বাঁশী/তৃতীয় পরিচ্ছেদ

তৃতীয় পরিচ্ছেদ।

 আমাকে বৈঠকখানায় রাখিয়া অমরেন্দ্র বাড়ীর ভিতর গমন করিলেন। তাঁহার আত্মীয়র বাড়ীখানি ছোট, কিন্তু যেন ছবির মত। বাড়ীতে লোকজন অতি কম। একজন চাকর ও এক দাসী বাড়ীর কর্তা ও গৃহিণীর সেবা করে। সন্তানাদি দেখিতে পাইলাম না।

 আমি বৈঠক থানায় একখানি মখমলের গদী পাতা চেয়ারে বসিয়া রহিলাম। অমরেন্দ্র আমার উপদেশ মত অন্দরে গিয়া; প্রকাশ করিলেন, তাঁহার এক বন্ধু সুধাকে দেখিতে আসিয়াছেন। শুনিলাম, বাড়ীর কর্ত্তা উপস্থিত নাই। প্রায় আধঘণ্টা বসিয়া ভাবিতেছি, এমন সময় অমরেন্দ্র এক বালিকার হাত ধরিয়া বৈঠকখানায় প্রবেশ করিলেন। আমি দেখিয়াই তাঁহাকে বলিয়া উঠিলাম, “দিব্যি মেয়ে। আপনার বৌমা বেশ সুন্দরী।”

 অমরেন্দ্রনাথ বিমর্ষভাবে উত্তর করিলেন, “ভগবানের ইচ্ছায় আগে সেই দিনই হউক।”

 আমি বলিলাম, “সে কি! আপনি হতাশ হইতেছেন কেন? যখন ঠিক সময়ে জানিতে পারিয়াছি, তখন নিশ্চয়ই ইহার একটা উপায় করিব। তবে অদৃষ্টের লিখন অখণ্ডনীয়।”

 সুধাকে আমার নিকট বসাইয়া অমরেন্দ্রনাথ বৈঠকখানায় দরজা বন্ধ করিয়া দিলেন। আমি তখন সুধার দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “তোমার নাম কি মা?”  সুধা লাজুক নহে। যে লজ্জিত না হইয়া বেশ পরিষ্কার করিয়া উত্তর করিল, “আমার নাম শ্রীমতী সুধাবালা দেবী।”

 উত্তর শুনিয়া ও সুধার সাহস দেখিয়া, আমার মনে আনন্দ হইল। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “কাল রাত্রে তুমি ভয় পাইয়াছিলে কেন? তোমার শ্বশুর মহাশয় আমায় তখন তোমার ভয়ের কথা বলিতেছিলেন।”

 ভয়ের কথা শুনিয়া সুধার মুখ মলিন হইল। সে অতি কষ্টে গত রাত্রের সমস্ত কথা বলিল। অমরেন্দ্র যাহা বলিয়াছিলেন, তাহার সমস্ত মিলিল। আমি সুধাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “তোমার দিদির মৃত্যুর আগে এই রকম শব্দ হইয়াছিল, একথা তোমায় কে বলিল?”

 সুধা বলিল, “দিদি নিজেই বলিয়াছিল। সে খুড়া মহাশয়কে পর্য্যন্ত জানাইয়া ছিল, কিন্তু তিনি সে কথা হাসিয়া উড়াইয়া দেন।”

 সুধার বয়স বেশী নয়; বোধ হয় এগার বৎসরও পূর্ণ হয় নাই। কিন্তু তাহার গোলগাল গড়ন দেখিয়া, লোকে যুবতী বলিয়া মনে করিতে পারে। সে যে আমায় বিশ্বাস করিয়া শেষোক্ত কথাগুলি কেন বলিল, তাহা জানিও না। আমিও তাহাকে প্রকৃত কথা বলিতে ইচ্ছা করিলাম।

 দুই একটা অন্য কথার পর আমি বলিলাম, “দেখ মা! আমি একজন গোয়েন্দা, তোমার ভাবী শ্বশুর মহাশয় আমার উপর তোমার গতরাত্রের ভয়ের বিষয় সন্ধান করিবার ভার দিয়াছেন। সেই জন্যই আমি কৌশলে তোমাকে এখানে আনাইয়া তোমার সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছি। আমার কতকগুলি জিজ্ঞাস্য আছে।”  আমার কথায় সুধা যেন প্রফুল্ল হইল। বলিল, “আপনি যাহা ইচ্ছা জিজ্ঞাসা করুন; আমি যাহা জানি বলিব।”

 আ। যে ঘরে কাল রাত্রে তুমি ভয় দেখিয়াছিলে, সেই ঘরেই কি তোমার দিদির মৃত্যু হইয়াছিল?

 সু। আজ্ঞে না, তাহার পাশের ঘরে; কিন্তু সে ঘরের দরজা ভিতর মহলে।

 আ। এই দুইটী ঘরের মধ্যে যাতায়াতের কোন পথ আছে কি না?

 সু। না। আ। তুমি সচরাচর কোন্ ঘরে শুইয়া থাক? যে ঘরে ভয় দেখিয়াছি সেই ঘরে?

 সু। না। যতদিন দিদি ছিল, আমি তাহারই ঘরে থাকিতাম। দিদির মৃত্যুর পর আমি এই ঘরে আসিয়াছি।

 আ। সে অবধি এই ঘরে রহিয়াছ?

