বাংলা শব্দতত্ত্ব/কালচার ও সংস্কৃতি
কালচার ও সংস্কৃতি
১
কাল্চার্ শব্দের একটা নতুন বাংলা কথা হঠাৎ দেখা দিয়েছে; চোখে পড়েছে কি? কৃষ্টি।[১] ইংরেজি শব্দটার অভিধানিক অর্থের বাধ্য অনুগত হয়ে ঐ কুশ্রী শব্দটাকে কি সহ্য করতেই হবে। এঁটেল পােকা পশুর গায়ে যেমন কাম্ড়ে ধরে ভাষার গায়ে ওটাও তেমনি কামড়ে ধরেছে। মাতৃভাষার প্রতি দয়া করবে না তােমরা?
অন্য প্রদেশে ভদ্রতা বােধ আছে। এই অর্থে সেখানে ব্যবহার ‘সংস্কৃতি’। যে-মানুষের কালচার আছে তাকে বলা চলে সংস্কৃতিমান, শব্দটাকে বিশেষ করে যদি বলা যায় সংস্কৃতিমত্তা, ওজনে ভারি হয় বটে কিন্তু রােমহর্ষক হয় না। নিজের সম্বন্ধে অহংকার করা শাস্ত্রে নিষিদ্ধ, তবু আন্দাজে বলতে পারি, বন্ধুরা আমাকে কাল্চার্ড বলেই গণ্য করেন। কিন্তু যদি তাঁরা আমাকে সহসা কৃষ্টিমান উপাধি দেন বা আমার কষ্টিমত্তা সম্বন্ধে ভালােমন্দ কোনাে কথার উত্থাপন করেন তবে বন্ধুবিচ্ছেদ হবে। অন্তত আমার মধ্যে কৃষ্টি আছে এ কথার প্রতিবাদ করাকে আমি আত্মলাঘব মনে করব না।
ইংরেজি ভাষায় চাষ এবং ভব্যতা একই শব্দে চলে গেছে ব’লে কি আমরাও বাংলা ভাষায় ফিরিঙ্গিয়ানা করব? ইংরেজিতে সুশিক্ষিত মানুষকে বলে কাল্টিভেটেড— আমরা কি সেইরকম উঁচুদরের মানুষকে চাষ করা মানুষ ব’লে সম্মান জানাব, অথবা বলব কেদারনাথ।
[সংস্কৃত ভাষায় উৎকর্য প্রকর্ষ শব্দের ধাতুগত অর্থে চাষের ভাব আছে কিন্তু ব্যবহারে সে অর্থ কেটে গেছে। কৃষ্টিতে তা কাটে নি। সেইজন্যে তােমাদের সম্পাদকবর্গের কাছে আমার এই প্রশ্ন, চিৎপ্রকর্ষ বা চিত্তপ্রকর্ষ বা চিত্তোৎকর্ষ শব্দটাকে কালচার অর্থে চালালে দোষ কি? কাল্চার্ড মানুষকে প্রকৃষ্টচিত্ত লােক বলা যেতে পারে। কালচার্ড্ ফ্যামিলিকে প্রকর্ষবান পরিবার বললে সে-পরিবার গৌরব বােধ করবে। কিন্তু কৃষ্টিমান বললে চন্দনের সাবান মেখে স্নান করতে ইচ্ছা হবে।][২]
২
গত জ্যৈষ্ঠের (১৩৪২) ‘প্রবাসী’তে একস্থানে ইংরেজি ‘কাল্চার’ শব্দের প্রতিশব্দ রূপে “কৃষ্টি” শব্দের ব্যবহার দেখে মনে খট্কা লাগল। বাংলা খবরের কাগজে একদিন হঠাৎ-ব্রণের মতো ওই শব্দটা চোখে পড়ল, তার পরে দেখলুম ওটা বেড়েই চলেছে। সংক্রামকতা খবরের কাগজের বস্তি ছাড়িয়ে উপর মহলেও ছড়িয়ে পড়ছে দেখে ভয় হয়। ‘প্রবাসী’ পত্রে ইংরেজি অভিধানের এই ‘অবদান’টি সংস্কৃত ভাষার মুখোশ প’রে প্রবেশ করেছে, এটা নিঃসন্দেহ অনবধানতাবশত। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি বর্তমান বাংলাসাহিত্যে ‘অবদান’ শব্দটির যে প্রয়োগ দেখতে দেখতে ব্যাপ্ত হল সংস্কৃত শব্দকোষে তা খুঁজে পাই নি।
