বাঙ্গালীর প্রতিভা ও সুভাষচন্দ্র/সুভাষচন্দ্র

সুভাষচন্দ্র

 অর্দ্ধ শতাব্দী পূর্বে ভারতের দক্ষিণ সীমান্তে সমুদ্র উপকূলে যে মহাপুরুষের জন্ম হইয়াছিল, কে জানিত অদূর ভবিষ্যতে তাঁহার কার্যকলাপের দ্বারা এই অধীন পর-পদদলিত জাতির মসী-লাঞ্ছিত ইতিহাস সুবর্ণাক্ষরে মণ্ডিত হইবে? আজ যাহার অনন্যসাধারণ চরিত্র শুধু ভারতের নহে, পরন্তু সমগ্র পৃথিবীর বিস্ময়ের বিষয় হইয়াছে, যিনি এই সহস্রবর্ষব্যাপী পরাধীন দেশে জন্মগ্রহণ করিয়াও অসামান্য প্রতিভাবলে সমস্ত জগৎকে স্তম্ভিত করিয়াছেন, রাজা সীতারাম রায় ও মহারাজ প্রতাপাদিত্যের উপযুক্ত বংশধর বলিয়া আজ সমগ্র বাঙ্গালী জাতি যাহার মস্তকে জয়মাল্য দিয়া বাঙ্গালাদেশের গৌরব বৃদ্ধি করিতে উদ্যত হইয়াছেন, তাঁহার অলোকসাধারণ চরিত্র ও অপূর্ব জীবন-কাহিনী লোক-লোচনের সমক্ষে উপস্থিত করিতে প্রবৃত্ত হইয়া লেখক আপনাকে গৌরবান্বিত মনে করিতেছেন।

 এই পরাধীন ভারতের শত শত যোদ্ধা স্বাধীনতা-সংগ্রামে যোগদান করিয়া আত্মপ্রাণ বলি দিয়াছেন; কিন্তু প্রকৃত; স্বাধীনতার যে অপার্থিব সুখ তাহা একমাত্র নেতাজী উপলব্ধি করিয়াছেন। আসামের কিয়দংশ বৃটীশের দাসত্ব-শৃঙ্খল হইতে মুক্ত করিয়া এবং তাহাকে স্বাধীন ভারত আখ্যা দিয়া অল্পদিনের জন্য হইলেও সুভাষ চন্দ্র এই ভূখণ্ডের উপর আধিপত্য বিস্তার করিয়াছিলেন।

 দেশে একজন মহাপুরুষের জন্ম হইলে সে দেশ গৌরবান্বিত হয়। মহামতি শ্রীযুক্ত গোপালকৃষ্ণ গোখেল। আন্দোলনের সময়ে বড়লাটকে বলিয়াছিলেন—“আজ বাঙ্গালাদেশ যে বিষয় চিন্তা করে, কাল সমগ্র ভারতবর্ষ সে বিষয় চিন্তা করিবে।”[১] সুভাষচন্দ্রের জীবন-চরিত আলোচনা করিলে, এ বিষয়ের অনেক দৃষ্টান্ত পাওয়া যাইতে পারে। জাতীয় মহাসমিতির অধিবেশনে সুভাষচন্দ্রই প্রথম পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি উত্থাপন করিয়াছিলেন। পণ্ডিত জহরলাল নেহেরু ভিন্ন আর কেহই এ প্রস্তাব সমর্থন করেন নাই। কিছুদিন পরে মহাসমিতি সেই প্রস্তাব গ্রহণ করিয়া সুভাষচন্দ্রের মতই সমীচীন বলিয়া স্বীকার করিয়াছেন। আবার ত্রিপুরী কংগ্রেসের সভাপতির আসন গ্রহণ করিয়া তিনি বৃটিশ গভর্ণমেণ্টকে ‘চরমপত্র’ দিবার প্রস্তাব করিয়াছিলেন। এই জন্য তাঁহাকে “Quit india” বা “ভারত ত্যাগ কর” প্রস্তাবের জনক বলা যাইতে পারে। প্রত্যেক যুগসন্ধিকালে নূতনকে গড়িয়া তুলিবার জন্য প্রচলিত ও পুরাতনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ঘোষণা করিবার প্রয়োজন হয়। এই সময়ে মহাপুরুষগণ কর্মক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইয়া সংগ্রাম পরিচালনার ভার গ্রহণ করেন। তাঁহারা পুরাতনের অপূর্ণতাকে নূতনত্বে পর্য্যবসিত করিয়া নবযুগের সূচনা করিয়া দেন। সুভাষচন্দ্রকে এই যুগপ্রবর্তক ঋষি আখ্যা না দিলে সত্যের অপলাপ করা হইবে। বস্তুতঃ সুভাষচন্দ্রের সমগ্র জীবনের কার্য্যাবলি পর্যালোচনা করিলে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয়, তিনি যেন আলোকবর্তিকা হস্তে ধারণ করিয়া ভারতের নেতৃবৃন্দের পুরোভাগে গমন করিয়াছেন এবং দেশ-মাতৃকাকে দাসত্ব-শৃঙ্খল হইতে মুক্ত করিবার প্রকৃষ্টতম উপায় নির্ধারণ করিয়া দিয়াছেন।

  1. What Bengal thinks today, the whole of India will think tomorrow