বাঙ্গ্লার বেগম/জিন্নতুন্নিসা
জিন্নতুন্নিসা
জিন্নতুন্নিসা, নবাব মুর্শিদকুলীর একমাত্র কন্যা। যৎকালে মুর্শিদকুলি খাঁ হায়দারাবাদের দেওয়ানী পদে নিযুক্ত হ’ন, সেই সময়ে তাঁহার কন্যা জিন্নতুন্নিসার[১] সহিত দাক্ষিণাত্যবাসী সুজাখাঁর পরিণয়-ক্রিয়া সম্পাদিত হয়। সুজা খোরাসানাধিবাসী তুর্কজাতীয় ‘আফসার’ বংশ সম্ভূত। তিনি জিন্নতুন্নিসাকে বিবাহ করিয়া নবাব মুর্শিদকুলির পরিবার মধ্যেই বাস করিতে থাকেন। কিছুদিন পরে শ্বশুরের যত্ন ও চেষ্টায় সুজা খাঁ উড়িষ্যার সুবাদার পদে অধিষ্ঠিত হ’ন; কিন্তু অত্যল্পকাল পরে তাঁহার সহিত মুর্শিদকুলির শাসন সম্বন্ধে মতদ্বৈধ হওয়ায়, উভয়ের মধ্যে মনোমালিন্য উপস্থিত হয়। তখন সুজা শ্বশুরের নিকট হইতে চলিয়া গেলেন এবং স্বয়ং শাসন কার্য্য পরিদর্শন করিতে লাগিলেন।
নানা সদ্ গুণভূষিত সুজা একজন ন্যায়পরায়ণ শাসনকর্ত্তা ছিলেন। কেহ কখনও তাঁহাকে ক্রোধের বশীভূত হইতে দেখে নাই, কিন্তু দুঃখের বিষয় বিলাসিতা ও চরিত্রহীনতা তাঁহার যশঃসূর্যকে স্নান করিয়া দিয়াছিল।
স্বামীকে সৎপথে আনিবার জন্য পতিব্রতা জিন্নতুন্নিসা প্রাণপণে চেষ্টা করিতে লাগিলেন—যখন বুঝাইয়াও তাঁহাকে পাপপথ হইতে ফিরাইতে পারিলেন না—বিবাদ-বিসম্বাদ যখন অহরহঃ গৃহের শান্তি ভাঙ্গিতে লাগিল, তখন মনোদুঃখে বেগম-সাহেবা স্বীয় পুত্র সরফরাজকে সঙ্গে লইয়া পিত্রালয়েই জীবনের অবশিষ্ট দিন গুলি শান্তিতে যাপন করিতে মনস্থ করিলেন।
সুজার উড়িষ্যায় অবস্থানকালে মীরজামহম্মদ নামক এক ব্যক্তি তাঁহার নিকট উপস্থিত হ’ন। মীরজা সুজার কোন আত্মীয়াকে বিবাহ করিয়াছিলেন। এই বিবাহে দুইটী পুত্রের জন্ম হয়। জ্যেষ্ঠ হাজি অহম্মদ ও কনিষ্ঠ আলিবর্দ্দী। মীরজা মহম্মদ দারিদ্র্যের নিষ্পেষণে দিল্লী হইতে পত্নীকে লইয়া সুজার নিকট ভাগ্যপরীক্ষার্থ উপস্থিত হ’ন। সুজাও বিশ্বাসী মহম্মদকে আপনার অধীনে সরকারী কার্য্যে নিযুক্ত করেন। ইহার পর ঘটনাচক্রচালিত হইয়া, আলিবর্দ্দী খাঁও উড়িষ্যার নবাব-দরবারে উপস্থিত হইলেন। তিনি অল্পদিনের মধ্যেই সাহস ও বুদ্ধিবলে সুজার একান্ত প্রিয়পাত্র হইয়া উঠিলেন। দিন দিন আলিবর্দ্দীর উত্তরোত্তর উন্নতি হইতে লাগিল। অবশেষে তিনি তাঁহার ভ্রাতা হাজি অহম্মদকে সাজহানাবাদ হইতে সপরিবারে উড়িষ্যায় লইয়া আসিলেন। উভয় ভ্রাতাই যুদ্ধবিগ্রহাদি কার্য্যে ও রাজ্য শাসনকার্য্যে বিচক্ষণ ছিলেন। ইহাদের বুদ্ধিকৌশলে রাজ্যমধ্যে সুজার শাসনশক্তি সুদৃঢ় হইয়াছিল। আলিবর্দী খাঁ স্বীয় প্রতিভাবলে, সুজার অধীনে সর্বোচ্চ রাজপদ লাভ করিলেন।
