড়ন দেওয়ার ব্যবস্থা। আমিষ টকে হলুদ এবং মোটা মৎস্যাদির টকে লঙ্কা বাটা পর্য্যন্ত মিশান যায়। কোন কোন আমিষ টকে কেহ কেহ শেষে সরিষা বাটা মিশাইয়া থাকেন এবং কোন কোন নিরামিষ টকে যথা—পাকা কলা বা চালিতার টকে, পশ্চাৎ তিল বাটা মিশান বিধি আছে। টক বিশেষে শেষ পর্যন্ত আদা-ছেঁচা মিশানও হইয়া থাকে।

 প্রায় সকল নিরামিষ টকেই মিষ্টরস (চিনি বা গুড়) একটু অধিক পরিমাণে দেয়,—নিয়মিষ টক অম্ল-মধুর স্বাদবিশিষ্ট হইলেই অধিক উপাদেয় হয়। কোন কোন আমিষ টকেও অল্প পরিমাণে মিষ্ট দিলেই যেন ভাল হয়। টকের আনাজ বা ফলাদি অধিক আংসাইবে না। কোন কোন টকের ঝোল বা রস প্রচুর পরিমাণে রাখিয়া নামাইতে হয়,—এই সব টকের ঝোলটুকু চুমুক দিয়া খাইতেই উপাদেয়। পক্ষান্তরে অনেক টক অপেক্ষাকৃত ঘন বা শুষ্ক করিয়া নামান হইয়া থাকে। সাধারণতঃ তরল টকে গোটা সরিষা ফোড়ন দেওয়া হয় এবং ঘন টকে গুঁড়া সরিষা ফোড়ন দেয়। অথবা গুঁড় সরিষা ফোড়নের পরিবর্তে গোটা সরিষা ফোড়ন দিয়া শেষ পর্যন্ত সরিষা বাটা মিশান হইয়া থাকে।

 যে সব ফল বা আনাজাদির নিজের সুবাসের অভাব তাহার সহিত পশ্চাৎ আম-আদা বা আম্রমুকুলাদি যোগ করিয়া টক অনুবাসিত করা হইয়া থাকে।

 অনেক টকে খেঁসারীর বা মটরের অথবা বুটের বা বরবটীর ডাইলের ফুলবড়ী, বড়া, চাপড়ী, পাণিদলা প্রভৃতি অনুষঙ্গ রূপে ব্যবহৃত হইয়া থাকে।

 বরেন্দ্রে ‘টক’ না বলিয়া সাধারতঃ ‘অম্বল’ বলা হয়। বরেন্দ্র-বাসীগণ রাঢ়-বাসীগণের ন্যায় টকের তেমন ভক্ত নহেন, সুতরাং রাঢ়ে যেরূপ টকের প্রচলন আছে বরেন্দ্রে তাদৃশ নাই।

১৩৬। কচি আমের অম্বল

 কচি কাঁচা আম ছুল। আধখানা করিয়া কাটিয়া ভিতর হইতে কুঞা (বীচি) বাহির করিয়া ফেলিয়া লও। তেলে সরিষা (গোটা) ফোড়ন দিয়া আম ছাড়। অল্প আংসাইয়া জল দাও। নুণ ও চিনি মিশাও। সিদ্ধ হইলে অথচ প্রচুর পরিমাণে ঝোল থাকিতে নামাও। চৈত্র বৈশাখ মাসে এই তরল অম্ল চুমুক দিয়া খাইতে উপাদেয় এবং তৃষ্ণা নিবারক বটে।

 আমড়া, (দেশী অপেক্ষা বিলাতী আমড়ার অম্বলই উৎকৃষ্ট হয়।) জলপাই প্রভৃতির এই প্রকারে অম্বল রাঁধিবে।

১৩৭। আম-চূণার (আমসীর) অম্বল

 কাঁচা আমের খোসা ছাড়াইয়া কুঞা বাহির করিয়া ফেলিয়া ফালি ফালি করিয়া কুটিয়া রৌদ্রে শুকাইয়া লইলে ‘আমচুণা’ বা ‘আমসী’ প্রস্তুত হইল। অনেকে, আম একটু অধিক শুকাইয়া লইয়া ঢেঁকিতে কুটিয়া চুর্ণ করিয়া লয়েন, তাহাকে সচরাচর ‘আমচুর’ কহে। আম-চূণা ধুইয়া জলে ভিজাইয়া রাখ। তেলে সরিষা (গোটা) ফোড়ন দিয়া চূণ ও চূণা ভিজান জলটুকু একত্রে ছাড়। নুণ ও চিনি মিশাও। সিদ্ধ হইলে নামাও। ইহা তরল বা শুষ্ক উভয়বিধ প্রকারেই খাওয়া হয়।

১৩৮। পাকা আমের অম্বল।

 পাকা আমের খোসা ছুলিয়া ফেল। তেলে সরিষ (গোটা) ফোড়ন দিয়া আম ছাড়। অল্প আংসাইয়া জল দাও। ঈষৎ নুণ ও অধিক পরিমাণে চিনি বা গুড় দাও। ঝোল শুকাইয়া আসিলে নামাও।

১৩৯। আমসত্ত্বের অম্বল

 আমসত্ত্ব ধুইয়া ভিজাইয়া রাখ। তেলে সরিষা (গোটা) ফোড়ন দিয়া ভিজান আমসত্ত্ব ঐ জলে গুলিয়া লইয়া ছাড়। ফুটিলে চিনি দিয়া ইচ্ছানুরূপ তরল রাখিয়া বা ঘন করিয়া নামাও।

১৪০। পাকা তেঁতুলের অম্বল

 পাকা তেঁতুল জলে ধুইয়া ভিজাইয়া রাখ। ভিজিলে জলে গুলিয়া ‘গোলা’ করিয়া লও। গোলা ইচ্ছানুরূপ গাঢ় বা তরল করিতে পায়। গোলা হইতে অবশ্য তেঁতুলের সিটা ও বীচি ছাঁকিয়া উঠাইয়া ফেলিয়া দিবে। তেলে সরিষা (গোটা) ফোড়ন দিয়া তেঁতুল গোলা ছাড়। ফুটিলে অল্প নুণ এবং অনেকটা গুড় বা চিনি দাও। আবশ্যক মত ঘন করিয়া নামাও। ইহা মিষ্ট বা ‘মিঠে’ অম্বল হইল। নুণের তুলনায় চিনির ভাগ কম দিয়া এই অম্বল রাঁধিলে তাহা ‘খাটা’ অম্বল হইবে।

১৪১। কাঁচা তেঁতুলের অম্বল

 কাঁচা তেঁতুল খোলা সহ ধুইয়া ডুমা ডুমা করিয়া কুট। তেলে সরিষা (গোটা) ফোড়ন দিয়া তেঁতুল ছাড়। অল্প আংসাইয়া জল দাও। ফুটিলে নুণ, (হলুদ) ও অল্প পরিমাণে চিনি দাও। তরল রাখিয়াই নামাও।

