বাংলা শব্দতত্ত্ব/প্রতিশব্দ-প্রসঙ্গ

প্রতিশব্দ-প্রসঙ্গ

“কেনেষিতং পততি প্রেষিতং মনঃ।
কেন প্রাণঃ প্রথমঃ প্রৈতিযুক্তঃ।···

 ‘প্রৈতি’ শব্দটির প্রতি আমরা পাঠকদের মনোযোগ আকর্ষণ করিতে ইচ্ছা করি। বাংলা ভাষায় এই শব্দটির অভাব আছে। যেখানে বেগপ্রাপ্তি বুঝাইতে ইংরেজিতে impulse শব্দের ব্যবহার হয় আমাদের বিবেচনায় বাংলায় সেই স্থলে প্রৈতি শব্দের প্রয়োগ হইতে পারে।”[১]

শ্রীযুক্ত সুবোধচন্দ্র মহলানবিশ জীবতত্ত্ব সম্বন্ধে কয়েকটি কথা লিখিয়াছেন।··· প্রবন্ধে যে দু-একটি পারিভাষিক শব্দ আছে, তৎসম্বন্ধে আলোচনা অপ্রাসঙ্গিক হইবে না। বাংলায় এভোল্যুশন্ থিওরি-র অনেকগুলি প্রতিশব্দ চলিয়াছে। লেখক মহাশয় তাহার মধ্যে হইতে ক্রমবিকাশতত্ত্ব বাছিয়া লইয়াছেন। পূজ্যপাদ দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় এরূপ স্থলে অভিব্যক্তিবাদ শব্দ ব্যবহার করেন। অভিব্যক্তি শব্দটি সংক্ষিপ্ত; ক্রমে ব্যক্ত হইবার দিকে অভিমুখভাব অভি উপসর্গযোগে সুস্পষ্ট; এবং শব্দটিকে অভিব্যক্ত বলিয়া বিশেষণে পরিণত করা সহজ। তা ছাড়া ব্যক্ত হওয়া শব্দটির মধ্যে ভালোমন্দ উন্নতি-অবনতির কোনো বিচার নাই; বিকাশ শব্দের মধ্যে একটি উৎকর্ষ অর্থের আভাস আছে। লেখক মহাশয় natural selection-কে বাংলায় নৈসর্গিক মনোনয়ন বলিয়াছেন। এই সিলেক্‌শন্ শব্দের চলিত বাংলা ‘বাছাই করা’। বাছাই কার্য যন্ত্রযোগেও হইতে পারে; বলিতে পারি চা-বাছাই করিবার যন্ত্র, কিন্তু চা মনোনীত করিবার যন্ত্র বলিতে পারি না। মন শব্দের সম্পর্কে মনোনয়ন কথাটার মধ্যে ইচ্ছা-অভিরুচির ভাব আসে। কিন্তু প্রাকৃতিক সিলেক্‌শন্ যন্ত্রবৎ নিয়মের কার্য, তাহার মধ্যে ইচ্ছার অভাবনীয় লীলা নাই। অতএব বাছাই শব্দ এখানে সংগত। বাংলায় বাছাই শব্দের সাধু প্রয়োগ নির্বাচন। ‘নৈসর্গিক নির্বাচন’ শব্দে কোনো আপত্তির কারণ আছে কি না জানিতে ইচ্ছুক আছি। Fossil শব্দের সংক্ষেপে ‘শিলাবিকার’ বলিলে কিরূপ হয়?[২] Fossilized শব্দকে বাংলায় শিলাবিকৃত অথবা শিলীভূত বলা যাইতে পারে।[৩]

 ১৩০৮

‘চরিত্র নীতি’ প্রবন্ধটির লেখক শ্রীযুক্ত খগেন্দ্রনাথ মিত্র।··· ইংরেজি ethics শব্দকে তিনি বাংলায় চরিত্রনীতি নাম দিয়াছেন। অনেকে ইহাকে নীতি ও নীতিশাস্ত্র বলেন— সেটাকে লেখক পরিত্যাগ করিয়া ভালোই করিয়াছেন; কারণ নীতি শব্দের অর্থ সকল সময় ধর্মানুকূল নহে।

প্রহরিষ্যন্ প্রিয়ং ব্রূয়াৎ প্রহৃত্যাপি প্রিয়োত্তরম্।
অপিচাস্য় শিরশ্ছিত্ত্বা রুদ্যাৎ শোচেৎ তথাপি চ।


