বাঙ্গালীর প্রতিভা ও সুভাষচন্দ্র/নেতাজীর আদেশ

নেতাজীর আদেশ

Last special order of the Day

 রেঙ্গুন পরিত্যাগ করিবার প্রাক্কালে ২৪শে এপ্রেল তারিখে নেতাজী তাঁহার প্রিয় সেনা বাহিনীর জন্য যে বিশেষ আদেশ পত্র লিখিয়া রাখিয়া গিয়াছিলেন, তাহার সারাংশ নিম্নে প্রদত্ত হইল।

 আজাদ হিন্দ ফৌজের উচ্চ কর্ম্মচারিবৃন্দ এবং প্রিয় সৈনিকগণ—

 আমি গভীর শোকভারাক্রান্ত হৃদয়ে রেঙ্গুন পরিত্যাগ করিতে বাধ্য হইলাম। এই রেঙ্গুনে গত ১৯৪৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাস হইতে বীরত্বের সহিত আপনারা অনেক যুদ্ধ করিয়াছেন এবং বর্ত্তমানেও আপনারা অক্লান্তভাবে যুদ্ধ করিতেছেন। ইনফল এবং ব্রহ্মদেশীয় প্রথম যুদ্ধে আমরা পরাজিত হইয়াছি, একথা সত্য বটে কিন্তু মনে রাখিবেন ইহা প্রথম যুদ্ধ মাত্র। আমাদিগকে আরও অনেকগুলি যুদ্ধ করিতে হইবে। আমাদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল এ বিশ্বাস আমার চিরদিনই আছে। সুতরাং আমি পরাজয় মানিয়া লইব না। আপনারা ইনফলের ময়দানে, আরাকানের পার্ব্বত্য প্রদেশে, বনে জঙ্গলে এবং ব্রহ্মের নানা প্রদেশে শত্রু সৈন্যকে যেরূপভাবে বাধা দিয়াছেন, তাহা ভারতের এই স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হইয়া থাকিবে।

 সঙ্গিগণ, এই সঙ্কটময় পরিস্থিতির সময়ে আমি আপনাদিগকে একটি মাত্র আদেশ দিয়া যাইতেছি, যদি আপনারা বর্ত্তমান সংগ্রামে সাফল্যমণ্ডিত হইতে না পারেন, তথাপি আপনারা আপনাদের আত্মসম্মান অটুট রাখিয়া এবং সৈনিকের সর্ব্বোচ্চ আদর্শ সম্মুখে রাখিয়া বীরোচিত কার্য্য করিবেন। আপনাদের এই মহান্ স্বার্থত্যাগের ফলে আপনাদের সন্তান সন্ততিগণ ক্রীতদাস না হইয়া স্বাধীন মানবরূপে জন্মগ্রহণ করিবে। তাহারা সমস্ত জগতে ঘোষণা করিবে, “আপনারা—তাহাদের পিতৃপুরুষগণ মণিপুর, আসাম এবং ব্রহ্মদেশে স্বাধীনতা লাভের জন্য প্রাণপণে যুদ্ধ করিয়া পরাজিত হইয়াছেন বটে, কিন্তু আপনারা বিজয় এবং গৌরবের পথ সুগম এবং সহজ করিয়া গিয়াছেন।” ভারত যে স্বাধীন হইবে— এ বিশ্বাস এখনও আমার অটুট রহিয়াছে। আমাদের জাতীয় সম্মান, এবং ভারতীয়গণের বীরত্বের খ্যাতি অক্ষুণ্ণ থাকিবে এই আশায় আমি আমাদের জাতীয় ত্রিবর্ণ-রঞ্জিত পতাকা আপনাদের হস্তে সমর্পণ করিয়া যাইতেছি। আপনারা ভারতের মুক্তি সংগ্রামে অগ্রগামী সৈনিক, সুতরাং আপনারা ভারতের জাতীয় সম্মান রক্ষা করিবার জন্য আপনাদের প্রিয় বলিয়া যাহা কিছু এমন কি জীবন পর্য্যন্ত বিসর্জ্জন দিতেও কুণ্ঠিত হইবেন না। ইহাতে আপনাদের সঙ্গিগণ যখন অন্যত্র স্বাধীন সংগ্রামে লিপ্ত হইবেন, তখন তাঁহারা আপনাদের এই মহৎ দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হইবেন।

 আপনাদের ক্ষণিক পরাজয়ের দুঃখ ও গ্লানির অংশ গ্রহণ করিবার জন্য এই বিপদের সময়ে আমি রেঙ্গুন পরিত্যাগ করিবনা ইহাই স্থির করিয়াছিলাম, কিন্তু আমি নিজের মতে কাজ করিতে পারিলাম না। আমার মন্ত্রীগণের ও উর্দ্ধতন কর্ম্মচারিগণের পরামর্শে আমি ব্রহ্মদেশ ত্যাগ করিয়া যাইতেছি। আমি মনে করিয়াছি অন্যত্র গিয়া আমি এই সংগ্রাম পরিচালনা করিব। আপনাদের দুঃখ কষ্ট ও স্বার্থত্যাগ ব্যর্থ হইবেনা। আমি ১৯৪৩ সালের ২১শে অক্টোবর আমার জন্মভূমির ৩৮ কোটী লোকের সেবা করিবার জন্য যে অঙ্গীকারে আবদ্ধ হইয়াছি, আমরণ আমি তাহা পালন করিব এবং তাহাদের স্বাধীনতার জন্য চিরদিনই সংগ্রামে লিপ্ত থাকিব।

 উপসংহারে আমি আপনাদিগকে বলিতেছি যে আপনারা আমার ন্যায় বিশ্বাস করিবেন যে ঊষার আলোক পূর্ব্বগগন উদ্ভাসিত করিবার পূর্ব্বে সমগ্র জগৎ গভীরতম অন্ধকারে আবৃত থাকে। শেষ কথা ভারত স্বাধীন হইবেই অনতিবিলম্বেই স্বাধীন হইবে। ঈশ্বর আপনাদিগকে আশীর্ব্বাদ করুন।

ইনক্লাব জিন্দাবাদ 

আজাদ হিন্দ জিন্দাবাদ 
জয়হিন্দ 

(স্বাক্ষর) সুভাষ চন্দ্র বসু