বরেন্দ্র রন্ধন/দশম অধ্যায়

দশম অধ্যায়

জিরা পর্ব্ব

(৩) ঝাল—(নিরামিষ)

 আনাজ বা মৎস্য অপেক্ষাকৃত বড় ডুম ডুমা বা ঈষৎ লম্বা ছাঁদে কুটিয়া ঘৃতে বা তৈলে জিরা, তেজপাত ও লঙ্কা ফোড়ন দিয়া আংসাইয়া লইয়া নুণ, হলুদ ও বাট ঝাল (জিরা-গোলমরিচ বাটা) সহ জলে অথবা চেলেনী জলে সিদ্ধ করতঃ রসাল থাকিতে নামাইলে যে ব্যঞ্জন প্রস্তুত হইল তাহাকে ‘ঝাল’ কহে।

 নিরামিষ ঝাল—বস্তুতঃ তাবৎ নিরামিষ ব্যঞ্জনই—ঘৃতে রাঁধিতে পারিলে তবে তাহার স্বাদ অতি উৎকৃষ্ট হয়।

 নিরামিষ ঝালের ন্যায়ই আমিষ ঝাল রাঁধিবে, কেবল মোটা মাছের ঝালে জিরা-গোলমরিচ বাটা সহ লঙ্কা বাটা, ধনিয়া বাটা, পিপুল বাটা প্রভৃতি সমস্ত বাটা ঝালই দিবে। চেলেনী জলের পরিবর্ত্তে শুধু জল দিয়াই সচরাচর আমিষ ঝাল সিদ্ধ করা হয় এবং পশ্চাৎ কিছু পিঠালী মিশাইয়া ‘ঝাল-রস’ ঈষৎ ঘন করিয়া লইয়া নামান হয়।

 ‘ঝোলের সহিত ঝালের দৃশ্যতঃ সাদৃশ্য থাকিলেও ঝোলে লঙ্কা, মেথি ফোড়ন পড়ে,—ঝালে লঙ্কা, জিরা বা শুধু জিরা ফোড়ন পড়িয়া থাকে। ঝোলে বাটা ঝাল এককালে পড়ে না, পড়িলেও একমাত্র লঙ্কাবাটা কিছু পড়ে, ঝালে জিরা-মরিচ বাটা অবশ্য দেয় এবং তৎসহ আবশ্যকানুযায়ী আরও লঙ্কা বাটা, ধনিয়া বাটা, পিপুল বাটা, তেজপাত বাটা প্রভৃতি পড়িয়া থাকে।

 নিরামিষ ঝোলে সাধারণতঃ ডাইল, বিশেষতঃ মটর ও ছোলর ডাইল, ফেলান হইয়া থাকে, নিরামিষ ঝালে সাধারণতঃ বুট (খোসা সমেত), ডাইলের জল-বড়া (ধোকা), ডাইলের চাপড়ী ভাজা, মটর শুটী, মাষকলায়ের বড়ী (ভাজা) অনুষঙ্গরূপে ব্যবহৃত হইয়া থাকে। কিন্তু উভয়ই চেলেনী জল দিয়া রাঁধা যায়।

 পাঁচমিশালী আনাজের নিরামিষ ‘ঝোল’ শুকাইয়া রাঁধিলে তাহাকে যেমন ‘লাফরা বা লাবরা’ কহে, পাঁচ মিশালী আনাঙ্গের নিরামিষ ‘ঝাল’ শুকাইয়া রাঁধিলে তাহাকে তেমনই ‘ঝাল-লাফরা’ বলা যাইতে পারে। লাফরার ন্যায় ঝাল-লাফরাতেও লাফা-বেগুণ কিম্বা বিলাতী কুমড়া মিশাইয়া লপেট গোছ করিয়া লইতে হয়। এতদুভয়েই চেলেনী জল ব্যবহৃত হয় না। একাধিক প্রকারের আনাজে পক্ব ঝাল-বসার আনাজ বা আমিষাদি গোটা রাখিয়া রসটুকু শুকাইয়া ফেলিলে তাহা চড়চড়ীর ন্যায় প্রতিভাত হইবে। এইরূপ ব্যঞ্জনকে ‘ঝাল-চড়চড়ী’ আখ্যা প্রদান করা হইয়া থাকে। সুতরাং নামে চড়চড়ী হইলেও প্রকৃতপক্ষে ইহা ‘ঝাল’ অধ্যায়ের অন্তর্গত বটে। ঝাল-চড়চড়ীতে সচরাচর মাষকলাইর বড়ী (ভাজা) ও মটর শুটী প্রভৃতি অনুষঙ্গরূপে ব্যবহৃত হইয়া থাকে। ইহা চেলেনী জলের পরিবর্ত্তে শুধু জলে রাঁধিয়া পরে পিঠালী দিয়া শুকাইয়া চড়চড়ে গোছ করিয়া লইয়া নামান হয়।

 ‘ঘণ্টের’ সহিত ‘ঝালের’ পার্থক্য,—ঘণ্টে আনাজ মিহি করিয়া কুটিয়া লইতে হয়, তাহা অপেক্ষাকৃত অধিক কষাইতে হয় এবং সমস্ত উত্তমরূপে ঘাঁটিয়া মিশাইয়া অবশেষে বেশী পরিমাণে পিঠালী দিয়া আঁটিয়া লইয়া অপেক্ষাকত শুক্না অথচ নসনসে করিয়া রাঁধিয়া নামাইতে হয়। ঝালে আনাজ অপেক্ষাকৃত বড় ডুম ডুমা বা ঈষৎ লম্বা ছাঁদে কুটিতে হয়, তেমনতর আংসাইতে হয় না এবং আদৌ ঘাঁটিয়া মিশাইতে হয় না, পরন্তু আনাজাদি আস্ত রাখিয়া অল্প পরিমাণে পিঠালী দিয়া ‘ঝাল-রস’ আধিক গাঢ় করিয়া নামাইতে হয়। ফলে, ঝোলের সহিত ‘ছেঁচ্‌কীর’ বা ‘ভাঙ্গার’ যে সম্বন্ধ, ‘ঝালের’ সহিত ‘ঘণ্টের’ সেইরূপ সম্বন্ধ।

 কালিয়ার সহিত ‘ঝালের’ পার্থক্য—,কালিয়া ঝালের গুরুপক্ব সংস্করণ। ঝালের ন্যায়ই কালিয়া রাঁধিবে উপরন্তু তাহাতে গোটা গরম মশল্লা ও পেঁয়াজাদি ফোড়ন দিবে এবং শেষ পর্যন্ত ঘৃত এবং গরম মশল্লা বাটা মিশাইবে। নিরামিষ কালিয়াতে লঙ্কা বাটা এবং ধনিয়া বাটাও সচরাচর ব্যবহৃত হইয়া থাকে। এবং চেলেনী জলের পরিবর্ত্তে শুধু জল এবং প্রয়োজন মত পশ্চাৎ কিছু পিঠালী ব্যবহৃত হয়।

 ‘সূপের’ সহিত ‘ঝালের’ পার্থক্য,—সূপে আনাজ বা ডাইলাদি সচরাচর প্রথমে জলে সিদ্ধ করিয়া লইয়া পশ্চাৎ ঘৃতে ফোড়ন দিয়া সম্বারা দেওয়া হয়, ঝালে প্রথমেই তাহা তেলে বা ঘৃতে কষিয়া বা আংসাইয়া লইয়া পশ্চাৎ জলে সিদ্ধ করা হয়।

