বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড)/২৬

মোশাররফ হোসেন

 অসহযোগ আন্দোলনের শুরতেই আমি নানাবিধ অস্ত্রশস্ত্র ও এক্সপ্লোসিভ যোগাড় করতে থাকি। ২৪ শে মার্চ কর্ণফুলী নদীতে অবস্থানরত ‘সোয়াত’, জাহাজ হতে শেল নিক্ষেপ করা হয়। ক্যাণ্টনমেণ্ট হতে বাঙ্গালী সৈন্যের একটি দল ক্যাপ্টেন রফিকের অধীনে কুমিরার দিকে যাত্রা করে। ২৫শে মার্চ রাত্রিতে চট্টগ্রাম ক্যাণ্টনমেণ্টে গোলাগুলি বিনিময় হয়।

 ইতিমধ্যে আমি ও আমার সংগীরা শুভপুর ব্রীজটির আংশিকভাবে ক্ষতিসাধন করি। অন্যদিকে চট্টগ্রামের দিকে আসার সময় লোকদিগকে রাস্তায় গাছপালা, ইটপাটকেল ইত্যাদি দিয়ে নানভাবে প্রতিরোধ সৃষ্টির জন্য পরামর্শ দেই। ২৬ তারিখে চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসরমান পাক সেনাদের সঙ্গে কুমিরার ক্যাপ্টেন রফিকের দলের এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ঐ যুদ্ধে একজন ক্যাপ্টেনসহ অনেক পাকিস্তানী সৈন্য মারা যায়। পরে মেজর জিয়াউর রহমানের অধীনে আর এক দল বাঙ্গালী সৈন্য কালুরঘাটের দিকে যাত্রা করে।

 এদিকে সমস্ত চট্টগ্রাম আমাদের অধীনে চলে আসে। হান্নান সাহেবসহ আমি অনতিবিলম্বে কালুরঘাটস্থ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রে উপস্থিত হই এবং আমরা স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠা করি। হান্নান সাহেবই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রথম বক্তা এবং তিনি বেলা দেড় ঘটিকার সময় বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।

 ২৬ তারিখ রাত্রে ‘সোয়াত' জাহাজ হতে চট্টগ্রাম শহরে অবিরাম গুলিবর্ষণ হয়। আমরা চট্টগ্রাম শহরে ক্যাণ্টনমেণ্টের ঘেরাওকৃত বাঙ্গালী সৈন্যদের সাহায্য করার প্রচেষ্টা চালাই তখন সমস্ত যুদ্ধ ব্যবস্থা মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন চলতে থাকে। ২৯ শে মার্চ তিনি শেখ মুজিবর রহমানকে Head of the State’ এবং নিজেকে ‘Supreme Commander of the Bengali Armed forces' ঘোষণা করে যুদ্ধ পরিচালনা করতে লাগলেন। কিন্তু এপ্রিল মাসের তৃতীয় দিনের মধ্যে চট্টগ্রাম শহরের কিছু কিছু অংশ ব্যতীত সবটুকুই পাক সেনাদের অধীনে চলে যায়। আমরা তখন কালুরঘাট ছেড়ে রামগড়ে চলে যাই। আমাদের অবস্থান আরও দৃঢ় করার জন্য এখানে একটি কণ্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়। চট্টগ্রাম শহর দখল করেই পাক সেনারা চট্টগ্রামের আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ে। ৭ ই এপ্রিল কালুরঘাটের পতন হয়।

 ঢাকা-চট্টগ্রাম তখন ক্যাপ্টেন শমসের মবিনের নেতৃত্বাধীন যুদ্ধ চলছিল। অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙ্গালী ও পাক সেনাদের মধ্যে যুদ্ধ চলতে থাকে। সীতাকুণ্ডে পাক-বাহিনীর সঙ্গে একটি যুদ্ধ হওয়ার পর ক্যাপ্টেন মবিনের সৈন্য বাহিনী চিনকি আস্তানায় চলে যায়। বাঙ্গালী সৈন্যবাহিনী এরপর মীরশ্বরাই ব্রীজের ক্ষতিসাধনের জন্য এখানে সমবেত হয়। এপ্রিলের প্রথম দিকে আমাদের সৈন্যবাহিনী এক সপ্তাহ যাবত পাক হানাদারদের মোকাবেলা করেছিল। ১৭ তারিখে ব্রীজ হতে দূরে বাঙালী ও পাক বাহিনীর মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয় দুটি কনভয়সহ প্রায় ৪০০ জন পাক সৈন্য ধ্বংস হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বাঙ্গালী সৈন্যরা বেলা দুটোর মধ্যে পিছু হটতে বাধ্য হয়। একজন বাঙ্গালী সুবেদার মৃত্যুবরণ করেন এবং দুজন সেপাই আহত হন।

