বাঙ্গালীর প্রতিভা ও সুভাষচন্দ্র/কর্পোরেশনের প্রধান কর্ম্মকর্ত্তা

কর্পোরেশনের প্রধান কর্ম্মকর্তা

First C.E.O. of C.C.

 অতঃপর সুভাষচন্দ্র ‘ফরওয়ার্ড’ পত্রিকার পরিচালনা এবং কর্পোরেশন নির্ব্বাচন উভয় কার্য্যেই মনোনিবেশ করিলেন। দেশবন্ধু কর্পোরেশনের প্রথম মেয়র এবং মিঃ সুরাবর্দ্দী ডেপুটী মেয়র হইলেন। এখন এই প্রতিষ্ঠানের C.E.O. বা প্রধান কর্ম্মকর্তা কে হইবেন তাহাই হইল সমস্যার বিষয়। সুভাষচন্দ্রের ন্যায় উপযুক্ত ব্যক্তি আর কে থাকিতে পারে? সুতরাং তিনি সংবাদপত্র সেবার কার্য্য পরিত্যাগ করিয়া ১৯২৪ সালের ২৪শে এপ্রিল কর্পোরেশনের প্রধান কর্ম্মকর্ত্তা বা C.E.O পদ গ্রহণ করিলেন। এই পদের বেতন মাসিক ৩০০০৲ টাকা হইলেও সুভাষচন্দ্র মাত্র ১৫০০৲ টাকা বেতন গ্রহণ করিতেন। এই পদে কাহাকেও নিয়োগ করিতে হইলে বাঙ্গালা সরকারের অনুমোদন লইতে হয়। বাঙ্গলা সরকার এক মাস অতীত করিয়া সুভাষচন্দ্রের নিয়োগ অনুমোদন করিয়াছিলেন। কিন্তু তিনি অধিক দিন ঐ পদে থাকিতে পারেন নাই। ১৯২৪ সালের ২৫শে অক্টোবর “বঙ্গীয় ফৌজদারি আইন সংশোধন অর্ডিন্যান্স” আইন অনুসারে তাঁহাকে পুনরায় কারারুদ্ধ করা হইল।

 সুভাষচন্দ্রকে কারারুদ্ধ করিবার পর, পুলিশ তাঁহার গৃহ হইতে স্বরাজ্যদলের সমস্ত কাগজপত্র এমন কি কর্পোরেশনের ফাইল পর্য্যন্ত লইয়া যায়। তাঁহাকে প্রথমতঃ আলিপুর সেণ্ট্রাল জেলে রাখা হয়, এবং তৎপরে বহরমপুরের জেলে পাঠান হয়। ইহাতেও সন্তুষ্ট না হইয়া গভর্ণমেণ্ট পরিশেষে তাঁহাকে ব্রহ্মদেশের মান্দালাই জেলে স্থানান্তরিত করেন।

 সুভাষবাবুকে কারারুদ্ধ করাতে সমগ্র দেশে প্রবল বিক্ষোভের সঞ্চার হয়। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন সুভাষচন্দ্রকে প্রাণের সহিত ভালবাসিতেন। তাঁহাকে বিনাদোষে গ্রেপ্তার করায় এবং বিনা বিচারে কারারুদ্ধ করায় দেশবন্ধু তাঁহার মেয়রের আসন হইতে গভর্ণমেণ্টের কার্য্যের তীব্র প্রতিবাদ করিতে লাগিলেন। এই উপলক্ষে কর্পোরেশনের এক সভায় তিনি মন্তব্য করিয়াছিলেন “স্বদেশানুরাগী হওয়াতে আইনের চক্ষে সুভাষচন্দ্র যদি অপরাধী হইয়া থাকেন, তাহা হইলে আমিও তাঁহার ন্যায় সমান অপরাধী”[]। ফরওয়ার্ড এবং অন্যান্য জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্রে গভর্ণমেণ্টের কার্য্যের কঠোর সমালােচনা হইতে লাগিল। গভর্ণমেণ্ট কিন্তু কোনও কথায় কর্ণপাত করিলেন না।

 দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন সহকর্ম্মী সুভাষচন্দ্রকে কারামুক্ত করিতে অক্ষম হওয়াতে শৃঙ্খলাবদ্ধ সিংহের ন্যায় রুদ্ধরোষের উচ্ছ্বাস দমন করিতে পারিলেন না। তাঁহার মনে হইল পণ্ডিত মদন মােহন মালব্য বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের গঠন প্রণালী সম্বন্ধে সাহায্য করিবার জন্য ইতিপূর্ব্বে সুভাষচন্দ্রের সাহায্য চাহিয়াছিলেন, তখন তিনি বিনীতভাবে তাঁহাকে প্রত্যাখ্যান করিয়াছিলেন—কেন না দেশের কাজের জন্য তাঁহার নয়ন-পুত্তলী সুভাষচন্দ্রকে তিনি কিছুতেই ছাড়িতে পারেননা। হায়! সেই সুভাষচন্দ্র আজ কারা প্রাচীরের অন্তরালে অবস্থান করিতেছেন। দেশের ভবিষ্যৎ চিন্তা করিয়া দেশপ্রেমিক চিত্তরঞ্জন শােকাবেগ সম্বরণ করিতে পারিলেননা। অবশেষে তিনি একদিন সকল দুঃখ সকল অত্যাচারের পরপারে চলিয়া গেলেন।

