বাঙ্গ্লার বেগম/লুৎফুন্নিসা
বাঙ্গ্লার বেগম
বাঙ্গালার হতভাগ্য শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজুদ্দৌলার জীবনের কাহিনী ইতিহাস-পাঠকের নিকট অপরিজ্ঞাত নহে; কিন্তু তাঁহার প্রধানা বেগম লুৎফুন্নিসার নামমাত্র অনেকের নিকট পরিচিত থাকিলেও, তাঁহার জীবনের ঘটনাবলী সম্বন্ধে অল্পই জানিতে পারা যায়।
লুৎফুন্নিসা কোন সম্ভ্রান্ত বংশে জন্মগ্রহণ করেন নাই। তিনি অতি অল্প বয়সেই ক্রীতদাসীরূপে[১] নবাব আলিবর্দ্দীর বেগমমহলে প্রবিষ্ট হ’ন। নবাবের প্রিয় দৌহিত্র সিরাজ অতি অল্প কালের মধ্যেই তাঁহার অনুপম রূপ-লাবণ্য ও নব-যৌবনের সৌন্দর্য্যরাশি দেখিয়া বিমোহিত হইয়াছিলেন। পতঙ্গের অনল-প্রীতির ন্যায় সিরাজেরও রূপোন্মাদ ঘটিয়াছিল। সিরাজ তাঁহাকে কামনার বস্তু মনে করিয়া উপভোগের জন্য লালায়িত হইয়াছিলেন। লুৎফুন্নিসা কিন্তু বাঙ্গালার ভাবী নবাবকে বহুবার প্রত্যাখ্যান করিয়াছিলেন এবং বিবাহ ব্যতীত কিছুতেই তাঁহার অঙ্কশায়িনী হইতে স্বীকৃত হ’ন নাই। বিবাহের পথে প্রধান কণ্টক আভিজাত্য জানিয়াও ক্রীতদাসী কিছুতেই ভাবী নবাবের লালসার সামগ্রী হইতে চাহিলেন না। কালক্রমে প্রথম প্রেমের উন্মত্ততা কিছু হ্রাস হইলে—রূপজ-মােহের ঘোর কিছু কাটিয়া আসিলে, তিনি তাঁহার গুণের পক্ষপাতী হইলেন। রূপ-লালসার স্থান প্রেম অধিকার করিল। গুণমুগ্ধ সিরাজ ক্রীতদাসীকে আত্মসমর্পণ করিয়া ফেলিলেন—তাঁহাকে প্রণয়িণীরূপে গ্রহণ করিতে স্বীকৃত হইলেন; কিন্তু এই প্রস্তাব মাতামহীর নিকট কি প্রকারে উথাপন করিবেন, ইহা ভাবিয়াই উভয়ে অস্থির হইলেন। শেষে বুদ্ধিমতী লুৎফুন্নিসার পরামর্শে মাতামহীর নিকট সিরাজ সকল কথাই জ্ঞাপন করিলেন। মাতামহীও স্নেহের সিরাজের ভাবান্তর কিছুদিন হইতে লক্ষ্য করিতেছিলেন। তিনি সিরাজকে এই বিবাহ হইতে নিবৃত্ত করিবার জন্য নানা উপদেশ দিলেন— কত সুন্দরী কন্যার প্রলােভন দেখাইলেন—বাঙ্গালার ভাবী নবাবের পক্ষে ক্রীতদাসী- বিবাহ যুক্তিসঙ্গত নয়, ইহাও বুঝাইলেন; কিন্তু সিরাজের মনে সেগুলির একটী রেখাও মুদ্রিত হইল না। সিরাজ মাতামহীর নিকট প্রতিজ্ঞা করিলেন—বাঙ্গালার মসনদ চাই না—চাই না তােমার রাজৈশ্বর্য্য—চাই শুধু লুৎফুন্নিসা। যদি লুৎফুন্নিসাকে না পাই, তবে ফকিরী গ্রহণ করিয়া নির্জ্জন বনে বাস করিব। মাতামহী সিরাজ-চরিত্র বুঝিতেন, তিনি নবার আলিবর্দ্দীর নিকট সকল কথা খুলিয়া বলিলেন। আলিবর্দ্দী এই সংবাদ শুনিয়া প্রথমে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়াছিলেন, কিন্তু বেগম সাহেবার অনুরােধে শেষে তাঁহাকে সম্মত হইতে হইয়াছিল—প্রণয়িণীর চক্ষের জল অটলপ্রতিজ্ঞ বৃদ্ধ নবাবকেও দ্রবীভূত করিয়াছিল।
