বাঙ্গালীর প্রতিভা ও সুভাষচন্দ্র/ইনফল হইতে পশ্চাদপসরণ
ইনফল হইতে পশ্চাদপসরণ
ভারতীয় সেনা বাহিনীর দুর্ভাগ্যক্রমে এই সময়ে বর্ষাকাল উপস্থিত হইল। রসদ ও সমরোপকরণ আসিবার রাস্তাগুলি অচিরে জলপ্লাবিত হইয়া গেল। ফেব্রুয়ারী মাসে জাতীয় বাহিনী যুদ্ধে অবতীর্ণ হইয়াছিল; এবং পাঁচমাস যুদ্ধ করিয়া কয়েকটি স্থান অধিকার করিবার পর অকস্মাৎ প্রাকৃতিক বিপর্য্যয়ে তাহাদের অগ্রগতি বন্দ হইয়া গেল। বর্ষার প্রকোপে আজাদগভর্ণমেণ্টের সহিত সংবাদ আদান প্রদান ও স্থগিত হইল। সৈন্য বাহিনীর রসদ ও যুদ্ধের উপকরণ সম্ভার না আসাতে জুলাই মাসেই সৈন্যদল পশ্চাদপসরণ করিতে বাধ্য হইল। সুযোগ পাইয়া ব্রিটিশ সৈন্যগণ ব্রহ্ম অভিমুখে অগ্রসর হইতে লাগিল। যে নবীন উৎসাহ লইয়া জাতীয় বাহিনী যুদ্ধে অবতীর্ণ হইয়াছিল, পশ্চাদপসরণ করিতে বাধ্য হইলেও, তাহা একেবারে নির্ব্বাপিত না হইয়া নূতন সুযোগের অপেক্ষা করিতে লাগিল। একথা নিশ্চয়রূপে বলা যাইতে পারে, যে ‘ইনফল জয়ে’ বাধা প্রাপ্ত হওয়া সত্ত্বেও আজাদগভর্ণমেণ্ট, জাতীয় বাহিনী এবং পূর্ব্ব এশিয়ার ৩০ লক্ষ প্রবাসী ভারতীয় এই আঘাত নির্ব্বিকার চিত্তে সহ্য করিলেন। বিন্দুমাত্র ভগ্নোৎসাহ না হইয়া দ্বিগুণ উৎসাহের সহিত তাঁহারা নূতনপথে এই যুদ্ধ পরিচালনা করিতে কৃতসংকল্প হইলেন। অগণিত অর্থ ও নূতন নূতন সৈন্য সংগ্রহ হইতে লাগিল। আক্রমণাত্মক অভিযানের জন্য সকলেই প্রস্তুত হইতে লাগিলেন। কিন্তু ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্টের বিপুল সৈন্য-বাহিনী এবং অপরিমিত সমর-সম্ভার উপস্থিত হওয়াতে দেশীয় বাহিনী তাহাদের অগ্রগতি রোধ করিতে অসমর্থ হইল এবং ইংরাজ সৈন্য ইরাবতী উত্তীর্ণ হইয়া মান্দালাই ও রেঙ্গুন অভিমুখে ধাবিত হইতে লাগিল।
ব্রহ্ম ও রেঙ্গুনের ভারতীয়গণ এই সকল ব্যাপারে বিন্দুমাত্র বিচলিত হইল না। তাহারা অর্থ ও সৈন্য দিয়া এমন কি শরীরের শেষ রক্তবিন্দু দিয়া যুদ্ধের ফলাফল দেখিবে এইরূপ স্থির করিল। প্রতি মাসের ২১শে তারিখে তাহারা “অস্থায়ী গভর্নমেণ্ট দিবস” পালন করিয়া আনন্দোৎসব কবিতে লাগিল। ৪টা হইতে ১১ই জুলাই পর্য্যন্ত “নেতাজী-সপ্তাহ”, ১৮ই অক্টোবর হইতে ২৪শে অক্টোবর পর্য্যন্ত “অস্থায়ী গভর্নমেণ্ট বার্ষিকী দিবস” এবং ২৩শে জানুয়ারী হইতে ২৯শে জানুয়াবি পর্য্যন্ত “নেতাজী জয়ন্তী” পালন করিয়া তাহারা নেতাজীর প্রতি ভক্তির পরাকাষ্ঠা দেখাইতে লাগিল।
ইনফল অভিযান ব্যর্থ হইলেও আজাদ হিন্দ ফৌজের মনোবল নষ্ট হয় নাই। কিন্তু মণিপুর যুদ্ধের ব্যর্থতার ফলে জাপান বাহিনী একেবারেই নিরুৎসাহ হইয়া পড়িল। ১৯৪৫ সালের ৮ই মার্চ্চ তারিখে মিত্র সৈন্য মান্দালাই সহরে প্রবেশ করে এবং ২০শে মার্চ্চ মান্দালাই সম্পূর্ণরূপে অধিকার করে। অতঃপর রেঙ্গুনের ৫০ মাইল উত্তরে মিত্র সেনার সহিত জাপ সৈন্যের যে যুদ্ধ হইল, তাহাতে জাপানীরা সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হইল। আজাদ হিন্দ স্যৈগণ অনন্যোপায় হইয়া একে একে আত্মসমর্পণ করিতে লাগিল, যাহারা যুদ্ধে বিরত হইল না তাহাদের অধিকাংশই মিত্রপক্ষের হস্তে বন্দী হইল।