 সু। না, মধ্যে দিনকতকের জন্য একবার দিদির ঘরে গিয়াছিলাম।

 আ। কেন?

 সু। মেরামতের জন্য।

 আ। কি মেরামত জান?

 সু। আজ্ঞে না। তবে বেশীর মধ্যে একটা নল বসান হইয়াছিল।

 আ। তোমার খুড়ার কয়টা সন্তান? সু। কেবল একটী পুত্র। আ। তাহার বয়স কত?  সু। চারি বৎসর।

 আ। তোমার খুড়া মহাশয়ের কি এই প্রথম পুত্র?

 সু। হাঁ। তাঁহার বেশী বয়সে ছেলে হইয়াছে।

 অ। তিনি তোমাদের ভালবাসেন?

 সুঁ। হা। তিনিও ভালবাসেন, খুড়ীমাও খুব ভাল বাসেন।

 আ। তোমার পিতার কোন উইল আছে জান?

 সু। শুনিয়াছি—আছে। আ। কি শুনিয়াছ? কাহার মুখে শুনিয়াছি?

 সু। খুড়ামহাশয় ও খুড়ী-মা উভয়েই বলিয়াছেন। শুনিয়াছি, আমাদের বিবাহের পর প্রত্যেকে দশহাজার করিয়া টাকা ও ঐ টাকার সুদ পাইব।

 আ। সুদ কেন? কতদিনের সুদ?

 সু। আমাদিগের যত বয়স ততদিনের সুদ। শুনিয়াছি, আমাদের জন্ম হইবার একমাসের মধ্যে ঐ টাকা কোন ব্যাঙ্কে জমা আছে।

 অ। ও টাকা ত তোমার পিতার উপার্জিত ধন বলিয়া বোধ হইতেছে। তাঁহার পৈত্রিক সম্পত্তির কি হইল? তাহার কোন অংশ পাও নাই?

 আ। হাঁ। সে কথাও আছে।

 আ। কি কথা?

 সু। ঐ দশহাজার টাকা ও তাহার সুদ ছাড়া আমরা প্রত্যেকে আরও পাঁচ হাজার করিয়া টাকা পাইব।

 আ। সে ত বিবাহের যৌতুক?  সু। না না-যৌতুকের কথা স্বতন্ত্র আছে।

 আ। ঠিক জান?

 সু। না, সে কথা বলিতে পারি না। তবে ইহা স্থির জানি যে, বিবাহের পর আমি প্রায় পনের ষোল হাজার টাকা পাইব। তবে যদি মরিয়া যাই, ফুরাইয়া যাইবে। এই বলিয়া সুধা দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিল। আমি তাহার কথায় দুঃখিত হইলাম। বলিলাম, “যখন আমি এ কাজে লাগিয়াছি, তখন তোমার কোন ভয় নাই। আর অমন কথা মুখে আনিও না। আর একটা কথা আছে, কোন উপায়ে আমাকে সেই ঘর দুইটী দেখাইতে পার?

 সু। কোন্ ঘর? দিদির ও আমার ঘরের কথা বলিতেছেন?

 আ। হাঁ।

 সু। সে কি করিয়া হইতে পারে? আপনি অন্দরে যাইবেন কিরূপে? অন্দরে না যাইলে ত দিদির ঘর দেখিতে পাইবেন না। বিশেষতঃ, আমার খুড়মহাশয় বড় ভয়ানক লোক। লোকে তাহাকে পাগল বলিয়া থাকে। এবং সেই জন্য সকলেই তাহাকে অত্যন্ত ভয় করিয়া থাকে।

 আ। আমি কৌশলে তোমাদের বাড়ীতে যাইব মনে করিয়াছি। যদি সফল হই, তাহা হইলে আমায় দেখাইতে পারিবে?

 সু। কেন পারিব না? কিন্তু আপনি কেমন করিয়া সেখানে যাইবেন?

 আ। তোমার বিবাহ উপলক্ষে তোমার খুড়ামহাশকে নিশ্চয়ই কতকগুলি নুতন চাকর রাখিতে হইবে।

 সু। হাঁ। আমিও এই কথা শুনিয়াছি।

 আ। আমি একজন চাকর সাজিয়া তোমার খুড়ার বাড়ীতে যাইব। কিন্তু সাবধান, যেন এ কথা আর কেহ জানিতে না পারে।

 সু। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। এ কথা আর কেহ জানিতে পারিবে না। অমরেন্দ্রনাথ আমাদের সমস্ত কথাবার্তা শুনিয়া মনে মনে আনন্দিত হইলেন। বলিলেন, “আপনাকে যথেষ্ট কষ্ট দিতেছি। কিন্তু কি করিব, আপনি না হইলে এই ভয়ানক রহস্য আর কেহ ভেদ করিতে পারিবে না।”

 আমি মিষ্ট কথায় তাহাকে সান্ত্বনা করিয়া বৈঠকখানা হইতে বাহির হইয়াছি, এমন সময় একজন চাকরের মুখে শুনিলাম, চক্রবেড়ে হইতে সুধাকে লইতে আসিয়াছে। আমি পূর্বেই সেইরূপ মনে করিয়াছিলাম। কার্যসিদ্ধ হইয়াছে জানিয়া, আর তথায় অপেক্ষা করিলাম না। অমরেন্দ্র আমাকে জল খাওয়াইবার জন্য বিস্তর অনুরোধ করিলেন, কিন্তু আমি সে অনুরোধ রক্ষা করিতে পারিলাম না।