বাংলা শব্দতত্ত্ব/ভাষার খেয়াল

ভাষার খেয়াল

ভাষা যে সব সময়ে ঘোগ্যতম শব্দের বাছাই করে কিংবা যোগ্যতম শব্দকে বাঁচিয়ে রাখে তার প্রমাণ পাই নে। ভাষায় চলিত একটা শব্দ মনে পড়ছে ‘জিজ্ঞাসা করা’। এ রকম বিশেষ্য-জোড়া ওজনে ভারী ক্রিয়াপদে ভাষার অপটুত্ব জানায়। প্রশ্ন করা ব্যাপারটা আপামর সাধারণের নিত্যব্যবহার্য অথচ ওটা প্রকাশ করবার কোনো সহজ ধাতুপদ বাংলায় দুর্লভ এ কথা মানতে সংকোচ লাগে। বিশেষ্য বা বিশেষণ রূপকে ক্রিয়ার রূপে বানিয়ে তোলা বাংলায় নেই যে তা নয়। তার উদাহরণ যথা— ঠ্যাঙানো, কিলোনো, ঘুমোনো, গুঁতোনো, চড়ানো, লাথানো, জুতোনো। এগুলো মারাত্মক শব্দ সন্দেহ নেই, এর থেকে দেখা যাচ্ছে যথেষ্ট উত্তেজিত হলে বাংলায় ‘আনো’ প্রত্যয় সময়ে সময়ে এই পথে আপন কর্তব্য স্মরণ করে। অপেক্ষাকৃত নিরীহ শব্দও আছে, যেমন আগল থেকে আগলানো; ফল থেকে ফলানো, হাত থেকে হাতানো, চমক থেকে চম্কানো। বিশেষণ শব্দ থেকে, যেমন উলটা থেকে উলটানো, খোঁড়া থেকে খোঁড়ানো, বাঁকা থেকে বাঁকানো, রাঙা থেকে, রাঙানো।

 বিদ্যাপতির পদে আছে ‘সখি, কি পুছসি অনুভব মোয়’। যদি তার বদলে— ‘কি জিজ্ঞাসা করই অনুভব মোয়’ ব্যবহারটাই ‘বাধ্যতামূলক’ হত কবি তা হলে ওর উল্লেখই বন্ধ করে দিতেন।[১] অথচ প্রশ্ন করা অর্থে শুধানো শব্দটা শুধু যে কবিতায় দেখি তা নয় অনেক জায়গায় গ্রামের লোকের মুখেও ওই কথার চল আছে। বাংলা ভাষার ইতিহাসে যাঁরা প্রবীণ তাঁদের আমি শুধাই, জিজ্ঞাসা করা শব্দটি বাংলা প্রাচীন সাহিত্যে বা লোকসাহিত্যে তাঁরা কোথাও পেয়েছেন কিনা।

 ভাবপ্রকাশের কাজে শব্দের ব্যবহার সম্বন্ধে কাব্যের বােধশক্তি গদ্যের চেয়ে সূক্ষ্মতর এ কথা মানতে হবে। লক্ষ্যিয়া, সন্ধিয়া, বন্দিনু, স্পর্শিল, হর্ষিল শব্দগুলাে বাংলা কবিতায় অসংকোচে চালানাে হয়েছে। এ সম্বন্ধে এমন নালিশ চলবে না যে ওগুলাে কৃত্রিম, যেহেতু চলতি ভাষায় ওদের ব্যবহার নেই। আসল কথা, ওদের ব্যবহার থাকাই উচিত ছিল; বাংলা কাব্যের মুখ দিয়ে বাংলা ভাষা এই ত্রুটি কবুল করেছে। (‘কব্‌লেছে’ প্রয়ােগ বাংলায় চলে কিন্তু অনভ্যস্ত কলমে বেধে গেল!) ‘দর্শন লাগি ক্ষুধিল আমার আঁখি’ বা ‘তিয়াষিল মাের প্রাণ’— কাব্যে শুনলে রসজ্ঞ পাঠক বাহবা দিতে পারে, কেননা, ক্ষুধাতৃষ্ণাবাচক ক্রিয়াপদ বাংলায় থাকা অত্যন্তই উচিত ছিল, তারই অভাব মােচনের সুখ পাওয়া গেল। কিন্তু গদ্য ব্যবহারে যদি বলি যতই বেলা যাচ্ছে ততই ক্ষুধােচ্চি অথবা তেষ্টাচ্চি তা হলে শ্রোতা কোনাে অনিষ্ট যদি না করে অন্তত এটাকে প্রশংসনীয় বলবে না।