লুৎফুন্নিসা সিরাজের পরিণীতা পত্নী কি না, এ সম্বন্ধে ঐতিহাসিকগণের মধ্যে অনেক বাদানুবাদ দেখিতে পাওয়া যায়। প্রথমতঃ, আমরা দেখিতে পাই, হাজি অহম্মদের দৌহিত্রী—আতা উল্লা খাঁর কন্যার সহিত সিরাজের বিবাহ ধার্য্য হয়; কিন্তু হঠাৎ ঐ কন্যাটীর মৃত্যু হওয়ায়, ইরাজ খাঁর কন্যার সহিত সিরাজ পরিণয়-সূত্রে আবদ্ধ হ’ন এবং এই ইরাজ খাঁর কন্যাই সিরাজের প্রথম বিবাহিতা পত্নী;[২] কিন্তু সমসাময়িক ইতিহাস বা নিজাম রেকর্ডে কোথাও তাঁহার এই পত্নীর সবিশেষ উল্লেখ নাই। ঐতিহাসিকেরা এক বাক্যে লুৎফুন্নিসাকেই সিরাজ-বনিতা বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়াছেন। বাস্তবিকই লুৎফুন্নিসা সিরাজের সুখ-দুঃখের সহচরী ছিলেন এবং চিরদিন ছায়ার ন্যায় তাঁহার অনুবর্ত্তিনী হইয়াছিলেন। লুৎফুন্নিসার পাটনা-গমন হইতে আমরা এ বিষয়ের সুস্পষ্ট প্রমাণ পাইয়া থাকি।
সিরাজের পিতা জৈনুদ্দীন আহম্মদ আফগানগণ কর্ত্তৃক নিহত হইলে, নবাব আলিবর্দ্দী সিরাজকে বেহারের শাসনকর্ত্তা এবং রাজা জানকীরামকে তাঁহার সহকারীরূপে বেহারে পাঠান। নবাব সিরাজকে অত্যন্ত স্নেহ করিতেন এবং এক মুহূর্ত্ত তাঁহাকে নয়নের অন্তরালে রাখিতে পারিতেন না। তিনি জানকীরামকে পাটনার শাসনকার্য্যের সমস্ত ভার দিয়া সিরাজকে পুনরানয়ন করিয়া নিজের নিকটে রাখেন। এই সময় মেহেদীনেসার (মুতাক্ষরীণ-প্রণেতা গােলাম হােসেনের মাতুল) ও কয়েকজন চাটুকার সিরাজকে বুঝাইয়া দিল যে, যদিও নবাব আলিবর্দ্দী তাঁহার পৈতৃক সিংহাসন বেহার প্রদেশ তাঁহাকে অর্পণ করিয়াছেন; কিন্তু কার্য্যতঃ এক্ষণে জানকীরামই শাসনকর্ত্তা। সিরাজ এই কুপরামর্শ অনুসারে জানকীরামের নিকট হইতে পৈতৃক সিংহাসন উদ্ধার করিয়া স্বাধীনভাবে রাজকার্য্য পরিচালনা করিতে মনস্থ করিলেন। তিনি লুৎফুন্নিসা ও অনুচরবর্গের সহিত রাত্রিযোগে পাটনা যাত্রা করিলেন। নানা বিপদ ঘটিবার সম্ভাবনা দেখিয়া সিরাজ প্রথমে লুৎফুন্নিসাকে সঙ্গে লইতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন, কিন্তু পতিগতপ্রাণা সতী পতিকে ছাড়িয়া থাকিতে অস্বীকার করায়, সিরাজ তাঁহাকে সঙ্গে লইতে বাধ্য হইয়াছিলেন।
