বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড)/৫০
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
উর্দু ভাষাকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করার পক্ষে বক্তব্য | মাহে নও | জুলাই, ১৯৫১ |
উর্দুর ভূমিকা
ফজলুর রহমান
উর্দু বিভিন্ন ভাষার উপাদানের একটা সংমিশ্রণ এবং যারা উর্দুকে মাতৃভাষা বলে দাবী করেননি তাঁরাও উর্দুর তরান্ধীর পথে অনেক খোরাক জুগিয়েছেন। পাক-ভারত উপমহাদেশের ভাষার ক্ষেত্রে উর্দু বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জনগণকে এক গ্রন্থিতে সংযুক্ত করেছে। বিরোধী সমালোচকরা যাই বলুক না কেন প্রথম উর্দুর মধ্যেই এই উপমহাদেশের আন্তঃপ্রাদেশিক ভাষা সমস্যার সমাধান সম্ভবপর হয়েছিল। বিভিন্ন ভাষা দ্বারা সমৃদ্ধ হয়েছে যে উর্দু তার সার্বজনীন গ্রহণ ক্ষমতা দ্বারাই ইহা সম্ভবপর হয়েছে। উর্দু সাহিত্যে যদিও কিছুটা আভিজাত্যের ছাপ আছে, তবু উর্দু ভাষার দেশের জনগণের সংগে অতি নিকট সম্পর্ক রয়েছে। তার জন্যই উর্দু কৃতিত্বের সংগে ও হিন্দু শাসকদের মারাত্মক আক্রমণের মোকাবেলা বৃটিশ ও জনগণের মনে প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছে।
আমাদের এই গোলযোগপূর্ণ ঝড়-ঝঞ্চ অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পর আমাদের ভাবী বংশধরগণ কতকগুলো অপূর্ব অবদানের জন্য পাক-ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসের এই মুসলমান যুগটিকে কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করবে।
প্রথমতঃ- স্থায়ী কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থার জন্য দায়ী এই আদর্শ শাসন ব্যবস্থার ফলে দেশের পৃথক পৃথক অংশগুলো একই গ্রন্থিতে সংযোজিত হয়েছে।
দ্বিতীয়তঃ- দুনিয়ার কতকগুলো অতি সুন্দর স্থপতি শিল্পের জন্য।
তৃতীয়তঃ- উর্দু ভাষার ক্রমবিকাশের জন্য এই ভাষা আঞ্চলিক বাধা বিদূরিত করে দূর-দূরান্তের জনগণের নৈকট্য সাধন করেছে ও স্বাধীনভাবে আলাপ-আলোচনা ও ভাবের আদান-প্রদান করার সুযোগ দিয়েছে। শেষোক্ত দানটি প্রথমোক্ত দুইটার চাইতে অধিক স্থায়ী, কারণ শেষ পর্যন্ত বস্তুগত অলংকার অপেক্ষা সাহিত্য এবং কৃষ্টিই মনুষ্যজীবনে চিরস্থায়ী ছাপ রেখে যায়। বস্তুগত অলংকার ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে যায়; কিন্তু আদর্শ ও ভাবধারা বেঁচে থাকে।
ভাষা স্বতন্ত্রভাবে সমৃদ্ধশালী হয় না। ব্যবহারকারী জনগণের বাণীই ভাষা। কাজেই মুসলমানদিগকে একটা জাতি হিসাবে টিকে থাকার সংগ্রাম আর উর্দুকে জিইয়ে রাখার সংগ্রাম একই কথা। লক্ষ লক্ষ অমুসলমানের ভাষা ছিল এই উর্দু কিন্তু দেশ বিভাগের পূর্বে তারা উর্দুর দাবীকে প্রকাশ্যভাবে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নিন্দা করতে থাকে ও ইহার মর্যাদাহীন করতে প্রবৃত্ত হয়। এই সংগ্রামে উর্দুই এই উপমহাদেশের মুসলিম তমদ্দুন ও তাহজীবের সাহিত্য ভাণ্ডাররূপে পরিগণিত হয়েছিল। যে সকল মুসলমান উর্দুকে তাদের মাতৃভাষা বলে দাবী করেননি, তাঁরাও এ বিষয়টা উপলব্ধি করেছিলেন এবং উর্দুই তাঁদের জাতিত্ববোধের অন্যতম সহায়ক হয়েছিল।
ইতিহাস আজ উর্দুকে বিবিধ ভূমিকায় গ্রহণের ইশারা দিচ্ছে। উর্দু আজ পাকিস্তান ভারতের মধ্যে মৈত্রী বন্ধনের সেতু নির্মাণ করছে এবং পাকিস্তান তার নিজের তরফ থেকেও এই সেতু অটুট রাখার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আমরা আশা করি, অপর দিক থেকে শুভেচ্ছাকারীরাও উর্দুর ঐতিহাসিক ও তামুদুনিক বিশেষত্বের প্রশংসা করবেন।
পাকিস্তানে উর্দুর মাধ্যমেই আন্তঃপ্রাদেশিক আলাপ-আলোচনা ও সংবাদাদি আদান-প্রদান চলবে। উর্দু যদিও এদেশের লোকের মাতৃভাষা নয়; তথাপি ইহা তাঁদের মৌলিক ভাবধারার উপরই প্রতিষ্ঠিত এক দলের মতে পাঞ্জাব এবং অন্য দলের মতে সিন্ধু উর্দুর উৎপত্তি স্থান। সে যাই হোক, উর্দু সর্বদাই আমাদের দেশের শিক্ষিত লোকদের নিকট নিজ ভাষারূপে প্রিয় হয়ে রয়েছে। যুগ যুগ ধরে লাহোর ও ঢাকা উর্দুকে সমৃদ্ধিশালী করে শিক্ষার বাহনরূপে গ্রহণ করা হয়েছে। সিন্ধু প্রদেশেও উত্তরোত্তর উর্দুর জনপ্রিয়তা বেড়ে যাচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ উর্দুকে তাদের দ্বিতীয় ভাষারূপে গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেছে এবং আমি নিঃসংশয়ে বলতে পারি যে, উর্দু এবং বাংলা পরস্পরের সংমিশ্রণে উভয় ভাষাকেই সমৃদ্ধিশালী করবে।
