বাংলা শব্দতত্ত্ব/অনুবাদ-চর্চা
অনুবাদ-চর্চা
শান্তিনিকেতন পত্রের পাঠকদের নিকট হইতে একটি ইংরেজি অনুবাদের বাংলা তরজমা চাহিয়াছিলাম। কতকগুলির উত্তর পাইয়াছিলাম। সকল উত্তরের সমালোচনা করি এমন স্থান আমাদের নাই। ইহার মধ্যে যেটা হাতে ঠেকিল সেইটেরই বিচার করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। প্রথম বাক্যটি এই: At every stage of their growth our forest and orcbard trees are subject to the attacks of hordes of insect enemies, which, if unchecked, would soon utterly destroy them। একজন তরজমা পাঠাইয়াছেন: “বৃদ্ধির প্রথম সোপানেই আমাদের আরণ্য ও উদ্দানস্থ ফল বৃক্ষ সমূহ কীটশত্রু সম্প্রদায় কর্তৃক আক্রমণের বিষয়ীভূত হয়, যাহারা প্রশমিত না হইলে অচিরেই তাহাদের সর্বতোভাবে বিনাশসাধন করিত।”
ইংরেজি বাক্য বাংলায় তরজমা করিবার সময় অনেকেই সংস্কৃত শব্দের ঘটা করিয়া থাকেন। বাংলা ভাষাকে ফাঁকি দিবার এই একটা উপায়। কারণ, এই শব্দগুলির পর্দার আড়ালে বাংলা ভাষারীতির বিরুদ্ধাচরণ অনেকটা ঢাকা পড়ে। বাংলা ভাষায় ‘যাহারা’ সর্বনামটি গণেশের মতো বাক্যের সর্বপ্রথম পূজা পাইয়া থাকে। ‘দস্যুদল পুলিসের হাতে ধরা পড়িল যাহারা গ্রাম লুটিয়াছিল’ বাংলায় এরূপ বলি না, আমরা বলি, “যাহারা গ্রাম লুটিয়াছিল সেই দস্যুদল পুলিসের হাতে ধরা পড়িল। The pilgrims took shelter in the temple, most of whom were starving— ইংরেজিতে এই ‘whom’ অসংগত নহে। কিন্তু বাংলায় ঐ বাক্যটি তরজমা করিবার বেলা যদি লিখি, ‘যাত্রীরা মন্দিরে আশ্রয় লইল যাহাদের অধিকাংশ উপবাস করিতেছিল’ তবে তাহা ঠিক শোনায় না। এরূপ স্থলে আমরা যাহারা সর্বনামের বদলে ‘তাহারা’-সর্বনাম ব্যবহার করি। আমরা বলি ‘যাত্রীরা মন্দিরে আশ্রয় লইল, তাহারা অনেকেই উপবাসী ছিল’। অতএব আমাদের আলোচ্য ইংরেজি প্যারাগ্রাফে যেখানে ‘which’ আছে সেখানে ‘যাহারা’ না হইয়া ‘তাহারা’ হইবে।
‘যে’ সর্বনাম সম্বন্ধে যে নিয়মের আলোচনা করিলাম তাহার ব্যতিক্রম আছে এখানে তাহার উল্লেখ থাকা আবশ্যক। ‘এমন’ সর্বনাম শব্দানুগত বাক্যাংশ বিকল্পে ‘যে’ সর্বনামের পূর্বে বসে। যথা: ‘এমন গরিব আছে যাহার ঘরে হাঁড়ি চড়ে না।’ ইহাকে উল্টাইয়া বলা চলে ‘যাহার ঘরে হাঁড়ি চড়ে না এমন গরিবও আছে।’ ‘এমন জলচর জীব আছে যাহারা স্তন্যপায়ী এবং ভাসিয়া উঠিয়া যাহাদিগকে খাস গ্রহণ করিতে হয়’। এই ‘এমন’ শব্দ না থাকিলে বাক্যের শেষভাগে ‘যাহাদিগকে’ শব্দ ব্যবহার করা যায় না। যেমন, ‘তিমি জাতীয় স্তন্যপায়ী জলে বাস করে, ভাসিয়া উঠিয়া যাহাদিগকে শ্বাস গ্রহণ করিতে হয়’— ইহা ইংরেজি রীতি; বাংলা রীতিতে যাহাদিগকে না বলিয়া তাহাদিগকে বলিতে হইবে।
ইংরেজিতে subject শব্দের অনেকগুলি অর্থ আছে তাহার মধ্যে একটি অর্থ, আলোচ্য প্রসঙ্গ। ইহাকেই আমরা বিষয় বলি। Subject of conversation, subject of discussion ইত্যাদির বাংলা— আলাপের বিষয়, তর্কের বিষয়। কিন্তু subject to cold ‘সর্দির বিষয়’ নহে। এরূপ স্থলে সংস্কৃত ভাষায় আস্পদ, পাত্র, ভাজন, অধীন, বশীভূত প্রভৃতির প্রয়োগ চলে। রোগাস্পদ, আক্রমণের পাত্র, মৃত্যুর বশীভূত ইত্যাদি প্রয়োগ চলিতে পারে।
আমাদের অনেক পত্রলেখকই subject কথাটাকে এড়াইয়া চলিয়াছেন। তাঁহারা লিখিয়াছেন কীটশত্রু ‘গাছগুলিকে আক্রমণ করে’। ইহাতে আক্রমণ ব্যাপারকে নিত্য ঘটনা বলিয়া স্বীকার করা হয়। কিন্তু subject to attack বলিলে বুঝায় এখনো আক্রমণ না হইলেও গাছগুলি আক্রমণের লক্ষ্য বটে।
ইংরেজি বাক্যটিকে আমি এইরূপ তরজমা করিয়াছি: ‘আমাদের বনের এবং ফলবাগানের গাছগুলি আপন বৃদ্ধিকালের প্রত্যেক পর্বে দলে দলে শত্রুকীটের আক্রমণভাজন হইয়া থাকে; ইহারা বাধা না পাইলে শীঘ্রই গাছগুলিকে সম্পূর্ণ নষ্ট করিত।’
‘What the loss our forest and shade trees would mean to us can better be imagined than described.’ পত্রলেখকের তরজমা: ‘বন্য ও ছায়াপাদপের ক্ষতি বলিতে কতটা ক্ষতি আমাদের বোধগম্য হয় তাহা বর্ণনা করা অপেক্ষা আমাদের অধিক উপলব্ধির বিষয়।’
‘বর্ণনা করা অপেক্ষা অধিক উপলব্ধির বিষয়’ এরূপ প্রয়োগ চলে না। একটা কিছু করার সঙ্গে আর-একটা কিছু করার তুলনা চাই। ‘বর্ণনা করা অপেক্ষা উপলব্ধি করা সহজ’ বলিলে ভাষায় বাধিত না বটে কিন্তু উপলব্ধি করা এবং imagine করা এক নহে।
আমাদের তরজমা: ‘আমাদের বন-বৃক্ষ এবং ছায়াতরুগুলির বিনাশ বলিতে যে কতটা বুঝায় তাহা বর্ণনা করা অপেক্ষা কল্পনা করা সহজ।’
‘Wood enters into so many products, that it is difficult to think of civilised man without it, while the fruits of the orchards are of the greatest importance.’