১৮৬। ঝাল-রসা

 গোল আলু, লাল আলু, গড় আলু, ওল, মান, শালুক, বেগুণ, পটোল, শিম, কাঁঠাল বীচি, আনাজি কলা, গাভথোড়, আঁটা, কুমড়া প্রভৃতির মধ্যে ঋতু অনুসারে ও পছন্দ মত চারি পাঁচ প্রকার আনাজ বাছিয়া, লইয়া বড় বড় ডুমা ডুমা করিয়া অথবা একটু লম্বা ছাঁদে কুট। ইচ্ছা করিলে অবশ্য হালি আনাজ ফুলকোবি, ওলকোবি, সালগম, স্কোয়াস, মটর শুটা প্রভৃতিও এতৎসহ লইতে পার। তেলে মাষকলাইর বড়ী ভাজিয়া রাখ। তৈলে জিরা, তেজপাত, লঙ্কা ফোড়ন দিয়া আনাজ ছাড়। আংসাও। নুণ, হলুদ দিয়া জল দাও। ফুটিলে ভাজা বড়ী (গোটা) ছাড়। সিদ্ধ হইলে বাটা ঝাল মিশাও। একটু চিনি দাও। পরে সামান্য পিঠালী দিয়া ঝোল বা ‘রস’ একটু ঘন করিয়া লইয়া নামাও। একটু গাওয়া ঘি মিশাও। ইহাতে সমস্ত আনাজ আস্ত থাকিবে—গলিয়া মিশিয়া যাইবে না।

 মাষ বা মটরের বড়ী, খেঁসারী বা মটর ডাইলের ভাজা-বড়া, খেঁসারী বা মটর ডালের জল-বড়া, (পাণিদলা) অথবা ছোলার ডাইলের ধোকা (পাণিদলা) ইহার সহিত অনুষঙ্গরূপে ব্যবহৃত হইয়া থাকে।

 এই সমস্ত কোন প্রকার অনুষঙ্গ না দিয়া এই পাঁচমিশালি ঝালের ‘রস’ শুকাইয়া ফেলিয়া ব্যঞ্জন নামাইলে তাহা ‘লাফরা’ ব্যঞ্জনের ন্যায় প্রতিভাত হইবে। তাহাকে তৎক্ষেত্রে ‘ঝাল-রসা’ না বলিয়া ‘ঝাল-লাফরা’ বলিবে। কিন্তু তৎক্ষেত্রে লাফা-বেগুণ বা বিলাতী কুমড়া প্রভৃতি ইহার সহিত মিশাইয়া লাফরার ন্যায় ইহাও বেশ লপেট গোছ করিয়া লইবে।

 আর যদি তাহা লপেট গোছ না করিয়া বড়ী প্রভৃতি অনুষঙ্গ সহই ঝাল রাঁধিয়া তাহার রস শুকাইয়া লও, তবে তাহাকে ‘ঝালচড়চড়ী’ বলিবে।

 ঝাল-রসাতে লঙ্কা বাটা, জিরা-মরিচ বাটা, তেজপাত বাটা, ব্যবহার করিবে ধনিয়া বাটা ইচ্ছা করিলে ব্যবহার না করিলেও চলে। তবে ধনিয়া বাটা ব্যবহার করিলে তাহা ফোড়নের পরে তেলে ছাড়িয়া ভাজিয়া লইবে, অথবা পুর্ব্বে কাটখোলায় ভাজিয়া গুঁড়া করিয়া লইয়া জিরা মরিচ বাটা প্রভৃতি ঝালের সহিত এক সঙ্গে পরে মিশাইবে।

 ঝাল রসাতে করিলা প্রভৃতি তিক্তস্বাদ বিশিষ্ট আনাজ ব্যবহার করিবে না।

১৮৭। হিন্দুস্থানী ঝাল-লাফরা

 (ক) আলু, পটোল, বেগুণ, (গাভ-থোড়), বিলাতী কুমড়া (একটু ভাগে বেশী) লইয়া ডুমা ডুমা করিয়া কুট। একটু তেঁতুল জলে গুলিয়া রাখ। ঘৃতে বা তৈলে জিরা, তেজপাত, লঙ্কা ও হিঙ ফোড়ন দিয়া আনাজ ছাড়। আংসাও। ঢাকিয়া দাও। নরম হইলে নুণ হলুদ দিয়া একটু চিনি ও তেঁতুল গোলা মিশাও। জল শুকাইয়া গেলে নামাও। ইচ্ছা হইলে উপরে কাটখোলায় ভাজা ঝালের গুঁড়া ছড়াইয়া দাও। একটু ঘি মিশাও।

 কেবলমাত্র বিলাতী কুমড়া অথবা তৎসহ আলু দ্বারা এই হিন্দুস্থানী ঝাল-লাফরা রাঁধা হতে পারে। তেঁতুল গোলার পরিবর্ত্তে আমের চুণা ব্যবহার করিতে পার।

 (খ) আলু বেগুণ, শিম ডুমা ডুমা করিয়া কুটিয়া লও। তেলে হিঙ, জিরা ও রাই-সরিষা ফোড়ণ দিয়া আনাজ ছাড়। আংসাও। নুণ হলুদ দিয়া সামান্য জল দাও বা জল না দিয়াই ঢাকিয়া দাও। আনাজ নরম হইয়া আসিলে গরম মশল্লা ও আমচুর দিয়া নাড়িয়া চাড়িয়া নামাও।

 এখানে বারানসের এই ‘গরমমশল্লা’ ও ‘আমচুর’ সম্বন্ধে কিছু বক্তব্য আছে। এই ‘গরমমশল্লা’তে বাঙ্গলা দেশের গরমমশল্লার ভাজা গুঁড়ার সহিত ভাজা ধনিয়া, জিরা-মরিচ, লঙ্কা প্রভৃতির গুঁড়া মিশাইয়া থাকে।—দারচিনি ১ তোেলা, লবঙ্গ ১ তোলা, জৈত্রী ১ তোলা, জায়ফল ১ তোলা, ধনিয়া ১ তোলা, সা-জিরা ১ তোলা, জিরা ১ তোলা, গোলমরিচ ১ তোলা, তেজ পাত ১/২ তোলা, শুক্না লঙ্কা ১ তোল, শুক্না নারিকেল ২তোলা, শ্বেত তিল ২ তোলা এবং শুপারীর ফুল ও কথের (খয়েবের) ফুল কিছু লইয়া কাটখোলায় বা তেলে ভাজিয়া সব একত্রে গুঁড়া করিয়া লও। কাশীতে ইহা বাজারে কিনিতে পাওয়া যায়। কাঁচা আম কাটিয়া শুকাইয়া ঢেঁকিতে কুটিয়া লইয়া তৎসহ মুলতানী হিঙ ৩ মাষা, পাঞ্জাবী লঙ্কা (শুক্না) ৴৵৹ আধ পোয়া, কালা-লবণ ৴৴৹ এক ছটাক ও সৈন্ধব লবণ ৴৴৹ এক ছটাক, এই সব মশল্লার গুঁড়া মিশাইয়া ছাঁকিয়া আমচুর করা হয়। কাশীর রাইসরিষাও বাঙ্গলা দেশের মত নহে, তাহা ক্ষুদ্র দানাবিশিষ্ট—অন্য প্রকারের।

