বাঁশী/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।
সুধার সহিত আমার যখন দেখা হইল, তখন রাত্রি প্রায় দশটা। বাড়ীর গৃহিণী পুত্রকে লইয়া শয়ন করিয়াছেন। কর্ত্তা অনেকক্ষণ পূর্ব্বেই বিশ্রাম করিতে গিয়াছেন। বাড়ীর আর আর চাকর দাসীও যে যাহার ঘরের মধ্যে গিয়াছে। দুই দ্বারে দুইখানা নহবৎ বসিয়াছে। শানাইদার বেহাগ গাহিয়া খানিক আগেই দলবল সমেত চলিয়া গিয়াছে।
বাড়ী নিস্তব্ধ। সুধা আমায় প্রথমে তাহার দিদির ঘরে লইয়া গেল। আমি তাহার সহিত সেই ঘরের ভিতর গিয়া, দরজা বন্ধ করিয়া দিলাম।
ঘরের চারিদিক উত্তমরূপে পরীক্ষা করিম; কিন্তু বিশেষ কিছু বাহির করিতে পারিলাম না। ঘরখানি নিতান্ত ছোট নয়। দৈর্ঘ্যে প্রায় বার হাত, প্রস্থেও দশ হাতের কম নয়। ঘরের ভিতর একখানি পালঙ্ক ছিল, কিন্তু তাহাতে কোন শয্যা ছিল না। তা ছাড়া সেখানে একটী দেরাজ, দুইটী আলমারি ও আটখানি ছবিও ছিল। ছবিগুলি সমস্তই হিন্দু দেবদেবীর প্রতিমূর্তি।
ঘরে চারিটী জানালা ও একটী দরজা। এ ছাড়া বাহির হইতে ভিতরে আসিবার আর কোন পথ ছিল না। কেবল ঘরের এক কোণে উপরের ঘরের সহিত সংলগ্ন একটা মােটা নল ছিল। নলটী বাস্তবিকই ঘরের শোভা নষ্ট করিয়াছে। কারণ উহা ছাদ ভেদ করিয়া ঘরের মেঝে হইতে প্রায় দেড় হস্ত দূরে আসিয়া শেষ হইয়াছে। ঘরের ভিতর এ রকম ভাবে নল রাখা আর কখনও দেখি নাই। অনেক লোকের ঘর দেখিয়াছি,—রাজাধিরাজের প্রাসাদ হইতে দরিদ্রের কুটীর পর্যন্ত সমস্তই আমার দেখা হইয়াছে; কিন্তু এরূপ ভাবে ঘরের ভিতর নল রাখিতে আর কাহাকেও দেখি নাই। আমি আশ্চর্য হইয়া সুধাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “এই নলটী কোন কাজে লাগে?
সু। উহা দিয়া উপরের জল বাহির হয়।
আ। এ ঘরের জল বাহির হইবার পথ কোথায়?
সু। সে নলটা ঘরের উত্তর দিকের কোণে আছে।
অ। আমি ত দেখিতে পাইলাম না।
সু। না পাইবার কারণ আছে। নলের মুখটা প্রায়ই ঢাকা। থাকে। আপনি ঐ কোণের একখানি মার্বেল পাথর তুলিলেই দেখিতে পাইবেন।
সুধার কথামত কার্য্য করিলাম। দেখলাম, সুধা যাহা বলিয়াছিল তাহা সত্য। আমি তখন আরও আশ্চর্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “এ নলের মুখটা ঢাকা কেন?”
সু। 'কাকার হুকুম।
আ। সে কিরূপ?
সু। কাকার অনুমতি ছাড়া ঐ নলের মুখ খোলা হয় না। যেদিন উপরের ঘর ধৌত করা হয়, সেইদিন তাহার অনুমতি বইয়া ঐ নলের মুখও খোলা হয়।
অ। উপরের ঘর হইতে জল পড়িলে এই ঘরের মেঝেও জলময় হইয়া থাকে?
সু। হাঁ; কিন্তু সে সময় এ ঘর ও ধৌত হয়। আ। উপরের নলটী ঘরের মেঝের নিকট পর্যন্ত নামিল না কেন? অতটা যায়গা ফাঁক রাখিবার প্রয়োজন কি?
সু। সে কথা আমি বলিতে পারিলাম না।
আ। এখন যেখানে পালঙ্কখানি রহিয়াছে, ঐ স্থানেই কি উহা পূর্ব্বেও ছিল?
সু। হুঁ। আ। তুমিও পূর্বে এই ঘরে বাস করিতে, বলিয়াছ না? তোমরা কি উভয়ে একই শয্যায় শয়ন করিতে?
সু। না—আমারও এখানে এই রকম একখানি পালঙ্ক ছিল। আমি তাহাতেই শয়ন করিতাম।
আ। এখন সেখানি কোথায়?
সু। আমার শোবার ঘরে।
আ। তোমার দিদির বিছানার নিকটেই ঐ নলটা ছিল বোধ হইতেছে, কেমন?
সু। হাঁ আপনি ঠিক বলিয়াছেন। আমি আরও খানিকক্ষণ নলটা পরীক্ষা করিলাম। পরে সুধাকে বলিলাম, “এইবার তোমার শোবার ঘরে লইয়া চল।”
সুধা ঘরের দরজা খুলিয়া একবার চারিদিক লক্ষ্য করিল এবং কাহাকেও দেখিতে না পাইয়া আমায় সঙ্গে লইয়া তাহার শয়নগৃহে প্রবেশ করিল। আমি ভাবিয়াছিলাম, সুধার দাসী সেই ঘরে থাকিবে কিন্তু গৃহের ভিতর যাইয়া কাহাকেও দেখিতে পাইলাম না। তখন সুধাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আজ তোমার দাসী কোথায় গেল? শুনিয়াছিলাম, সে তোমারই ঘরে নিদ্রা যায়।”
সু। হাঁ, সে এইখানেই শোয়, কিন্তু আজ তাহার কি প্রয়োজন আছে ঠিক জানি না। সে সন্ধ্যার পর এ বাড়ী হইতে চলিয়া গিয়াছে।
অ। তবে কি সে তোমাদের চাকরি ছাড়িয়া দিল?
