বাঙ্গালীর প্রতিভা ও সুভাষচন্দ্র/অন্ধকূপ হত্যা স্মৃতিস্তম্ভ অপসারণ
অন্ধকূপ-হত্যা স্মৃতিস্তম্ভ অপসারণ
মিষ্টার হলওয়েল “অন্ধকূপ-হত্যা” কাহিনী দ্বারা ভারতের ইতিহাসের পৃষ্ঠায় দুরপনেয় কলঙ্ক কালিমা লেপন করিয়াছিলেন তাহা সকলেই অবগত আছেন। ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্ট এই কলঙ্ককাহিনী চিরস্মরণীয় করিবার জন্য কলিকাতা মহানগরীর বক্ষে লালদীঘির নিকটে একটি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করিয়াছিলেন। মুসলমান রাজগণ যে কিরূপ নিষ্ঠুর ছিলেন তাহারই একটি চিত্র ভারতবাসীর সম্মুখে স্থাপন করাই এই স্তম্ভ স্থাপনের উদ্দেশ্য। অপরাধীদিগকে দণ্ডস্বরূপ অবরুদ্ধ রাখিবার নিমিত্ত ইংরাজদিগের কলিকাতাস্থ দুর্গে একটি ক্ষুদ্র গৃহ ছিল। গৃহটি দৈর্ঘ্য বিস্তারে বারহাতের অধিক ছিল না এবং তাহাতে দুইটি মাত্র গবাক্ষ ছিল। ঐতিহাসিক মিষ্টার হলওয়েল লিখিয়া গিয়াছেন, সিরাজের সৈন্যগণের নিকট পরাজিত হইয়া অন্যান্য ইংরাজগণ পলায়ন করিবার পরে, দুর্গে যে অল্পসংখ্যক ইংরাজ ছিলেন, তাঁহারা প্রাণপণে যুদ্ধ করিয়া অবশেষে আত্মসমর্পণ করেন। ইহার পরে ১৪৬ জন ইংরাজকে নবাবপক্ষের জনৈক সেনানায়ক সিরাজের অজ্ঞাতসারে উপরোক্ত গৃহে একরাত্রির জন্য অবরুদ্ধ করিয়া রাখিয়াছিলেন। পরদিন প্রভাতে গৃহদ্বার উন্মুক্ত হইলে দেখা গেল বন্দীগণের মধ্যে ২৩জন মাত্র জীবিত আছেন।
বহুদিন পর্য্যন্ত এই ঐতিহাসিক ঘটনার সত্যাসত্য নির্দ্ধারণ করিবার জন্য কোনও বাঙ্গালী গবেষণা কার্য্যে প্রবৃত্ত হন নাই। কিন্তু পরবর্ত্তী ঐতিহাসিকগণ অনুসন্ধান করিয়া যখন জানিতে পারিলেন যে ঘটনাটি কল্পনা-প্রসূত এমন কি কেহ কেহ এই সঙ্কীর্ণ গৃহের আয়তন এবং এক একজন মনুষ্যের সাধারণ আয়তনের সাহায্যে প্রমাণ করিলেন যে এই অল্পায়তন গৃহে কোনও মতেই ১৪৬ জন লোকের স্থান হইতে পারে না, তখন দেশবাসিগণ এই কাহিনীকে আর ঐতিহাসিক সত্য বলিয়া গ্রহণ করিতে পারিলেন না। মহানগরীর বক্ষ হইতে ইহার অপসারণের জন্য অনেক চেষ্টাও হইল। ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্ট কোনও কথায় কর্ণপাত করিলেন না।
পরিশেষে সুভাষচন্দ্র বঙ্গভূমিতে অবতীর্ণ হইলেন। এই নির্ভীক তেজস্বী পুরুষ তাঁহার সমগ্র জীবনে কখনও কোন অবিচার সহ্য করিতে পারেন নাই। তিনি সকল ক্ষেত্রেই ন্যায়, ধর্ম্ম ও সত্যের মর্য্যাদা রক্ষা করিয়া স্বীয় কর্ত্তব্য নির্দ্ধারণ করিতেন। গভর্ণমেণ্টের কার্য্যের প্রতিবাদ কল্পে তিনি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে প্রবৃত্ত হইলেন। বাঙ্গালী তাঁহাকে দেবতার ন্যায় ভক্তি করিত। সুতরাং এই আন্দোলনে হিন্দুমুসলমান সকলেই তাঁহার অনুগামী হইল। হিন্দুমুসলমানগণ সত্যাগ্রহ অবলম্বন করিয়া দিনের পর দিন কারাবরণ করিতে লাগিল। ভারত রক্ষা আইনানুসারে সুভাষবাবু অবশেষে কারারুদ্ধ হইলেন। অনির্দ্দিষ্ট কালের জন্য তিনি কারাপ্রাচীরের অন্তরালে দিনপাত করিতে লাগিলেন।
সুভাষবাবুকে হারাইয়াও দেশবাসিগণ এই সত্যাগ্রহ ভঙ্গ না করিয়া দ্বিগুণ উৎসাহের সহিত আন্দোলন চালাইতে লাগিলেন। অবশেষে বাধ্য হইয়া ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্ট এই প্রস্তরীভূত বিরাট অসত্যের স্তম্ভকে মহানগরীর বক্ষ হইতে অপসারিত করিলেন।