১৮৮। আলুর ঝাল

 উত্তম নইনীতালী আলু ডুমা ডুমা করিয়া কুটিয়া লও। তৈলে বা ঘৃতে কষাইয়া রাখ। দুটো ছোলা (বুট) ভিজাইয়া রাখ। কিছু গুলী ধানের আতপ চাউল জলে ভিজাইয়া রাখ। ঘণ্টা দুই মত পরে তাহা ঐ জলে কচলাইয়া সেই চেলেনী জলটুকু ছাকিয়া লও। (এই জল অধিক ঘন হইলে চলিবে না, তাহা হইলে ঝাল-রস সাদাটে বর্ণের হইবে এবং দঢ়াইয়া যাইবে অথচ অধিক পাৎলা হইলেও চলিবে না, তাহা হইলে ব্যঞ্জনের রঙ্গ, স্বাদ ও গাঢ়তা যথাযোগ্য হইবে না।) এক্ষণে ঘৃতে বা তৈলে জিরা, তেজপাত ও লঙ্কা ফোড়ন দিয়া লঙ্কা বাটা, ধনিয়া বাটা ও হলুদ বাটা (বা গুঁড়া) অল্প জলে গুলিয়া ঢালিয়া দাও। এই মশল্লা বেশ ভাজা ভাজা হইলে ঐ চেলেনী জল দাও। ফুটিলে কষান আলু ছাড়। ভিজান বুট ছাড়। সিদ্ধ হইলে জিরা-মরিচ বাটা ও তেজপাত বাটা মিশাও। একটু চিনি দাও। ঝাল-রস আবশ্যক মত ঘন হইয়া আসিলে নামাও। একটু গাওয়া ঘি মিশাও।

 ফোড়নের পরে ধনিয়া বাটা তেলে বা ঘৃতে ছাড়িয়া না ভাজিয়া পূর্বে কাটখোলায় ভাজিয়া গুঁড়া করিয়া লইয়া জিরা-মরিচ প্রভৃতির বাটার সহিত মিশাইয়া একত্রে জলে গুলিয়া পরে দিতেও পার।

 পটোলের ঝাল বা একত্রে আলু-পটোলের ঝাল, ওল, মান, খামাকচু, আনাজি কলার ঝাল, কাচা কাঁকুর, তরমুজ, শশা, ছাঁচী কুমড়া, কাঁকরোল, লাউর ঝাল, ঝুনা নারিকেলের ঝাল, যজ্ঞ-ডুমুরের ঝাল, স্কোয়াস, ফুলকোবি, ওল-কোরি, সালগম প্রভৃতির ঝাল এই প্রকারে কলাই শুটী বা বুট যোগে রাঁধিবে। আলু-পটোলের ঝালের সহিত আরও কাঁটালের বীচি মিশাইয়া একত্রে ঝাল রাঁধিতে পার।

 বলা বাহুল্য এক পটোল ছাড়া আর সমস্ত আনাজই ডুম ডুমা করিয়া কুটিয়া লইতে হইবে। আবশ্যকমত কোনও কোনও আনাজ ছোট ডুমা করিয়া কুটিবে অথবা কোনও আনাজ যথা কাঁচা কাঁকুর, তরমুজাদি একটু বড় বড় ডুমা করিয়া কুটিবে। পটোলের গায়ের ‘সবুজা’ বটি দিয়া চঁচিয়া উঠাইয়া ফেলিয়া, এবং ডগা দুইটুকু কাটিয়া ফেলিয়া বাধাইয়া দুই ফাঁক (এক দিকে এক ফাঁক ও অপর দিকে এক ফাঁক) করিয়া কুটিয়া লইতে হয়।

১৮৯। ইঁচড়ের (কাঁচা কাঁটাল) ঝাল

 কড়া অবস্থায় ইঁচড়ের যেমন চড়চড়ী ভাল হয়, ডাগর অবস্থায় তেমন তাহার ‘ঝাল’ ও ‘কালিয়া’ ভাল হয়। আবার অধিক ডাগর হইলে তাহার ঝাল, কালিয়া আর তেমন সুবিধা হয় না, তখন তাহার ‘ভাজি’ বা ‘আচার’ উত্তম হইয়া থাকে অথবা তখন তাহা অড়হরের ডাইলের বা পোলাওর মধ্যে ফেলিয়া রাঁধা যাইতে পারে। কাঁটাল পাকা অবস্থায় রাঁধাই যায় না, তখন তাহা ফলরূপে খাওয়া হয়।

 ডাগর ইঁচড় লইয়া অপেক্ষাকৃত ছোট ছোট ডুমা করিয়া কুটিয়া লও। একটু কড়া গোছের হইলে ভাপ দিয়া লইবে। ঘৃতে বা তৈলে জিরা, তেজপাত, দুটো মৌরী ও লঙ্কা ফোড়ন দিয়া ছাড়। আংসাও। নুণ হলুদ, লঙ্কাবাটা দিয়া চেলেনী জল দাও। ফুটিলে দুটো ভিজান ছোলা বা বড়ী (ভাজা) ভাঙ্গিয়া মিশাও। সিদ্ধ হইলে একটু চিনি দাও। ঈষৎ ঝাল-রস থাকিতে নামাইয়া জিরা-গোলমরিচ বাটা মিশাও। একটু গাওয়া ঘি মিশাও। ইচ্ছা করিলে ধনিয়া বাটা বা ভাজা ধনিয়ার গুঁড়াও এই ঝালে মিশাইতে পার।

১৯০। মোচার ঝাল

 মোচার ফুল-কলার ফুল ও চোঁচা ফেলিয়া ঈষৎ লম্বা ছাঁদে কুটিয়া লও। কাঁটালের বীচি ছুলিয়া লও উভয়ই ভাপ দিয়া জল গালিয়া ফেল। তেলে জিরা, তেজপাত, লঙ্কা ফোড়ন দিয়া মোচা ও কাঁটাল বীচি ছাড়। আংসাও। (মোচা বেশী আংসাইও না তাহা হইলে চিমড়া পানা হইয়া যাইবে)। নুণ (হলুদ) দিয়া চেলেনী জল দাও। সিদ্ধ হইলে বাটা ঝাল ও একটু চিনি দাও। ঝাল-রস ঈষৎ গাঢ় গোছ হইলে নামাইয়া লও। একটু ঘি মিশাও, এবং মোচার ব্যঞ্জন বিধায় কিছু বাটা গরমমশল্লাও মিশাইতে পার।

 ইহার সহিত ঝুনা নারিকেল কুচি কুচি করিয়া কুটিয়া মিশাইতে পার।

১৯১। কলমী শাকের ঝাল

 কলমী শাক নূতন উঠিলে তাহার কচি কচি ডগা ও পাতা বাছিয়া লও। মাষকলাইর বড়ি কষাইয়া বাখ। তেলে জিরা, তেজপাত ও লঙ্কা ফোড়ন দিয়া শাক ছাড়। আংসাও, (ঢাকিয়া দাও)। নরম হইলে নুণ দিয়া চেলেনী জল দাও। ফুটিলে ভাজা বড়ি ছাড়, সিদ্ধ হইলে জিরা-মরিচ বাটা, তেজপাত বাটা ও একটু চিনি দাও। ঝল-রস ঈষৎ ঘন হইলে নামাইয়া একটু গাওয়া ঘি মিশাও। বড়ির পরিবর্ত্তে বুট (ভিজান) অনুষঙ্গরূপে ব্যবহার করিতে পার।

