বাঙ্গালীর প্রতিভা ও সুভাষচন্দ্র/হরিপুরা ও ত্রিপুরী অধিবেশন ও ফরওয়ার্ড ব্লক
ভারতীয় জাতীয় মহাসমিতি
হরিপুরা অধিবেশন
সুভাষবাবু ইউরোপ প্রবাসকালে যে সময়ে ইংলণ্ডে অবস্থান করিতেছিলেন, সেই সময়ে জাতীয় মহাসমিতির একপঞ্চাশত্তম অধিবেশন হরিপুরায় অনুষ্ঠিত হইবে এইরূপ স্থির হয়। সুভাষবাবু এই সভার সভাপতি নির্ব্বাচিত হন। তিনি ভারতে আসিয়া ১৯৩৮ সালে এই অধিবেশনে যােগদান করেন এবং একটি সুচিন্তিত অভিভাষণ প্রদান করেন। এই অভিভাষণে তাঁহার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, দূরদর্শিতা এবং চিন্তাশীলতার যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়।
ত্রিপুরী অধিবেশন
১৯৩৯ খৃষ্টাব্দে সুভাষচন্দ্র নিখিল ভারতীয় জাতীয় মহাসমিতির ত্রিপুরী অধিবেশনের সভাপতি নির্ব্বাচিত হন। এই নির্ব্বাচন উপলক্ষে ডাক্তার পট্টভি সীতারামিয়া তাঁহার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। কিন্তু সুভাষবাবুর জনপ্রিয়তা এরূপ প্রসার লাভ করিয়াছিল যে বিপুল সংখ্যক ভােটে তিনি তাঁহার প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাজিত করিয়া কংগ্রেসের সভাপতি পদে মনােনীত হইলেন। দুঃখের বিষয় সুভাষবাবুর এই বিজয় মহাত্মা গান্ধী প্রমুখ কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ নির্ব্বিকারচিত্তে গ্রহণ করিতে পারেন নাই। বিশেষতঃ ত্রিপুরী অধিবেশন উপলক্ষে মহাত্মার আশ্রয়-পুষ্ট কংগ্রেস হাইকমাণ্ডের সদস্যগণ সুভাষবাবুর যেরুপ বিরুদ্ধাচরণ করিয়াছিলেন, তাহা কংগ্রেসের ইতিহাসকে চিরদিন কলঙ্ক কালিমায় আবৃত করিয়া রাখিবে। এমনকি মহাত্মা গান্ধীর আচরণেও এই বাঙ্গালী-বিদ্বেষ যেরূপ পরিস্ফুট হইয়াছিল, তাহা বঙ্গবাসী এখনও ভুলিতে পারে নাই।
সুভাষবাবু ৫ই মার্চ্চ তারিখে অসুস্থ অবস্থায় কলিকাতা হইতে ত্রিপুরী যাত্রা করেন। ১০ই মার্চ্চ ত্রিপুরী কংগ্রেসের ৫২তম অধিবেশন হয়, কিন্তু অসুস্থতা নিবন্ধন শ্রীযুক্ত বসু এই অধিবেশনে যোগদান করিতে অসমর্থ হন।
ত্রিপুরী কংগ্রেস
সুভাষচন্দ্রের অভিভাষণ
বন্ধুগণ, কংগ্রেসের বর্ত্তমান অবস্থা মেঘাচ্ছন্ন। কংগ্রেসের মধ্যে নানা বিভেদের সৃষ্টি হইয়াছে। সেইজন্য আমাদের বহু বন্ধু নিস্তেজ ও নিরুৎসাহ হইয়া পড়িয়াছেন; কিন্তু আমি অত্যন্ত আশাবাদী—যে মেঘ আজ দেখা দিয়াছে, তাহা শীঘ্রই অপসারিত হইবে। দেশবাসীর দেশপ্রেমের উপর আমার প্রবল বিশ্বাস আছে। আমি এ বিষয়ে নিশ্চিত যে অচিরে আমরা বর্ত্তমান বাধা বিঘ্ন কাটাইয়া উঠিতে পারিব এবং আমাদের দলসমূহের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত করিতে সক্ষম হইব।
