বাঁশী/সপ্তম পরিচ্ছেদ
সপ্তম পরিচ্ছেদ।
সুধাকে তখন আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলাম না। দুইটা ঘর পরীক্ষা করিতে প্রায় একঘণ্টার উপর কাটিয়া গেল। সুধাকে আর রাত্রি জাগরণ না করাইয়া, আমি তাহাকে তাহার ঘরে রাখিয়া বাহিরে আসিলাম। আসিবার সময় সুধাকে বলিলাম, “আজ তোমার দাসী নাই। তোমাকে একাই এখানে শুইতে হইবে। কিন্তু মা! তোমার কোন ভয় নাই। আজ আমি সমস্ত রাত্রি এইখানেই থাকিব। কোনরূপ ভয় পাইলে শীঘ্র দ্বার খুলিয়া ঘরের বাহিরে আসিবে, আমি নিকটেই রহিলাম।”
সুধার ইচ্ছা ছিল, অপর কোন দাসীকে তাহার ঘরে লইয়া আসিবে, কিন্তু আমি তাহাকে নিষেধ করিলাম। বলিলাম, “এত রাত্রে কোন দাসীকে ডাকাডাকি করিলে তুমি এতক্ষণ কোথায় ছিলে একথা উঠিতে পারে, তাহা হইলে হয়ত আমার কথা প্রকাশিত হইয়া পড়িবে। “
সুধা আমার কথা বুঝিতে পারিল। সে ভীত হইয়া একাই সে ঘরে রাত্রি যাপন করিতে সম্মত হইল এবং আমি গৃহ হইতে।
বাহির হইলে দ্বার বন্ধ করিয়া দিল। আমিও নিকটে এক নিভৃত স্থানে বসিয়া রহিলাম।
রাত্রি ১২টা বাজিয়া গেল। দুই একটা আলো ছাড়া বাড়ীর আর সকল আলোকই নিভিয়া গেল। আমিও চুপ করিয়া সেইখানে বসিয়া আছি, এমন সময়ে উপরে কাহার পদশব্দ শুনিতে পাইলাম। এত রাত্রে উপরে কে বেড়াইতেছে, জানিবার জন্য আমি গাত্রোখান করিলাম। একবার মনে হইল, সুধার কাকা কোন কারণ বশতঃ বাহিরে আসিয়াছেন, কিন্তু তাহা হইলে তাহার ঘরের দরজা খোলার শব্দ পাইতাম। বিশেষতঃ আজ তাহার শরীর অসুস্থ। যতই এই বিষয় ভাবিতে লাগিলাম, ততই আমার সন্দেহ বাড়িতে লাগিল। আমি তখন আর স্থির থাকিতে পারিলাম না। আস্তে আস্তে তেতলায় উঠিলাম। |
চারিদিক অন্ধকার। একটা মাত্র আলোক মিটু মিট করিয়া জ্বলিতেছিল। আমি সেই সামান্য আলোকে দেখিলাম, একজন লোক দালানে ধীরে ধীরে বেড়াইতেছে। লোকটাকে পূর্বে কখনও দেখি নাই। ভাল চিনিতে পারিলাম না।
আমি সুধার কাকার ঘরের দরজা হইতে প্রায় দশ হাত দূরে একটা কোণে আসিয়া দাঁড়াইলাম। লোকটা খানিকক্ষণ এদিক ওদিক বেড়াইয়া, প্রাণকৃষ্ণ বাবুর ঘরের দরজার নিকট দাঁড়াইল। খানিকক্ষণ নিস্তব্ধভাবে দাঁড়াইয়া কি যেন ভাবিতে লাগিল। পরে আস্তে আস্তে কপাটে ঘা মারিতে লাগিল।
তৎক্ষণাৎ ঘরের দরজা খুলিয়া গেল। ঘরের ভিতর হইতে প্রাণকৃষ্ণ বাবু বাহির হইলেন এবং অতি মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমায় যাহা বলিয়াছিলাম, তাহার কি হইল?” আগস্তুকও চুপি চুপি উত্তর করিল, “আপনার হুকুম কবে অমান্য করিয়াছি?”
প্রা। আনিয়াছ?
অ। আনিয়াছি।
প্রা। কোথায়?
