বাঙ্গালীর প্রতিভা ও সুভাষচন্দ্র/প্রতিভা

প্রতিভা

 মানব যেদিন প্রতিভার পূজা করিতে শিখিয়াছে, সেই দিন হইতেই জগতে প্রকৃত ইতিহাসের সূচনা হইয়াছে। মহাপুরুষগণ নিজ নিজ জ্ঞান-গরিমা অথবা মহান্ কার্য্যকলাপের দ্বারা এই মরজগতে যে অবিনশ্বর কীর্তি রাখিয়া যান, ইতিহাস যুগযুগান্তর ধরিয়া তাহারই স্মৃতি বক্ষে ধারণ করিয়া মহিমান্বিত হয়। প্রাগৈতিহাসিক যুগের কাহিনী কিংবদন্তীতে পর্যবসিত হয়। বর্ত্তমান জ্ঞান-বিজ্ঞানের লীলাভূমি পাশ্চাত্য ভূখণ্ডেও দুইশতবৎসর পূর্বে প্রকৃত ইতিহাসের সৃষ্টি হয় নাই। প্রাচীন সভ্যতার অরুণ আলোেক যে গ্রীস ও রোমে প্রথম প্রকটিত হয়, সেখানেও প্রতিভাবান্ ব্যক্তিগণের কাহিনী বিস্মৃতির অতলজলে নিমজ্জিত ছিল। কিংবদন্তীর সাহায্যে অনুসন্ধিৎসু মানব কিয়ৎপরিমাণে তাহার উদ্ধার করিতে সমর্থ হইয়াছে। গ্রীসের আদি কবি হোমার ভার্জিল প্রভৃতির সম্বন্ধে যে সকল তথ্য প্রকাশিত হইয়াছে, তাহা সংগ্রহ করিবার জন্য জনপ্রবাদের উপর নির্ভর করিতে হইয়াছে। তথাপি বহু তথ্য অপ্রকাশিত রহিয়াছে। হোমার অন্ধ অবস্থায় ট্রয়যুদ্ধের কাহিনী অবলম্বন করিয়া ‘ইলিয়াড’ এবং ‘ওডিসি’ নামক যে দুই মহাকাব্য রচনা করিয়া গিয়াছেন, তাহা ইহাকে কাব্য-জগতে অমর করিয়া রাখিয়াছে। কিন্তু তাঁহার দেশবাসিগণ বহু চেষ্টা করিয়াও তাহার জন্মস্থান নির্ণয় করিতে পারেন নাই। তাহার মৃত্যুর দীর্ঘকাল পরে সমগ্রদেশ যখন তাহার কবি-প্রতিভা সম্বন্ধে সচেতন হইল, তখন একে একে সাতটী দেশ তাহার জন্মস্থান বলিয়া দাবি করিতে লাগিল।[] ইংলণ্ডের শ্রেষ্ঠ কবি সেক্সপিয়ারও জীবদ্দশায় তাহার স্বদেশবাসিগণের নিকট হইতে বিন্দুমাত্র সমাদর লাভ করিতে পারেন নাই। মৃত্যুর অনেক পরেই তাঁহার দেশবাসিগণ তাহার অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় পাইয়াছিল।