১৯২২ সালে গয়া কংগ্রেসের সময় অনুরূপ অবস্থার উদ্ভব হইয়াছিল। তাহার পরই পুণ্যশ্লোক দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস এবং পণ্ডিত মতিলাল নেহেরু স্বরাজ্যদল স্থাপন করেন। তাঁহাদের স্মৃতি এবং ভারতের অন্যান্য বীরসন্তান এই সঙ্কটে আমাদের অনুপ্রাণিত করুন এবং আমার ঐকান্তিক প্রার্থনা মহাত্মা গান্ধী কংগ্রেসের বর্ত্তমান পরিস্থিতি দূর করিয়া আমাদের জাতিকে পথ প্রদর্শন করুন।
১৯৩৮ সালে হরিপুরা কংগ্রেসের পর আন্তর্জ্জাতিক রাজনীতি ক্ষেত্রে বহু উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটিয়াছে, তন্মধ্যে ১৯৩৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যে মিউনিক চুক্তি হয়, তাহা বিশেষ জরুরী। ঐ চুক্তিতে ফ্রান্স ও গ্রেটব্রিটেন হীনভাবে নাৎসী জার্ম্মাণির নিকট আত্মসমর্পণ করিয়াছে। ফলে ফ্রান্সের ক্ষমতা খর্ব্ব হইয়া গিয়াছে, আর জার্ম্মাণি বিনা অস্ত্রে ইউরোপে রাষ্ট্রীয় প্রাধান্য লাভ করিয়াছে। সম্প্রতি গণতান্ত্রিক স্পেনের পতনে ফ্যাসিস্ট ইতালিও নাৎসি জার্ম্মাণির শক্তি ও মর্য্যাদা বৃদ্ধি পাইয়াছে। ইউরোপের রাষ্ট্রনীতি ক্ষেত্র হইতে আপাততঃ সোভিয়েট রুশিয়াকে মুছিয়া ফেলিবার ষড়যন্ত্রে তথাকথিত গণতান্ত্রিক ফ্রান্স ও গ্রেটব্রিটেন ইটালি ও জার্ম্মাণির সহিত যোগ দিয়াছে। কিন্তু রুশিয়াকে কতকাল দাবাইয়া রাখা সম্ভব হইবে এবং রুশিয়াকে অপদস্থ করিবার চেষ্টায় ফ্রান্স ও গ্রেটব্রিটেনের কি লাভ হইয়াছে? সম্প্রতি ইউরোপ ও এশিয়ায় যে সকল আন্তর্জ্জাতিক ঘটনা ঘটিয়াছে, তাহাতে ব্রিটিশ ও ফরাসী সাম্রাজ্যবাদের শক্তি ও মর্য্যাদা যথেষ্ট খর্ব্ব হইয়াছে।
এখন আমাদের স্বদেশের রাজনীতি আলোচনা করা যাউক। আমার শরীর অসুস্থ বলিয়া আমি কয়েকটি জরুরী সমস্যার মাত্র উল্লেখ করিব।
গত কিছুদিন যাবৎ আমি বোধ করিতেছি যে এখন আমাদের স্বরাজের দাবি উত্থাপন করিয়া ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্টকে চরম পত্র দেওয়া কর্ত্তব্য। যুক্তরাষ্ট্র প্রবর্ত্তনের প্রতীক্ষায় নিস্ক্রিয়ভাবে অবস্থান করিবার নীতি অবলম্বনের সময় বহু পূর্ব্বে গত হইয়াছে। কখন আমাদের উপর যুক্তরাষ্ট্র চাপান হইবে, এখন আর আমাদের সমস্য নহে। ইউরােপে শান্তি স্থাপিত হইবার আশায় যদি কয়েক বৎসর যুক্তরাষ্ট্র প্রবর্ত্তন স্থগিত রাখা হয়, তবে আমরা কি করিব উহাই এখন সমস্যা। চতুঃশক্তি চুক্তি দ্বারাই হউক, আর অপর কোন উপায়েই হউক, যদি একবার ইউরােপে স্থায়ী শক্তি স্থাপিত হয়, তাহা হইলেই গ্রেটবৃটেন যে কঠোর সাম্রাজ্য নীতি অবলম্বন করিবে, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। আন্তর্জ্জাতিক রাজনীতিক্ষেত্রে নিজেকে দুর্ব্বল বলিয়া বােধ করিয়াই বৃটেন প্যালেস্টাইনে ইহুদীদিগের প্রতিকূলভাবে আরবদিগকে শান্ত করিবার চেষ্টার আভাষ দিতেছে। অতএব আমাদিগের নির্দ্দিষ্ট সময়ের মধ্যে উত্তর চাহিয়া বৃটিশ গভর্ণমেণ্টের নিকট চরম পত্র দেওয়া উচিত। যদি নির্দ্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোন উত্তর না পাওয়া যায়, কিম্বা প্রাপ্ত উত্তর সন্তোষজনক না হয়, তাহা হইলে আমাদের জাতীয় দাবি পূরণের জন্য যথাসাধ্য ব্যবস্থা অবলম্বন করিতে হইবে। সেই ব্যবস্থা হইতেছে আইন অমান্য সত্যাগ্রহ। আর বৃটিশ গভর্ণমেণ্ট এখন সর্ব্বভারতীয় সত্যাগ্রহের ন্যায় বৃহৎ সঙ্ঘর্ষের সম্মুখীন হইতে পারিবেন না।
