বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড)/২৫
মমতাজ বেগম
২৫শে মার্চ রাত্রে আমি ঢাকার দীননাথ সেন রোডে ছিলাম। এখানে থেকে ১লা এপ্রিল কুমিল্লায় যাত্রা করি। কয়েকদিন আমি কসবায় অবস্থান করি। এখানে অবস্থানকালে জনসাধারণকে স্বাধীনতার পক্ষে উৎসাহিত করি এবং আনসার ও স্থানীয় ছাত্রলীগের কর্মীদের নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করি। ইতিমধ্যে মেজর বাহার কুমিল্লা ক্যাণ্টনমেণ্ট হতে পালিয়ে প্রাক্তন সৈনিক, ইপিআর ও আনসার বাহিনীর সদস্যদের একত্রিত করে বাংলাদেশের জন্য একটি সৈন্যদল গঠনের চেষ্টা করেন। এ সময় আমাদের কিছু সদস্য ভারত সরকারের সাথে যোগাযোগ করে। বাংলাদেশকে শত্রুর কবল থেকে মুক্ত করার জন্য একটি সরকার গঠন করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ১০ এপ্রিল যখন সরকার গঠন করা হয় তখন সেখানে মহিলা সদস্যদের মধ্যে শুধু আমিই উপস্থিত ছিলাম। পরে সেই সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে মুজবনগর (কুষ্টিয়ার আম্রকাননে) শপথগ্রহণ করে। ১২ই এপ্রিল ক্যাপ্টেন ভূঁইয়া আমার সাথে যোগাযোগ করেন। তাঁর নেতৃত্বে আমার ছোট ভাই আজিজ, ফজলু, কুদ্দুস, কসবা ছাত্রলীগের সভাপতি কাইউম, দোদুল ও আরো কিছু সংখ্যক ছেলে ইলিয়টগঞ্জ পুল ও কোম্পানীগঞ্জ পুল ধ্বংস করার পরিকল্পনা নেয়। উক্ত দলটি ইলিয়টগঞ্জ পুল ধ্বংস করতে সক্ষম হয় কিন্তু কোম্পানীগঞ্জ পুল ধ্বংস করা যায়নি। ১৩ই এপ্রিল মেজর খালেদ মোশাররফ আমার সাথে যোগাযোগ করেন। পরের দিন অতর্কিতভাবে পাক বাহিনী কসবা এসে পড়লে আমরা আগরতলার দেবীপুরে চলে যাই।
আগরতলায় পূর্বের মতোই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গঠন করার কাজে সহায়তা করি। এপ্রিল মাসের শেষের দিকে দেবীপুরে (আগরতলা) অবস্থানরত ক্যাপ্টেন গাফফার ও তার বাহিনীর সহযোগিতায় শালদানদীর খাদ্য গুদাম থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য কয়েক হাজার বস্তা গম ও চাল সংগ্রহের ব্যাপারেও সক্রিয় ছিলাম। মুক্তিবাহিনী ও মুজিব বাহিনীর যোদ্ধাদের সামরিক শিক্ষার জন্য এবং শিক্ষাপ্রাপ্তদের দেশের অভ্যন্তরে কুমিল্লায় খাদ্য আশ্রয় ও চিকিৎসার যথাসম্ভব ব্যবস্থা করে দিতেও সচেষ্ট ছিলাম। আমরা মহিলাদেরকেও মুক্তি সংগ্রামে অংশগ্রহণ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করি। তাই মহিলা আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী নামে একটা সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয়। জাহানারা হক এই সংগঠনের সভানেত্রী ও ফরিদা মহিউদ্দিন সেক্রেটারী মনোনীত হন। এখানে মেয়েদের নার্সিং শেখার ব্যবস্থা করা হয়। আমরা বিভিন্ন ক্যাম্পে ত্রাণ কার্যও পরিচালনা করি।
চৌদ্দগ্রাম থানা, কতোয়ালীর বৃহৎ অংশ, বুড়িচং, মুরাদনগরের অংশ বিশেষ, কসবা, আখাউড়া, কুমিল্লা ক্যাণ্টনমেণ্ট মুক্তিবাহিনীর লক্ষ্যস্থল ও পাকবাহিনীর দুর্ভেদ্য দূর্গ ছিল। সে সময় ঘরবাড়ী, মানুষ, রাস্তাঘাট ও যানবাহনের ব্যাপক ক্ষতিসাধিত হয়। কসবা, আখাউড়া, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, লালমাই ও লাকসামে বেশ কয়েকটি গণকবর রচিত হয়। প্রতিরোধ যুদ্ধের মধ্যে কুমিল্লা পুলিশ লাইনের পুলিশ বাহিনীর কথা উল্লেখ করা যায়। রামমালার আনসার বাহিনীও প্রতিরোধ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে। লালমাই স্টেশনের সন্নিকটে কিছুসংখ্যক ইপিআর ও বেঙ্গল রেজিমেণ্টের কিছু লোক প্রায় ৫দিন পর্যন্ত প্রতিরোধ যুদ্ধ করে। কসবা ও শালদা নদীতে ক্যাপ্টেন গাফফারের নেতৃত্বে সৈন্যবাহিনী বেশ কিছুদিন প্রতিরোধ যুদ্ধ করে। লাকসাম, চৌদ্দগ্রাম, বুড়িচং, কসবা ও আখাউড়ায় সর্বাধিক নারী নির্যাতন হয়। আমার কসবাস্থ বাসস্থান বোমাবর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে পাক সামরিক জান্তা বিনষ্ট করে।
যুদ্ধ চলাকালীন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে বন্ধুরাষ্ট্র ভারতে যাওয়ার সময় কর্ণেল এম এ জি ওসমানী আমাদের কসবাস্থ বাসভবনে দুদিন অবস্থান করেন। প্রথম দিকে অবশ্য তাকে আমরা চিনতে পারিনি। কেননা তিনি পরিচয় গোপন রেখেছিলেন এবং তার সপরিচিত গোঁফ ছিল না। পরে তাকে চিনতে পারি এবং ভারতে যাবার ব্যাপারে সহায়তা করি। পথে এক জায়গায় পাঞ্জাবী মনে করে তাকে কয়েকজন বাঙ্গালী মারতে উদ্যত হয়েছিল। কিন্তু আমার এক আত্মীয়ের সনাক্তকরণের ফলে তাকে রক্ষা করা সম্ভব হয়।
মমতাজ বেগম
গণপরিষদ সদস্যা
(সাবেক এম এন এ, মহিলা আসন-৬)
৩০ জুন, ১৯৭৩।