 ভাদ্র মাসে নূতন ‘আউসের’ চাউলের ভাতের সহিত এই অম্বল মাখিয়া খাইতে ভাল।

১৪২। বোরের (বদরীর) অম্বল

 ফাল্গুনে বোর (বদরী) সুপক্ব হইলে তাহা রৌদ্রে উত্তমরূপে শুকাইয়া উঠাইয়া রাখিতে হয়। চৈত্র বৈশাখে—গ্রীষ্মকালে এই শুষ্ক বোরের তরল অম্বল রাঁধিয়া চুমুক দিয়া খাইতে উপাদেয়। ইহা পেট ঠাণ্ডা করে এবং তৃষ্ণা নিবারণ করে। সদ্য পক্ব বোর দিয়াও অম্বল রাঁধা যায়। শুকনা বোর ধুইয়া খানিকক্ষণ জলে ভিজাইয়া রাখিয়া পর অম্বল রাঁধিতে হয়। সদ্য পক্ব বোর অবশ্য আর ভিজাইয়া রাখিতে হয় না। তেলে সরিষা ফোড়ন দিয়া বোরগুলি ছাড়। শুকনা বোরগুলি যে জলে ভিজান হইয়াছিল ঐ জলটুকু শুদ্ধ ছাড়। আবশ্যক বোধ করিলে জল আরও দিতে পার। নুণ,(হলুদ) এবং গুড় বা চিনি দাও। প্রচুর ঝোল রাখিয়া নামাও। যারা বোরের ঘন অম্বল খাইতে ইচ্ছা করেন তাঁহারা বোরগুলি সুসিদ্ধ হইলে হাতা দ্বারা ঘাঁটিয়া ভাঙ্গিয়া অভ্যন্তরের শাঁস বাহির করিয়া দেন এবং অম্বল আবশ্যক মত শুকাইয়া থকথকে গোছ করিয়া লইয়া নামান।

১৪৩। আনারসের অম্বল

 পক্ব আনারসের খোসা ছাড়াইয়া এবং চোখগুলি উঠাইয়া ফেলিয়া একটু চূণ মাখিয়া খানিকক্ষণ রাখিয়া দাও। পরে চূণ উত্তমরূপে জলে ধুইয়া ফেলিয়া ডুমা ডুমা করিয়া কুটিয়া লও। চূণ মাখিলে এবং চোখ উঠাইয়া ফেলিলে আনারসের মুখ ধরা দোষ নষ্ট হইবে। আশা করি গোটা আনারস কিরূপে প্রথমে চাকা চাকা করিয়া কুটিয়া লইয়া পরে অভ্যন্তরের শক্ত ‘মুষলা’টা বাদ দিয়া ডুমা ডুমা করিয়া কুটিয়া লইতে হয় তা অন্ততঃ অনেক পাঠিকাই অবগত আছেন।

 তেলে সরিষা (গোটা) ফোড়ন দিয়া আনারস ছাড়। আংসাও। জল দাও। নুণ, (হলুদ) এবং চিনি দাও। সিদ্ধ করিয়া আবশ্যক মত অল্পাধিক রস রাখিয়া নামাও।

 পাকা কামরাঙ্গা, পাকা কদম ফুল, মূলা প্রভৃতি চাকা চাকা করিয়া কুটিয়া এইরূপে অম্বল রাঁধিবে।

১৪৪। করঞ্জার অম্বল

 ডাগর (প্রায় পক্ব) করঞ্জারই অম্বল ভাল হয়। করঞ্জা দুই ফাঁক করিয়া কুটিয়া বীচি বাহির করতঃ ধুইয়া লইয়া নুণ মাখ। মটর বা খেঁসারীর ডাইলের পানীদলা প্রস্তুত করিয়া লও। তৈলে সরিষা ফোড়ন দিয়া করঞ্জা ছাড়। আংসাও। পানীদলা ছাড়। আংসাও। জল দাও (হলুদ) ও মিষ্ট দাও। সুসিদ্ধ হইলে একটু ঝোল ঝোল রাখিয়া নামাও। পানীদলার পরিবর্ত্তে মটর, খেঁসাড়ী, ছোলা বা বরবটী ডালের ‘বড়ী’ অথবা ‘ফুলবড়ী’ যোগেও এই অম্বল রাঁধা চলে।

 শুধু পানীদলা, বড়া কিম্বা ফুলবড়ীরও এই প্রকারে অম্বল রাঁধা চলে। তৎক্ষেত্রে তেলে সরিষা ফোড়ন দিয়া আংসান ফুলবড়ী প্রভৃতি নুণ ও চিনি সহ পাৎলা তেঁতুল গোলায় সিদ্ধ করিয়া লইবে।

