বাঙ্গালীর প্রতিভা ও সুভাষচন্দ্র/সুভাষচন্দ্রের মনীষা ও চরিত্র বিশ্লেষণ

সুভাষচন্দ্রের মনীষা ও চরিত্র বিশ্লেষণ

 নিখিল ভারত ফরওয়ার্ড ব্লকের সাধারণ সম্পাদক মিষ্টার হরিবিষ্ণু কামাথ সুভাষচন্দ্রের জয়ন্তী উপলক্ষে বলিয়াছেন—

 ভারতের স্বাধীনতা-যজ্ঞের ঋষি সুভাষচন্দ্রের অদ্ভুত কার্য্য কলাপ আমাদের অন্তরে এক অপূর্ব্ব উন্মাদনার সঞ্চার করিয়াছে। তাঁহার জাতীয় বাহিনী গঠন এবং ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্টের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা ভারতের স্বাধীনতা ক্ষেত্রে এক নূতন অধ্যায়ের সূচনা করিয়াছে। সুভাষচন্দ্রের জীবনব্যাপী সাধনা—বাল্যকালে আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য হিমালয় ভ্রমণ হইতে আরম্ভ করিয়া পরিণত বয়সে রাজনৈতিক মুক্তির জন্য ভারতের বাহিরে গমন একই অধ্যায় সূচিত করিতেছে। এ যেন এক আজন্ম-বিপ্লবীর ইতিহাস —যাহা পরাধীন জাতির দুঃখ দারিদ্র্য ও লাঞ্ছনা সাম্রাজ্যবাদের সহিত কোনও প্রকার আপোষ মীমাংসা করিতে একেবারেই সম্মত হয় নাই।

 সুভাষবাবু আপনাকে একজন যথার্থ ধর্ম্মপ্রচারক বলিয়া মনে করিতেন এবং তিনি যে একজন প্রকৃত ঋষি ছিলেন তাহা তাঁহার অসম্পূর্ণ আত্মজীবনীতে (unfinished autobiography) লিখিত আছে। তিনি যে কেবল রাজনীতিবিদ ছিলেন এমন নহে, তিনি বর্ত্তমান জগতের একজন শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রবিপ্লবী ছিলেন। গঠনমূলক কার্য্যে তাঁহার অদ্ভূত দক্ষতা ছিল। তিনি যে সাধারণ মানব অপেক্ষা অনেকাংশে শ্রেষ্ঠ ছিলেন, কোনও বিষয়ের প্রতিবাদকালে তাহা স্পষ্টই প্রতীয়মান হইত। তিনি নির্ভীক কর্ণধারের ন্যায় সমস্ত ঝড়ঝঞ্ঝা অগ্রাহ্য করিয়া গন্তব্য পথে অগ্রসর হইতেন। ভারতের স্বাধীনতা লাভের মহান্ আদর্শ তাঁহার সমগ্র জীবনে ওতঃপ্রোতভাবে বিদ্যমান ছিল। বস্তুতঃ যে আদর্শ লইয়া কংগ্রেস পূর্ণ স্বাধীনতার পথে অগ্রসর হইতেছে, চিন্তাশীল সুভাষচন্দ্র বসু ও পণ্ডিত জহরলাল নেহেরু তাহার রূপ দিয়াছেন।

 ১৯২৮।২৯ সালে সুভাষচন্দ্র বসু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সহিত কোনওরূপ আপোষ আলোচনা না করিয়া সংগ্রাম চালাইয়া যাইবার পক্ষপাতী ছিলেন। ১৯৩৯ সালে রোগশয্যায় শায়িত হইয়া তিনি ত্রিপুরী কংগ্রেসের সভাপতির আসন গ্রহণ করিয়াছিলেন। সেই সভাতেই তিনি ভবিষ্যৎ বাণী করিয়াছিলেন যে “বিশ্বযুদ্ধ আসন্ন।” ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্টকে চরমপত্র দিবার মত তিনি এই সভাতেই প্রকাশ করিয়াছিলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিবার নিমিত্ত দেশকে প্রস্তুত হইতেও উপদেশ দিয়াছিলেন। এই জন্যই তাঁহাকে “Quit India” বা “ভারত ত্যাগ কর” প্রস্তাবের জনক বলা যাইতে পারে। ভারতীয় জাতীয় গভর্ণমেণ্ট ও ভারতীয় জাতীয় বাহিনী গঠন ও তাহাদের বীরত্বপূর্ণ কার্য্যকলাপ সমস্তই ভারতের স্বাধীনতা লাভের কর্ম্মসূচির অন্তর্গত। তিনি তাঁহার এই প্রথম উদ্যমে সাফল্য লাভ করিতে পারেন নাই। এরূপ ব্যর্থতা ইতিহাসে অনেক দেখিতে পাওয়া যায়, কিন্তু এই ব্যর্থতাই অনেক সময়ে সফলতার গৌরবে মণ্ডিত হইয়া থাকে।

 জাপানের বিখ্যাত সংবাদপত্র সম্পাদক C. Haziwara আমেরিকার ইউনাইটেড প্রেসের প্রতিনিধিকে বলিয়াছিলেন—

