বাংলা শব্দতত্ত্ব/শব্দতত্ত্বের একটি তর্ক

শব্দতত্ত্বের একটি তর্ক

শ্রীযুক্ত বিজনবিহারী ভট্টাচার্য শব্দতত্ত্বঘটিত তাঁর এক প্রবন্ধে ‘গান গা’ব’ বাক্যের ‘গা’ব’ শব্দটিকে অশুদ্ধ প্রয়ােগের দৃষ্টান্তস্বরূপে উল্লেখ করেছেন। এই দৃষ্টান্তটি আমারই কোনাে রচনা থেকে উদ্‌ধৃত।

 স্বীকার করি, এরূপ প্রয়ােগ আমি করে থাকি। এটা আমার ব্যক্তিগত বিশেষত্ব কি না তারই সন্ধান করতে গিয়ে আমি মহামহােপাধ্যায় পণ্ডিত বিধুশেখরকে জিজ্ঞাসা করলেম যে যদি বলি, ‘আজ সভায় আমি গান গা’ব না গা’বেন বসন্তবাবু, এখানে গান গা’বার আরাে অনেক লােক আছে তাতে কোনাে দোষ হবে কি না― প্রশ্ন শুনে তিনি বিস্মিত হলেন, বললেন তাঁর কানে কোথাও ত্রুটি ঠেকছে না। বাংলা শব্দকোষকার পণ্ডিত হরিচরণকেও অনুরূপ প্রশ্ন করাতে তিনি বললেন তিনি স্বয়ং এই রকমই প্রয়ােগ ক’রে থাকেন।

 বিজনবিহারীর সঙ্গেও আলােচনা করেছি। তিনি বাংলা শব্দতত্ত্বের একটি নিয়মের উল্লেখ করে বললেন, বাংলা গাওয়া শব্দটার মূলধাতু ‘গাহ্’—যে ইকার এই হ ধ্বনির সঙ্গে মিলিত, তার বৈধব্য ঘটলেও বিনাশ হয় না, হ লােপ হলেও ই টিকে থাকে। অতএব গাওয়া থেকে গাইব হয়, গা’ব হতে পারে না, সহমরণের প্রথা এ স্থলে প্রচলিত নেই।

 আমাকে চিন্তা করতে হল। শব্দের ব্যবহারটা কী, আগে স্থির হলে তবে তার নিয়ম পরে স্থির হতে পারে। বলা বাহুল্য, বাংলার যে ভূভাগের ভাষা প্রাকৃত বাংলা বলে আজকালকার সাহিত্যে চলেছে সেইখানেই অনুসন্ধান করতে হবে।

 এখানে হ ধ্বনিযুক্ত ক্রিয়াপদের তালিকা দেওয়া যাক।—

 কহ্, গাহ্, চাহ্, নাহ্, সহ্, বহ্,, বাহ্, রহ্, দোহ্।

 দেখা যায় অধিকাংশ স্থলেই এই-সকল ক্রিয়াপদে ভবিষ্যৎ কারকে বিকল্পে ই থাকে এবং লােপ পায়।

 ‘কথা কইবে’ও হয় ‘কথা ক’বে’ও, যথা, ‘গেলে কথা ক’বে না সে নব ভূপতি।’

 ভিক্ষে চা’ব না বললেও হয়, ভিক্ষে চাইব বললেও হয়। ‘তােমার কাছে শান্তি চা’ব না’ গানের পদটি আমারই রচনা বটে, কিন্তু কারাে কানে এ পর্যন্ত খটকা লাগে নি।

 ‘এ অপমান স’বে না’ কিংবা ‘দুঃখের দিন রবে না’ বললে কেউ বিদেশী বলে সন্দেহ করে না।

 যদি বলি ‘গঙ্গায় না’বে, না তোলা জলে’ তা হলে ভাষার দোষ ধরে শ্রোতা আপত্তি করবে না।

 কেবল বহা ও বাহা ক্রিয়াপদে ‘ব’বে’ ‘বা’বে’ ব্যবহার শোনা যায় না তার কারণ পাশাপাশি দুটো ‘ব’-কে ওষ্ঠ পরিত্যাগ করতে চায়।

 হ ধ্বনি বর্জিত এই জাতীয় ক্রিয়াপদে প্রাকৃত প্রয়োগে নিঃসংশয়ে ই স্বর লুপ্ত হয়। কথ্য ভাষায় কখনোই বলি নে খাইব, যাইব, পাইব।

 ‘দোহা’ ক্রিয়াপদের আরম্ভে ওকার আছে, তারই জোরে ই থেকে যায়—বলি ‘গোরু দুইবে’। কিন্তু একেবারেই ই লোপ হ’তে পারে না বলে’ আশঙ্কা করি নে। ‘রুগ্‌ণ গোরু কখনোই দোবে না’ বাক্যটা অকথ্য নয়।

 ‘পোহা’ অর্থাৎ প্রভাত হওয়া ক্রিয়াপদের ধাতুরূপ ‘পোহা’— পোহাইবে বা পোহাইল শব্দে লিখিত ভাষায় ই চলে কিন্তু কথিত ভাষায় চলে না। সন্দেহ হচ্ছে ‘কখন রাত পুইবে’ বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ ‘পোয়াবে’ এবং ‘পুইবে’ দুইই হয়।

 শ্রাবণ ১৩৪৩