 মান্দালাইয়ে নির্জ্জন কারাবাসের ফলে এবং অত্যধিক উত্তাপের জন্য শ্রীযুক্ত বসুর স্বাস্থ্যভঙ্গ হয়। তাঁহার ৪০ পাউণ্ড ওজন কমিয়া যায় ও ক্ষয়রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। সুভাষ চন্দ্রের ভ্রাতা বিখ্যাত ডাক্তার সুনীলচন্দ্র বসু ও সরকারি মেডিকেল অফিসার তাঁহাকে পরীক্ষা করিয়া ঘোষণা করেন যে তাঁহার অবস্থা আশঙ্কাজনক! ১৯২৭ সালের এপ্রেল মাসে তিনি একেবারে শয্যাশায়ী হইয়া পড়েন। তাঁহার তৎকালিন শারীরিক অবস্থা দেখিয়া সরকারি ডাক্তার এরূপ মন্তব্য করিয়াছিলেন যে তাঁহাকে চিকিৎসার জন্য অবিলম্বে ইউরোপে পাঠান হউক। যাহা হউক ১৯২৭ সালের ১৫ই মে ভগ্ন স্বাস্থ্যের জন্য সুভাষচন্দ্রকে মুক্তি দেওয়া হয়।

 সুভাষচন্দ্র যখন কারাগারে ছিলেন তখন কলিকাতা কর্পোরেশন ১৯২৭ সালের ১২ই মে পর্য্যন্ত তাঁহার ছুটি মঞ্জুর করেন। এই ছুটির কাল শেষ হইলে মিঃ জে, সি, মুখার্জিকে স্থায়ীভাবে ঐ পদে নিয়োগ করা হয়। ঠিক ইহার তিন দিন পরে অর্থাৎ ১৫ই মে তারিখে গভর্ণমেণ্ট তাঁহাকে মুক্তিদান করেন।

 মুক্তিলাভের পর সুভাষচন্দ্র তাঁহার ভগ্নস্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের আশায় স্বনামধন্য ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়ের শরণাপন্ন হন। ডাক্তার রায়ের সুচিকিৎসায় সুভাষচন্দ্র অনতিবিলম্বে সুস্থ ও সবল হইলেন এবং দেশের কাজে আত্মনিয়োগ করিতে সমর্থ হইলেন। তিনি দেখিতে পাইলেন, যে শক্তিতে শক্তিমান হইয়া একদিন তিনি কর্ম্মক্ষেত্রে বিচরণ করিতেছিলেন, দেশবন্ধুর মহাপ্রয়াণে তাঁহার সেই শক্তি মন্দীভূত হইয়া আসিতেছে। কিন্তু মুহূর্ত্তের এই দুর্ব্বলতা শীঘ্রই দূর হইল। এতদিন তিনি সংসারের ঘোর আবর্ত্তনে পতিত হইয়া যে শক্তি সঞ্চয় করিয়াছিলেন, তাহার প্রভাব এখন বুঝিতে পারিলেন। ধনীর সন্তান হইয়াও তিনি কিশোর বয়স হইতেই দুঃখকে বরণ করিয়া লইয়াছিলেন। জন্মভূমির দুঃখ দারিদ্র্য দূর করিবার জন্য, আর্ত্তের সেবা করিবার জন্য অনশন, অর্দ্ধাশন এবং অনিদ্রা তাঁহার চিরসাথী হইয়াছিল। পথশ্রমে তিনি কোনও দিনই ক্লান্তি অনুভব করেন নাই। দিনের পর দিন পদব্রজে ভ্রমণ করিয়া তিনি বিপদসঙ্কুল দীর্ঘপথ অতিক্রম করিয়াছেন। তথাপি তিনি স্বদেশ সেবায় বিরত হন নাই। সুতরাং আত্মশক্তিতে উদ্বুদ্ধ হইয়া দ্বিগুণ উৎসাহের সহিত তিনি কর্ম্মক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইলেন।

 মনেরভাব ভাষায় ফুটাইয়া তুলিবার ক্ষমতা তাঁহার কিরূপ অসাধারণ ছিল, কলিকাতা কংগ্রেসের অধিবেশনে অনেকেই তাহা বুঝিতে পারিয়াছিলেন। কংগ্রেস স্বরাজের প্রার্থী ছিলেন বটে, কিন্তু স্বরাজের প্রকৃত অর্থ কি এতদিন কেহই তাহা স্থির করিতে পারেন নাই। কলিকাতা কংগ্রেসের অধিবেশনে সুভাষচন্দ্রই প্রথম বুঝাইয়া দিলেন যে “স্বরাজের” অর্থ “স্বাধীনতা” এবং কংগ্রেসকে এই অর্থ গ্রহণ করিতে অনুরোধ করিয়াছিলেন। মহাত্মা গান্ধী অনুমোদন না করাতে কলিকাতা কংগ্রেস এ প্রস্তাব গ্রাহ্য করিলেন না। কিন্তু পরবর্ত্তীকালে মহাসমিতি সুভাষচন্দ্রের অর্থই সমীচীন মনে করিয়াছিলেন।

  1. If love of country is a crime, I am a criminal. If Mr. Subhas Chandra Bose is a criminal, I am also a criminal— not only the Chief Executive Officer of the Corporation but the Mayor of this Corporation is equally guilty.
     —The Calcutta Municipal Gazette Vol XLII No 16 P, 442.