সিরাজ পাটনায় উপস্থিত হইয়া জানকীরামকে দুর্গ প্রত্যর্পণ করিতে আদেশ পাঠাইলেন (১১৬৩ হিঃ রজব জুলাই ১৭৫০)। জানকীরাম বিষম সমস্যায় পড়িয়া নবাব আলিবর্দ্দীর আদেশ না পাওয়া পর্য্যন্ত দুর্গদ্বার রুদ্ধ করিয়া রাখিলেন; সিরাজও বাধ্য হইয়া দুর্গ আক্রমণ করিলেন; কিন্তু ভাগ্যলক্ষ্মী তাঁহার প্রতি বিরূপ হইলেন। জানকীরামের সাহসী শিক্ষিত সৈনিকগণের নিকট সিরাজের সৈনিকগণ স্রোতের মুখে তৃণের ন্যায় ভাসিয়া গেল—সিরাজের পরাজয় হইল। ভীত সিরাজ লুৎফুন্নিসাকে লইয়া দুর্গের বাহিরে একটী কুটীরে সামান্য পরিচ্ছদে দীনদরিদ্রবেশে আশ্রয় গ্রহণ করিলেন। রাজা জানকীরাম সকলই জানিতে পারিলেন। সিরাজকে আবদ্ধ রাখা তাঁহার অভিপ্রেত নহে, বরং যাহাতে বাঙ্গালা বেহার উড়িষ্যার ভাবী নবাব অক্ষতশরীরে স্বচ্ছন্দে থাকিতে পারেন, তাহার বন্দোবস্ত করিয়া দিয়াছিলেন। কুটীর হইতে তাঁহাকে সসম্মানে আনয়ন করিয়া, তিনি দুর্গের বহির্ভাগে নবাবের থাকিবার উপযুক্ত স্থানে রক্ষা করিয়া, আলিবর্দ্দীর আগমন প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন। সিরাজ সেখানে একরূপ নজরবন্দী হইয়া রহিলেন। নবাব পাটনায় আসিয়া সিরাজের হঠকারিতার জন্য তাঁহাকে কিছুমাত্র তিরস্কার না করিয়া, বরং স্নেহার্দ্র হৃদয়ে আলিঙ্গন ও মুখচুম্বন করিলেন। অনুতপ্ত সিরাজ ক্ষমা ভিক্ষা করিবার বহুপূর্ব্বেই বৃদ্ধ নবাব তাঁহাকে ক্ষমা করিয়াছিলেন।
আমরা এখানে লুৎফুন্নিসার দয়ার একটা দৃষ্টান্ত উদ্ধার করিয়া দিতেছি। ১৭৫৬ খৃষ্টাব্দে কলিকাতা জয়ের সময় কাশিমবাজারের ইংরাজকুঠীর অধ্যক্ষ ওয়াট্স সাহেব, পত্নী পুত্র কন্যাগণ সহ কাশিমবাজারে বন্দী হ’ন। তাঁহারা প্রধানতঃ সিরাজমাতা আমিনা বেগমের অনুকম্পায় জীবনলাভ করিয়াছিলেন। তিনি গোপনে ওয়াট্স সাহেবের পত্নী ও পুত্রকন্যাগণকে আপনার মহলের মধ্যে ৩৭ দিবস সযত্নে রাখিয়াছিলেন। পরে লুৎফুন্নিসার সহিত পরামর্শ করিয়া তাঁহাদিগকে জলপথে চন্দননগরে ফরাসী গভর্ণারের নিকট পাঠাইয়া দিয়াছিলেন। এ বিষয় নবাব ঘুণাক্ষরে জানিতে পারিলে যে উভয়ের বিষম অনর্থ ঘটিত, তাহা কাহাকেও আর বলিয়া দিতে হইবে না। রমণী ও বালক-বালিকার দুঃখে তাঁহারা যে শুধু কাতর হইয়াছিলেন, তাহা নহে। একদিন লুৎফুন্নিসা নবাবের নিকট ওয়াট্স সাহেবের