নবম পরিচ্ছেদ।

 সন্ধ্যার কিছু পূর্বে শুনিলাম, বাবুর শরীর বড় অসুস্থ। আগেই তাহার শরীর খারাপ ছিল; বিশেষত, সেদিন কলিকাতা নানা কার্য্যে ঘুরিয়া তিনি আরও অসুস্থ হইয়াছিলেন। সুতরাং সান্ধ্য জলযোগ করিয়া সন্ধ্যার পরই বিশ্রাম করিতে গেলেন।

 গৃহিণী যখন নিমন্ত্রণ রক্ষা করিয়া আসিলেন, তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে। তিনিও খানিক পরেই পুত্রকে লইয়া। শয়ন-গৃহে গমন করিলেন। সুধাও দাসীর সহিত আপনার ঘরে বিশ্রাম করিতে গেল।

 আমি তখন ভোলার নিকট গিয়া বলিলাম, “ভোলা! একটা কাজ করতে পারবি?”

 ভোলা আমার কথায় আশ্চর্য্য হইল। বলিল, “এখানে আপনার এমন কি কাজ?”

 আ। পারবি কি না বল?

 ভো। আপনার কাজ করিব না ত কার কাজ করি।? কি করিতে হইবে বলুন?

 আ। একবার সুধাকে ডাকতে পারিস?

 ভো। এই কাজ? এখনই ডাকিতেছি।

 এই বলিয়া ভোলা বাড়ীর ভিতর গেল। খানিক পরে ফিরিয়া আসিয়া বলিল, “সুধা শুইয়াছিল, অনেক কষ্টে তাহাকে ডাকিয়া তুলিয়াছি। আপনি আসুন।”

 আমি সুধার সহিত দেখা করিলাম। বলিলাম, “অজি কি তুমি এই ঘরেই শুইবে?”

 সু। তা না হইলে আর কোথায় শুইব?

 আ। কেন, তোমার দিদির ঘরে?

 সু। কাকা জানিতে পারিলে আমার উপর রাগ করিবেন।

 আ। তোমার দাসী কোথায়?

 সু। সে ঘুমাইয়াছে?

 আ। এই ঘরেই আছে নাকি?

 সু। হাঁ, এই ঘরেই শুইয়া আছে।

 আ। দাসী কি তোমার বিশ্বাসী?

 সু। হাঁ। ঐ দাসীই আমায় মানুষ করিয়াছিল। ও আমায় মায়ের মত ভালবাসে।  আ। তবে এক কাজ কর। দাসীকে লইয়া আজ তোমার দিদির ঘরে যাও। আমরা আজ এ ঘরে থাকিব।

 সু। যদি কাকা জানিতে পারেন?

 আ। তোমায় সে ভয় করিতে হইবে না। আমি পুলিসের লোক, তোমার কাকাকে বড় ভয় করি না।

 সু। আপনি করিবেন কেন? আমাকে ত ভয় করিতে হইবে। আমার অন্যায় দেখিলে বাড়ী হইতে দুর করিয়া দিবেন।

 আ। তিনি অন্য উপায়ে সেই চেষ্টাই করিতেছেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, কাল প্রাতে সমস্তই প্রকাশিত হইবে। তোমার দিদি যে কেবল ভয়েই মারা পড়িয়াছিল, তাহা সম্পূর্ণ মিথ্যা। হয়ত কাল প্রতেই পাঁচ জনে তাহা জানিতে পারিবে। এখন আমি যাহা বলি, কর। তোমার দাসীকে আমার কথা না বলিয়া, এখান হইতে তোমার দিদির ঘরে লইয়া যাও। আজিকার মত সেই ঘরেই শয়ন কর। কিন্তু দেখিও, যেন আজ আর কেহ এ বিষয় জানিতে না পারে। এখন বাড়ীর সকলেই বিশ্রাম করিতে গিয়াছে। সুতরাং আমার বিশ্বাস, এ কথা কেহই জানিতে পারিবে না। তবে তোমার দাসীকেও তুমি সাবধান করিয়া দিও

 সুধা আর কোন কথা বলিল না। সে ঘরের ভিত যাইয়া দাসীকে ডাকিতে লাগিল। আমি ভোলাকে লইয়া আবার বাহিরে আসিলাম।

 খানিক পরে ভোলা জিজ্ঞাসা করিল, “তবে আমি শুই গে?”

 আমি হাসিতে হাসিতে বলিলাম, “সে কি! এরই মধ্যে বুঝি কাজ শেষ হয়ে গেল? এখনও বল, আজ আমার সঙ্গে রাত্রি জাগিতে পাবি কি না?”  ভোলা অপ্রতিভ হইল। সেও লজ্জার হাসি হাসিয়া বলিল, “সকল কথা আমায় না বলিলে আমি কেমন করিয়া জানিতে পারিব? অর যে রাত্রি জাগরণের কথা বলিতেছেন, তাহা একটার কথা কি, আমি আপনার কাজে ক্রমান্বয়ে তিন চারি রাত্রি জাগিতে পারি।”

 আমি ভোলার কথার অর্থ বুঝিতে পারিলাম না। পুর্ব্বে সে আমার চাকর ছিল, আমাকে সে বড় ভালবাসিত। মনিব বলিয়া নয়, যেন আমি তাহার আত্মীয়। আমিও কখন তাহাকে একটী রূঢ় কথা বলি নাই। সে আমার নিকট চারি টাকা বেতন পাইত। কিন্তু ইহা ছাড়া আমার মক্কেলদিগের নিকট হইতে মধ্যে মধ্যে মাসে প্রায় দশ বার টাকা আদায় করিত।

 যে কারণেই হউক, ভোলা এখনও আমায় সেই রকম ভাল বাসে, তাহা বুঝিতে পারিলাম। বলিলাম, “তোকে তিন চার রাত্রি জাগতে হবে না। এক রাত্রি জাগলেই যথেষ্ট হবে, আর এই কাজের জন্য তুই পুরস্কারও পাবি?”

 ভোলা বলিল, “সে কথা পরে, এখন আমায় কি করিতে হইবে বলুন?

 আ। আমার সঙ্গে সুধার.ঘরে গিয়া সমস্ত রাত্রি জাগতে হবে।

 ভো। তবে চলুন।