পত্রলেখকের তরজমা: ‘কাষ্ঠ হইতে এত দ্রব্য উৎপন্ন হয় যে, সভ্য মানবের পক্ষে উহাকে পরিহার করিবার চিন্তা অত্যন্ত কঠিন, এদিকে আমাদের উদ্যানজাত ফলসমূহও সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয়।’
কাষ্ঠ হইতে দ্রব্য নির্মিত হয়, উৎপন্ন হয় না। এখানে ‘উহাকে’ শব্দের ‘কে’ বিভক্তিচিহ্ন চলিতে পারে না। ‘ফল সমূহ সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয়’ বলিলে অত্যুক্তি করা হয়। ইংরেজিতে ‘are of the greatest importance' বলিতে এই বুঝায় যে পৃথিবীতে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়তা যে-সকল জিনিসের আছে, ফলও তাহার মধ্যে একটি। ‘সভ্য মানুষের পক্ষে উহাকে পরিহার করিবার চিন্তা অত্যন্ত কঠিন’ ইহা মূলের অনুগত হয় নাই।
আমাদের তরজমা: ‘কাঠ আমাদের এতপ্রকার সামগ্রীতে লাগে যে ইহাকে বাদ দিয়া সভ্য মানুষের অবস্থা চিন্তা করা কঠিন; এদিকে ফলবাগানের ফলও আমাদের যার-পর-নাই প্রয়োজনীয়।’
বলা বাহুল্য ‘যার-পর-নাই’ কথাটা শুনিতে যত একান্ত বড়ো, ব্যবহারে ইহার অর্থ তত বড়ো নহে।
Fortunately, the insect foes of trees are not without their own persistent enemies, and among them are many species of birds, whose equipment and habits specially fit them to deal with insects and whose entire lives are spent in pursuit of them.'
পত্রলেখকের তরজমা: ‘সৌভাগ্যক্রমে বৃক্ষের কীট-অরিগণও নিজেরা তাহাদের স্থায়ী শত্রুহস্ত হইতে মুক্ত নয়, এবং তাহাদের মধ্যে নানাজাতীয় পক্ষী আছে, যাহাদিগকে তাহাদের অভ্যাস ও দৈহিক উপকরণগুলি বিশেষভাবে কীটদিগের সহিত সংগ্রামে উপযোগী করিয়াছে এবং যাহাদিগের সমস্ত জীবন তাহাদিগকে অনুধাবন করিতে ব্যয়িত হয়।’
‘যে’ সর্বনাম শব্দের প্রয়োগ সম্বন্ধে পূর্বেই আমাদের বক্তব্য জানাইয়াছি।
আমাদের তরজমা: ‘ভাগ্যক্রমে বৃক্ষের শত্রু-কীট-সকলেরও নিজেদের নিত্যশক্রর অভাব নাই; এই শত্রুদের মধ্যে এমন অনেক জাতীয় পাখি আছে যাহাদের যুদ্ধোপকরণ এবং অভ্যাস সকল কীট-আক্রমণের পক্ষে বিশেষ উপযোগী এবং যাহারা কীট শিকারেই সমস্ত জীবন যাপন করে।’
ইংরেজিতে persistent কথাটি নিতান্ত সহজ। কথ্য বাংলায় আমরা বলি নাছোড়বান্দা। কিন্তু লেখায় সব জায়গায় ইহা চলে না। আমাদের একজন পত্রলেখক ‘দৃঢ়াগ্রহ’ শব্দ ব্যবহার করিয়াছেন। কিন্তু ‘আগ্রহ’ শব্দে, অন্তত বাংলায়, প্রধানত একটি মনোধর্ম বুঝায়। নিষ্ঠা শব্দেও সেইরূপ। Persistent শব্দের অর্থ, যাহা নিরস্তর লাগিয়াই আছে। ‘নির্বদ্ধ’ শব্দটিতে সেই লাগিয়া থাকা অর্থ আছে; ‘দৃঢ়নির্বদ্ধ’ কথাটা বড়ো বেশি অপরিচিত। এখানে কেবল মাত্র ‘নিত্য’ বিশেষণ যোগে ইংরেজি শব্দের ভাব স্পষ্ট হইতে পারে।