আমি দেখিয়া দুঃখিত হইলাম, কংগ্রেসে এমন লােক আছেন যাঁহারা মনে করেন যে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিরাট আন্দোলন আরম্ভ করিবার সময় উপস্থিত হয় নাই। বিষয়টি আমি বাস্তববাদীর দৃষ্টিতে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পর্য্যবেক্ষণ করিয়াও নৈরাশ্যের অণুমাত্র কারণ খুঁজিয়া পাইলাম না। আটটি প্রদেশে শাসন ক্ষমতা লাভ করায় আমাদের জাতীয় প্রতিষ্ঠান কংগ্রেসের ক্ষমতা ও মর্য্যাদা বৃদ্ধি পাইয়াছে। বৃটিশভারতে গণ আন্দোলন অনেকটা অগ্রসর হইয়াছে। দেশীয় রাজ্যসমূহেও অভূতপূর্ব্ব জাগরণ দেখা দিয়াছে। আন্তর্জ্জাতিক পরিস্থিতিও আমাদের অনুকূল। এতদবস্থায় স্বরাজ লাভের পথে চুড়ান্তভাবে অগ্রসর হইবার আমাদের জাতীয় ইতিহাসে ইহার চেয়ে আর কি সুসময় উপস্থিত হইতে পারে?
আমি স্থির মস্তিস্ক বাস্তববাদী হিসাবে বলিতে পারি, বর্ত্তমান পরিস্থিতি আমাদের এত অনুকূল যে এখনই সাফল্যের সর্ব্বাধিক আশা পোষণ করা উচিত। আমরা যদি কেবল ভেদ ও বাদ বিসম্বাদ বিসর্জ্জন দিয়া জাতীয় আন্দোলনে আমাদের সমগ্র শক্তি ও সম্পদ নিয়োজিত করি তাহা হইলেই বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে অপ্রতিহত আক্রমণ চালাইতে পারিব। বর্ত্তমান সুযোগপূর্ণ পরিস্থিতির সদ্ব্যবহার করিয়া আমরা রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির পরিচয় দিব অথবা জাতীয় জীবনের দুর্লভ সুযোগ হেলায় হারাইব।
দেশীয় রাজ্যসমূহে জাগরণের কথা আমি উল্লেখ করিয়াছি। আমার দৃঢ় অভিমত এই যে, দেশীয় রাজ্য সম্পর্কে আমরা হরিপুর কংগ্রেসের প্রস্তাবে যে মনোভাব প্রকাশ করিয়াছি, তাহা পরিবর্ত্তন করা উচিত। উক্ত প্রস্তাবে কংগ্রেসের নামে দেশীয় রাজ্যসমূহে কোন কোন কাজ চালান নিষিদ্ধ হইয়াছে, তদনুসারে দেশীয় রাজ্যসমূহে কংগ্রেসের নামে পার্লামেণ্টারি কার্য্য কিম্বা আন্দোলন চালানাে যাইবে না। কিন্তু কংগ্রেসের হরিপুরা অধিবেশনের পর অনেক ঘটনা ঘটিয়াছে। এখন আমরা দেখিতেছি যে সার্ব্বভৌম শক্তি অধিকাংশ স্থানেই দেশীয় রাজ্যের শাসনকর্ত্তাদিগের সহিত একজোট হইয়াছে। এই অবস্থায় দেশীয় রাজ্যের প্রজাদিগের সহিত ঘনিষ্ঠভাবে মিলিত হওয়া উচিত নহে কি? বর্ত্তমানে আমাদের কর্ত্তব্য কি তৎসম্বন্ধে আমার মনে কোনও সন্দেহ নাই।