মারিতে মারিতে কহিবে মিষ্ট,
মারিয়া কহিবে আরো।
মাথাটা কাটিয়া কাঁদিয়া উঠিবে
যতটা উচ্চে পারো।

 ইহাও এক শ্রেণীর নীতি, কিন্তু এথিক্‌স্‌ নহে। সংস্কৃত ভাষায় ধর্ম বলিতে মুখ্যত এথিক্‌স্‌ বুঝায়, কিন্তু ধর্মের মধ্যে আরো অনেক গৌণ পদার্থ আছে। মৌনী হইয়া ভোজন করিবে, ইহা ব্রাহ্মণের ধর্ম হইতে পারে কিন্তু ইহা এথিক্‌স্‌ নহে। অতএব চরিত্রনীতি শব্দটি উপযুক্ত হইয়াছে, কিন্তু ইহাকে আর-একটু সংহত করিয়া ‘চারিত্র’ বলিলে ব্যবহারের পক্ষে সুবিধাজনক হয়। চরিত্রনীতিশিক্ষা, চরিত্রনীতিবোধ, চরিত্রনৈতিক উন্নতি অপেক্ষা ‘চারিত্রশিক্ষা, ‘চারিত্রবোধ’, ‘চারিত্রোন্নতি’ আমাদের কাছে সংগত বোধ হয়।··· আরএকটি কথা জিজ্ঞাস্য, metaphysics শব্দের বাংলা কি ‘তত্ত্ববিদ্যা’ নহে।[৪]

লেখক মহাশয় [উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী] সেন্‌ট্রিপীটাল ও সেন্‌ট্রিফ্যুগাল ফোর্স-কে কেন্দ্রাভিসারিণী ও কেন্দ্রাপগামিনী শক্তি বলিয়াছেন― কেন্দ্রানুগ এবং কেন্দ্রাতিগ শক্তি আমাদের মতে সংক্ষিপ্ত ও সংগত।[৫]

 ১৩০৮

লেখক মহাশয় ইংরেজি ফসিল্ শব্দের বাংলা করিয়াছেন ‘প্রস্তরীভূত কঙ্কাল’। কিন্তু উদ্‌ভিদ্‌ পদার্থের ফসিল্‌ সম্বন্ধে কঙ্কাল শব্দের প্রয়োগ কেমন করিয়া হইবে। ‘পাতার কঙ্কাল’ ঠিক বাংলা হয় না।··· ফসিলের প্রতিশব্দ শিলাবিকার হইতে পারে, এরূপ মন্তব্য প্রকাশ করিয়াছিলাম। কিন্তু মহলানবিশ মহাশয়ের সহিত আলোচনা করিয়া দেখিয়াছি ‘শিলাবিকার’ metamorphosed rock-এর উপযুক্ত ভাষান্তর হয়, এবং জীবশিলা শব্দ ফসিলের প্রতিশব্দরূপে ব্যবহৃত হইতে পারে।[৬]

 ১৩০৮

বাংলায় বৈজ্ঞানিক পরিভাষা স্থির হয় নাই, অতএব পরিভাষার প্রয়োগ লইয়া আলোচনা কর্তব্য, কিন্তু বিবাদ করা অসংগত। ইংরেজি মিটিয়রলজির বাংলা-প্রতিশব্দ এখনো প্রচলিত হয় নাই, সুতরাং জগদানন্দবাবু যদি আপ্তের সংস্কৃত অভিধানের দৃষ্টান্তে ‘বায়ুনভোবিদ্যা’ ব্যবহার করিয়া কাজ চালাইয়া থাকেন, তাঁহাকে দোষ দিতে পারি না। যোগেশবাবু ‘আবহ’ শব্দ কোনো প্রাচীন গ্রন্থ হইতে উদ্ধার করিয়াছেন, তাহার অর্থ ভূবায়ু। কিন্তু এই ভূবায়ু বলিতে প্রাচীনেরা কী বুঝিতেন, এবং তাহা আধুনিক অ্যাট্‌মস্‌ফিয়ার শব্দের প্রতিশব্দ কি না, তাহা বিশেষরূপে প্রমাণের অপেক্ষা রাখে— এক কথায় ইহার মীমাংসা হয় না। অগ্রে সেই প্রমাণ উপস্থিত না করিয়া জোর করিয়া কিছু বলা যায় না। শকুন্তলার সপ্তম অঙ্কে দুষ্যন্ত যখন স্বর্গলোক হইতে মর্ত্যে অবতরণ করিতেছেন, তখন মাতলিকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এখন আমরা কোন্ বায়ুর অধিকারে আসিয়াছি।” মাতলি উত্তর করিলেন, “গগনবর্তিনী মন্দাকিনী যেখানে বহমানা, চক্রবিভক্তরশ্মি জ্যোতিষ্কলোক যেখানে বর্তমান, বামনবেশধারী হরির দ্বিতীয় চরণপাতে পবিত্র এই স্থান ধুলিশূন্য প্রবহবায়ুর মার্গ।” দেখা যাইতেছে, প্রাচীনকালে ‘প্রবহ’ প্রভৃতি বায়ুর নাম তৎকালীন একটি কাল্পনিক বিশ্বতত্ত্বের মধ্যে প্রচলিত ছিল―সেগুলি একটি বিশেষ শাস্ত্রের পারিভাষিক প্রয়োগ। দেবীপুরাণে দেখা যায়:

প্রাবাহো নিবহশ্চৈব উদ্বহঃ সংবহস্তথা
বিবহঃ প্রবহশ্চৈব পরিবাহস্তথৈব চ
অন্তরীক্ষে চ বাহ্যে তে পৃথঙ্‌মার্গবিচারিণঃ।

 এই-সকল বায়ুর নাম কি আধুনিক মিটিয়রলজির পরিভাষার মধ্যে স্থান পাইতে পারে। বিশেষ শাস্ত্রের বিশেষ মত ও সংজ্ঞার দ্বারা তাহার পরিভাষাগুলির অর্থ সীমাবদ্ধ, তাহাদিগকে নির্বিচারে অন্যত্র প্রয়োগ করা যায় না। অপর পক্ষে নভঃ শব্দ পারিভাষিক নহে, তাহার অর্থ আকাশ, এবং সে-আকাশ বিশেষরূপে মেঘের সহিত সম্বন্ধযুক্ত সেইজন্য নভঃ ও নভস্য শব্দে শ্রবণ ও ভাদ্র মাস বুঝায়। কিন্তু নভঃ শব্দের সহিত পুনশ্চ বায়ু শব্দ যোগ করিবার প্রয়োজন নাই, এ কথা স্বীকার করি। আপ্তেও তাঁহার অভিধানে তাহা করেন নাই; তাঁহার আভিধানিক সংকেত অনুসারে নভোবায়ু-বিদ্যা বলিতে নভোবিদ্যা বা বায়ুবিদ্যা বুঝাইতেছে। ‘নভোবিদ্যা’ মিটিয়রলজির প্রতিশব্দরূপে ব্যবহৃত হইলে সাধারণের সহজে বোধগম্য হইতে পারে।[৭]

 ১৩০৮

প্রতিষ্ঠান কথাটা আমাকে বানাইতে হইল। ইংরেজি কথাটা institution। ইহার কোনো বাংলা প্রচলিত প্রতিশব্দ পাইলাম না। যে প্রথা কোনো-একটা বিশেষ ব্যবস্থাকে অবলম্বন করিয়া দেশে প্রতিষ্ঠালাভ করা যায়, তাহাকে প্রতিষ্ঠান বলিতে দোষ দেখি না। Ceremony শব্দের বাংলা অনুষ্ঠান এবং institution শব্দের বাংলা প্রতিষ্ঠান করা যাইতে পারে।[৮]

 ১৩১২

  1. সাধনা, ৪র্থ বর্ষ ১ম ভাগ, পৃ ১৯০ পাদটীকা
  2. দ্রষ্টব্য: ‘প্রতিশব্দ-প্রসঙ্গ’ ৫}}
  3. মাসিক সাহিত্য সমালোচনা, বঙ্গদর্শন, বৈশাখ ১৩০৮, পৃ ৬২-৬৩
  4. সাহিত্যপ্রসঙ্গ, বঙ্গদর্শন, বৈশাখ ১৩০৮, পৃ ৬৩
  5. মাসিক সাহিত্য সমালোচনা, বঙ্গদর্শন, বৈশাখ ১৩০৮, পৃ ৬৫}}
  6. মাসিক সাহিত্য সমালোচনা, বঙ্গদর্শন, আষাঢ় ১৩০৮, পৃ ১৭৭
  7. মাসিক সাহিত্য সমালোচনা, বঙ্গদর্শন, আষাঢ় ১৩০৮,পৃ ১৪৫-৪৬}}
  8. ভাণ্ডার, বৈশাখ ১৩১২, পৃ ৫২