বাঙ্গালীর প্রতিভা ও সুভাষচন্দ্র/মালয়ে বক্তৃতা

মালয়ে বক্তৃতা

 ১৯৪৩ সালের ২৫ শে অক্টোবর নেতাজী মালয় প্রদেশে যে বক্তৃতা দিয়াছিলেন এবং যাহার ফলে ধনী নির্ধন সকল ভারতবাসী তাহাদের ধনসম্পত্তি ভারতীয় সৈনিক বিভাগের তহবিলে মুক্ত হস্তে দান করিয়াছিলেন, তাহার সারাংশ নিম্নে প্রদত্ত হইল।

 বন্ধুগণ,

 যখন একদল সৈন্য যুদ্ধক্ষেত্রে গমন করে, যুদ্ধ করিবার বা দেশ জয় করিবার দায়িত্ব সৈন্য বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্ম্মচারী হইতে নিম্নপদস্থ সৈনিক পর্য্যন্ত সকলেরই উপর তুল্যাংশে অর্পিত হয়। ভারতভূমির যে সকল সন্তান অধুনা পূর্ব্ব এশিয়ায় অবস্থান করিতেছেন, তাঁহাদের সকলকেই নিজ নিজ কর্ত্তব্য পালন করিতে হইবে। আপনাদের মধ্যে কেহ বা ধনী, কেহ বা নির্ধন, কেহ বা শিক্ষিত, কেহ বা শিক্ষার আলোক প্রাপ্ত হন নাই, কিন্তু তথাপি আমি আপনাদিগকে স্মরণ করাইয়া দিতেছি যে কর্ত্তব্য পালন সম্বন্ধে আপনাদের সকলকেই সমানভাবে অবহিত হইতে হইবে। আমি আশাকরি পূর্ব্ব এশিয়ার প্রবাসী প্রত্যেক ভারত-সন্তান প্রাণপণে স্বীয় কর্ত্তব্য পালন করিবে।

 আপনারা জানেন পূর্ব্ব এশিয়ার যুদ্ধে সোনান (Syonan) অত্যন্ত প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছে। ‘ভারতীয় স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠান’এর (Indian Independence League) প্রধান কেন্দ্র এই সোনান। I. N. A বা ভারতীয় জাতীয় বাহিনীর প্রধান কেন্দ্র এই স্থানে স্থাপিত হইয়াছে। আজাদ হিন্দের অস্থায়ী গভর্ণমেণ্টও এই সোনানে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। যে সোনানে এক সময়ে ব্রিটিশ রাজ্যের দুর্গ ছিল, সেই সোনান এখন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হইয়াছে। সুতরাং সোনান হইতে যে আদেশ প্রচারিত হইবে তাহা সমগ্র পূর্ব্ব এশিয়াকে মানিয়া লইতে হইবে।

 আমরা এতদিন পর্য্যন্ত আমাদের দেশে কেবল সভাসমিতি করিয়া আসিয়াছি। কিন্তু মনে রাখিবেন যে কোন স্বাধীন দেশে যুদ্ধ উপস্থিত হইলে সভাসমিতি বা আবেদন নিবেদন করিবার প্রয়োজন আদৌ অনুভূত হয় না। স্বাধীন দেশের নেতৃগণ দেশের প্রত্যেক সবল ও সক্ষম ব্যক্তিকে যুদ্ধে যোগদান করিবার জন্য আহ্বান করেন, এবং প্রত্যেক দেশবাসী স্বেচ্ছায় যুদ্ধ ব্যাপারে অত্মনিয়োগ করেন। স্বাধীন দেশের অধিবাসীগণ অবগত আছেন যে স্বাধীনতা রক্ষা করিতে হইলে বা (পরাধীন জাতির পক্ষে) স্বাধীনতা অর্জ্জন করিতে হইলে প্রত্যেক ব্যক্তিকে স্বার্থত্যাগ করিতে হইবে, এবং সামরিক ব্যাপারে অর্থের প্রয়োজন হইলে, সভাসমিতি করিয়া বা আবেদন নিবেদন করিয়া সে টাকা সংগ্রহ করিবার অবসর পাওয়া যায় না।