১৪৫। বড়ার অম্ল-ঝোল (বৈদ্যনাথ-দেওঘর)

 বুট বা বরবটীর বেসম সামান্য হিঙ সহ জল দিয়া মাথিয়া ফেলাইয়া লও। তেলে বড়া ভাজ। তেঁতুল বা আম চূণা জলে ভিজাইয়া রাখিয়া অপেক্ষাকৃত তরল গোলা করিয়া লও। লঙ্কা বাটা, ধনিয়া বাটা, জিরা বাটা,তেজপাত বাটা এবং হলুদ বাটা ঐ অম্ল গোলায় মিশাও। জ্বাল দাও। ফুটিলে বড়া ছাড়। নুণ ও একটু চিনি দাও। রস থক্‌থকে গোছ হইলে নামাও।

 কষান ফুল বড়ীর অম্ল-ঝোল এই প্রকারে রাঁধিতে পার।

 ইহা ‘অম্বল’ অধ্যায়ভুক্ত না হইয়া ‘ঝাল’ অধ্যায়ভুক্ত হওয়াই বোধ হয় সমীচীন।

১৪৬। টোমেটোর অম্বল

 সুপক্ব দেখিয়া উত্তম টোমেটো লও। ধুইয়া রাখ। জলে পাকা তেঁতুল ভিজাইয়া পাৎলা করিয়া গোলা প্রস্তুত করিয়া রাখ। তেলে সরিষা ফোড়ন দিয়া টোমেটো ছাড়। আংসাও। পানীদলা, বড় বা পূর্ব্বে কষান ফুলবড়ী ছাড়। আংসাও। তেঁতুল গোলা ঢালিয়া দাও। নুণ এবং গুড় বা চিনি মিশাও। সিদ্ধ হইলে ঈষৎ ঝোল রাখিয়া নামাও।

 কোনরূপ অনুষঙ্গ না দিয়াও এই অম্বল রাঁধা চলিতে পারে।

 চুকা-পালঙ্গ, মেচ্‌তা বা মেদা, নাল ও পাকা করঞ্জার অম্বল এই প্রকারে রাঁধিবে।

১৪৭। বিলাতী কুমড়ার অম্বল

 (ক) সুপক্ব বিলাতী (মিঠা)কুমড়ার চোঁচা ফেলিয়া ঘণ্টের কুমড়ার ন্যায় মিহি করিয়া কুটিয়া লও। পাকা তেঁতুল জলে ভিজাইয়া পাৎলা করিয়া গোলা করিয়া লও। কুমড়া পুর্ব্বে তেলে কষাইয়া তোল। পরে ঐ তেলে সরিষা ফোড়ন দিয়া তেঁতুল গোলা ছাড়। ফুটিলে কষান বিলাতী ছাড়। নুণ, (হলুদ) এবং গুড় বা চিনি মিশাও। আবশ্যক মত তরল বা ঘন করিয়া নামাও। বিলাতী গুলি যেন গলিয়া না যায়। ইহার সহিত মটরাদি ডাইলের ফুল বড়ী, বড়া বা পানিদলা অনুষঙ্গ রূপে ব্যবহার করিতে পার।

 গোল আলু, লাল আলু প্রভৃতির এইরূপে অম্বল রাঁধিবে।

 (খ) বিলাতী কুমড়ার খোসা ছাড়াইয়া ডুমা ডুমা করিয়া কুট। পাকা তেঁতুল জলে গুলিয়া রাখ। তেলে সরিষা ফোড়ন দিয়া কুমড়া ছাড়। আংসাও। কুমড়া গুলি নাড়িয়া গলাইয়া ফেল। তেঁতুল গোলা ছাড়। নুণ ও গুড় বা চিনি মিশাও। নাড়িয়া চাড়িয়া থকথকে করিয়া নামাও।

 ইহার সহিতও মটরাদি ডালের ফুলবড়ী, বড়া অথবা পানিদলা অনুষঙ্গ রূপে ব্যবহার করিতে পার।