মুক্তি ভিক্ষা চাহিলেন। নবাবকে বলিলেন—“কুঠিয়াল সাহেব ত আপনার প্রজা—আপনার সন্তান। সন্তানকে কেন ব্যথা দিতেছেন? বাঙ্গালা মুলুকের মালিকের পক্ষে সামান্য একজন ইংরাজ প্রজাকে বন্দী রাখা কখনও উচিত নয়।” তিনি নবাবের পদতলে কৃপাভিক্ষা করিলেন। নবাব লুৎফুন্নিসার পরদুঃখকাতরতায় আশ্চর্য্যান্বিত হইয়া বুঝাইলেন, ওয়াট্স্কে বন্দী করিয়া রাখিলেই কলিকাতায় ইংরাজ-বণিকেরা সংযত হইয়া চলিতে শিখিবে। লুৎফুন্নিসার অশ্রুবর্ষণ ও কাতর অনুরোধে নবাবের সংকল্প ভাসিয়া গেল; অবশেষে তিনি ওয়াট্স্কে মুক্তি দিতে বাধ্য হইয়াছিলেন।[৩]
পলাশীর যুদ্ধাবসানে ইংরাজের বিজয়-দুন্দুভি যখন বাজিতেছিল—যখন বন উপবন কম্পিত করিয়া কামান সকল ইংরাজের জয় ঘোষণা করিতেছিল—ভাগীরথী যখন মুষ্টিমেয় ইংরাজ-সেনার অদম্য সাহস ও ক্লাইভের বুদ্ধিকৌশল দেখিয়া স্তম্ভিত হইয়া তরতরবেগে ছুটিতেছিল, তখন হতভাগ্য বাঙ্গালার নবাব সিরাজ, মির্জ্জাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় মর্ম্মাহত হইয়া ভাবিতেছিলেন—“করি কি?” মুষ্টিমেয় সামান্য অনুচর লইয়া তিনি কি করিতে পারেন? অদৃষ্টের তীব্র উপহাসেব্যথিত সিরাজ চতুর্দ্দিক অন্ধকার দেখিলেন। অদ্য প্রাতে যিনি বাঙ্গালা বিহার উড়িষ্যার দণ্ডমুণ্ডের কর্ত্তা, সায়ংসন্ধ্যায় তিনিই পথের ভিখারী। কল্য যে ইংরাজ-বণিক তাঁহারই অনুগ্রহলাভের জন্য লালায়িত ছিল, অদ্য তাহারা সর্ব্বেসর্ব্বা—মির্জ্জাফর তাহাদের হস্তের ক্রীড়নক। চিন্তা আর তাঁহার ভাল লাগিল না। উপায়ান্তর না দেখিয়া তিনি পলায়ন করিতে কৃতসংকল্প হইলেন। এই সংকল্প শুনিয়া তাঁহার সুখের সময়ের প্রায় সকল আনুচর একে একে তাঁহাকে পরিত্যাগ করিল। কাল বিলম্ব না করিয়া সিরাজ তাঁহার শ্বশুর ইরাজ খাঁর নিকট আপন মন্তব্য প্রকাশ করিলেন, কিন্তু কিছুতেই তিনি তাঁহার সহিত যাইতে সম্মত হইলেন না। ধনরত্ন আত্মসাৎ করিয়া ইরাজ খাঁ গোপনে পলায়ন করিলেন। আশা-ভরসাহীন— সিরাজ একাকী পলায়নের উদ্যোগ করিতেছেন, এমন সময়ে লুৎফুন্নিসা আসিয়া তাঁহার চরণোপান্তে বসিয়া কাঁদিতে লাগিলেন। স্বামীর সুখে যিনি আত্মহারা হইয়াছিলেন, সেই লুৎফুন্নিসা স্বামীর বিপদে স্বামীর সহিত পলায়ন করিতে দৃঢ়-সংকল্প হইলেন। সিরাজ কিছুতেই তাঁহাকে বুঝাইতে পারিলেন না যে, এ পলায়ন সাময়িক—এ পলায়নের উদ্দেশ্য বল-সংগ্রহ— আত্মরক্ষা ও মোগল-গৌরবের পুনঃ প্রতিষ্ঠা। লুৎফুন্নিসার হৃদয় তাহা বুঝিল না—তিনি স্বামীর অনুগামিনী হইলেন। তিনি বুঝিয়াছিলেন, পতিই নারীর দেবতা—পতি যখন যে অবস্থায় থাকেন, পত্নীর তখন সেই অবস্থায় থাকাই শ্রেয়ঃ ও বাঞ্ছনীয়।