মুর্শিদকুলি নিজের মৃত্যু নিকট দেখিয়া ও জামাতা সুজার প্রতি পূর্ব্ব হইতে বিরূপ থাকায়, স্বীয় দৌহিত্র সরফরাজকে বাঙ্গালার নিজামতি প্রদানের জন্য অভিলাষ প্রকাশ করেন। এই কথা সুজার কর্ণগোচর হইবামাত্র, তিনি আলিবর্দ্দী ও হাজি অহম্মদের সহিত পরামর্শ করিয়া, বাঙ্গালা ও উড়িষ্যার নিজামতি প্রাপ্তির জন্য দিল্লীর বাদসাহের নিকট নানাবিধ উপঢৌকন পাঠান।
ইহার অত্যল্পকাল পরেই মহাপ্রতাপশালী নবাব মুর্শিদকুলির নথর দেহ শীতল সমাধিতলে বিশ্রামলাভ করিল। তাঁহার মৃত্যুর কয়েক দিবস পূর্ব্বেই সুজা আলিবর্দ্দীকে সঙ্গে লইয়া মুর্শিদাবাদ যাত্রা করিয়াছিলেন; পথিমধ্যেই তিনি দিল্লী হইতে পরওয়ানা প্রাপ্ত হইলেন ও শ্বশুরের মৃত্যু সংবাদ শুনিলেন। উপযুক্ত অবসর বুঝিয়া, তিনি সসৈন্যে মুর্শিদাবাদের পথে অগ্রসর হইতে লাগিলেন। রাজধানীতে উপস্থিত হইবামাত্রই ভাগ্যলক্ষ্মী তাঁহার উপর প্রসন্না হইয়া, তাঁহার মস্তকে মণিময় মুকুট পরাইয়া দিলেন—সুজা খাঁ বাঙ্গালার নবাব হইলেন।
জিন্নতুন্নিসা তখন সরফরাজের সহিত মুর্শিদাবাদ হইতে ২ মাইল দুরে অবস্থান করিতেছিলেন। সরফরাজ তখনই পিতৃসকাশে আগমন করিয়া তাঁহার চরণ বন্দনা করিলেন, তাঁহার মসনদ অধিকারে কোনরূপ বিষণ্ণচিত্ত না হইয়া, বরং প্রচুর আনন্দ প্রকাশ করিলেন। পিতাপুত্রে এই ভাবেই মিলন হইল। সুজাও পত্নীর নিকট গতজীবনের জন্য অনুশোচনা করিয়া দণ্ডায়মান হইলে, ধর্ম্মপরায়ণা পত্নী পতিদেবতার সকল দোষ ভুলিয়া গিয়া চরণতলে লুণ্ঠিত হইয়া পড়িলেন। এইরূপে পিতৃবিয়োগ-বিধুরা সন্তপ্ত জিন্নতুন্নিসা প্রেমাস্পদের সহিত মধুর মিলনে মিলিত হইয়া, পিতৃশোক কিয়ৎ পরিমাণে উপশম করিয়াছিলেন।
এই সময়ে আজিমাবাদ পাটনা বাঙ্গালার শাসনকর্ত্তার অধীনে আসিল ও তাহার শাসনভার সুজার হস্তে পড়িল। সুজা খাঁ তাহার দুই পুত্র সরফরাজ ও তকী খাঁর[২] মধ্যে কাহাকে প্রতিনিধি নিযুক্ত করিবেন, তাহা স্থির করিয়া উঠিতে পারিলেন না। জিন্নতুন্নিসা স্বীয় পুত্র সরফরাজকে পাটনায় পাঠাইতে সম্মত হইলেন না; অধিকন্তু স্বপত্নীপুত্র মহম্মদ তকীকেও অসূয়াপরশ হইয়া প্রতিনিধি নিযুক্ত করিতে বাধা দিলেন। সুজা খাঁ পত্নীর অমতে কিছুই করিতে পারিলেন না। অবশেষে তিনি আলিবর্দ্দীকেই প্রতিনিধিরূপে পাটনায় পাঠাইতে মনস্থ করিলেন। জিন্নতুন্নিসা এই প্রস্তাবের সম্যক্ অনুমোদন করিলেন। তিনি আলিবর্দ্দীকে স্বীয় কক্ষদ্বারে ডাকাইয়া আনিয়া, নিজে বহুমূল্য পরিচ্ছদ প্রদান করিলেন ও নিজেই যেন তাঁহাকে বেহারের শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত করিলেন, আভাষে এইরূপ মনোভাব প্রকাশ করিলেন।[৩]