 বেগুনের অম্বল এই প্রকারে রাঁধিবে।

১৪৮। আলু-ই-বোখারার অম্বল

 আলু-ই-বোখারা ধুইয়া পরিষ্কার করিয়া জলে ভিজাইয়া রাখ। কিসমিস ধুইয়া পরিষ্কার করিয়া রাখ। তেলে সরিষা ফোড়ন দিয়া আলু-ই-রোখারা মায় জলটুকু ছাড়। নুণ ও গুড় বা চিনি মিশাও। ফুটিলে কিসমিস ছাড়। আরক মত ঘন করিয়া নামাও।

 ইচ্ছা করিলে অপরাপর ঘন ‘মিঠে’ অম্বলেও কিসমিস মিশাইতে পার। আবার তেঁতুল গোলা যোগে ফুলবড়ী, বড়া বা পানিদলা অনুষঙ্গ দিয়া শুধু কিসমিসেরও রাঁধিতে পার।

১৪৯। পাকা কলার অম্বল

 পাকা কলা ছুলিয়া চাকা করিয়া কুটিয়া লও। পাকা তেঁতুল জলে ভিজাইয়া রাখিয়া আবশ্যক মত ঘন গোলা করিয়া লও। তেলে সরিষা ফোড়ন দিয়া তেঁতুল গোলা ছাড়। নুণ,(হলুদ) ও গুড় বা চিনি মিশাও। ফুটিলে পাকা কলা এবং কষান মটর ডালের চাপড়ী ছাড়। সিদ্ধ হইলে তিল বাটা দিয়া নাড়িয়া চাড়িয়া নামাও।

 কষান ফুলবড়ী, বড়া, পানিদলা প্রভৃতি ইহার সহিত অনুষঙ্গ রূপে ব্যবহার করিতে পার। অথবা বিনা অনুষঙ্গেও অম্বল রাঁধিতে পার।

 চালিতার টক এই প্রকারে রাঁধিবে।

১৫০। আম-আদা দিয়া পেঁপের টক

 কাঁচা পেঁপের খোসা ও বীচি ফেলিয়া দিয়া সরু সরু করিয়া কুটিয়া লও। জলে একটু ভাপ দিয়া জল চিপিয়া ফেল। তেঁতুল অপেক্ষাকৃত পাৎলা করিয়া গুলিয়া রাখ। তেলে সরিষা ফোড়ন দিয়া পেঁপে ছাড়। আংসাও। তেঁতুল গোলআ ঢলিয়া দাও। নুণ ও চিনি দাও। জল শুকাইয়া আসিলে নামাইয়া কিছু আম-আদা বাটা মিশাও।

১৫১। দহির অম্বল

 দহি জলে গুলিয়া আবশ্যক মত তরল করিয়া রাখ। বেগুন ছোট করিয়া কুটিয়া তেলে বা ঘৃতে ভাজিয়া রাখ। তেলে সরিষা ফোড়ন দিয়া দহি-গোলা ছাড়। নুণ ও চিনি দাও। ফুটিলে ভাজা বেগুন ছাড়িয়া নামাইয়া লও।

 দ্রষ্টব্য—দহি অধিক ফুটাইলে ‘ফাটিয়া’ গিয়া উহার ছানা কাটিবে, সুতরাং তদ্বিষয়ে সাবধান থাকিবে।

১৫২। ‘তক্র’—বৈদ্যনাথ-দেওঘর)

 আধ সেরটাক দহি লইয়া তাহাতে জল মিশাইয়া আবশ্যক মত তরল করিয়া লও। আখ পোয়াটাক বুটের বেসম মিশাও। পাৎলা নেকড়ায় ছাঁকিয়া লও। একটু হিঙ, নুণ ও হলুদ বাটা মিশাও। জ্বাল দাও। দহি না ফাটে সে দিকে লক্ষ্য রাখিবে। থকথকে গোছ হইলে নামাইয়া (সের প্রতি একপোয়া হিসাবে) মোয়া ক্ষীর এবং বুটের বেসমের বোঁদে বা মতিচুরের লাড়ু (ভাঙ্গিয়া) মিশাও। আবশ্যক মত চিনি দাও। এক্ষণে ঘৃতে জিরা, তেজপাত, (হিঙ) ও লঙ্কা ফোড়ন দিয়া ‘তক্র’ সম্বারা দিয়া লও।