এ হেন নারীরত্নকে কোন কোন ঐতিহাসিক “রক্ষিতা” বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন। লুৎফুন্নিসা একাধারে সচিব, সখী, প্রিয়তমা জীবনসঙ্গিনী— হিন্দু-মুসলমানের আদর্শ-পত্নী। তাঁহাকে “রক্ষিতা” নামে অভিহিত হইতে দেখিলে বাস্তবিকই মর্ম্মাহত হইতে হয়। নিজাম রেকর্ড অন্বেষণ করিয়া বিফল মনোরথ হইয়া, ঐতিহাসিকগণ তাঁহার ‘পত্নীত্বে’ সন্দিহান হন; মুতাক্ষরীণকারও তাঁহাকে ‘ক্রীতদাসী’ বলিয়া অভিহিত করিয়া অনেকটা গোল বাধাইয়াছেন, কারণ তাঁহাদের বিশ্বাস, হিন্দুদিগের ন্যায় মুসলমান অভিজাতদিগের সহিত নীচ ক্রীতদাসীর বিবাহ অসম্ভব। কথাটা কতকটা সত্য হইলেও এ ক্ষেত্রে তাহা ঘটিয়াছিল।
রাত্রি তিনটার সময় সিরাজ দীনবেশে লুৎফুন্নিসা ও তাঁহার চারি বৎসরের কন্যা, কয়েকজনমাত্র বিশ্বস্ত অনুচর ও ধনরত্নাদি সহ সামান্য গো-যানে আরোহণ করিয়া ভগবানগোলার দিকে অগ্রসর হইতে লাগিলেন। রাত্রি প্রভাত হইল; ক্রমে সূর্য্যকিরণ প্রখর হইতে প্রখরতর হইতেছিল। কোমলাঙ্গী অসূর্য্যম্পশ্যা লুৎফুন্নিসা নিজের কষ্টকে তুচ্ছ করিয়া, অসাধারণ ধৈর্য্যের সহিত ক্রমাগত রুমাল ব্যজন করিয়া স্বামীর ক্লান্তি, অপনোদন করিতে লাগিলেন। সিরাজ স্থলপথে ভগবানগোলায় পৌঁছিলেন। তথা হইতে নৌকাযোগে পদ্মার উত্তাল তরঙ্গরাশি উত্তীর্ণ হইয়া মহানন্দা নদী-পথে উজান বাহিয়া, উত্তরাভিমুখে যাইতে লাগিলেন। ক্রমে যখন তিনি মহানন্দা অতিক্রম করিয়া কালিন্দীর জল প্রবাহ উত্তীর্ণ হইতেছিলেন এবং তাঁহার নৌকা যখন রাজমহলের অপর পারে প্রায় ৪ ক্রোশ দূরে বড়াল নামক পল্লীতে উপস্থিত হইল, তখন সহসা তাঁহার নৌকার গতিরােধ হইল। নাজেরপুরের মােহানা অতিক্রম করিতে পারিলেই বড় গঙ্গায় প্রবেশ করিতে পারা যাইত, কিন্তু জলাভাবে নাজের পুরের মােহানা বন্ধ।