আমাদের আলোচ্য ইংরেজি প্যারাগ্রাফে একটি বাক্য আছে ‘among them are many species of birds’; আমাদের একজন ছাত্র এই species শব্দকে ‘উপজাতি’ প্রতিশব্দ দ্বারা তরজমা করিয়াছে। গতবারে ‘প্রতিশব্দ’ প্রবন্ধে[১] আমরাই speciesএর বাংলা ‘উপজাতি’ স্থির করিয়াছিলাম অথচ আমরাই এবারে কেন many ‘species of birds’কে ‘নানাজাতীয় পক্ষী’ বলিলাম তাহার কৈফিয়ত আবশ্যক। মনে রাখিতে হইবে এখানে ইংরেজিতে species পারিভাষিক অর্থে ব্যবহার করা হয় নাই। এখানে কোনো বিশেষ একটি মহাজাতীয় পক্ষীরই উপজাতিকে লক্ষ্য করিয়া species কথা বলা হয় নাই। বস্তুত কীটের যে-সব শক্র আছে তাহারা নানা জাতিরই পক্ষী— কাকও হইতে পারে শালিকও হইতে পারে, শুধু কেবল কাক এবং দাঁড়কাক শালিক এবং গাঙশালিক নহে। বস্তুত সাধারণ ব্যবহারে অনেক শব্দ আপন মর্যাদা লঙ্ঘন করিয়া চলে, কেহ তাহাতে আপত্তি করে না, কিন্তু পারিভাষিক ব্যবহারে কঠোরভাবে নিয়ম মানিয়া চলিতে হয়। যেমন বন্ধুর নিমন্ত্রণক্ষেত্রে মানুষ নিয়মের দিকে দৃষ্টি রাখে না, সামাজিক নিমন্ত্রণে তাহাকে নিয়ম বাঁচাইয়া চলিতে হয়— এও সেইরূপ।
আমাদের তরজমায় আমরা অর্থ স্পষ্ট করিবার খাতিরে দুই-একটা বাড়তি শব্দ বসাইয়াছি। যেমন শেষ বাক্যে মূলে যেখানে আছে, ‘and among them many species of birds’, আমরা লিখিয়াছি ‘এই শত্রুদের মধ্যে নানাজাতীয় পক্ষী আছে’— অবিকল অনুবাদ করিলে লিখিতে হইত এবং তাহাদের মধ্যে ইত্যাদি। ইংরেজিতে একটি সাধারণ নিয়ম এই যে, সর্বনাম শব্দ তাহার পূর্ববর্তী নিকটতম বিশেষ শব্দের সহিত সম্বন্ধবিশিষ্ট। এ স্থলে them সর্বনামের অনতিপূর্বেই আছে enemies, এইজন্য এখানে ‘তাহাদের’ বলিলেই শত্রুদের বুঝাইবে। বাংলায় এ নিয়ম পাকা নহে, এইজন্য, ‘তাহাদের মধ্যে নানাজাতীয় পক্ষী আছে’ বলিলে যদি কেহ হঠাৎ বুঝিয়া বসেন, ‘গাছেদের মধ্যে নানাজাতীয় পক্ষী আছে, অর্থাৎ পক্ষী বাসা বাঁধিয়া থাকে’ তবে তাঁহাকে খুব দোষী করা যাইবে না।
ইংরেজিতে ‘and’, আর বাংলায় এবং শব্দের প্রয়ােগ-ভেদ আছে। সেটা এখানে বলিয়া লই। ‘তাঁহার একদল নিন্দুক শত্রু আছে এবং তাহারা খবরের কাগজে তাঁহার নিন্দা করে’ এই বাক্যটা ইংরেজি ছাঁচের হইল। এ স্থলে আমরা ‘এবং’ ব্যবহার করি না। ‘তাঁহার একদল নিন্দুক শত্রু আছে এবং তাহারা সরকারের বেতনভােগী’। এখানেও ‘এবং’ বাংলায় চলে না। ‘তাঁহার একদল নিন্দুক শত্রু আছে এবং