এবারে সেই গোড়াকার কথাটায় ফেরা যাক। কৃষ্টি কথাটা হঠাৎ তীক্ষ্ণ কাঁটার মতো বাংলা ভাষার পায়ে বিঁধেছে। চিকিৎসা করা যদি সম্ভব না হয় অন্তত বেদনা জানাতে হবে। ঐ শব্দটা ইংরেজি শব্দের পায়ের মাপে বানানো। এতটা প্রণতি ভালো লাগে না।
ভাষায় কখনো কখনো দৈবক্রমে একই শব্দের দ্বারা দুই বিভিন্ন জাতীয় অর্থজ্ঞাপনের দৃষ্টান্ত দেখা যায়, ইংরেজিতে কাল্চার কথাটা সেই শ্রেণীর। কিন্তু অনুবাদের সময়েও যদি অনুরূপ কৃপণতা করি তবে সেটা নিতান্তই অনুকরণ-প্রবণতার পরিচায়ক।
সংস্কৃত ভাষায় কর্ষণ বলতে বিশেষভাবে চাষ করাই বোঝায়। ভিন্ন ভিন্ন উপসর্গযোগে মূল ধাতুটাকে ভিন্ন ভিন্ন অর্থবাচক করা যেতে পারে, সংস্কৃত ভাষার নিয়মই তাই। উপসর্গভেদে এক কৃ ধাতুর নানা অর্থ হয়, যেমন উপকার বিকার আকার। কিন্তু উপসর্গ না দিয়ে কৃতি শব্দকে আকৃতি প্রকৃতি বা বিকৃতি অর্থে প্রয়োগ করা যায় না। উৎ বা প্র উপসর্গযোগে কৃষ্টি শব্দকে মাটির থেকে মনের দিকে তুলে নেওয়া যায়, যেমন উৎকৃষ্ট, প্রকৃষ্টি। ইংরেজি ভাষার কাছে আমরা এমনি কী দাসখৎ লিখে দিয়েছি যে তার অবিকল অনুবর্তন করে ভৌতিক ও মানসিক দুই অসবর্ণ অর্থকে একই শব্দের পরিণয়-গ্রন্থিতে আবদ্ধ করব?
বৈদিক সাহিত্যে সংস্কৃতি শব্দের ব্যবহার পাওয়া যায়, তাতে শিল্প সম্বন্ধেও সংস্কৃতি শব্দের প্রয়োগ আছে। ‘আত্মসংস্কৃতির্বাব শিল্পানি।’ এ’কে ইংরেজি করা যেতে পারে, Arts indeed are the culture of soul। ‘ছন্দোময়ং বা এতৈর্যজমান আত্মানং সংস্কুরুতে’— এই-সকল শিল্পের দ্বারা যজমান আত্মার সংস্কৃতি সাধন করেন। সংস্কৃত ভাষা বলতে বোঝায় যে ভাষা বিশেষভাবে cultured, যে ভাষা cultured সম্প্রদায়ের। মারাঠি হিন্দী প্রভৃতি অন্যান্য প্রাদেশিক ভাষায় সংস্কৃতি শব্দটাই কাল্চার অর্থে স্বীকৃত হয়েছে। সাংস্কৃতিক ইতিহাস (cultural history) ক্রৈষ্টিক ইতিহাসের চেয়ে শোনায় ভালো। সংস্কৃত চিত্ত, সংস্কৃত বুদ্ধি cultured mind, cultured intelligence অর্থে কৃষ্টচিত্ত কৃষ্টবুদ্ধির চেয়ে উৎকৃষ্ট প্রয়োগ সন্দেহ নেই। যে মানুষ cultured তাকে কৃষ্টিমান বলার চেয়ে সংস্কৃতিমান বললে তার প্রতি সম্মান করা হবে।[৩]
৩
মনিয়র বিলিয়ম্সের অভিধানে কৃষ্টি ও সংস্কৃতি ও তার আনুষঙ্গিক শব্দের ইংরেজি কয়েকটি প্রতিশব্দ নিম্নে উদ্ধৃত করা গেল। বর্তমান আলোচ্য প্রসঙ্গে যেগুলি অনাবশ্যক সেগুলি বাদ দিয়েছি।
