বাঁশী/অষ্টম পরিচ্ছেদ

অষ্টম পরিচ্ছেদ।

 পরদিন বেলা নয়টার পর শুনিলাম, প্রাণকৃষ্ণবাবু বিবাহের জিনিষ-পত্র কিনিবার জন্য কলিকাতায় যাইবেন। তাহার সঙ্গে ভোলা ও আর আর চাকরগুলিও যাইবে। আমার শরীর অসুস্থ ছিল বলিয়া, বাবু আমায় সঙ্গে লইতে ইচ্ছা করিলেন না।

 এদিকে শুনিলাম, বাড়ীর গৃহিণী, তাহার পুত্র ও সুধাকে লইয়া নিকটস্থ এক আত্মীয়ের বাড়ী নিমন্ত্রণ রক্ষা করিতে যাইবন। তাহার সহিত দুইজন দাসীও যাইবে। বাড়ীতে কেবল আমি, দ্বারবান ও একজনমাত্র দাসী থাকিবার কথা হইল।

 সুযোগ উপস্থিত হওয়ায়, আমি আন্তরিক সন্তুষ্ট হইলাম। ভাবিলাম, এই সুযোগে প্রাণকৃষ্ণ বাবুর ঘটা দেখিতে পাইব।

 আহারাদির পর কর্তা দল-বল সমেত বাহির হইলেন। গিন্নিও তার কিছু পরেই সুধা ও তাহার আদরের পুত্রকে লইয়া নিমন্ত্রণ রক্ষার্থ গমন করিলেন। আমার অসুখ হইয়াছে প্রচার করিয়া- ছিলাম, সুতরাং সেখানে কোনরূপ আহার না করিয়া বাজারে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। সেখানে একটা দোকানে বসিয়া আহার করিয়া গৃহে ফিরিলাম। পরে বিশ্রামের আশায় একস্থানে শয়ন করিলাম।

 বেলা প্রায় দুইটা বাজিল। বাড়ীর দরোয়ান ও সেই দাসী অকাতরে ঘুমাইতেছিল। বাড়ীতে জন প্রাণীর সাড়া নাই। আমি তখন গাত্রোথান করিলাম; এবং ধীরে ধীরে তেতলায় যাইলাম। দেখিলাম, প্রাণকৃষ্ণ বাবুর ঘর বন্ধ। ঘরের দরজায় দুইটী তালা লাগান রহিয়াছে। আমার কাছে তালা খুলিবার যন্ত্র ছিল, অনায়াসে দুইটী তালাই খুলিয়া ফেলিলাম এবং কোন শব্দ না। করিয়া আস্তে আস্তে ঘরের ভিতর প্রবেশ করলাম। দেখিলাম, ঘরটা প্রকাণ্ড। কিন্তু দুই ভাগে বিভক্ত। মধ্যে এক কাঠের ব্যবধান। তাহার মধ্যে একটা ক্ষুদ্র দরজা। সেই দরজা পার হইয়া ঘরের অপর অংশে যাইলাম। দেখিলাম, সেখানে তিনটা বড় বড় সেকেলে সিন্দুক। সিন্দুকের নিকট বোতলে করা দুগ্ধ, এক কাঁদি সুপক্ক রম্ভা, তিনটা কাচের বাটীতে অল্প অল্প দুধ। দুধের উপর এক একটী রম্ভা। ইচ্ছা ছিল, সিন্দুক গুলি খুলিয়া দেখি। কিন্তু অনেক চেষ্টা করিয়াও উহাদিগকে খুলিতে পারিলাম না।

 ঘরের ভিতর আর কোন আশ্চর্য দ্রব্য দেখিতে পাইলাম না। অপর অংশে বড় বড় গোটাকতক আলমারি। আলমারিগুলির মধ্যে পুরাতন খাতায় পরিপূর্ণ। ঘরের পাঁচ ছয়খানি চেয়ার, দুইখানি কোচ, একখানা প্রকাও আয়না, থানকতক বিলাতী ছবি, একটী প্রকাণ্ড ঘড়ি ও একটা আলনা রহিয়াছে। আমি প্রত্যেকটা বিশেষ করিয়া পরীক্ষা করিলাম, কিন্তু কোন সন্ধান পাইলাম না। তখন সেই নল দুইটীর নিকট যাইলাম। দেখিলাম, নলের মুখ ঢাকা। মুখের আবরণ খুলিয়া ফেলিলাম, পকেট হইতে দুরবীণটা বাহির করিয়া বেশ করিয়া দেখিলাম। নলের মুখ খোলা হইলে এক প্রকার আমিষ গন্ধ বাহির হইল। সেই গন্ধে আমার আনন্দ হইল। আমি যাহা সন্দেহ করিয়াছিলাম, এখন তাহা সত্য বলিয়া ধারণা হইল; এবং সেই রাত্রেই রহস্য ভেদ করিতে মনস্থ করিলাম।

 প্রায় আধ ঘণ্টার মধ্যেই এই সকল কার্য সমাপন করিয়া আমি প্রাণকৃষ্ণ বাবুর ঘরের দরজা পূর্বের মত বন্ধ করিলাম এবং নিজের জায়গায় আসিয়া আবার শয়ন করিলাম।