বাঁশী/পঞ্চম পরিচ্ছেদ

পঞ্চম পরিচ্ছেদ।

 বাড়ীতে অনেকগুলি চাকর ছিল; কিন্তু ভোলা ভিন্ন অর কাহারও অন্দরে যাইবার অধিকার ছিল না। গৃহিণী ভোলাকে পুত্রাধিক স্নেহ করিতেন।

 যে কাজে আমি লাগিয়াছি, তাহাতে অন্দরে যাইতে না। পাইলে আমিও কিছুই করিতে পারিব না। ভোলাকে অগত্যা সেই কথা বলিলাম। ভোলা গৃহিণীর নিকট হইতে আমার অন্দরে যাইবার অনুমতি আনিল।

 প্রথমে আমি ভোলার সঙ্গে অন্দরে প্রবেশ করিলাম। ভোলা আমাকে সকলকার ঘর দেখাইয়া দিল। আমি সরকার মহাশয়ের হুকুমত কাজ করিতে করিতে সময়মত ঘরগুলি লক্ষ্য করিতে লাগিলাম। কিন্তু ইতিমধ্যে একবারও সুধাকে দেখিতে পাইলাম না। সন্ধানে জানিলাম, সুধা নিকটেই কোন ব্রাহ্মণের বাড়ী খাইতে গিয়াছে।  সন্ধ্যার পর আমি অন্দর হইতে বাহির হইতেছি, এমন সময়ে জমীদার মহাশয়কে অন্দরে আসিতে দেখিলাম। তাহাকে দেখিতে কাল, অতান্ত বলিষ্ঠ ও গজস্কন্ধ। তাঁহার বয়স চল্লিশের উপর। লোকটাকে দেখিয়াই ভয়ানক দুষ্ট বলিয়া বোধ হইল।

 আমাকে দেখিয়াই তিনি রাগিয়া উঠিলেন। বলিলেন, “তুমি কে হে বাপু? অন্দরে কি করিতেছিলে?”

 কথাগুলি বড় কর্কশ, শুনিয়া আমার বড় রাগ হইল। অবশেষে সাহস করিয়া উত্তর করিলাম, “আমি নতুন চাকর। অজি ভর্ত্তি হইয়াছি।”

 জ। তোমার নাম কি? কোথা হইতে আসিয়াছ?

 আ। আমার নাম সদানন্দ। সম্প্রতি চাকরি না থাকায় এখানে আসিয়াছি।

 জ। অন্দরে আসিয়াছ কেন? কে তোমায় অন্দরে আসিতে বলিল?

 জা। আজ্ঞে, গিন্নীমার হুকুম পাইয়াছি।

 জ। সত্যি না কি? কিন্তু বাপু তুমি সাবধান হইয়া কাজ করিও। তোমার মুখ যেন আমার চেনা বলিয়া বোধ হইতেছে। তোমায় ভদ্রলোক বলিয়া আমার অনুমান হইতেছে। যদি কোন রকম কু-মৎলব থাকে, সরে পড়। কেন বাপু-গরিবের ছেলে, শেষে কি মারা যাইবে?

 আমি যেন অত্যন্ত ভীত হইলাম। ভয়ে কঁপিতে কাপিতে হাতজোড় করিয়া বলিলাম, “না হুজুর! আমার কু-মৎলব কি? খাইতে না পাইয়া আপনার দ্বারস্থ হইয়াছি।”

 জমীদার মহাশয় আমার কথায় আরও গরম হইলেন। বলি-

লেন, “তোমার মত অনেক দেখিয়াছি। এ বয়সে আর আমার দেখিতে কিছু বাকি নাই। যাও এখনকাজ দেখ গে। কিন্তু সাবধান! আমি যে সে লোক নই। গ্রামের সকলে আমায় বাঘের মত ভয় করে। আমার সহিত কোন রকম চাতুরী করিলে মারা যাইবে।”

 এই বলিয়া জমীদার মহাশয় ভিতরে গেলেন, আমিও বাহিরে আসিয়া ভোলাকে সকল কথা বলিম। ভোলা বলিল, “বাবু কি আর কখনও আপনাকে দেখিয়া ছিলেন?”

 আমি বলিলাম, 'কই, আমার ত মনে পড়ে না। কিন্তু তিনি যে রকম ভাবে কথা বলিলেন, তাহাতে বোধ হয়, তিনি আমায় পূর্ব্বে কোথাও দেখিয়া থাকিবেন।”

 ভোলা বলিল, “আপনি সে সন্দেহ করিবেন না।

 বাবু। সকলকেই ঐ কথা বলিয়া থাকেন। তাহার কথাই ঐরূপ কর্কশ।”

 ভোলার কথায় আমি সন্তুষ্ট হইলাম। পরে জিজ্ঞাসা করিলাম, “সুধা আসিয়াছে?”

 ভো। হাঁ, আসিয়াছে।

 আ। একবার আমাকে তাহার সহিত দেখা করিয়া দিতে পারি?

 ভো। এখন নহে। বাবুর আজ শরীর বড় ভাল নয়। তিনি এখনই বিশ্রাম করিতে যাইবেন।