কৃষ্ট―ploughed or tilled, cultivated ground।
কৃষ্টি―men, races of men, learned man or pandit, ploughing or cultivating the soil।
সংস্কার―making perfect, accomplishment, embellishment।
সংস্কৃত―perfected, refined, adorned, polished, a learned man।
সংস্কৃতি-perfection।
কার্তিক ১৩৪২
- ↑ দ্রষ্টব্য প্রতিশব্দ ১৪}}
- ↑ ১৩৩৯ মাঘ সংখ্যা পরিচয় পত্রে চিহ্নবিভ্রাট নামে প্রকাশিত সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে লিখিত পত্রের শেষাংশ। বাংলা শব্দতত্ত্বের ১৩৪২ সংস্করণ অনুযায়ী পত্রের অংশ দুই অংশে স্বতন্ত্রভাবে সন্নিবিষ্ট হইল। []-বন্ধনী-ভুক্ত অংশ ঐ সংস্করণে বর্জিত।
- ↑ প্রবাসী ভাদ্র ১৩৪২ সংখ্যায় এই প্রবন্ধ প্রকাশিত হইলে প্রবাসী আশ্বিন সংখ্যায় যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি এই প্রসঙ্গে লেখেন—
“Culture of mind অর্থে কৃষ্টি শব্দ প্রচলিত হয়েছে। গত ভাদ্রের প্রবাসীতে রবীন্দ্রনাথ আপত্তি তুলেছেন।
বোধ হয়, প্রথমে আমি কৃ-ষ্টি শব্দ প্রয়োগ করি। সে দশ-বার বৎসর পূর্বের কথা। আমি এখনও কৃ-ষ্টি লিখে থাকি। সং-স্কৃ-তি দেখেছি, কিন্তু আমার মনে লাগে নি। সং-স্কৃ-তি ও সং-স্কা-র অর্থে এক। সং-স্কা-র শব্দের নানা অর্থ আছে। মেদিনীকোষ তিনটি মূলার্ধ দিয়েছেন -প্রতিযত্ন, অনুভব, মানসকর্ম। কৃ-ষ্টি শব্দের এত ব্যাপক অর্থ নাই।
অমরকোষে পণ্ডিত শব্দের বত্রিশটি সমার্থ শব্দ আছে। তন্মধ্যে কৃ-ষ্টি একটা। মেদিনীকোষ কৃ-ষ্টি শব্দের দুইটা অর্থই ধরেছেন, পুংলিঙ্গে ‘বুধ’, স্ত্রীলিঙ্গে ‘আকর্ষ’। ভূমির কর্ষণ হয়, চিত্ত ভূমিরও কর্ষণ হতে পারে। রামপ্রসাদ তার সাক্ষী।
পশ্চিমদেশের সংস্পর্শে সে দেশের নানা সংস্কার আসছে নুতন নূতন শব্দও রচিত হচ্ছে। ভাগ্যক্রমে কৃ-ষ্টি নব-রচিত নয়, কিন্তু অর্থে অবিকল culture।”
বিদ্যানিধি মহাশয় মেদিনীকোষ ও অমরকোষের উল্লেখ করিয়াছিলেন, এইসূত্রে, মনিয়ার বিলিয়ম্সের অভিধান হইতে সংস্কৃতি, কৃষ্টি প্রভৃতি শব্দের যে-সকল প্রতিশব্দ রবীন্দ্রনাথ উদ্ধৃত করেন, এই আলোচনার তৃতীয় নিবন্ধরূপে তাহা মুদ্রিত হইল।
এটি “কালচার” নামে প্রবাসী ১৩৪২ ভাদ্র সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। ইহার অংশবিশেষ বাংলা শব্দতত্ত্বের দ্বিতীয় পরিবর্ধিত সংস্করণে (অগ্রহায়ণ ১৩৪২) ‘ভাষার খেয়াল’ নামে এক স্বতন্ত্র প্রবন্ধাকারে সংকলিত