বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড)/২৭
মোহাম্মদ আজিজুর রহমান
২৪শে মার্চ আমি ঠাকুরগাঁও দিনাজপুরের ইপিআর বাহিনীর কয়েকজন সুবেদার ও হাবিলদারের সঙ্গে গোপনে আলাপ করি এবং তাদের উপদেশ দেই পাক অফিসাররা তাদের অস্ত্র জমা দিতে তারা যেনো অস্ত্রগার দখল করে নেন। এতে তারা রাজী হন। দিনাজপুর ইপিআর বাহিনীর একজন সুবেদার যুদ্ধ ঘোষণার পূর্বেই অস্ত্রাগার লুণ্ঠন এবং পাক সৈন্য দের হত্যার জন্য আমার এবং জেলা আওয়ামী লীগ সেক্রেটারী অধ্যাপক ইউসুফ আলীর কাছে অনুমতি চান। কিন্তু আমরা তার এ প্রস্তাবে রাজী হইনি। ২৫শে মার্চ রাত প্রায় ১১টা পর্যন্ত স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবর্গ এবং অবাঙ্গালী বিহারীদের মধ্যে মিটিং হয়। এই মিটিং-এ বিহারীরা শান্তিরক্ষার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং বিহারী বাঙ্গালী ভাই ভাই প্রভৃতি শ্লোগান দেয়। ২৫শে মার্চের মধ্যরাতেই আমরা গুলির শব্দ মুনতে পাই। চারদিক থেকে ‘জয় বাংলা'র প্রভৃতির শ্লোগান ও কানে ভেসে আসে। ভোর পর্যন্ত এ রকম ধ্বনি শুনতে পাই।২৬ মার্চ সকালে ফজরের নামাজান্তে আমার বাসার সামনে একটি হালকা কামান বসানো দেখতে পাই। পাঞ্জাবী সামরিক কর্মকর্তা আমাদের ডেকে নিয়ে যান এবং তাদের কথামতো কাজ করতে চাপ দেন। তারা আমাদের স্পষ্ট জানিয়ে দেন তাদের কথা না শুনলে যে কোন দণ্ড তারা দিতে পারেন। এখান থেকে বাসায় না গিয়ে আওয়ামী লীগের এক নেতার বাসায় চলে যাই। ইতিমধ্যে শহরে কারফিউ জারি হয়ে গেছে। ২৭ শে মার্চ সকালে দু'ঘণ্টার জন্য কারফিউ তুলে নেয়া হয়। এ সুযোগে আমি বেরিয়ে পড়ি এবং ইপিআর বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করি। সিদ্ধান্ত মোতাবেক স্থির হয় দিনাজপুর ইপিআর ৮ম বাহিনীর বাঙ্গালীদের দায়িত্বে থাকবেন ক্যাপ্টেন নজরুল হক এবং ৯ম বাহিনীর দায়িত্বে থাকবেন সুবেদার মেজর আবদুর রউফ। আর আমি বেসামরিক বিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করবো।
ঐ দিন পাক বাহিনী আমাকে অনেক খোঁজাখুঁজি করে। আমি কাঞ্চন নদী পেরিয়ে গ্রামে এক আত্তীয়ের বাড়ীতে আশ্রয় নেই। ২৮ শে মার্চ এখানে থেকে ঠাকুরগাঁয়ের ইপিআর বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য রওয়ানা হই। ২৯শে মার্চ ঠাকুরগাঁ পৌঁছি। সেখানেও গোলাগুলির শব্দ শুনতে পাই। এখানে সুবেদার মেজর কাজিমউদ্দিন এবং ঠাকুরগাঁ আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে একত্রে কাজ চালিয়ে য়াই। সুগার মিলের জীপ নিয়ে দিনাজপুর ৯নং ইপিআর বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য ২৯ তারিখেই রওয়ানা হই। ৩০শে মার্চ দিনাজপুরের কাঞ্চন নদীর ঘাটে মুক্তি