 বন্ধুগণ আরও দেখুন, দেশে যুদ্ধ উপস্থিত হইলে কাহারও কোন ব্যক্তিগত ধনসম্পত্তি থাকিতে পারেনা, কিম্বা থাকা উচিত নহে। এই রাষ্ট্র-বিপ্লবের সময়ে গভর্ণমেণ্ট বা রাজাকেই সমস্ত ধনসম্পত্তির মালিক বলিয়া গণ্য করিতে হইবে, কেননা স্বাধীনতা রক্ষা বা অর্জ্জন করিতে হইলে বিপুল অর্থের প্রয়োজন। দেশের লোকের সহানুভূতি ভিন্ন এই বিপুল অর্থ সংগৃহীত হইতে পারে না। আবার দেশ পরাধীন হইলে, অথবা রাজ্যে বিপ্লব উপস্থিত হইলে ব্যক্তিগত ধন সম্পত্তিরও অস্তিত্ব থাকে না। প্রত্যেক লোকের জীবনও তখন জাতীয় সম্পত্তি বলিয়া গণ্য হইবে। সুতরাং আমাদের জীবন ও ধনসম্পত্তি এখন আর আমাদের নিজের নহে। উহাকে এখন সমগ্র ভারতের সম্পত্তি বলিয়া গণ্য করিতে হইবে।

 বন্ধুগণ, আমরা ভারত মাতার নামে যে অস্থায়ী স্বাধীন গভর্ণমেণ্ট স্থাপন করিয়াছি, সে গভর্ণমেণ্টের জন্য জনবল ও অর্থবল উভয়ই সংগ্রহ করিতে হইবে। বর্ত্তমান মহাসমরে জার্ম্মাণী ও জাপান শুধু যে দেশের সক্ষম ও বলিষ্ঠ প্রত্যেক ব্যক্তিকে সৈনিক বিভাগে নিযুক্ত করিয়াছেন তাহা নহে, প্রত্যেক লোকের ধন সম্পত্তি ষ্টেটের অন্তর্ভূক্ত করিয়া লইয়াছেন। আমরাও বর্ত্তমানে এই অস্থায়ী স্বাধীন গভর্ণমেণ্টের পরিপুষ্টির জন্য জার্ম্মাণী ও জাপানের অনুকরণ করিব। স্বাধীন গভর্ণমেণ্ট মাত্রেরই সে অধিকার আছে। যদি আপনারা মনে করেন আপনাদের পরিশ্রম লব্ধ ধনসম্পত্তি আপনাদের নিজের, তাহা হইলে আপনাদের ভুল হইবে। উহা এখন স্বাধীন ভারতের সম্পত্তি। আপনারা যদি স্বাধীনতার প্রার্থী না হন এবং স্বাধীনতার মূল্য স্বরূপ এই স্বার্থত্যাগ করিতে পশ্চাৎপদ হন, তাহা হইলে আপনাদের জন্য একটি মাত্র পথ নির্দ্দিষ্ট আছে। যুদ্ধ শেষ হইবার পর যখন ভারত স্বাধীন হইবে, তখন স্বাধীন ভারতে আপনাদের স্থান হইবে না।

 বন্ধুগণ, আমি সোনান হইতে আপনাদের নিকট যে আবেদন করিয়াছি, তাহাই আমার শেষ আবেদন। আজ আমি অর্থ সাহায্যের জন্য ভিক্ষাপাত্র হস্তে লইয়া আপনাদের নিকট উপস্থিত হই নাই। আজ আমি অস্থায়ী আজাদ হিন্দ গভর্ণমেণ্টের প্রতিনিধি স্বরূপ এখানে উপস্থিত হইয়া আপনাদিগকে জানাইতেছি যে আপনাদের জীবন এবং সম্পত্তির উপরে এই গভর্ণমেণ্টের অবাধ অধিকার আছে।