দেশীয় রাজ্যের ব্যাপারে কংগ্রেসের উপর হইতে নিষেধাজ্ঞা তুলিয়া লইতে হইবে। তাহা ছাড়া ওয়ার্কিং কমিটিকে ব্যাপক ও প্রণালীবদ্ধ উপায়ে দেশীয় রাজ্য সমূহে ব্যক্তি স্বাধীনতা ও দায়িত্বশীল শাসনতন্ত্র লাভের জন্য আন্দোলন চালাইতে হইবে। দেশীয় রাজ্যে এযাবৎ কেবল বিক্ষিপ্তভাবে কাজ করা হইয়াছে, কোন পদ্ধতি বা পরিকল্পনা অনুসারে হয় নাই। এখন ওয়ার্কিং কমিটিকে এই দায়িত্বভার গ্রহণ করিয়া ব্যাপক ও প্রণালীবদ্ধ আন্দোলন চালাইতে হইবে এবং যদি প্রয়ােজন হয় তবে এতদুদ্দেশ্যে একটি বিশেষ সাবকমিটি গঠন করিতে হইবে। এই কার্য্যে মহাত্মা গান্ধীর নির্দ্দেশ ও সহযােগিতা পূর্ণভাবে গ্রহণ করিতে হইবে। নিখিলভারত দেশীয় রাজ্য-প্রজা সম্মেলনের সহযােগিতা ও লইতে হইবে।
স্বরাজলাভের জন্য যে আমাদিগের চুড়ান্তভাবে অগ্রসর হওয়া যুক্তিসঙ্গত, তাহা আমি পূর্ব্বে উল্লেখ করিয়াছি। তজ্জন্য যথেষ্ট আয়োজন দরকার। প্রধানতঃ ক্ষমতার লোভে আমাদের মধ্যে যে দুর্নীতি ও দুর্ব্বলতা প্রবেশ করিয়াছে, প্রথমতঃ নির্ম্মম হস্তে তাহা দূরিভূত করিবার ব্যবস্থা করিতে হইবে।
আমাদের দেশের কিষাণ-আন্দোলন, ট্রেড-ইউনিয়ন আন্দোলন প্রভৃতি সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী প্রতিষ্ঠান সমূহের সহিত ঘনিষ্ঠ ভাবে, মিলিয়া মিষিয়া আমাদিগকে কাজ করিতে হইবে। দেশের সর্ব্বপ্রকার চরমপন্থী শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করিতে হইবে, এবং বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে চুড়ান্ত সংগ্রাম চালাইবার জন্য সমস্ত সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী প্রতিষ্ঠানগুলিকে একযোগে অগ্রসর হইতে হইবে।
বন্ধুগণ আজ কংগ্রেসের ভিতরে কলহের মেঘ দেখা দিয়াছে। এই কারণে আমাদের বহু বন্ধু নিরুৎসাহ বোধ করিতেছেন। কিন্তু আমি কিছুতেই নিরাশ হই না, আমাদের দেশবাসীর স্বদেশপ্রেমে আমার বিশ্বাস আছে। আমার দৃঢ় ধারণা অচিরেই আমরা এই সঙ্কট হইতে মুক্ত হইতে পারি। আমাদের মধ্যে পুনরায় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হইবে। বন্দেমাতরম্।’
ফরওয়ার্ড ব্লক
কংগ্রেসের সভাপতি-নির্ব্বাচন এবং ত্রিপুরী কংগ্রেসের অধিবেশন উপলক্ষে সদস্যগণের মধ্যে যে মতভেদ হয়, তাহা ক্রমশঃ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইয়া কংগ্রেসের মধ্যে দারুণ অশান্তির সৃষ্টি হয়। মহাত্মা গান্ধীর আদর্শ ও সুভাষচন্দ্রের আদর্শের বিভিন্নতা ও সুভাষচন্দ্রকে বিচলিত করিয়া তুলিল। মহাত্মা বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের অঙ্গরূপেই ভারতের নূতন শাসনপদ্ধতি রচনা করিবার চেষ্টা করিতেছিলেন। কিন্তু সুভাষচন্দ্রের আদর্শ সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল। এই সকল কারণে সুভাষচন্দ্র ২৯শে এপ্রেল তারিখে কলিকাতার নিখিলভারত রাষ্ট্রীয় সমিতির অধিবেশন উপলক্ষে কংগ্রেসের সভাপতিপদ পরিত্যাগ করিলে এবং ফরোয়ার্ড ব্লক, গঠন করিতে কৃতসংকল্প হইলেন।