১৫৩। দহি-লাউ—(বারাণসী)

 লাউ চাকা চাকা বা ডুমা ডুমা করিয়া কুটিয়া লও। তেলে জিরা, লঙ্কা, হিঙ ও রাইসরিষা ফোড়ন দিয়া লাউ ছাড়। নুণ, হলুদ দিয়া নাড়িয়া চাড়িয়া ঢাকিয়া দাও। মোলায়েম হইলে দহি ও গরম মশল্লা মিশাইয়া নাড়িয়া চাড়িয়া নামাও।

 দহির পরিবর্ত্তে ছোলার ডালের বেসম গোলা, ‘গরম মশল্লা’ ও ‘আমচুর’ মিশাইয়া নাড়িয়া চাড়িয়া নামাইলে ‘লাউ-বেসম’ হইবে।

১৫৪। রস-মুণ্ডি বা রস-গোল্লার অম্বল

 পাকা তেঁতুল জলে অপেক্ষাকৃত তরল করিয়া গুলিয়া লও। সরিষা ফোড়ন দিয়া তেঁতুল গোলা ছাড়। ঈষৎ নুণ ও চিনি দাও। ফুটিলে রস-মুণ্ডি বা রস-গোল্লা ছাড়। কিছুক্ষণ ফুটাইয়া নামাও। একটু গোলাপজল মিশাও।

অম্বল—(আমিষ)

১৫৫। আম-শোল

 শোল মাছ ছুলিয়া ছোট ডুমা ডুমা করিয়া কুট। হলুদ মাখিয়া কষাইয়া রাখ। কচি কাঁচা আম ছুলিয়া দুই ফাঁক করিয়া কুটিয়া ভিতর হইতে কুঞা (বীচি)বাহির করিয়া ফেলিয়া লও। তেলে (তেজপাত), লঙ্কা, (মেথি) ও সরিষা ফোড়ন দিয়া লঙ্কা বাটা গোলা জল ছাড়। নুণ হলুদ দিয়া আর একটু জল দাও। ফুটিলে কষান মাছ ও আম ছাড়। সুসিদ্ধ হইলে ঈষৎ চিনি দিয়া ঝোল অপেক্ষাকৃত তরল থাকিতেই নামাও।

 কচি আমের পরিবর্তে পাকা টোপা বোর বা আমের মুকুল দিয়া এই অম্বল ধিতে পার। শোল মাছের ন্যায় কই মাছের গাদা ছোট ছোট ভুনা করিয়া কুটিয়া এই প্রকারে অম্বল রাঁধিতে পার।

১৫৬। খইরা মাছের অম্বল

 নুণ হলুদ মাখিয়া খইরা মাছ তেলে কষাইয়া রাখ। তেঁতুল জলে গুলিয়া অপেক্ষাকৃত তরল গোছের গোলা করিয়া লও। তেলে (তেজপাত) লঙ্কা, (মেথি), ও সরিষা ফোড়ন দিয়া তেঁতুল গোলা ঢালিয়া দাও। নুণ, হলুদ (ও ঈষৎ চিনি) দাও। ফুটিলে কষান মাছ ছাড়। সিদ্ধ হইয়া ঝোল আবশ্যক মত ঘন হইলে নামাও।

 ফাঁসা, মোয়া, পুঁঠি, পিয়ালী, ছোট রাই-খইরা, নছি (রুই, কাৎলাদির বাচ্ছা), বাটা, ছোট কই, খলিশা, ছোট চিঙড়ী এবং সামুদ্রিক ইলিশ জাতীয় বিবিধ ছোট ছোট মাছের এই প্রকারে অম্ল রাঁধিবে।