 মটর শাক, পালং শাক, কণ্ঠে শাক, শান্তির শাক, শুশুনীর শাক, ঢাকা শাক, বিলাতী কুমড়ার শাক (অর্থাৎ কচি কচি ডগা ও কচি পাতা) প্রভৃতিরও এই প্রকারে ঝাল রাঁধা চলে।

 শাকের ঝালে শিম, বেগুণ, আলু, মটরশুঁটী, কাঁটালবীচি প্রভৃতি এক বা দুই প্রকারের আনাজ মিশান হইয়া থাকে।

১৯২। বেগুণের ঝাল

 বেগুণ লম্বালম্বি চারি ফলা করিয়া কুটিয়া লও। আলু ডুমা ডুমা করিয়া কুটিয়া তেলে কষাইয়া রাখ। তেলে জিরা, তেজপাত, লঙ্কা ফোড়ন দিয়া বেগুণ ছাড়। আংসাও। নুণ (হলুদ) ও বাটা ঝাল জলে গুলিয়া ঢালিয়া দাও। কষান আলু ও কষান মাষ বড়ি ছাড়। একটু চিনি দাও। সামান্য একটু পিঠালী দিয়া ঝোল কিছু থকথকে কবিয়া নামাও। ইচ্ছা করিলে আলু বাদ দিতেও পার।

১৯৩। গন্ধ-ভাদালীর ঝাল

 আমাশয়ের বা পেটের পীড়ায় রোগীকে অন্ন পথ্য দিবার সময়ে গন্ধ ভাদালীর পাতার ঝাল সহ ভাত দেওয়া হইয়া থাকে। সুতরাং ইহাতে লঙ্কার সংস্পর্শ অদৌ করিবে না এবং অপরাপর মশল্লাও যথাসম্ভব কম পরিমাণে ব্যবহার করিবে, তৈলের পরিবর্ত্তে ঘৃত ব্যবহার করিবে, এবং আনাজ প্রভৃতিও কচি দেখিয়া লইবে। পটোল, বেগুণ, গাভথোড়, আনাজি কলা, থোক্‌সা-ডুমুর প্রভৃতি লইয়া ছোট ছোট করিয়া কুটিয়া লও। তেজপাত ফোড়ন দিয়া আনাজ ছাড়। আংসাও। নুণ (হলুদ) সহ চেলেনী জল দাও। সিদ্ধ হলে সামান্য চিনি দাও। জিরা-মরিচ বা পিপুল (ও দুটো কালজিরা) গন্ধ-ভাদালীর পাতার সহিত একত্রে জল দিয়া বাটিয়া লইয়া ঢালিয়া দাও। ঝোল ঘন হইয়া আসিলে নামাও। সামান্য একটু গাওয়া ঘি মিশাও।

১৯৪। বিলাতী কুমড়ার বীচির শাঁসের ঝাল

 বিলাতী কুমড়ার বীচি সংগ্রহ করিয়া খূঁটিয়া তাহাব শাঁস বাহির করিয়া লও। পাটায় বাট। হাতে টিপিয়া ছোট ছোট দলা পাকাইয়া ফুটন্ত জলে ছাড়িয়া সিদ্ধ করিয়া জল-বড়া বাঁধ। জল-বড়ায় নুণ, (হলুদ) মাখিয়া তৈলে বা ঘৃতে অল্প কষাও। দলা বড় বড় হইলে সিদ্ধ পর চাকু দ্বারা ডুম ডুমা করিয়া কাটিয়া লইয়া ঘৃতে ভাজিবে। আলু ডুমা ডুমা করিয়া কুটিয়া কষাইয়া রাখ। কলাইশুঁটী থাকিলে তাহাও ছাড়াইয়া রাখিতে পার, অথবা বুট ভিজাইয়া রাখিতে পার। এক্ষণে তৈলে বা ঘৃতে জিরা, তেজপাত, লঙ্কা ফোড়ন দিয়া ধনিয়া বাটা ও লঙ্কা বাটা একত্রে অল্পজলে গুলিয়া ছাড়। আংসাও। বেশ ভাজা ভাজা হইলে চেলেনী জল দাও। ফুটিলে বীচির জল-বড়া, আলু ও বুট বা কড়াইশুঁটী ছাড়। নুণ দাও। সিদ্ধ হইলে জিরা-মরিচ বাটা ও একটু চিনি দাও। ঝাল-রস গাঢ় হইয়া আসিলে নামাও। একটু গাওয়া ঘি মিশাও।

 মটর, খেসারী ও বুটের ডাইলের জলবড়া (পাণিদলা বা ধোকা) এবং ছানা প্রভৃতির ঝাল এই প্রকারে রাঁধিবে। তবে অবশ্য ছানা আর পূর্ব্বে জলে সিদ্ধ করিয়া লইবার প্রয়োজন করে না।

১৯৫। পেঁপের ঝাল

 কাঁচা পেঁপে লইয়া খোসা ছড়াইয়া বীচি ফেলিয়া দিয়া ভুনা ভুনা করিয়া কুট। বুট ভিজাইয়া রাখ। পেঁপে একটু জলে ভাপ দিয়া লও। জিরা, তেজপাত ফোড়ন দিয়া পেঁপে ছাড়। আংসাও। ঈষৎ লালচে মত হইলে নুণ (হলুদ) দিয়া চেলেনী জল দাও। ফুটিলে ভিজান বুট ছাড়। সিদ্ধ হইলে একটু চিনি দাও। রস ঘন হইয়া আসিলে জিরা-গোলমরিচ বাটা, তেজপাত বাটা মিশাইয়া নামাও। একটু গাওয়া ঘি মিশাও।

 অনেকে নামাইয়া আবার তিল বা পোস্ত বাটা মিশাইয়া থাকেন। ইহা প্রায় রোগীর পথ্য রূপে ব্যবহৃত হয় বলিয়া ইহাতে লঙ্কা সংস্পর্ষ করা হয় না।

১৯৬। মুগ ডাইলের ঝাল

 কাঁচা বা বালুতে ভাজা মুগ ডাইল লও। আলু ডুমা ডুমা করিয়া কষাইয়া রাখ। ঘৃতে জিরা, তেজপাত ও লঙ্কা ফোড়ন দিয়া ডাইল ছাড়। আংসাও। নুণ, (হলুদ) দিয়া চেলেনী জল দাও। ফুটিলে আলু ছাড়। সিদ্ধ হইলে জিরামরিচ বাটা ও একটু মিষ্ট দাও। ঝাল-রস বেশ থকথকে হইলে নামাও। একটু গাওয়া ঘি মিশাও।

১৯৭। ফুলকোবির ঝাল-চড়চড়ী

 ফুল-কোবি নাতিবৃহৎ ডালে বিভক্ত করিয়া কুটিয়া ধুইয়া লও; ডাঁটা . অধিক লম্বা থাকিলে কাটিয়া ছোট করিয়া লও। ইচ্ছা করিলে এতৎসহ আল ডুমা ডুমা করিয়া কুটিয়া লইতে পার এবং কলাইশুঁটী ছাড়াইয়া লইতে পার মাষকলাইর বড়ি ভাজিয়া রাখ। তৈলে জিরা, তেজপাত ও লঙ্কা ফোড়ন দিয়া আলু ও কোবি ছাড় (অথবা আলু পূর্ব্বেই কষাইয়া রাখিলে ভাল হয়। আংসাও। নুণ (হলুদ) দিয়া অল্প চেলেনী জল দাও। (অর্থাৎ জল এতটুকু দিবে যেন জল শুইয়া লইলে সিদ্ধ কোবি বেশ গোটাই থাকিবে-গলিয়া যাইবে না।) ফুটিলে কলাই শুঁটী ও বড়ি (ভাঙ্গিয়া) মিশাও। সুসিদ্ধ হইলে জিরা-মরিচ বাটা, তেজপাত বাটা মিশাও। বেশ শুকাইয়া লইয়া নামাও।