 বিশেষ্য-জোড়া ক্রিয়াপদের জোড় মিলিয়ে এক করার কাজে মাইকেল ছিলেন দুঃসাহসিক। কবির অধিকারকে তিনি প্রশস্ত রেখেছেন, ভাষার সংকীর্ণ দেউড়ির পাহারা তিনি কেয়ার করেন নি। এ নিয়ে তখনকার ব্যঙ্গ রসিকেরা বিস্তর হেসেছিল। কিন্তু ঠেলা মেরে দরজা তিনি অনেকখানি ফাঁক ক’রে দিয়েছেন। ‘অপেক্ষা করিতেছে’ না ব’লে ‘অপেক্ষিছে’, ‘প্রকাশ করিলাম’ না বলে ‘প্রকাশিলাম’ বা ‘উদ্‌ঘাটন করিল’-র জায়গায় ‘উদ্‌ঘাটিল’ বলতে কোনাে কবি আজ প্রমাদ গণে না। কিন্তু গদ্যটা যেহেতু চলতি কথার বাহন ওর ডিমক্রাটিক বেড়া অল্প একটু ফাঁক করাও কঠিন। ‘ত্রাস’ শব্দটাকে ‘ত্রাসিল’ ক্রিয়ার রূপ দিতে কোনাে কবির দ্বিধা নেই কিন্তু ‘ভয়’ শব্দটাকে ‘ভয়িল’ করতে ভয় পায় না এমন কবি আজও দেখি নি। তার কারণ ত্রাস শব্দটা চলতি ভাষার সামগ্রী নয়, এইজন্যে ওর সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ অসামাজিকতা ডিমক্রাসিও খাতির করে। কিন্তু ‘ভয়’ কথাটা সংস্কৃত হলেও প্রাকৃত বাংলা ওকে দখল করে বসেছে। এইজন্যে ভয় সম্বন্ধে যে প্রত্যয়টার ব্যবহার বাংলায় নেই তার দরজা বন্ধ। কোন্ এক সময়ে ‘জিতিল’ ‘হাঁকিল’ ‘বাঁকিল’ শব্দ চলে গেছে, ‘ভয়িল’ চলে নি— এ ছাড়া আর কোনাে কৈফিয়ৎ নেই।

 বাংলা ভাষা একান্ত আচারনিষ্ঠ। সংস্কৃত বা ইংরেজি ভাষায় প্রত্যয়গুলিতে নিয়মই প্রধান, ব্যতিক্রম অল্প। বাংলা ভাষার প্রত্যয়ে আচারই প্রধান; নিয়ম ক্ষীণ।― ইংরেজিতে ‘ঘামছি’ বলতে am perspiring বলে থাকি, ‘লিখছি’ বলতে am penning বলা দোষের হয় না। বাংলায় ঘামছি বললে লোকে কর্ণপাত করে কিন্তু কল্‌মাচ্চি বললে সইতে পারে না। প্রত্যয়ের দোহাই পাড়লে আচারের দোহাই পাড়বে। এই কারণেই নূতন ক্রিয়াপদ বাংলায় বানানো দুঃসাধ্য, ইংরেজিতে সহজ। ওই ভাষায় টেলিফোন কথাটার নূতন আমদানি, তবু হাতে হাতে ওটাকে ক্রিয়াপদে ফলিয়ে তুলতে কোনো মুশকিল ঘটে নি। ডানপিটে বাঙালি ছেলের মুখ দিয়েও বের হবে না ‘টেলিফোনিয়েছি’ বা ‘সাইক্লিয়েছি’। বাংলা গদ্যের অটুট শাসন কালক্রমে কিছু কিছু হয়তো বা বেড়ি আলগা করে আচার ডিঙোতে দেবে। বাংলায় কাব্য-সাহিত্যই পুরাতন, এইজন্যেই প্রকাশের তাগিদে কবিতায় ভাষার পথ অনেক বেশি প্রশস্ত হয়েছে। গদ্য-সাহিত্য নূতন, এইজন্যে শব্দসৃষ্টির কাজে তার আড়ষ্টতা যায় নি। তবু ক্রমশ তার নমনীয়তা বাড়বে আশা করি। এমন-কি, আজই যদি কোনো তরুণ লেখক লেখেন, ‘মাইকেল বাংলা-সাহিত্যে নূতন সম্পদের ভাণ্ডার উদ্‌ঘাটিলেন’ তা নিয়ে প্রবীণরা খুব বেশি উত্তেজিত না হতে পারেন। ভাবীকালে আধুনিকেরা কতদূর পর্যন্ত স্পর্ধিয়ে উঠবেন বলতে পারি নে কিন্তু অন্তত এখনি তাঁরা ‘জিজ্ঞাসা করিলেন’-এর জায়গায় যদি ‘জিজ্ঞাসিলেন’ চালিয়ে দেন তা হলে বাংলা ভাষা কৃতজ্ঞ হবে।