১৫৭। ইলিশ মাছের টক

 ইলিশ মাছ সাধারণ ভাবে খণ্ড খণ্ড করিয়া কুটিয়া লও। নুণ হলুদ মাখ। পেটী অপেক্ষা গাদার মাছেই অম্ল ভাল হয়। তেঁতুল জলে গুলিয়া আবশ্যক মত ঘন ‘গোলা’ করিয়া লও। তেলে সরিষা (গোটা বা গুঁড়া) ও লঙ্কা (ইলিশে কাঁচা এবং রুই প্রভৃতি মাছে শুক্না) ফোড়ন দিয়া মাছ ছাড়। অল্প আংসাইয়াই তেঁতুল গোলা ছাড়। পুনঃ কিছু নুণ, হলুদ (এবং ঈষৎ চিনি বা গুড়) দাও। সিদ্ধ হইয়া ঝোল আবশ্যক অনুযায়ী ঘন হইলে নামাও। (মাছের টক ইউরোপীয়দের নিকট Tamarind-Fish নামে খ্যাত হইয়াছে।)

 রুই (পেটীর মাছেরই ভাল টক হয়), সারঙ্গপুঁঠি, চিঙড়ী, কাঁকড়া, শোল, ছাতিয়ান, প্রভৃতি মাছের টক এই প্রকারে রাঁধিবে।

১৫৮। ইলিশ মাছের ডিমের অম্বল

 ইলিশ মাছের ডিম নুন হলুদ দিয়া মাখিয়া কষাইয়া রাখ। তৈলে সরিষা (গোটা বা গুঁড়া) ফোড়ন দিয়া তেঁতুল গোলা ছাড়। নুণ হলুদ (ও ঈষৎ মিষ্ট) দাও। ফুটিলে কষান ডিম ছাড়। ঝোল কিছু শুকাইয়া নামাও। রুই, বাট্‌কিয়া, সারঙ্গ পুঁঠি, এলঙ্গ, কই প্রভৃতি মাছের ডিমেরও এই প্রকারে অম্বল রাঁধিবে।

১৫৯। করঞ্জা দিয়া ইলিশ মাছের ডিমের অম্বল

 ইলিশ মাছের ডিমে নুণ হলুদ মাখিয়া কষাইয়া রাখ। করঞ্জা ডাগর দেখিয়া বাছিয়া লইয়া দুই ফাঁক করিয়া কুটিয়া ভিতর হইতে বীচি রাহির করিয়া ফেল। তেলে সরিষা (গোটা) ফোড়ন দিয়া করঞ্জ ছাড়। আংসাও। নুণ হলুদ ও একটু মিষ্ট দিয়া জল দাও। ফুটিলে কষান ডিম ছাড়। আবশ্যক মত ঝোল পাৎলা বা ঘন করিয়া নামাও।

 রুই প্রভৃতি, বাট্‌কিয়া, সারঙ্গ পুঁঠি, এলঙ্গ, কই প্রভৃতি মাছের ডিমের এই প্রকারে অম্বল রাঁধিবে।

 পাকা কামরাঙ্গা দিয়া ও এই প্রকারে টক রাঁধিতে পার। ঈষৎ নরম গোছের ইলিশ এবং পোনা মাছেরও এই প্রকারে করঞ্জা দিয়া অম্বল হয়।

১৬০। আনারস দিয়া চিঙড়ী মাছের অম্বল

 আনারস পূর্বোক্ত মত ছুলিয়া চূণ মাখিয়া ধুইয়া ডুমা ডুমা করিয়া কুটিয়া লও। তেঁতুল জলে গুলিয়া রাখ। তেলে সরিষা (গোটা) ফোড়ন দিয়া নুণ হলুদ মাখা চিঙড়ী মাছ ছাড়। অল্প আংসাইয়া আনারস ছাড়। আংসাও। সাবধান, যেন অধিক আংসাইয়া চিঙড়ী মাছ শক্ত করিয়া ফেলিও না। তেঁতুল গোলা ছাড়। পুনঃ অল্প নুণ, হলুদ ও চিনি বা গুড়) দাও। মাছ সিদ্ধ হইলে আবশ্যক মত তরল বা ঘন করিয়া নামাও।