 ঐদিন রাত্রেই আমরা মীরেশ্বরাই থেকে সামান্য উত্তরে মোস্তাননগরে ওঁৎ পেতে থাকি। ১৮ তারিখে পাক সেনাদের সাথে একটি খণ্ড যুদ্ধ হয়। এতে প্রায় ৩০/৪০ জনের মত পাক সৈন্য নিহত হয়। ১৮ তারিখ সন্ধ্যায় ঐ স্থান ছেড়ে বাঙালী সৈন্যরা করেরহাট চলে আসে এবং হিংগুলি ব্রীজটির ক্ষতিসাধন করে। মোস্তান নগর যুদ্ধের পর পাক সেনার আর বেশী অগ্রসর হতে পারেনি। তারপর আমাদের সৈন্যরা রামগড় রাস্তার ওপর তুলাতুলি ব্রীজটি উড়িয়ে দেয়। এদিকে শুভপুর, তুলাতুলি, খাগড়াছড়ি ও ফটিকছড়ি প্রভৃতি স্থানে যুদ্ধ চলছিল এবং ক্রমান্বয়ে পাক সেনারা রামগড় ঘিরে ফেলে। আমরা সীমান্ত পেরিয়ে সাবরুমে চলে যাই। পরে হরিনাতে গিয়ে একটি Army Camp ও পাশাপাশি ‘Youth Camp' গঠন করি। উক্ত ক্যাম্পে যুবকদের সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ছিল। প্রশিক্ষণ নেয়ার পর তারা বিভিন্ন গেরিলা দলে বিভক্ত হয়ে অপারেশন চলে যায়। অন্যদিকে সেপ্টেম্বর মাসে বিহারের চাকুরিয়া ট্রেনিং সেণ্টারেও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। অক্টোবরের ১৫ তারিখ হতে নভেম্বরের ২০ তারিখ পর্যন্ত মীরেশ্বরাই, সীতাকুণ্ড, চট্টগ্রাম শহর পর্যন্ত স্পেশাল কমাণ্ডো গ্রুপ নিয়ে অপারেশনে লিপ্ত ছিলাম। বাকী সময়টুকু হরিনা সেক্টর নং ১, হেডকোয়ার্টারে ছিলাম।

 মীরেশ্বরাই থানার করেরহাট ও হিংগুল ইউনিয়ন সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এখানে পাক-সেনাদের হেডকোয়ার্টার ছিল। ঐ স্থানগুলি সীমান্তের কাছেই ছিল। প্রতিরোধ যুদ্ধে কেন্দ্র হিসেবে এখানে বহু হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত হয়। মীরেশ্বরাই থানার Wireless Station'- এর পাশে সবচেয়ে বেশী হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। বিভিন্ন স্থান থেকে ধৃত লোকদিগকে এখানে আনা হত এবং বিভিন্ন পৈশাচিক কায়দায় হত্যা করা হত। এখানে আজহারুস সোবাহান নামে এক ব্যক্তি জবাই করত এবং প্রতি জবাইতে পাঁচটি করে সিকে পয়সা পেত। এখানে আনুমানিক ৫০০ জনকে হত্যা করা হয়। ওসমানপুর ইউনিয়নে একসাথে ৫ জনকে লোককে গুলি করে হত্যা করা হয়। হিংগুলি ইউনিয়নেও একসাথে ১০জনকে হত্যা করা হয়।

 মাতবরহাটে আমাদের প্রতিরক্ষা যুদ্ধের হেডকোয়ার্টার ছিল। ইছাখালী ইউনিয়ন, কাঁটাছোড়া, ওসমনাপুর, মিঠানালা ও বগাদিয়া প্রভৃতি ইউনিয়নে আমাদের অবস্থান দৃঢ় ছিল। এসমস্ত স্থান হতে আমরা গেরিলা যুদ্ধ চালাতাম।

মিয়াজান ঘাটের যুদ্ধ (জুন/জুলাই)

 ওসমানপুর ইউনিয়নে মিয়াজান ঘাটে ১৮ ঘণ্টা ধরে এক যুদ্ধ হয়। ঐ যুদ্ধে পাকিস্তানের একজন মেজর ও তিনজন সেপাই প্রাণ হারায়। মাত্র ১৫০ জন সৈন্য নিয়ে শেষ অবধি তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়।

দারোসা বাজারের যুদ্ধ (এপ্রিল/মে)

 কাঁটাছেড়া ইউনিয়নের দারোসা বাজার হতে কিছু দূরে মাইন ফাটিয়ে মুক্তিবাহিনী পাক বাহিনীর একটি গাড়ী উড়িয়ে দেয়। মাইন ফাটলে প্রায় ৬ জন পাক বাহিনীর লোক মারা যায়। এরপর এখানে প্রায় ৬ ঘণ্টা ধরে যুদ্ধ হয়। পরে ওরা পিছু হটতে শুরু করে এবং পলায়ন করার সময় কয়েকজন লোককে হত্যা করে। তাদের মধ্যে হাজী দুলাল মিয়া অন্যতম।