অ। বলেন ত আপনার কাছে আনি।
প্রা। যাও, শীঘ্র আন।
আ। সিঁড়ির উপরে রাখিয়াছি;—এখনই আনিতেছি।
এই বলিয়া লোকটা ব্যস্ত-সমস্ত হইয়া সিঁড়ির কাছে গেল। পরে একটা বাঁশের চুবড়ী লইয়া পুনরায় প্রাণকৃষ্ণ বাবুর নিকট আনিল। বলিল, “এই আনিয়াছি। কোথায় রাখিব বলুন?”
দেখিলাম, লোকটার কথায় প্রাণকৃষ্ণ বাবু সন্তুষ্ট হইলেন। তিনি বলিলেন, “ঘরের ভিতরেই রাখ।”
লোকটা তাহাই করিল। সে সেই চুবড়ীটাকে ঘরের ভিতর রাখিয়া বলিল, “এ জিনিষটা বড় ভয়ানক। ঘরের ভিতর এ সকল জিনিষ রাখা ভাল নয়। আপনার ছেলেপিলের ঘর; তাই ভয় করে।”
প্রাণকৃষ্ণ হাসিয়া উঠিলেন। বলিলেন, “অত ভয় করিলে কোন কাজ হয় না। তা ছাড়া, এ ঘরে আসিবার কাহারও অধিকার নাই। এই যে এতকাল আমার ঘরে এই সকল জিনিষ রহিয়াছে, কেহ ঘুণাক্ষরেও কিছু জানিতে পারিয়াছে কি?”
লো। আজ্ঞা না। বলিহারি যাই আপনার বুদ্ধিকে। এমন, না হলে কি কাজ হয়। তবে আমায় বিদায় করুন।’
প্রা। আজই? লো। আজ্ঞা। এ সব কাজ হাতাহাতিই ভাল। কি জানি, কবে কি হয় বলা যায় না।
প্রা। ভাল-আজ এত রাত্রিতে আর গোলযোগে কাজ নাই। কাল প্রাতেই হইবে।
লো। আপনার সঙ্গে দিনের বেলায় দেখা করা আমার ভাল দেখায় না। লোকে নানা রকম সন্দেহ করিতে পারে। তাই বলিতেছি, আজই আমায় বিদায় করুন।
প্রা। জিনিষটা না দেখিয়া—
লো। তবে কি আপনি আমায় অবিশ্বাস করেন? আপনি কি মনে করেন, আমি আপনাকে ঠকাইতেছি।
প্রা। না না, সে কথা মনে করি না। তোমার সঙ্গে আমার এই প্রথম কারবার নয়।
লো। আমিও তাই বলিতেছিলাম। তখন প্রাণকৃষ্ণ বাবু ঘরের ভিতর হইতে কি আনিয়া লোকটার হাতে দিলেন। সে সন্তুষ্ট হইয়া সেখান হইতে চলিয়া গেল। প্রাণকৃষ্ণ বাবুও আবার ঘরের দরজা বন্ধ করিয়া বিশ্রাম করিতে লাগিলেন। আমিও আর সেখানে থাকা যুক্তিসিদ্ধ নয় বিবেচনা কবিয়া, নামিয়া আসিলাম এবং এক গোপনীয় স্থানে লুকাইয়া রহিলাম।
লোকটা কোথা হইতে আসিল, কেনই বা এত রাত্রে জমীদার বাবুর সহিত সাক্ষাৎ করিল। সেই চুবড়ী করিয়া কি আনিল। তাহাকে দেখিয়া সন্ন্যাসীর ন্যায় বোধ হইয়াছিল। এই গভীর, রাত্রে সন্ন্যাসীর সহিত প্রাণকৃষ্ণের প্রয়োজন কি?; বিশেষতঃ আজ তঁহার শরীর অসুস্থ বলিয়া শীঘ্র শীঘ্র বিশ্রাম করিতে গিয়াছেন। এই সকল প্রশ্ন আমার মনোমধ্যে উদিত হইল। সমস্ত রাত্রি আমি এই সকল বিষয় ভাবিতে লাগিলাম।
এইরূপ চিন্তা করিতে করিতে রাত্রি প্রায় তিনটা বাজিয়া গেল। আমি সে রাত্রি আর কোনরূপ গোলযোগের সম্ভাবনা নাই ভাবিয়া, এক প্রকার নিশ্চিন্ত হইয়াছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে আমার তন্দ্রাও আসিয়াছিল, এমন সময়ে সহসা সুধার গৃহদ্বার খুলিয়া গেল এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে এক আশ্চর্য্য বংশীরব আমার কর্ণগোচর হইল। আমি তখনই লম্ফ দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলাম। দেখিলাম, সুধা অত্যন্ত ভীত হইয়া আমারই দিকে আসিতেছে। আমি তাহাকে তদবস্থ দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “কি হইয়াছে মা? আজও কি সেই রকম ভয় পাইয়াছি?”