 এদেশের ইতিহাস সম্বন্ধেও অনুরূপ কথা বলা যাইতে পারে। বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, উপপুরাণ, শ্রুতি, স্মৃতি, রামায়ণ, মহাভারত প্রভৃতির সহিত এদেশের ইতিহাস ওতপ্রোতভাবে বিজড়িত রহিয়াছে। ইহার মধ্যে ঐতিহাসিক সত্য কতটুকু তাহা জানিবার উপায় নাই। কোন কোন মনীষী এই গভীর জ্ঞানসমুদ্রে নিমজ্জিত হইয়া দুই চারিটী রত্ন উদ্ধার করিয়াছেন সত্য বটে, কিন্তু একটা জাতির জ্ঞানভাণ্ডারে সে যে কত সামান্য তাহার উল্লেখ করা নিষ্প্রয়োজন। মহাকবি কালিদাসের অভিজ্ঞান-শকুন্তল, কুমার-সম্ভব, মেঘদূত প্রভৃতি কাব্য জগতের যে কোনও সভ্যজাতির শ্রেষ্ঠ কাব্যের সহিত তুলনীয় হইতে পাবে। কিন্তু তাহার জীবিতকালের ইতিহাস অন্ধতমসাচ্ছন্ন। সকলেই অবগত আছেন, এই মহাকবি কোন্ সময়ে এবং কোন্ প্রদেশে জন্মগ্রহণ করিয়া এই ভারতভূমি পবিত্র করিয়াছিলেন, বহু গবেষণার ফলেও তাহা স্থিরীকৃত হয় নাই। অথচ তাহার মহাকাব্যনিচয় শুধু ভারতে নহে, পাশ্চাত্য দেশের সুধীগণ কর্তৃকও উচ্চকণ্ঠে প্রশংসিত হইয়াছে।[]

 ভারতবাসী ইতিহাস রচনায় উদাসীন হইলেও কখনও প্রতিভার পূজা করিতে শিক্ষা করে নাই, একথা বলিলে সত্যের অপলাপ করা হইবে। উজ্জয়িনীরাজ মহারাজ বিক্রমাদিত্যের সভা কালিদাস প্রমুখ নবরত্নের দ্বারা সুশোভিত ছিল একথা একরূপ ঐতিহাসিক সত্য। মোগল-সম্রাট আকবর আফুলফজল, বীরবল, ফৈজি প্রভৃতি অশেষ প্রতিভাশালী ব্যক্তিগণকে যথেষ্ট সমাদব করিতেন একথাও সর্বজনবিদিত। কোনও জাতিব আত্মচৈতন্যের উদয় হইলে, সে জাতি আপন সমাজের মহৎ ব্যক্তিগণের প্রতিভাব সমাদর করিয়া পরোক্ষভাবে আপনাদিগকেই সম্মানিত কবিয়া থাকে। যে ব্যক্তি নিজে গুণবান সেই কেবল গুণেব আদর কবিতে জানে। যোগ্য ব্যক্তিকে উপযুক্ত সম্মান না দিলে নিজেরই যোগ্যতার অভাব পবিলক্ষিত হয়। কবি বলিয়াছেন—

গুণ গুণ বেত্তি ন বেক্তি নির্গুণঃ।
বলী বলং বেত্তি ন বেত্তি নির্বলঃ।
পিকো বসন্তস্য গুণং ন বায়সঃ।
করি চ সিংহস্য বলং ন মুষিকঃ॥

বঙ্গানুবাদ



গুণীগণ গুণবানে সমাদর করে,
নিগুণ গুণীব গুণ কি বুঝিতে পারে?
বলীই বলীর বল বুঝে ভালমতে,
দুর্বলের সাধ্য কিবা আছে এ জগতে?
ঋতুবাজ বসন্তের মাধুরী অপার,
পিকবর জানে শুধু, বায়স কি ছার।
কেশরীব পরাক্রম করি ভাল জানে,
নগণ্য মুষিক বল জানিবে কেমনে?

  1. Seven countries claimed for Homer being born through which the living Homer had passed without a bread.
  2. বিখ্যাত জার্মান কবি গেটে এই মহাকবির শ্রেষ্ঠ কাব্য ‘শকুন্তলা’ পাঠ করিয়া উচ্ছসিত কণ্ঠে যে প্রশংসা-গীতি গাহিয়াছেন, তাহার ইংরাজী অনুবাদ পাঠ করিয়া সংস্কৃতানভিজ্ঞ পাঠকগণ তাঁহার কবি প্রতিভায় মুগ্ধ হইয়াছেন। ইংরাজি অনুবাদটি নিম্নে উদ্ধৃত হইল—

    “Wouldst thou the young year's blossom
    And the fruits of its decline
    And all by which the soul is charmed
    Enraptured, teasted, fed?
    Wouldst thou the earth and heaven itself
    In one sole name combine?
    I name thee, O Sakuntala!
    And all at once is said.”