পাকিস্তান কায়েম হওয়ার অব্যবহিত পরে ১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে করাচীতে পাকিস্তান এডুকেশনাল কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয় এবং তাতে উর্দুকেই আমাদের দেশের জাতীয় ভাষা বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ১৯৪৮ সালের প্রথম ভাগে বাবায়ে মিল্লাৎ মরহুম কায়েদে আজম পূর্ব বংগে শুভাগমন করেন এবং তিনিও এই সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেন। পাকিস্তান এডুকশেনাল কনফারেন্স এবং এডুকেশন এডভাইজারী বোর্ড আরো সুপারিশ করেন যে, যে সকল এলাকায় উর্দুকে অবশ্য পঠনীয় বিষয়রপে গ্রহণ করতে হবে। পূর্ব বংগ ও সিন্ধু প্রাদেশিক সরকার এই সুপারিশ গ্রহণ করেছেন এবং ইহা কার্য্যে পরিণত করার কাজও আরম্ভ করে দিয়েছেন। আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় বোর্ডের সমর্থনানুসারে শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ড পশ্চিম পাকিস্তানের সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে ইংরেজীর পরিবর্তে উর্দুকে শিক্ষার বাহন করার জন্যও সুপারিশ করেছন।
এ প্রসংগে আমি এ কথা বলতে চাই যে, প্রত্যেক ভাষাই তার নিজস্ব গতিশীলতা দ্বারা পরিচালিত হয় এবং প্রত্যক ভাষার মান নিণীত হয় সাহিত্য এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে তার অবদান দ্বারা। সাহিত্যের প্রসার বিরাট হলেই চলবে না। মানুষের আত্মার সংগে সংযোগ স্থাপনের জন্য তার গভীরতার প্রয়োজন আছে। তাছাড়া বিশ্ব সভ্যতার উন্নয়নের জন্য তার দান থাকা উচিত।
আমাদের আজাদী লাভের পর থেকেই উর্দুর উপর নতুন দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছে। উর্দুকে এই চ্যালেঞ্জ’ গ্রহণ করতেই হবে। সর্বকালে গ্রহণীয় প্রাচীন উর্দু সাহিত্য রক্ষার্থে আমাদের অনতিবিলম্বে যত্নবান হওয়া উচিত। পাকিস্তানেই প্রাচীন সাহিত্য পর্যায়ক্রমে মুদ্রিত হওয়া উচিত। আমার বিশ্বাস যে, আমাদের সাহিত্য প্রতিষ্ঠানগুলো এবং প্রকাশকগণ এই মহৎ কার্য্যে সহযোগিতা করবেন।
বর্তমান এবং ভবিষ্যতের মাপকাঠি দিয়েই অতীতের রূপ নির্ণয় করতে হবে। সাহিত্যকেও ঐতিহ্যপূর্ণ হতে হলে তা পারিপার্শ্বিকতাকে এবং বর্তমানকালকে অতিক্রম করে বহু উর্ধ্বে উঠতে হবে অথচ তাদের সংগে সম্বন্ধও পেয়েছে গোটা পাক-ভারত উপমহাদেশের একাধিক ভাষা থেকে শব্দ সঞ্চয়নের দ্বারা। এটা খুবই স্বাভাবিক যে, উর্দুর মাধ্যমে পাকিস্তানের জনশিক্ষা প্রসারের সংগে সংগে তাতে বাংলা, সিন্ধি ও পোশত ভাষার শব্দেরও ছাপ থাকবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যারা উর্দুর শুভাকাঙ্খী তারা উর্দুর এই সার্বজনীনতাকে সম্ভাষণই জানাবেন। আমি আশা করি, আমাদের দেশের লেখক এবং বুদ্ধিজীবীগণ পাকিস্তানের বিভিন্ন আশা-আকাঙ্খা এবং সমস্যা দ্বারা প্রভাবান্বিত হবেন এবং উর্দু সাহিত্যের তরক্কী সাধনে ব্রত হবেন।
আঞ্জুমানে তরক্কীয় উর্দু ও ইহার অধ্যবসায়ী সভাপতি মৌলবী আবদুল হক সাহেবকে শুকরিয়া আদায় করে আমি আমার বক্তব্যের ইতি করতে চাই।
কথিত আছে যে, কোন একটা প্রতিষ্ঠান একটি ব্যক্তিত্বের প্রতিবিম্বস্বরূপ। আঞ্জুমান ও মৌলবী আবদুল হক সাহেবের মধ্যে যে সম্পর্ক সে সম্পর্ক এই স্বতঃসিদ্ধ পুরোপুরিভাবেই প্রযোজ্য। এই আঞ্জুমানের মারফত উর্দুর তরকীর জন্য তিনি আজীবন যে সেবা করেছেন, তা আমাদের সাহিত্য ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, তার যোগ্য পরিচালনায় উর্দু কনফারেন্স উর্দু ভাষা ও সাহিত্যের তরকীর জন্য নতুন পথের সন্ধান দেবে।