নাদির শাহ যখন দিল্লীর দ্বারে উপস্থিত, সেই সময়ে বাঙ্গালার লোকপ্রিয় প্রজাহিতৈষী সুজা খাঁ পরলোক গমন করিয়া,রোশনীবাগে চিরদিনের জন্য সমাহিত হইলেন। তাঁহার মৃত্যুর পর পুত্র সরফরাজ মসনদে অধিরূঢ় হইলেন। আলিবর্দ্দী ও তাঁহার আত্মীয়-স্বজনের শ্রীবৃদ্ধিতে সরফরাজের দরবারে তাঁহাদের কতকগুলি শত্রুর সৃষ্টি হইয়াছিল। তাহারা প্রতিনিয়ত সরফরাজকে মীরজামহম্মদ, আলিবর্দ্দী ও হাজি অহম্মদের বিরুদ্ধে নানা কথা বলিতে লাগিল। ইহার ফলে হাজি অহম্মদকে প্রধান দেওয়ান বা রাজমন্ত্রীর পদ হইতে বিচ্যুত করা হইল ও তাঁহার জামাতা আতাউল্লা খাঁর হস্ত হইতে রাজমহলের ফৌজদারী গ্রহণ করিয়া তাঁহাকে পদচ্যুত করিবার মন্ত্রণা চলিতে লাগিল। এই সমস্ত কারণে হাজি অহম্মদ উৎপীড়িত, অপমানিত ও লাঞ্ছিত হইয়া, প্রতিকার বিধানের জন্য স্বীয় ভ্রাতা আলিবর্দ্দীকে পাটনায় পত্র লিখিলেন।
এই সংবাদ শ্রবণে ও সরফরাজের নানারূপ অত্যাচারের প্রতিকার মানসে আলিবর্দ্দী সসৈন্যে পাটনা হইতে মুর্শিদাবাদ যাত্রা করিলেন ও গিরিয়ার ভীষণ যুদ্ধে সরফরাজকে পরাস্ত করিলেন। এই যুদ্ধে সরফমাজের মৃত্যু হয়। যুদ্ধের দুই দিবস পরে আলিবর্দ্দী বিশেষ সমারোহে নগরে প্রবেশ করিলেন। প্রাসাদে প্রবেশ করিয়া, মসনদে বসিবার পূর্ব্বে তিনি জিন্নতুন্নিসার কক্ষদ্বারে উপস্থিত হইলেন ও সসম্রমে মস্তক অবনত করিয়া বেগম-সাহেবার নিকট ক্ষমা ভিক্ষা চাহিলেন। পরে ধীরস্বরে বলিলেন—“অদৃষ্টে যাহা ছিল, তাহা হইয়াছে এবং এই হতভাগ্য গোলামের অকৃতজ্ঞতা ইতিহাসের পৃষ্ঠায় জাজ্বল্যমান থাকিবে; কিন্তু আমি শপথ করিয়া বলিতেছি যে, যতদিন জীবিত থাকিব, ততদিন আপনার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করিতে ত্রুটি করিব না। আশা করি, এই হতভাগ্য, বিনীত ও সন্তপ্ত গোলামের অপরাধ সময়ে আপনার স্মৃতি হইতে মুছিয়া যাইবে।”
পুত্রশোকাতুরা জিন্নতুন্নিসা আপনার শোচনীয় অবস্থার বিষয় চিন্তা করিয়া ও মুর্শিদাবাদের চতুর্দ্দিকে আলিবর্দ্দীর সৈন্য-সমাবেশ দেখিয়ে বন্দিনী হইবার ভয়ে নিরুত্তর রহিলেন।
ইহার পর কতদিন তিনি যে কি ভাবে জীবন যাপন করিয়াছিলেন, তাহা জানিতে পারা যায় না। তবে আজিমনগরে, প্রাসাদ হইতে অর্দ্ধ মাইল উত্তরে বেগম-সাহেবা যে মস্জিদ নির্ম্মাণ করাইয়াছিলেন; তাহার ভগ্নাবশেষ অদ্যাপি বিদ্যমান রহিয়াছে এবং ইহার অনতিদূরে তিনি সমাহিত আছেন।
- ↑ ইঁহার অপর নাম আজামুন্নিসা বা আজামতুন্নিসা।
- ↑ হলওয়েল সাহেব বলেন, মহম্মদ তকী, জিন্নতুন্নিসার গর্ভজাত।
- ↑ She appointed him to the government of Behar, as from herself, এই স্থলের পাদটীকায় মুতাক্ষরীণকার লিখিয়াছেন:—
“Jinet-en-nissa seems to have insisted on her husband recognising her as the heiress to the government, and considered him rather as the viceroy-consort than viceroy in his own right.” Siyar-ul-Mutakherin. Translated by John Briggs, I-315.