বাহিনীর ঘাঁটিতে পৌঁছে। ঐদিনই দিনাজপুর ইপিআর ঘাঁটির সব অস্ত্র আমরা লাভ করি। এসব অস্ত্রপাতি স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা, ছাত্র এবং মুজাহিদদের সহায়তা কাঞ্চন নদীর পশ্চিমে এক গ্রামে রেখে দিই। এখানে রফিক সাহেব, ফয়েজ সাহেব, নাজিম ভূঁইয়া, জজ, আব্দুল হান্নান চৌধুরী এবং ক্যাপ্টেন নজরুল হকের সঙ্গে দেখা হয়। ভারতীয় বন্ধুগণ এখানে আমাদের রসদ সরবরাহ করতো।
৩১শে মার্চ ঠাকুরগাঁ ঘাঁটি আমাদের দখলে আসে। রাত দশটায় আমরা অস্ত্রগারের অস্ত্র নিজেদের অধিকারে আনি। ঠাকুরগাঁ আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আবুবকর খানও এই সময় আমাদের সঙ্গে ছিলেন। যুদ্ধের শেষের দিকে তিনি শহীদ হন। ঐ রাতেই ঠাকুরগাঁ থেকে একটু দূরে আমাদের ঘাঁটি ও ট্রেঞ্চ বসাই। এ সময় স্থানীয় গ্রামবাসী আমাদের সর্বাত্মক সহায়তা করে। তারা মুক্তিয়োদ্বাদের সঙ্গে কাজ করে। এ সময় ভারতীয় সীমান্ত থেকে কিছু অস্ত্র এবং অয়ারলেস সংগ্রহ করি। আমি ঠাকুরগাঁ ও পঞ্চগড় এলাকার দায়িত্ব পালন করি। রেল লাইন অচল করে দেই এবং প্রাক্তন উইং কমাণ্ডার জনাব মির্জার সঙ্গে পরামর্শ করে শিবগঞ্জ বিমান ঘাঁটি নষ্ট করে দেই। ক্যাপ্টেন নজরুলের দেয়া অস্ত্রসহ আমরা এলাকাব্যাপী মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহ ও সংগঠনে তৎপর হই।
২রা এপ্রিল সীমান্ত পার হয়ে অস্ত্রের জন্য ভারতে যাই। সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য সুবেদার কাজিম উদ্দিনকে পাঠিয়ে আমি ঐ তারিখে গভীর রাতে আবার দেশ ফিরে আসি। ৩রা মার্চা দিনাজপুরে আমাদের যুদ্ধঘাঁটি পরিদর্শন করি। ঐদিনই দিনাজপুরের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টর ক্যাপ্টেন আশরাফকে ঠাকুরগাঁয়ে ডেকে পাঠাই এবং মিটিং করে সৈয়দপুর ঘাঁটি সৈয়দপুর ঘাঁটি আক্রমণের পরিকল্পনা নেই। ৫ই এপ্রিল আমি সেতাবগঞ্জ ও পীরগঞ্জ ঘাঁটি অভিমুখে রওনা হই। ৬ ই এপ্রিল রাতে ভারতে যাই এবং কংগ্রেস নেতা বাবু আর দত্ত এম এন এ- এর সঙ্গে আলাপ করি। অধ্যাপক ইউসুফ আলী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামারুজ্জামান, মিজানুর রহমান, মনসুর আলী প্রমুখ নেতৃবর্গের সঙ্গেও সেখানে সাক্ষাৎ হয়।
১৩ই এপ্রিল দিনাজপুরের রায়গঞ্জে ফিরি এবং দিনাজপুর মহর উপকণ্ঠে প্রবেশের চেষ্টা করি। কিন্তু সে সময় পাক বাহিনী দিনাজপুরে প্রবেশ করে প্রবল গুলিবর্ষণ করে। রাত্রে ক্যাপ্টেন নজরুল হক, সুবেদার মেজর রউফ, ওসমান গণী সাহেবের সঙ্গে ভারত সীমান্তে সাক্ষাৎ হয়। এ সময় রাধিকাপুর স্টেশনে ভারতগামী হাজার হাজার শরণার্থীদেখতে পাই। এখান থেকে বিএসএফ ক্যাম্পে চলে যাই এবং সেখানে অবস্থান করি। ১৯ শে এপ্রিল মুক্তিবাহিনীসহ পাকবাহিনীর ঘাঁটি আক্রমণ করি। যুদ্ধে আমরা জয়ী হই এবং প্রচুর খাদ্যদ্রব্য উদ্ধার করি। শরণার্থী ক্যাম্পের যুবকদের নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং স্থাপন করি। আমার সঙ্গে এ সময় দিনাজপুরের জজ, ডাঃ নইম উদ্দিন, ছাত্রনেতা আজিজুল ইসলামও ছিলেন। মুজিবনগর সরকার এবং ভারতীয় বাহিনী আমাদের এ ব্যাপারে সহায়তা করেন। এ সময় বাংলাদেশ সীমান্তে এম এন এ, এম পি এ-এর দের এক সম্মেলন হয়। আমাকে মুক্তিবাহিনীর ৬নং সেক্টরের বেসামরিক উপদেষ্টার দায়িত্ব প্রদান করা হয়। অক্টোবর মাস পর্যন্ত আমি এ দায়িত্ব পালন করি। জলপাইগুড়ির রাজগঞ্জ যুবশিবির, ইসলামপুর, গংগারামপুর, হামজাপুর, বালুঘাট প্রভৃতি যুবশিবির পরিদর্শন করে যুবকদের অনুপ্রাণিত করি এবং উৎসাহ দেই। ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করি। যুবশিবিরে যুবকদের গেরিলা ট্রেনিং দিয়ে তাদের বাছাই করে যুদ্ধের জন্য বাংলাদেশে প্রেরণের ব্যবস্থা করি। শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করে তাদের অবস্থা ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করি। পশ্চিম বাংলার প্রধানমন্ত্রী বাবু সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের সাথে এ ব্যাপারে যোগাযোগ করি।
৫ ই ডিসেম্বর আমি ভারত থেকে মিত্রবাহিনীর সঙ্গে ঠাকুরগাঁও-এ প্রবেশ করি। এখানে বেশ কয়েকদিন ব্যস্ততার মধ্যে কাটে। ইতিমধ্যে ১৬ই ডিসেম্বর আমরা দিনাজপুরে স্বাধীনতা উৎসব পালন করি।
১৯৭১ সালের যুদ্ধের নয় মাস আমাদের দিনাজপুর জেলায় পাক বাহিনী অসংখ্য নারী নির্যাতন, ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যা চালায়। ১৩ই এপ্রিল পাক বাহিনী দিনাজপুর শহর পুর্নদখলকালে অমানুষিক অত্যাচার চালায়। দিনাজপুর শহরের টেলিফোন ভবনে অনেক লোককে পাক সেনারা হত্যা করে। পীরগঞ্জে, সেতাবগঞ্জ সুগার মিলে হাজার হাজার লোককে হত্যা করা হয়। পীরগঞ্জের ডাঃ সুজাউদ্দিন, আওয়ামী লীগের প্রেসিডেণ্ট আবদুর রহমান ও একজন অধ্যাপককে পাক সেনারা নির্মমভাবে হত্যা করে। সেতাবগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা ডাঃ তমিজউদ্দিন চৌধুরী, মুনিরউদ্দিন, দিনাজপুর ডিগ্রী কলেজের অধ্যাপক শাহ সুলেমান তৈয়ব পাক সেনাদের গুলিতে শহীদ হন। ঠাকুরগাঁও খানকা শরিফের পীরসাহেবের কনিষ্ঠ পুত্রকেও তারা হত্যা করে। ঠাকুরগাঁও সুগার মিলে আওয়ামীলীগের সহ- সভাপতি আবু বকর খানকে দালালদের সহায়তা নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। পাক সেনারা তেঁতুলিয়া ও বালিয়াডাংগীতেও অকথ্য অত্যাচার ও হত্যাকাণ্ড চালায়।
মোহাম্মদ আজিজুর রহমান
গণপরিষদ সদস্য (সাবেক এম,এন,এ)
দিনাজপুর
২৭ অক্টোবর, ১৯৭২।