 ক্ষুদ্র ডুমাকারে কুটিয়া সালগম, ওলকোবি, স্কোয়াস এবং আলু, পটোল, কুমড়া প্রভৃতির ঝাল-চড়চড়ী কষান বড়ি বা মৎস্য যোগে এই প্রকার রাঁধিবে।

 বিশেষ দ্রষ্টব্য,—বরেন্দ্রে সাধারণতঃ নিরামিষ ঝাল, বস্তুতঃ অধিকাংশ নিরামিষ ব্যঞ্জনই, বিনা হলুদে এবং আমিষ ব্যঞ্জন হলুদযোগে রাঁধা হইয়া থাকে এবং তাহাই প্রশস্তও বটে। তবে স্থলবিশেষে এই সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটিয়া থাকে। আবার কোন কোন নিরামিষ ব্যঞ্জন হলুদ দিয়া রাঁধিলেই যেন তাহার স্বাদ অধিক পরিস্ফুট হয় সুতরাং সেগুলি হলুদ যোগেই রাঁধা কর্তব্য।

ঝাল (আমিষ)

১৯৮। রুই মাছের ঝাল

 ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাছের যেমন ‘ঝোল’ ভাল হয়— রুই প্রভৃতি মোটা মাছের তেমনই ‘ঝাল’ উত্তম হইয়া থাকে। ক্ষুদ্র মাছের ঝোলে সাধারণতঃ আনাজাদি কোনও অনুষঙ্গ দেওয়া হয় না, কিন্তু মোটা মাছের ঝালে বিবিধ আনাজ এবং মাষকলাইর বড়ি প্রভৃতি অনুষঙ্গরূপে দেওয়া যায়। এক এক প্রকার মাছের ঝালে এক এক প্রকার আনাজ দেওয়া হইয়া থাকে। রুই মাছের ঝালে আলু, পটোল, শিম, বেগুন (গৃহস্থী বা কড়ুই), মূলা, কাঁটাল বীচি প্রভৃতি আনাজ সাধারণতঃ ব্যবহৃত হইয়া থাকে। এতন্মধ্যে বাছিয়া দুই প্রকার আনাজের বেশী একসঙ্গে দেওয়ার আবশ্যকতা নাই। যথা,—আলু-পটোল, আলু-বেগুণ, শিম-বেগুণ, মূলা-বেগুণ, পটোল-কাঁটালবীচি প্রভৃতি। হালি আনাজ ফুলকোবি, ওলকোবি, সালগম, স্কোয়াস, মটর শুটী, বীন প্রভৃতিও দেওয়া যাইতে পারে।

 প্রণালীর সামান্য কিছু তারতম্যে রুই আদি মাছের ঝাল তিন-চারি প্রকারে রাঁধা যাইতে পারে।

 (ক) ‘গাদা’ ‘পেটী’ ভেদে মাছ কুটিয়া লও। মুড়া, ফিছা, কণ্ঠা প্রভৃতি ও লইবে, (অনেকে মুড়ার দ্বারা পৃথক ভাবে শুকনা শুকনা করিয়া ঝাল রাঁধিয়া থাকেন।) নুণ, হলুদ মাখ। মাষকলাইর বড়ি তেলে কষাইয়া তোল। উপরোক্ত মত বাছিয়া দুই প্রকারের আনাজ লইয়া পৃথক ভাবে তেলে কষাইয়া রাখ। অতঃপর তেলে জিরা, তেজপাত, লঙ্কা ফোড়ন দিয়া মাছ ছাড়। আংসাও। লঙ্কা বাটা ও ধনিয়া বাটা অল্প জলে গুলিয়া ঢালিয়া দাও। আংসাও। সুগন্ধ বাহির হইলে নুণ হলুদ দিয়া জল দাও। ফুটিত কষান আনাজ এবং তৎপর কষান বড়ি (গোটা) ছাড়। সিদ্ধ হইলে জিরা-মরিচ বাটা, (তেজপাত বাটা, পিপুল বাটা) এবং পিঠালী একত্র অল্প জলে গুলিয়া ঢালিয়া দাও। পিঠালী আলাহিদা জলে গুলিয়া ও ঢালিয়া দিতে পার। ‘ঘণ্টে’ পিঠালীর ভাগ যেমত অধিক দিতে হয় ঝাল ও কালিয়াতে তাদৃশ হয় না—অল্প পরিমাণে দিলেই চলে। ‘রস’ অপেক্ষাকৃত গাঢ় হইলে নামাও। নামাইয়া একটু ভাজা রাঁধনীর গুঁড়া মিশাইতে পার।

 (খ) মাছ উপরোক্ত ভাবে কুটিয়া লইয়া নুণ, হলুদ মাখিয়া উত্তপ্ত তৈলে কষাইয়া তোল। (তৈল উপযুক্তরূপে উত্তপ্ত না হইলে তাহাতে মাছ ছাড়িলে মাছ ভাঙ্গিয়া যাইবে ও ছোবা ছোবা হইবে। এ সম্বন্ধে ইতিপূর্ব্বে ‘ভাজি’ অধ্যায়ে বিস্তারিত লিখা হইয়াছে। পক্ষান্তরে অধিক উত্তপ্ত তৈলে মাছ ছাড়িলে তেল জ্বলিয়া উঠিতে পারে অথবা মাছ পুড়িয়া যাইতে পারে তাহাও স্মরণ রাখিতে হইবে।) বাছিয়া দুই প্রকারের আনাজ ও মাষকলাইর বড়ি লইয়া পৃথক পৃথক ভাবে তেলে কষাইয়া রাখ। পরে পুনঃ তেলে জিরা, তেজপাত, লঙ্কা ফোড়ন দিয়া লঙ্কা বাটা ও ধনিয়া বাটা ছাড়িয়া কষাও। ভাজা মশলার বেশ সুগন্ধ বাহির হইলে নুণ হলুদ দিয়া জল দাও। ফুটিলে কষান মাছ ছাড় ও তৎপর কষান আনাজ ও বড়ি (গোটা) ছাড। সিদ্ধ হইলে জিরামরিচ বাটা, (তেজপাত বাটা, পিপুলবাটা ও পিঠালী একত্র অল্প জলে গুলিয়া ঢালিয়া দাও। পিঠালী অবশ্য আলাহিদাও দিতে পার। ঝাল রস অপেক্ষাকৃত গাঢ় হইলে নামাও। ইচ্ছা করিলে কিছু ভাজা রাঁধনীর গুঁড়া জল দিয়া বাটিয়া লইয়া মিশাইবে।