 সুভাষবাবুর চরিত্রে ভাব-প্রবণতা এবং বিবেক এতদুভয়ের যেরূপ সমন্বয় দৃষ্ট হয়, সেরূপ সচরাচর আর কোথাও দৃষ্ট হয় না। সুভাষবাবু বলিতেন তাঁহার এবং মহাত্মা গান্ধীর গন্তব্য স্থল একই, কিন্তু উভয়ের পথ বিভিন্ন। ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিবার জন্য সুভাষবাবুর সহিত মিলিত হওয়া মহাত্মা গান্ধীর একেবারেই ইচ্ছা ছিল না।

 সম্পাদক মহাশয় রেঙ্গুন, ব্যাঙ্কক, সিঙ্গাপুর এবং ম্যানিল্লা এই চারিটি সংবাদপত্র সম্মেলনে সুভাষবাবুর সহিত মিলিত হইয়াছিলেন। সুভাষবাবু যে একজন ধীশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তি এ ধারণা তাঁহার বদ্ধমূল হইয়াছে।

 তিনি আরও বলেন আই. এন. এর জনৈক সৈনিক কয়েকটি আভ্যন্তরিক সংবাদ সংগ্রহ করিবার জন্য ভারতে আসিয়া অবগত হইয়াছিলেন, সুভাযবাবু সিঙ্গাপুর হইতে রেডিও যোগে যে বক্তৃতা করিতেন, ভারতরক্ষা আইনানুসারে তাহা শ্রবণ করা আইন-বিরুদ্ধ হইলেও তাঁহার স্বদেশবাসিগণ বিশেষ আগ্রহের সহিত উহা শ্রবণ করিত।

 ১৯৪৩ সালের আগষ্ট মাসে সুভাষবাবু যখন রেঙ্গুনে আসেন, তখন ভারতীয় জাতীয় বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা পঞ্চাশ হাজার হইতে দুই লক্ষ ছিল। নেতাজীর এই বিশ্বাস বদ্ধমূল ছিল যে, ভারত ও ব্রহ্মদেশের সংগঠনমূলক কার্য্য আর একটু অগ্রসর হইলে, সৈন্য সংখ্যা বহুল পরিমাণে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইতে পারে।

 সম্পাদক মহাশয় উপসংহারে বলিয়াছেন, মহাত্মা গান্ধীর সহিত অধিকাংশ বিষয়ে সুভাষবাবু একমত হইলেও তিনি তাঁহার অহিংসনীতিতে আস্থাবান ছিলেন না। তিনি বলিতেন ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্টের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করিলে সুফল এই হইবে যে তাঁহার সহযোগীগণের এমন কি ভারতের জন সাধারণের অন্তরে এক অভূতপূর্ব্ব উত্তেজনার সঞ্চার হইবে। ভারতের স্বাধীনতা লাভের পক্ষে ইহাই সর্ব্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয়। তবে তাঁহার চেষ্টা ব্যর্থ হইলে হয়ত তাঁহার জীবনকেই আহুতি দিতে হইবে।

 নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মতিথি উপলক্ষে মনীষী আর. এস. রুইকর বলিয়াছেন—

 মহাত্মা গান্ধীর অসামান্য প্রভাবও ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে ধ্বংশ করিতে পারে নাই। সময়ে সময়ে তিনি সাফল্যের নিকটবর্ত্তী হইয়াছেন, কিন্তু মুহূর্ত্তমধ্যে ব্রিটিশশক্তি পুনরায় সবল হইয়া দাঁড়াইয়াছে। পূর্ণ স্বাধীনতা আজও মহাত্মার আদর্শই রহিয়া গিয়াছে। ১৯২০—৩০ সালে ইহা যেখানে ছিল, আজও সেইখানেই আছে। কিন্তু মহাত্মা গান্ধী যাহা পারেন নাই, নেতাজী তাহাই করিয়াছিলেন। নেতাজী কেবলমাত্র প্রবল ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে রণক্ষেত্রে সংগ্রাম করেন নাই, তিনি আজাদ হিন্দ গভর্ণমেণ্ট ও প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। সহস্র সহস্র মাইলব্যাপী ভূখণ্ডের উপর ত্রিবর্ণ রঞ্জিত পতাকা প্রভুত্ব করিয়াছে। হইতে পারে ইহা দুই তিন বৎসর মাত্র ছিল। কিন্তু এরূপ অবস্থা সৃষ্টি করিতে পারে এরূপ নেতা কোথায়?

 সামরিক বিচারালয়ে সাক্ষ্য প্রদানকালে ক্যাপ্টেন শাহনওয়াজ নেতাজীর মনোভাব এইরূপে বিশ্লেষণ করিয়াছেন। সুভাষচন্দ্র বলিয়াছেন—

 “যখন দেখিলাম ভারতের কোটী কোটী নরনারাকে নিষ্ঠুরভাবে শোষণ করিবার জন্য ব্রিটিশ গভর্নমেণ্ট তাহাদিগের মধ্যে শিক্ষার বিস্তার না করিয়া তাহাদিগকে অজ্ঞ ও নিরক্ষর করিয়া রাখিয়াছেন, তখনই আমি ভারতের শাসন-পদ্ধতির উপর বীতশ্রদ্ধ হইলাম। আমার মনে হইল ইহা অত্যন্ত অবিচার এবং এই অবিচার নিবারণ কল্পে আমি আমার স্বদেশ, আত্মীয়স্বজন এমনকি জীবন পর্য্যন্ত বিসর্জ্জন দিতেও কৃতসঙ্কল্প হইলাম।”

সমাপ্ত