 আজ আমি আপনাদিগকে কোন ফাঁকা কথা বলিতেছিনা—আমার সুচিন্তিত অভিমতই আমি চিরদিন সকলকে বলিয়া থাকি। আমি ইতিপূর্ব্বে অনেকবার বলিয়াছি যে ভারতের স্বাধীনতা আমাকে যে কোনও উপায়ে অর্জ্জন করিতে হইবে। এ বিষয়ে আপনাদের সাহায্য স্বেচ্ছাকৃত হইলেই সুখের বিষয় হইবে। যদি না হয় আমাকে বাধ্যতামূলক আচরণ অবলম্বন করিতে হইবে। হয়ত বলপ্রয়োগ দ্বারাও অর্থ সংগ্রহ করিতে হইবে। আপনাদের পক্ষে দুইটি পথ খোলা আছে। আপনারা হয় মিত্ররূপে যোগ দিতে পারেন, নতুবা শত্রুরূপে পরিগণিত হইতে পারেন। যাঁহারা এই স্বাধীনতা আন্দোলনে সহায়তা করিবেন, তাঁহারা আমাদের মিত্র, আর যাঁহারা বিপরীত পথে যাইবেন তাঁহারা আমাদের শত্রু মধ্যে গণ্য। আপনাদিগকে আমি অনুরোধ করিতেছি, আপনারা একটা পথ বাছিয়া লইবেন। খোলাখুলি একথা বলিতেছি, কারণ আমরা এখন জীবন মরণের সন্ধিস্থলে উপনীত হইয়াছি।

 আপনারা আরও জানিয়া রাখুন ভারতীয় জাতীয় বাহিনী যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইয়া আত্মপ্রাণ রক্ষার জন্য পশ্চাদপসরণ করিবে এরূপ শিক্ষা তাহাদের নাই। যুদ্ধক্ষেত্রে জয়লাভ করিবার, অথবা শেষ রক্তবিন্দু দান করিবার সংকল্প লইয়াই তাহারা এই যুদ্ধে আত্মনিয়োগ করিয়াছে।

 উপসংহারে আমি আপনাদিগকে জানাইতেছি যে আমার দেশবাসীদের মধ্যে এরূপ উন্মাদনার সঞ্চার হইয়াছে যে তাহারা দলে দলে আসিয়া এই সেনাবাহিনীতে যোগদান করিতেছেন। এখন আমাদের জনবল এত অধিক যে তাঁহাদের সাহায্যে আমরা দীর্ঘকাল ব্যাপী যুদ্ধ চালাইতে সক্ষম হইব। কিন্ত আমাদের অর্থবল নাই। যদি আমরা সকলেই দরিদ্র হইতাম, তাহা হইলে বিদেশীর নিকটে অর্থভিক্ষা করা আমাদের পক্ষে অশোভন হইত না। কিন্তু যখন আমাদের মধ্যে এমন সমৃদ্ধিশালী ব্যক্তি অনেক রহিয়াছেন, যাঁহারা মনে করিলেই আমাদের অর্থাভাব দূর করিতে পারেন, তখন বিদেশীর দ্বারে ভিক্ষাভাণ্ড লইয়া উপস্থিত হওয়া অত্যন্ত অপমানের বিষয় হইবে। আপনারা ভাবিয়া দেখুন, জীবন ও অর্থ এই উভয়ের মধ্যে কোনটি শ্রেষ্ঠ। জীবনের সহিত তুলনা করিলে অর্থের স্থান কত নিম্নে। যদি কোন বিদেশী গভর্ণমেণ্ট আসিয়া বলে হে ধনিন্ তোমার আজন্ম সঞ্চিত কোটী স্বর্ণমুদ্রা অথবা তোমার জীবন এতদুভয়ের মধ্যে একটি তোমাকে ছাড়িয়া দিতে হইবে, তখন তুমি নিশ্চয়ই কোটী মুদ্রার বিনিময়ে আত্মপ্রাণ রক্ষা করাই শ্রেয় মনে করিবে।