 (গ) মাছ উপরোক্ত ভাবে কুটিয়া লইয়া নুণ, হলুদ মাখিয়া উত্তপ্ত তেলে কষাইয়া রাখ। দুই প্রকারের আনাজ ও মাষকলাইর বড়ি পৃথক পৃথক তেলে কষাইয়া রাখ। পুনঃ তেলে ধনিয়া বাটা ও লঙ্কা বাটা ছাড়িয়া কষ। ভাজা মশল্লার সুবাস বাহির হইলে নুণ হলুদ সহ জল দাও। ফুটিলে কষান মাছ ও পশ্চাৎ কষান আনাজ ও বড়ি (গোটা) ছাড়। সিদ্ধ হইলে জিরা-মরিচ বাটা, (পিপুল বাটা, তেজপাত বাটা) ও পিঠালী মিশাও। নাড়িয়া চাড়িয়া নামাও। এক্ষণে পুনঃ তেলে জিরা, তেজপাত ও লঙ্কা ফোড়ন দিয়া রাধা মাছ সম্বারা দিয়া লও। নামাইয়া ইচ্ছা করিলে কিছু ভাজা রাঁধনীর গুঁড়া জল দিয়া বাটিয়া লইয়া মিশাইতে পার।

 (ঘ) মাছ উপরোক্ত ভাবে কুটিয়া লইয়া নুণ, হলুদ মাখ। দুই প্রকারের আনাজ ও মাষকলাইর বড়ি তেলে পৃথক্ পৃথক্ কষাইয়া রাখ। তৎপর তেলে জিরা, তেজপাত, লঙ্কা ফোড়ন দিয়া মাছ ছাড়। আংসাও। নুণ হলুদ দিয়া জল দাও। ফুটিলে কষান আনাজ ও বড়ি (গোটা) ছাড়। সিদ্ধ হইলে জিরা-মরিচ বাটা, (তেজপাত বাটা, পিপুল বাটা) ও পিঠালী জলে গুলিয়া ঢালিয়া দাও। নাড়িয়া চাড়িয়া রস অপেক্ষাকৃত গাঢ় হইলে নামাও। নামাইয়া কাটখোলায় ভাজা ধনিয়া ও রাঁধনীর গুঁড়া একত্রে জল দিয়া পাটায় একটু বাটিয়া লইয়া মিশাও।

 ধনিয়া এবং রাঁধনী কাঁচা বাটিয়া দিলে তাহার স্বাদ ব্যঞ্জনে ভাল মত সংক্রমিত হয় না। এই নিমিত্ত উহা কাঁচা বাটিয়া মিশান স্থলে যাহাতে তৈলে, বা ঘৃতে একটু ভাজা হইতে পারে তাহার ব্যবস্থা করিতে হয়। কিন্তু ইহাতে তৈল বা ঘৃতের খরচ কিছু অধিক হয় সুতরাং তন্নিমিত্তও বটে এবং নিত্য ঝাল বাটার শ্রমের লাঘবের জন্যও বটে, গৃহস্থ বাটীতে সাধারণতঃ ধনিয়া এবং রাঁধনী পূর্ব্বে কাটখোলায় ভাজিয়া পাটায় পিষিয়া মিহি গুঁড়া করিয়া কাপড়ে ছাঁকিয়া ভাঁড়ে করিয়া উঠাইয়া রাখা হয়। রন্ধন কালে এই ভাজা ঝালের গুঁড়া আবশ্যক মত বাহির করিয়া একটু জল দিয়া পাটায় বাটিয়া লইয়া জিরা-মরিচাদির ঝাল সহ একত্রে বা পৃথক ভাবে পাক শেষে ব্যঞ্জন নামাইয়া বা নামাইবার অব্যবহিত পূর্ব্বে দেওয়া হয়।

 যাহাতে ভাজা ঝালের সুগন্ধ উপিয়া গিয়া অপচয় না হয়, অথবা স্যাঁতা লাগিয়া শীঘ্র নষ্ট না হয় তজ্জন্য উহা তৈলে বা ঘৃতে ‘পাকান’ মাটির ভাঁড়ে রাখিয়া উত্তমরূপে তাহার মুখ একখানা ‘মুচির’ দ্বারা ঢাকিয়া পুনঃ এক খণ্ড ন্যাকড়ায় ভাঁড়ের মুখ বাঁধিয়া শুষ্ক স্থানে উঠাইয়া রাখা হয়। কিন্তু জিরা-মরিচ সম্বন্ধে তদ্রুপ করা হয় না,—উহা প্রতিবারে রন্ধন কালে টাটকা বাটিয়া লইয়া ব্যঞ্জন নামাইবার অব্যবহিত পুর্ব্বে বা পরে মিশান হইয়া থাকে। তাহার কারণ, জিরা ঐরূপ ভাবে কাটখোলায় ভাজিয়া তুলিয়া রাখিলে তাহার সুবাস অধিক দিন স্থায়ী হয় না এবং উহার কাঁচা-সদ্যবাটা অবস্থার আস্বাদনই উত্তম; অপিচ ফোড়ন রূপে ভাজা অবস্থাতেও উহা ব্যঞ্জনে পড়িয়া থাকে, সুতরাং পুনঃ উহা কাটখোলায় বা ঘৃতে ভাজিয়া লইয়া মিশাইলে ব্যঞ্জনের স্বাদের আর কিছুমাত্র উন্নতি হয় না। গোলমরিচ কাট-খোলায় বা ঘৃতে ভাজিয়া দিলে তাহার স্বাদেরও ব্যত্যয় ঘটে।

 আর একটি বিষয় লক্ষ্য করিতে হইবে, কাঁচা জিরা-মরিচ বাটা এবং কাটখোলায় ভাজা ধনিয়া, লঙ্কা প্রভৃতি ঝাল ব্যঞ্জন রন্ধন শেষ হইয়া তাহা নামাইবার অব্যবহতি পুর্ব্বে বা পরে মিশান কর্ত্তব্য। কেন না অধিকক্ষণ সিদ্ধ করিলে কাঁচা জিরা-মরিচ বাটার সুবাস এবং ভাজা ধনিয়া, লঙ্কা প্রভৃতির গুঁড়ায় সুবাস উপিয়া যাইয়া অপচয় ঘটে সুতরাং তদ্দ্বারা ব্যঞ্জন আর যথেষ্ট অনুবাসিত হয় না। অপরন্তু কাটখোলায় ভাজা ঝাল ঘৃতে বা তৈলে আর পুনঃ কষান কর্ত্তব্য নহে, কেন না একবার যাহা ভাজা হইয়াছে পুনর্ব্বার তাহা কষাইলে (ভাজিলে) তাহার সুবাস সম্পূর্ণরূপে উপিয়া যাইয়া কেবল তাহার সিটা মাত্র অবশিষ্ট রহিবে।

 পাকা রুই, চিতল প্রভৃতি মোটা মাছের ‘ঝাল’ রাঁধিতে জিরা-মরিচের ঝাল সহ লঙ্কা, ধনিয়া, তেজপাত, পিপুল এবং রন্ধনী প্রভৃতি সর্ব্ব প্রকারের বাটা ঝাল মিশাইলে তবে আস্বাদন উৎকৃষ্ট হইয়া থাকে। রাঁধনী অবশ্য ভাজিয়া গুঁড়া করিয়া লইয়া সর্ব্বপশ্চাৎ মিশাইতে হয়। নিরামিষ ঝালে এবং অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মৎস্যের ঝালে কেবল মাত্র জিরা-মরিচের বাটা ঝাল মিশাইলেই যথেষ্ট হয়।