তিনি তাহাদিগকে গ্রাহ্য করেন না’ এরূপ স্থলে হয় ‘এবং’ বাদ দিই অথবা ‘কিন্তু’ বসাই। তাহার কারণ, ‘আছে’র সঙ্গে ‘আছে’, ‘করে’র সঙ্গে করে’, ‘হয়’-এর সঙ্গে ‘হয়’, মেলে, ‘আছে’র সঙ্গে ‘করে’, ‘করে’র সঙ্গে ‘হয়’ মেলে না। ‘তাঁহার শত্রু আছে এবং তাঁহার তিনটে মােটর গাড়ি আছে’— এই দুটি অসংশ্লিষ্ট সংবাদের মাঝখানেও ‘এবং’ চলে কিন্তু ‘তাঁহার শত্রু আছে এবং তিনি শৌখিন লােক’ এরূপ স্থলে ‘এবং’ চলে না, কেননা ‘তাঁর আছে’ এবং ‘তিনি হন’ এ দুটো বাক্যের মধ্যে ভাষার গতি দুই দিকে। এগুলাে যেন ভাষার অসবর্ণ বিবাহ, ইংরেজিতে চলে বাংলায় চলে না। ইংরেজির সঙ্গে বাংলার এই সূক্ষ্ম প্রভেদগুলি অনেক সময় অসতর্ক হইয়া আমরা ভুলিয়া যাই।
And শব্দযুক্ত ইংরেজি বাক্যে তরজমা করিতে গিয়া বারবার দেখিয়াছি তাহার অনেক স্থলেই বাংলায় ‘এবং’ শব্দ খাটে না। তখন আমার এই মনে হইয়াছে ‘এবং’ শব্দটা লিখিত বাংলায় পণ্ডিতদের কর্তৃক নূতন আমদানী, ইহার মানে ‘এইরূপ’। ‘আর’ শব্দ ‘অপর’ শব্দ হইতে উৎপন্ন, তাহার মানে ‘অন্যরূপ’। ‘তাঁহার ধন আছে এবং মান আছে’ বলিলে বুঝায় তাঁহার যেমন ধন আছে সেইরূপ মানও আছে। ‘তিনি প’ড়ে গেলেন, আর, একটা গাড়ি তাঁর পায়ের উপর দিয়ে চলে গেল’— এখানে পড়িয়া যাওয়া একটা ঘটনা, অন্য ঘটনাটা অপর প্রকারের, সেইজন্য ‘আর’ শব্দটা খাটে। ‘তিনি পড়িয়া গেলেন এবং আঘাত পাইলেন’ এখানে দুইটি ঘটনার প্রকৃত যোগ আছে। ‘তিনি পড়িয়া গেলেন এবং তাঁহার পায়ের উপর দিয়া গাড়ি চলিয়া গেল’, এখানে ‘এবং’ শব্দটা বেখাপ। এরূপ বেখাপ প্রয়োগ কেহ করেন না বা আমি করি না এমন কথা বলি না কিন্তু ইহা যে বেখাপ তাহার উদাহরণ গতবারের শান্তিনিকেতন পত্রে কিছু কিছু দিয়াছি। He has enemies and they are paid by the Government ইহার বাংলা, ‘তাঁর শত্রু আছে; তারা সরকারের বেতন খায়’। এখানে ‘এবং’ কথাটা অচল। তাহার কারণ, এখানে দুই ঘটনা দুইরূপ। ‘তাঁহার পুত্র আছে এবং কন্যা আছে।’ ‘তাঁহার গাড়ি আছে এবং ঘোড়া আছে’। এ-সব জায়গায় ‘এবং’ জোরে আপন আসন দখল করে।
আশ্বিন-কার্তিকের সংখ্যার শান্তিনিকেতনে বলিয়াছিলাম যে ‘এবং’ শব্দ দিয়া যোজিত দুই বাক্যাংশের মধ্যে ক্রিয়াপদের রূপের মিল থাকা চাই। যেমন ‘সে দরিদ্র এবং সে মূর্খ’ ‘সে চরকা কাটে এবং ধান ভানে’—প্রথম বাক্যটির দুই অংশই অস্তিত্ববাচক, শেষের বাক্যটির দুই অংশই কর্তৃত্ববাচক। সে দরিদ্র এবং সে ধান ভানিয়া খায় আমার মতে এটা খাঁটি নহে। আমরা এরূপ স্থলে ‘এবং’ ব্যবহারই করি না, বলি, ‘সে দরিদ্র, ধান ভানিয়া খায়’। অথচ ইংরেজিতে অনায়াসে বলা চলে, She is poor and lives on husking rice।