 মিঠানালা কম্যুনিটি সেণ্টার, দুর্গাপুর হাইস্কুল ও আবু তোরাব হাইস্কুলে অবস্থানরত রাজাকার ও পাক বাহিনীর সৈন্যদিগকে পুনঃ পুনঃ আক্রমণ চালিয়ে উৎখাত করা হয়। এসমস্ত অভিযানে আমাদের কিছু মুক্তিবাহিনীর লোকও মারা যায়। দুর্গাপুর হাইস্কুল অভিযানে ফরিদ আহমেদ নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। পাক সেনাদের একটি বাংকারে গ্রেনেড ছোড়ার সময় হঠাৎ প্রতিপক্ষের একটি বুলেট তার বুকে বিদ্ধ হয়।

হাদি ফকিরের হাটের যুদ্ধ (নভেম্বর)

 শাহ আলমের অধীনে এক প্লাটুন মুক্তিবাহিনী একটি রাজাকার দলকে আক্রমণ করলে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। প্রচণ্ড আক্রমণে ৭ জন রাজাকার মারা যায়। পরে রাজাকারদের সাহায্যার্থে পাক বাহিনী চলে আসে। পাক সৈন্য আসলে ওদের শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং মুক্তিবাহিনীর দল ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। শাহ আলম এক ধান ক্ষেতে আত্মগোপন করে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। কিন্তু পাক বাহিনী শেষ অবধি তাকে ধরে ফেলে হত্যা করে। এ যুদ্ধে পাকিস্তানের কয়েকজন সৈন্য আহত হয়।

বাংলা বাজারের (পাকিস্তান বাজার) যুদ্ধ (মে/জুন)

 জনাব মুস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা বাংলা বাজারের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। মুক্তিযোদ্ধার পাকবাহিনীর দলটিকে অতর্কিত আক্রমণ করে এবং ১০ জনকে হত্যা করে। যুদ্ধ চলাকালে মুস্তাফিজুর রহমান বুলেটবিদ্ধ হন।

তেতুইয়া, তেমোহনী ও আবুর হাটের যুদ্ধ (অক্টোবর)

 পাক বাহিনী উপরোক্ত মুক্তিবাহিনীর গেরিলা সেণ্টার আক্রমণ করে। এ যুদ্ধ প্রায় দু'দিন স্থায়ী হয়। মুক্তিবাহিনীর প্রধান যুদ্ধকেন্দ্র মাতার হাট পর্যন্ত আক্রান্ত হয়। প্রধান গেরিলা সেণ্টার ছেড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত পিছু হটে যেতে হয়েছিল। পরে প্রবল আক্রমণের মুখে পাকিস্তান বাহিনী মাতার হাট ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়। যুদ্ধে উভয় পক্ষের বেশ কিছু লোক আহত ও নিহত হয়।

 আবুর হাটে একজন সাধারণ পানের দোকানী দেশ স্বাধীন করার অদম্য এক ইচ্ছার নজির স্থাপন করেছেন। পাক বাহিনী বাংলাদেশে হানা দেয়ার প্রথম দিকে আবুর হাটের দিকে সতে শুরু করলে লোকজন নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে আরম্ভ করে। কিন্তু উক্ত দোকানদার তফাজ্জল হোসেন পাক সেনাদের সম্মুখে গিয়ে কয়েকটি গ্রেনেড ছুড়ে মারে। গ্রেনেড লক্ষ্যবস্তুতে না পড়লে কয়েকজন পাকসৈন্য আহত হয়।

 ২৬ শে মার্চ পাক বাহিনী যখন চট্টগ্রামের দিকে আসছিল তখন তারা রাস্তার দু'পাশের বাড়ীঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। বড় তাকিয়া বাজারে উপস্থিত হয়ে পাক বাহিনী লুট ও অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় এক সাহসী যুবক দা ও লাঠি নিয়ে একজন পাকসেনাকে আক্রমণ করে। তারপর পাকসেনারা তাকে ধরে ফেলে এবং হত্যা করে।

 চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসরমান পাক বাহিনী সীতাকুণ্ডে পৌঁছেই লোহাগাড়া গ্রামে ঢুকে পড়ে। ১০/১২ জন পাক সৈন্য একটা মেয়েকে ধরে আনে এবং একটা পুকুর পাড়ে এনে উপর্যুপুরি ধর্ষণ করে। মেয়েটি কয়েকদিন মাত্র জীবিত ছিল, তারপর সে মারা যায়।

মোশাররফ হোসেন
গণপরিষদ সদস্য
(সাবেক এম, পি, এ চট্টগ্রাম)
১২ জুন, ১৯৭৩।