 কষান মোটা মাছ অল্পাধিক ভাঙ্গিয়া ঝাল ঘাঁধিলে উত্তম হয়।

 কাৎলা কালবাউস, মৃগেল, মহাশোল, সারঙ্গ পুঁটী প্রভৃতি মোটা মাছ এবং চিতল, আইড়, বোয়াল, ঢাঁই (সিলঙ্গ), গাগর, রিঠা, বাচা প্রভৃতি তৈলাক্ত মোটা মাছ এবং সামুদ্রিক ভেটকী, ভাঙ্গন, সবলী, তুলাদণ্ডী, চাদা (পমফ্রেট), সুর (মেকরেল) প্রভৃতি মাছের এই প্রকারে ঝাল রাঁধা যাইতে পারে। চিতল, বোয়াল, ভেটকী, সুর প্রভৃতি তৈলাক্ত মাছের ঝালে দুটো কালজিরা অতিরিক্ত ফোড়ন দিবে।

১৯৯। চিতল মাছের ঝাল

 চিতল, বোয়াল, ঢাঁই (সিলঙ), আইড়, গাগর, রিঠা, বাচা প্রভৃতি তৈলাক্ত মোটা মাছের ঝাল রুই মাছের ঝালের ন্যায়ই জিরা-মরিচ বাটা, লঙ্কা বাটা, ধনিয়া বাটা, পিপুল বাটা, তেজপাত বাটা, রাঁধনী (ভাজা) বাটা প্রভৃতি সর্ব্বপ্রকার বাটা ঝাল দিয়া পাক করিবে। কেবল ফোড়নে দুটো কালজিরা (এবং দুটো মেথি) অতিরিক্ত ফোড়ন দিবে এবং মাছ অল্পমাত্র কষাইয়া বা এককালে না কষাইয়া বাঁচা মাছই একছের ফুটন্ত ঝোলে ছাড়িয়া রাঁধিবে।

 এই সব তৈলাক্ত মোটা মাছ রুই মাছের মত গাদা পেটি ভেদে বিভক্ত করিয়া কুটিতে হয় না, এগুলি এড়োভাবে কেবল দুই বা তিন অঙ্গুলী পুরু রাখিয়া গাদা পেটি সহ প্রতিখণ্ড কুটিয়া লইতে হয়। কেবল চিতল মাছের শিরদাঁড়ার উপর দিকের অর্দ্ধেকটা গাদার মাছ কাটিয়া ফেলিতে হয়। এইরূপভাবে কর্তিত মৎস্যখণ্ডগুলিকে বরেন্দ্রে ‘শিঙড়ী’ কহে। পেটের দিকের শিঙড়ী অপেক্ষা ফিঁছার দিকের শিঙড়ীই অধিক তৈলাক্ত ও উপাদেয়। আইড় মাছ রুই মাছের ন্যায়ই কুটা হয়। কিন্তু রুই মাছের বিপরীতে পেটি অপেক্ষা ইহার গাদার মাছই অধিক তৈলাক্ত ও সুস্বাদু।

 আইড়ের ফিঁছার দিক হইতে কাটিয়া যে সম্পূর্ণ চাত্রাকার মাছ বাহির হয় সেই ‘চাকা’ সমধিক সুস্বাদু। রুই অপেক্ষা এই সকল তৈলাক্ত মাছের ঝালে মাষকলাইর হিঙ-বড়ি অধিক মজে সুতরাং এই সব মাছের ঝালে প্রচুর পরিমাণে মাষকলাইর হিঙ-বড়ি দেওয়া হইয়া থাকে। আইড়াদিতে মুলা, বেগুণ, শালুক, মান প্রভৃতি আনাজ ভাল মজে।

 অপরাপর তৈলাক্ত মোটা মাছ এবং সামুদ্রিক চাঁদা (পম্‌ফ্রেট), সুর (মেক্‌রেল), ভাঙ্গন, এবং ভেটকী প্রভৃতিও এই প্রকারে রাঁধিবে।

২০০। কৈ মাছের ঝাল

 সুপুষ্ট দেখিয়া কৈ মাছ সংগ্রহ কর। মাছ গোটা রাখিয়া কুটিয়া লও। মাছের গাত্রে দুই এক স্থানে পাথাইল বা আড় ভাবে সামান্য চিরিয়া লইতে পার। নুণ হলুদ মাখ। কচি লাউ লইয়া ডুমা ডুমা করিয়া কুটিয়া কষাইয়া লও। যদি পাওয়া যায় নুতন আলুও কুটিয়া কষাইয়া রাখিতে পার। মাষকলাইর হিঙ-বড়ি কিছু বেশী পরিমাণে লইয়া কষাইয়া রাখ। তৈলে জিরা, তেজপাত, লঙ্কা ও মেথি ফোড়ন দিয়া মাছ ছাড়। আংসাও। লঙ্কা বাটা, হলুদ বাটা বা গুড়া ও নুণ দিয়া জল দাও। ফুটিলে কষান বড়ি (গোটা) এবং কষান লাউ ও নুতন আলু ছাড়। (আলু ও লাউ পৃথক ভাবে দিয়াও ঝাল রাঁধিতে পার।) সিদ্ধ হইলে জিরা-মরিচ বাটা, তেজপাত বাটা ও ইচ্ছা করিলে তৎসহ পিপুল বাটা ও একটু পিঠালি দিয়া ঝালরস ঈষৎ গাঢ় করিয়া নামও। ইচ্ছা করিলে ভাজা রাঁধনীয় গুঁড়াও মিশাইতে পার।

 কার্ত্তিক, অগ্রহায়ণ ও পৌষ মাসে যখন কৈ-মাছ বেশ সুপুষ্ট হয় এবং যখন লাউ ও আলু নূতন উঠে এবং যখন মাষকলাইর বড়ি নূতন প্রস্তুত হয় তখন সেই কৈ মাছের ঝাল রাঁধিয়া খাইলে তবে তাহার প্রকৃত আস্বাদন বুঝা যাইবে।

২০১। মাগুর মাছের ঝাল

 মাগুর মাছ কুটিয়া নুণ হলুদ মাখ। আলু ও কচি পটোল বা বেগুণ কষাইয়া রাখ। তৈলে তেজপাত ও জিরা ফোড়ন দিয়া মাছ ছাড়। আংসাও। নুণ হলুদ দিয়া জল দাও। ফুটিলে কষান আনাজ ছাড়। সিদ্ধ হইলে জিরামরিচ বাটা, পিপুল বাটা, তেজপাতা বাটা দাও। অতঃপর পিঠালী দিয়া ঝাল রস কিছু ঘন করিয়া নামাও।

 কানচ বা শিঙী এবং নহলা প্রভৃতি মাছের ঝালও এইরূপে রাঁধিবে।

 এবম্বিধ মাছের ঝাল রোগীর ও শিশুর পথ্যরূপে ব্যবহৃত হইয়া থাকে, সুতরাং ইহাতে লঙ্কার সংস্পর্শ করিবে না এবং বড়ি প্রভৃতি গুরুপক্ব দ্রব্যও অনুষঙ্গরূপে ব্যবহার করিবে না। তবে অমনি রাঁধিয়া খাইলে অবশ্য ইহাতে লঙ্কা ফোড়ন ও অল্প লঙ্কা বাটা ব্যবহার করিতে পার। সোমরাজী ফোড় দিয়া রাঁধিলে মাগুর মাছের ঝালের স্বাদ সুন্দর হয়।