 টোমেটো, কামরাঙ্গা, প্রভৃতি দিয়াও এই প্রকারে টক রাঁধিতে পার।

১৬১। দহি দিয়া মাছের অম্বল

 ইলিশ বা রুই মাছ একটু বড় বড় খণ্ডে কুট। নুণ হলুদ মাখ। ঈষৎ অম্ল দহিতে অল্প জল দিয়া উত্তমরূপে গুলিয়া আবশ্যক মত পাৎলা করিয়া লও—গোলা যেন সমভাব বিশিষ্ট হয়—কোথায়ও দহি চাপ বাঁধিয়া না থাকে। তেলে তেজপাতা, লঙ্কা, মেথি ও সরিষা ফোড়ন দিয়া মাছ ছাড়। আংসাও। দহি গোলা ছাড়। নুণ, হলুদ ও লঙ্কা বাটা মিশাও। মাছ সিদ্ধ হইয়া দহির জলটুকু শুকাইয়া আসিলে নামাও।

 রুই জাতীয় অপরাপর মাছের, ভেটকী, সারঙ্গ পুঁঠি, আইড়, সিলঙাদি, কৈ এবং চিঙড়ী মাছের দহি দিয়া অম্বল এই প্রকারে রাঁধিবে। মাছের পরিবর্ত্তে টোমেটো, কামরাঙ্গাদি দিয়াও এই প্রকারে টক রাঁধিতে পার।

১৬২। পক্ষীর ডিম্বের অম্বল

 পক্ষীর ডিম্ব শক্ত সিদ্ধ করিয়া খোলা ছাড়াইয়া দুই খণ্ড করিয়া কাটিয়া রাখ। তেঁতুল জলে গুলিয়া রাখ। তেলে লঙ্কা, মেথি ও সরিষা (গোটা বা গুঁড়া) ফোড়ন দিয়া তেঁতুল গোলা ছাড়। নুণ, হলুদ ও একটু মিষ্ট দাও। ফুটিয়া ঝোল আবশ্যক মত ঘন হইলে সিদ্ধ ডিম ছাড়িয়াই নামাও।

১৬৩। পাঁঠার মুড়ীর অম্বল

 পাঁঠার মুড়ি সিদ্ধ করিয়া ভাঙ্গিয়া ভিতর হইতে দঢ়ান মস্তিষ্ক বাহির করিয়া লও। নুণ, হলুদ ও লঙ্কা বাটা মাখ। তেঁতুল জলে গুলিয়া রাখ। তেলে সরিষা (গোটা বা গুঁড়া) ফোড়ন দিয়া মস্তিষ্ক ছাড়। আংসাও। তেঁতুল গোলা ছাড়। পুনঃ একটু নুণ, হলুদ ও মিষ্ট দাও। ফুটিয়া ঝোল আবশ্যক মত ঘন হইয়া আসিলে নামাও।

১৬৪। পাঁঠার মেটের অম্বল

 পাঁঠার মেটে প্রভৃতি নুণ হলুদ মাখিয়া তেলে কষাইয়া রাখ। জলে তেঁতুল গুলিয়া লও। তেলে সরিষা (গোটা বা গুঁড়া) ও লঙ্কা ফোড়ন দিয়া তেঁতুল গোলা ঢলিয়া দাও। নুণ, হলুদ, (লঙ্কা বাটা) ও মিষ্ট দাও। ফুটিলে কষান মাটিয়াদি ছাড়। সিদ্ধ হইলে আবশ্যক মত ঝোল ঘন করিয়া নামাও।