‘রাম ধনী এবং তার বাড়ি তিনতলা’ এরূপ প্রয়োগ আমরা সহজে করি না। আমরা বলি, ‘রাম ধনী, তার বাড়ি তিন তলা।’
‘যার জমি আছে এবং সেই জমি যে চাষ করে এমন গৃহস্থ এই গ্রামে নেই’— এরূপ বাক্য বাংলায় চলে। বস্তুত এখানে ‘এবং’ উহ্য রাখিলে চলেই না। পূর্বোক্ত বাক্যে ‘এমন’ শব্দটি তৎপূর্ববর্তী সমস্ত শব্দগুলিকে জমাট করিয়া দিয়াছে। এমন, কেমন? না, ‘যার-জমি-আছে-এবং-সেই-জমি-যে-নিজে-চাষ-করে’ সমস্তটাই গৃহস্থ শব্দের এক বিশেষণ পদ। কিন্তু ‘তিনি স্কুল মাস্টার এবং তাঁর একটি খোঁড়া কুকুর আছে’ বাংলায় এখানে ‘এবং’ খাটে না, তার কারণ এখানে দুই বাক্যাংশ পৃথক, তাহাদের মধ্যে রূপের ও ভাবের ঘনিষ্ঠতা নাই। আমরা বলি, ‘তিনি স্কুল মাস্টার, তাঁর একটি খোঁড়া কুকুর আছে।’ কিন্তু ইংরেজিতে বলা চলে, He is a school master and he has a lame dog।
সংস্কৃত ভাষায় যে-সব জায়গায় দ্বন্দ্ব সমাস খাটে, চলিত বাংলায় আমরা সেখানে যোজক শব্দ ব্যবহার করি না। আমরা বলি, ‘হাতি ঘোড়া লোক লশকর নিয়ে রাজা চলেছেন’ ‘চৌকি টেবিল আলনা আলমারিতে ঘরটি ভরা।’ ইংরেজিতে উভয় স্থলেই একটা and না বসাইয়া চলে না। যথা ‘The king marches with his elephants, horses and soldiers’, ‘The room is full of chairs, tables, clothes, racks and almirahs’।
বাংলায় আর-একটি নূতন আমদানি যোজক শব্দ ‘ও’। লিখিত বাংলায় পণ্ডিতেরা ইহাকে ‘and’ শব্দের প্রতিশব্দরূপে গায়ের জোরে চালাইয়া দিয়াছেন। কিন্তু মুখের ভাষায় কখনই এরূপ ব্যবহার খাটে না। আমরা বলি ‘রাজা চলেছেন, তাঁর সৈন্যও চলেছে’। ‘রাজা চলিয়াছেন ও তাঁহার সৈন্যদল চলিয়াছে’ ইহা ফোর্ট উইলিয়ামের গোরাদের আদেশে পণ্ডিতদের বানানো বাংলা। এখন ‘ও’ শব্দের এইরূপ বিকৃত ব্যবহার বাংলা লিখিত ভাষায় এমনি শিকড় গাড়িয়াছে যে তাহাকে উৎপাটিত করা আর চলিবে না। মাঝে হইতে খাঁটি বাংলা যোজক ‘আর’ শব্দকে পণ্ডিতেরা বিনা অপরাধে লিখিত বাংলা হইতে নির্বাসিত করিয়াছেন। আমরা মুখে বলিবার বেলা বলি ‘সে চলেছে, আর কুকুরটি পিছন পিছন চলেছে’ অথবা ‘সে চলেছে, তার কুকুরটিও পিছন পিছন চলেছে’ কিন্তু লিখিবার বেলা লিখি ‘সে চলিয়াছে ও (কিংবা এবং) তাহার কুকুরটি তাহার অনুসরণ করিতেছে।’ ‘আর’ শব্দটিকে কি আর-একবার তার স্বস্থানে ফিরাইয়া আনিবার সময় হয় নাই? একটা সুখের কথা এই যে, পণ্ডিতদের আশীর্বাদ সত্বেও ‘এবং’ শব্দটা বাংলা কবিতার মধ্যে প্রবেশ করিবার পথ পায় নাই।
১৩২৬
- ↑ দ্রষ্টব্য: প্রতিশব্দ ১, পৃ. ১৮৩-১৮৫