সুধা কপিতে কঁপিতে বলিল, “মহাশয়, আজ আবার সেই রকম শব্দ শুনিয়াছি। আমার নিশ্চয় বোধ হইতেছে, আমি আর বাঁচিব না। দিদিও মৃত্যুর আগে তিন চারিদিন এই রকম শব্দ শুনিয়াছিল।”
আমি তাহাকে শান্ত করিলাম। বলিলাম, “মা! আর কখনও তোমার এ রকম শব্দ শুনিতে হইবে না। আমি এ রহস্য শীঘ্রই ভেদ করিব। আজ তুমি ভিতরে যাও। রাত্রি প্রায় সাড়ে তিনটা বাজিয়াছে। কিন্তু আজিকার ভয়ের কথা যেন আর কেহ জানিতে না পারে। তোমার কোন ভয় নাই। আমি কালই তোমার ভয়ের প্রকৃত কারণ বাহির করিব।”
আমার কথা শুনিয়া সুধা বলিল, “আপনি কি আজ সমস্ত রাত্রি জাগরণ করিয়া আছেন?”
আ। হাঁ মা! আমি যখন যে কার্য্যে নিযুক্ত হই, তখন তাহা শেষ না করিয়া বিশ্রাম করিতে যাই না। আর এক কথা, তোমার খুড়ার সহিত কোন সন্ন্যাসীর আলাপ আছে কি?
সু। কেন? এ কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন কেন?
আ। আগে আমার কথার উত্তর দাও, তার পরে আসি সকল কথা বলিতেছি।
সু। আমার খুড়া সন্ন্যাসীদিগকে ভক্তি করেন। সন্ন্যাসী দেখিলেই তিনি যত্ন করিয়া তাহাদের সেবা করেন।
আ। কখনও তোমার খুড়াকে কোন সন্ন্যাসীর সহিত গোপনে পরামর্শ করিতে দেখিয়ছ?
সু। যখনই তিনি কোন সন্ন্যাসীর সহিত কথা কহিতে ইচ্ছা করেন, তখনই তিনি গোপনে তাহার সহিত আলাপ করেন।
আ। কেন জান?
সু। না-কাকিমা বলেন, তিনি ঐ সন্ন্যাসীদিগের নিকট হইতে অনেক উপকার পাইয়াছেন। শুনিয়াছি, উহাদের ঔষধ ধারণ করিয়াই কাকিমা পুত্র প্রসব করিয়াছেন।
আ। তোমার কাকার ঘরটা একবার দেখাইতে পার?
সু। কাকার ঘর! সে ঘরে কাকি-মারও যাইবার অধিকার নাই।
আ। তুমি কি কখনও সে ঘরে যাও নাই?
সু। না।
আ। কেন? সে ঘরে কি আছে?
সু। দরকারি দলিল আছে। আঁ। জমীদারীর কাগজপত্র সরকারের নিকট থাকে না কেন? সু। সরকারের কাছেও আছে। তবে খুব দরকারী কাগজপত্র সব নিজের কাছেই রাখেন।
আ। একবার আমায় সে ঘরটা দেখিতে হইবে। যদি কাল কোনরূপ সুবিধা হয় আমায় খবর দিও।
এই বলিয়া সুধাকে বিদায় দিলাম। সে তাহার দিদির ঘরে শুইতে গেল। আমিও বাহিরে আসিয়া একস্থানে শয়ন করিলাম।