 ‘লজ্জা করবার কারণ নেই’ এটা আমরা লিখে থাকি। ‘লজ্জাবার কারণ নেই’ লেখাটা নির্লজ্জতা। এমন স্থলে ওই জোড়া ক্রিয়াপদটা বর্জন করাই শ্রেয় মনে করি। লিখলেই হয় ‘লজ্জার কারণ নেই’। ‘প্রুফ সংশোধন করবার বেলায়’ কথাটা সংশোধনীয়, বলা ভালো ‘সংশোধনের বেলায়’। সহজ ব’লেই গদ্যে আমরা পুরো মন দিই নে, বাহুল্য শব্দ বিনা বাধায় যেখানে সেখানে ঢুকে পড়ে। আমার রচনায় তার ব্যতিক্রম আছে এমন অহংকার আমার পক্ষে অত্যুক্তি হবে।

 ভাষার খেয়াল সম্বন্ধে একটা দৃষ্টান্ত আমার প্রায় মনে পড়ে। ভালো বিশেষণ ও বাসা ক্রিয়াপদ জুড়ে ভালোবাসা শব্দটার উৎপত্তি। কিন্তু ওদুটো শব্দ একটা অখণ্ড ক্রিয়াপদ রূপে দাঁড়িয়ে গেছে। পূর্বকালে ওই ‘বাসা’ শব্দটা হৃদয়াবেগসূচক বিশেষ্য়পদকে ক্রিয়াপদে মিলিয়ে নিত। যেমন ভয় বাসা, লাজ বাসা। এখন হওয়া করা পাওয়া ক্রিয়াপদ জুড়ে ওই কাজ চালাই। ‘বাসা’ শব্দটা একমাত্র হৃদয়বোধসুচক; হওয়া পাওয়া করা তা নয়। এই কারণে ‘বাসা’ কথাটা যদি ছুটি না নিয়ে আপন পূর্ব কাজে বহাল থাকত তা হলে ভাবপ্রকাশে জোর লাগাত। ‘এ কথায় তার মন ধিক্কার বাস্ল’ প্রয়োগটা আমার মতে ‘ধিক্কার পেল’র চেয়ে জোরালো।

 ভাদ্র ১৩৪২

  1. ‘বাধ্যতামূলক’ নামে যে একটা বর্বর শব্দ বাংলাভাষাকে অধিকার করতে উদ্যত, তার সম্বন্ধে কি সাবধান হওয়া উচিত হয় না? কম্পল্‌সরি এডুকেশনে বাধ্যতা ব’লে বালাই যদি কোথাও থাকে সে তার মূলে নয় সে তার পিঠের দিকে বা কাঁধের উপর, অর্থাৎ ওই এডুকেশনটা বাধ্যতাগ্রস্ত বা বাধ্যতাচালিত। যদি বলতে হয় ‘পরীক্ষায় সংস্কৃত ভাষা কম্পল্‌সরি নয়’ তা হলে কি বলা চলবে ‘পরীক্ষায় সংস্কৃত ভাষা বাধ্যতামূলক নয়।’ সৌভাগ্যক্রমে ‘আবশ্যিক’ শব্দটা উক্ত অর্থে কোথাও কোথাও চলতে আরম্ভ করেছে।