সু। না না, সে তেমন নয়; কাকা তাহাকে অনেকবার দুর করিয়া দিয়াছিলেন, কিন্তু সে আমায় ছাড়িয়া আর কোথাও যাইতে চাহে না।
আ। তবে আজ সে কোথায় গেল?
সু। শুনিয়াছি, তাহার দেশ হইতে কোন আত্মীয় আসিঘাছে। বোধ হয়, সে তাহারই সহিত দেখা করিতে গিয়াছে।
আ। আজই ফিরিবে কি?
সু। না, কাল প্রাতে এখানে আসিবার কথা আছে।
অ। তবে ভালই হইয়াছে। এই বলিয়া আমি সেই ঘর ও ভাল করিয়া দেখিতে লাগিলাম। এ ঘরখানি পূর্বেকার ঘর অপেক্ষা ছোট। দৈর্ঘ্যে প্রায় দশ হাত, প্রস্থেও প্রায় আট হাত হইবে। কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, এ ঘরেও পূর্বের মত একটা নল ছাদ ভেদ করিয়া মেঝে হইতে প্রায় দেড় হস্ত উপর পর্যন্ত আসিয়া শেষ হইয়াছে।
সে ঘরেও ঐ প্রকার নল দেখিয়া, আমার কেমন সন্দেহ হইল। আমি সুধাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “এ বাড়ীর সকল বরেই কি এই রকম নল আছে?”
সু। না, কেবল এই দুইটা ঘরে
অ। তোমার ঘরের এই নলটা কতদিন আগে বসান হইয়াছে? সু। সম্প্রতি।
অ। কত দিন আগে মনে নাই?
সু। প্রায় তিন চারি মাস হইবে।
আ। সে সময় তুমি কোথায় শুইতে?
সু। দিদির ঘরে।
আ। তখন কোন শব্দ শুনিতে পাইয়াছিলে?
সু। কই, না।
আ। সে সময় কি তুমি একা শুইতে?
সু। না, আমার দাসীও আমার কাছে থাকিত।
আ। এ ঘরে নল বসান কেন হইল, বলিতে পার?
সু। না-সে কথা কাকাকে কে জিজ্ঞাসা করিবে? আর জিজ্ঞাসা করিলেও কাকা কোন উত্তর করিতেন না।
অ। কেন?
সু। তিনি বলেন, আমার বাড়ী, আমি যাহা ইচ্ছা করিব, অপরের তাহাতে কোন ক্ষতি বৃদ্ধি নাই।
আ। তখন তোমার বিবাহের কোন কথা হইয়াছিল কি? বিবাহের নাম শুনিয়া সুধার মুখ লজ্জায় রক্তিমবর্ণ ধারণ করিল। সে ঘাড় হেঁট করিয়া হাতের নখ খুটিতে লাগিল, মুখে কোন উত্তর করিল না।
সুধাকে লজ্জিতা দেখিয়া আমি অতি নম্রভাবে বলিলাম, মা! আমি তোমার পিতার মত। বিশেষতঃ তোমার ভাবী শ্বশুরের কথায় এই কার্য্যে নিযুক্ত হইয়াছি। আমার কাছে কথা বলিতে লজ্জা কি? সকল কথা না জানিতে পারিলে আমি এ কার্যে সফল হইতে পারিব না।” আমার কথা শুনিয়া সুধা মুখ তুলিল, এবং অল্প হাসিতে হাসিতে মৃদুস্বরে বলিল, “যে দিন আমার বিবাহের কথা উত্থাপন হয়, তাহারই দুই দিন পরে এই নল বসান হইয়াছিল।”
অ। এ নলটাও কি উপরের ঘরের জল বাহির করিবার জন্য বসান হইয়াছে?
সু। হাঁ, কাকা এইরূপই বলিয়া থাকেন।
আ। ইহার উপরে কাহার ঘর?
সু। কাকার।
আ। তোমার দিদির ঘরের উপরে কাহার ঘর?
সু। কাকার। অ। তবে তোমার কাকার কয়টী ঘর? সু। একটা। ঘরটী বড়; আমাদের দুজনের ঘরের সমান।
আ। সে ঘরের জল বাহির হইবার ত পথ ছিল, তবে সবার। এ নলটা বসান হইল কেন?
সু। কাকা বলেন, একটী পথে সমস্ত জল বাহির হইবার সুবিধা হয় না।
আ। এ বড় আশ্চর্য্য কথা! এতকাল এক পথ দিয়াই ত জল বাহির হইতেছিল।
সু। কার সাধ্য তাহার কথার উপর কথা কহিবে।
আ। আর একটা কথা। দেখিতেছি, তোমার ও বিছানা নলের নিকট রহিয়াছে। তুমি কি ইচ্ছা করিয়া তোমার পালঙ্ক খনি ঐ স্থানে রাখিয়াছ?
সু। না না, উহাও আমার কাকার হুকুম।
আ। কেন? তিনি কি বলেন? সু। তিনি বলেন, ঐখানে বিছানা থাকিলে লোকে সহসা নলটী দেখিতে পাইবে না। তাঁহার কথা নিতান্ত মিথ্যা নয়? আমার বিছানা প্রায় মসারি ঢাকা থাকে, সুতরাং নলও কেহ দেখিতে পায় না।