২০২। ইলিশ মাছের ঝাল

 তাজা ইলিশ মাছ কুটিয়া নুণ হলুদ মাখ। আলু, আনাজি কলা, কাঁঠাল বীচি খামাকচু, পটোল, কুমড়া, শশা, ডাঁটা প্রভৃতি অর্থাৎ বর্ষাকালের এই সব আনাজ মধ্যে কোন দুইটা বাছিয়া লইয়া কুট। কষাইয়া রাখ। ইলিশ মাছে লাউ আদৌ মজে না। মাষ-বড়ি কষাইয়া রাখ। অল্প তৈলে (ইলিশ প্রায়শ তৈলাক্ত হয় বলিয়া তৈল অল্প ব্যবহার করিতে হয়) জিরা, তেজপাতা, লঙ্কা ও দুটো মেথি বা কালজিরা ফোড়ন দিয়া মাছ ছাড়। একটু এপিট ওপিট করিয়া কষিয়াই লঙ্কা বাটা, হলুদ বাটা বা গুঁড়া জলে গুলিয়া ঢালিয়া দাও। ফুটিলে কষান গোটা বড়ি ও আনাজ ছাড়। সিদ্ধ হইলে, জিরা-মরিচ বাটা ও তেজপাত বাটা এবং একটু পিঠালী দিয়া ঝোল সামান্য ঘন করিয়া নামাও। ইলিশ মাছের ঝাল অধিক গাঢ় হইলে স্বাদ খারাপ লাগিবে। মাছ আদৌ না কষাইয়া কাঁচাই ফুটন্ত ঝোলে ছাড়িয়াও ঝাল রাঁধিড়ে পার।

 পাঠক পাঠিকা লক্ষ্য করিবেন ‘ঝাল’ পর্য্যায়ভুক্ত হইলেও বোয়ালদি তৈলাক্ত মাছ এবং কৈ, ইলিশ এবং লাউ সহ চিংড়ী মাছের ঝালে দুটো মেথি ফোড়ন দেওয়া হইতেছে, সুতরাং এই সব হলে সাধারণ নিয়মের কিঞ্চিৎ ব্যতিক্রম ঘটিতেছে। পক্ষান্তরে তেমনই কুমড়ার এবং পাঁচমিশালী আনাজের নিরামিষ ডাল-ফেলানি ঝোলে জিরা ফোড়ন দেওয়া যায়। মেথির পরিবর্ত্তে কালজিরা ফোড়ন জিরার সহিত চলে।

২০৩। চিঙড়ী মাছের ঝাল

 কচি লাউ ডুমা ডুমা করিয়া কুটিয়া কষাইয়া রাখ। চিংড়ী মাছে নুন হলুদ মাখ। তৈলে জিরা, তেজপাত, লঙ্কা ও দুটো মেথি ফোড়ন দিয়া মাছ ছাড়। আংসাও। ধনিয়া বাটা, লঙ্কা বাটা ও হলুদ বাটা একত্রে অল্প জলে গুলিয়া ঢালিয়া দাও। আংসাও। মশল্লার সুগন্ধ বাহির হইলে জল দিয়া নুণ দাও। ফুটিলে কষান লাউ ছাড়। জল কমিয়া আসিলে জিরা-মরিচ বাটা, তেজপাত বাটা ও একটু চিনি দাও। পরে পিঠালী দিয়া ঝোল ঘন করিয়া নামাও। ইচ্ছা হইলে লাউয়ের সহিত গাভথোড় বা দুটো ভিজান ছোলা মিশাইয়াও ঝাল বঁধিতে পার। কাঁকড়ার ঝাল এইরূপে রাঁধিবে।

২০৪। লাউ-শোল

 লাউ ডুমা ডুমা করিয়া কুটিয়া কষাইয়া রাখ। মাষকলাই বড়ি ভাজিয়া রাখ। শোল মাছের ছাল ছাড়াইয়া ছোট ছোট করিয়া কুট। নুণ হলুদ মাখ। তেলে জিরা, তেজপাত, লঙ্কা ফোড়ন দিয়া মাছ ছাড়। আংসাও। লংঙ্কা বাটা, ধনিয়া বাটা অল্প জলে গুলিয়া ঢালিয়া দেও। আংসাও। নুণ হলুদ দিয়া আর একটু জাল দেও। ফুটিলে কষান লাউ ও বড়ি ছাড়। সিদ্ধ হইলে জিরা-মরিচ বাটা, তেজপাতা বাটা, একটু চিনি ও পিঠালী দিয়া থক্‌থক করিয়া নামও।

২০৫। শোল মাছের কলাপতু

 শোল মাছের ছাল ছাড়াইয়া ছোট ছোট করিয়া কুটিয়া লও। নুণ (হলুদ) মাখ। বুট ভিজাইয়া রাখ। আলু ছোট ছোট ডুমাকারে কুটিয়া তেলে কষাইয়া রাখ। ঘৃতে, অভাবে তেলে জিরা, তেজপাতা, লঙ্কা ফোড়ন দিয়া মাছ ছাড়। আংসাও। ধনিয়া বাটা ও লঙ্কা বাটা অল্প জলে গুলিয়া ঢালিয়া দাও। আংসাও। ভাজা মশলার সুগন্ধ বাহির হইলে চেলেনী জলে নুণ (হলুদ) গুলিয়া ঢালিয়া দাও। ফুটিলে কষান আলু ও বুট (ভিজান) ছাড়। সিদ্ধ হইলে জিরা-মরিচ বাটা, তেজপাত বাটা ও একটু চিনি দিয়া ঝাল রস গাঢ় গোছ হইলে নামাও। একটু গাওয়া ঘি মিশাও। ইচ্ছা করিলে ধনিয়া পূর্ব্বেই কাটখোলায় ভাজিয়া গুঁড়া করিয়া লইয়া জিরা-মরিচ প্রভৃতি বাটনার সহিত একত্রে জল দিয়া একটু বাটিয়া লইয়া মিশাইতে পার।

 চেলেনী জলের পরিবর্ত্তে নারিকেল দুগ্ধ দিয়াও রাঁধিতে পার।

 বাইম মাছের ‘কলাপতু’ এই প্রকারে রাঁধিবে।

২০৬। মনোমোহিনী[১] ঝাল-চড়চড়ী

 এই ঝাল-চড়চড়ীতে আনাজের মধ্যে কেবল মাত্র আলু, বেগুণ, (বোঁটার দিকের অংশ দ্বারাই ভাল হয়), গাভ থোড় ও বিলাতী (মিঠা) কুমড়া ব্যবহৃত হইয়া থাকে, এবং ইহা পাকা রোহিতাদি মৎস্যের মুড়া-কাঁটা-গাদা যোগে রাঁধা হইয়া থাকে। ইহার আস্বাদন প্রকৃতই মন মোহন করে। অনাজ ডুমা ডুমা করিয়া কুটিয়া পৃথক পৃথক ভাবে তৈলে কষাইয়া লও। রুই মাছের মুড়া-কাঁটা-গাদাও তেলে কষাইয়া লও। ঘৃতে জিরা, তেজপাত, কালজিরা ও লঙ্কা ফোড়ন দিয়া কষান মাছ ও আনাজ ছাড়। নুণ, হলুদ ও লঙ্কা বাটা দিয়া জল দাও। সিদ্ধ হইলে মুড়া ভাঙ্গিয়া দিয়া জিরা-মরিচ বাটা ও তেজপাত বাটা মিশাও। শুকনা শুকনা করিয়া নামাও। ইচ্ছা করিলে একটু ভাজা রাঁধুনীর গুড়া মিশাইতে পার।


  1. আমার ৺মাসীমাতা মহাশয়ায় নিকট আমার স্ত্রী এই রান্নাটি শিখিয়াছিল সুতরাং তাঁহার নামেই ইহার নামকরণ করা গেল।