বাঙ্গালীর প্রতিভা ও সুভাষচন্দ্র/নেতাজীর বৈশিষ্ট্য

নেতাজীর বৈশিষ্ট্য

 (১) মিষ্টার এস্. এ আয়ার (Publicity and Propaganda minister) আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচারকালে যে সাক্ষ্য দিয়াছেন, তাহা হইতে জানা যায় যে নেতাজি যে সময়ে পূর্ব্ব এশিয়ায় জাতীয় বাহিনী গঠন করিয়া ব্রিটিশ শক্তির সহিত যুদ্ধের আয়োজন করিতেছিলেন, তখন তিনি রাত্রিকালে কেবলমাত্র ২ঘণ্টা ৪০ মিনিট কাল নিদ্রা যাইতেন। কিন্তু ব্রিটিশ গভর্নমেণ্ট ও আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিবার পরে তিনি দুই ঘণ্টার অধিক নিদ্রা যাইতেন না।

 (২) দিল্লীর কারাগার হইতে জাতীয় বাহিনীর সদ্য মুক্ত কয়েকজন সৈনিক নেতাজীর বিশিষ্টতা সম্বন্ধে অপর একটি বিবরণ প্রকাশ করিয়াছেন, তাহা হইতে জানা যায় যে তিনি রণসাজে সজ্জিত না হইয়া কখনও বাহির হইতেন না। এতদ্ভিন্ন একখানি তরবারি, একটি বন্দুক এবং দশদিনের খাদ্য সে সময়ে তাঁহার সঙ্গে থাকিত। মন্ত্রীগণ তাঁহার অনুগামী হইতেন। এইরূপে সজ্জিত হইয়া তিনি কখনও কখনও অতর্কিতভাবে তাঁহার পদাতিক সেনানিবাসে উপস্থিত হইয়া তাঁহাদিগকে বিস্ময়াবিষ্ট করিয়া দিতেন।

 (৩) স্বাধীন ভারত অস্থায়ী গভর্ণমেণ্টের সভাপতিরূপে নেতাজী যখন নিরতিশয় উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার সহিত কালযাপন করিতেছিলেন, সেই সঙ্কট জনক মুহূর্ত্তেও তিনি কিরূপ সহৃদয়তা ও মহানুভবতার পরিচয় দিয়াছেন, তাহার একটি মনোজ্ঞ বিবরণ প্রকাশিত হইয়াছে। তাঁহার একজন দেহরক্ষী ইউনাইটেড প্রেসের প্রতিনিধির নিকট এই ঘটনাটি বিবৃত করিয়াছেন।

 সুভাষচন্দ্রের গৃহপালিত এক বানর-দম্পতী ছিল। তিনি কয়েকটি পারাবত ও একটি কুকুরও পুষিয়াছিলেন। পশুপক্ষিগণের মধ্যে উক্ত বানর-দম্পতী তাঁহার সর্ব্বাপেক্ষা প্রিয় ছিল। তিনি স্বহস্তে তাহাদিগকে আহার করাইতেন এবং তাহারা পীড়িত হইলে তিনি স্বহস্তে তাহাদের সেবা শুশ্রুষা করিতেন। প্রতিদিন প্রত্যুষে উঠিয়া তিনি “জয়হিন্দ” রবে তাহাদিগকে অভিবাদন করিতেন। তাহারাও হস্ত উত্তোলন করিয়া নেতাজীকে প্রত্যভিবাদন করিত।

 নেতাজীর অনুপস্থিত কালে একদিন বানর-দম্পতীর সহিত কুকুরের বিবাদ হইল এবং কুকুরটি পুরুষ বানরটীকে দংশন করিয়া ক্ষতবিক্ষত করিল। নেতাজী গৃহে প্রত্যাবর্ত্তন করিয়া বানরের অবস্থা দেখিয়া অশ্রু সংবরণ করিতে পারিলেন না। সন্তান পীড়িত হইলে জননী যেমন প্রাণপাত করিয়া তাহার সেবা শুশ্রুষা করেন, এই শাখা-মৃগের শারীরিক ক্ষত উপশমের জন্য নেতাজীও সেইরূপ পরিশ্রম করিলেন। কিন্তু এত চেষ্টা করিয়াও তাহার প্রাণরক্ষা হইল না। ইহাতে সুভাষচন্দ্র এইরূপ শোকাভিভূত হইলেন এবং কুকুরের উপর এইরূপ ক্রোধান্বিত হইলেন যে তিনি অবিলম্বে তাহাকে হত্যা করিবার আদেশ দিলেন।

 সুভাষচন্দ্র সূর্য্যোদয়ের বহুপূর্ব্বে শয্যাত্যাগ করিতেন, এবং ভগবতোপাসনা ও ব্যায়াম শেষ করিয়া দৈনন্দিন কার্য্যে প্রবৃত্ত হইতেন। ব্রহ্মদেশের অধিবাসীগণের ধর্ম্মের প্রতি তাঁহার অসাধারণ ভক্তি ছিল। সামরিক পরিচ্ছদ অথবা পাদুকা পরিধান করিয়া তিনি কদাচ তাহাদের ধর্ম্মমন্দিরে (Pagoda) পদার্পণ করিতেন না। উক্ত ধর্ম্মের প্রতি তাঁহার এরূপ অনুরাগ ছিলযে তিনি ভূলুণ্ঠিত হইয়া সেই দেবতাগণের উপাসনা করিতেন। পারাবতগুলিকেও প্রতিদিন তিনি স্বহস্তে আহার করাইতেন।