“মুতাক্ষরীণ-লেখক সিরাজের পলায়ন-প্রণালীর দোষ প্রদর্শন করিবার জন্য লিখিয়া গিয়াছেন যে,—“স্থলপথে পলায়ন করিলেই ভাল হইত, অর্থলােভেই হউক, আর স্নেহ বশতই হউক, অনেকে তাঁহার অনুগমন করিতে পারিত; এবং বহুজনবেষ্টিত সিরাজুদ্দৌলাকে কেহ সহজে কারারুদ্ধ করিতে পারিত না। কিন্তু সিরাজ কি উদ্দেশ্যে একাকী নৌকারোহণে পলায়ন করিতেছিলেন, তাহার রহস্য নির্ণয় করিলে মুতাক্ষরীণের সমালোচনায় আস্থা স্থাপন করিতে পারা যায় না। কেবল প্রাণ রক্ষার জন্য পলায়ন করা আবশ্যক হইলে, ভগবানগােলা হইতে পদ্মাস্রোতে পূর্ব্বাভিমুথে তরণী ভাসাইয়া দিলেই অনায়াসে দূরাঞ্চলে উপনীত হইতে পারা যাইত। সিরাজুদ্দৌলা যে আত্মপ্রাণ তুচ্ছ করিয়া কেবল মােগল-গৌরব রক্ষা করিবার জন্যই জনশূন্য রাজধানী হইতে পলায়ন করিতেছিলেন, তাঁহার পলায়ন-প্রণালীই তাহার উৎকৃষ্ট প্রমাণ।[৪] কোনরূপে পশ্চিমাঞ্চলে পলায়ন করিয়া মসিয় ল সাহেবের সেনাসহায়ে পাটনা পর্য্যন্ত গমন করা ও তথায় রামনারায়ণের সেনাবল লইয়া সিংহাসন রক্ষার আয়ােজন করাই সিরাজুদ্দৌলার উদ্দেশ্য ছিল। বিহার প্রদেশের শাসনকর্ত্তা রাজা রামনারায়ণ যেরূপ সাহসী সুচতুর, সেইরূপ অকৃত্রিম প্রভুভক্ত; সুতরাং কোনরূপে তাঁহার সহিত মিলিত হওয়াই সিরাজুদ্দৌলার লক্ষ্য হইয়া উঠিল। সরলপথে রাজমহল গমন করিবার চেষ্টা করিলে, মীরজাফরের অনুচরবর্গ সহজে তাঁহাকে কারারুদ্ধ করিবার অবসর পাইবে, এই আশঙ্কায় তিনি মহানন্দার ভিতর দিয়া গুপ্তপথে দীনদরিদ্রেব ন্যায় পাটনার দিকে অগ্রসর হইতেছিলেন।”[৫]
এই দৈব-দুর্ঘটনাই সিরাজের কাল হইল। এইরূপে তিন দিন তিন রাত্রি অনাহারে কাটাইয়া নবাব ক্ষুৎপিপাসাতুর হইয়া যৎকিঞ্চিৎ খাদ্য সংগ্রহের জন্য দান শাহ্ নামে এক ফকিরের কুটীরে উপস্থিত হন। পূর্ব্বে সিরাজ এই দান শাহর উপর অনেক অত্যাচার করিয়াছিলেন।[৬] এক্ষণে সে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করিবার জন্য আহার্য্য-প্রস্তুতের ভাণ করিয়া, গােপনে মীরজাফরের জামাতা মীরকাসিম ও তদীয় সহােদর রাজমহলের ফৌজদার[৭] মীরদাউদকে সংবাদ দেন।
মীরকাশিম সিরাজকে সপরিবারে বন্দী করিয়া পরে মুর্শিদাবাদে প্রেরণ করেন। লুৎফুন্নিসা বেগম মীর কাশিমের হস্তগত হইলেন। মীরকাশিম ভয় প্রদর্শন করিয়া তাঁহার বহুমূল্য অলঙ্কার ও যাবতীয় ধনরত্নাদি কাড়িয়া লইলেন। মীরকাশিমের এই লুণ্ঠনকলঙ্ক তাঁহার জীবনকে চিরকলঙ্কিত করিয়া রাখিবে। ভাগ্যদোষে তিনি তাঁহার করতলগত হইয়াছিলেন, কিন্তু বেগম সাহেবার মর্য্যাদা তাঁহার ন্যায় ন্যায়নিষ্ঠ লােকের অক্ষুন্ন রাখা উচিত ছিল। ইহার পর তাঁহাকে ঢাকায় নির্ব্বাসিতা করা হয়।
মুর্শিদাবাদে উপস্থিত হইবার পর সিরাজের পরিণাম যাহা ঘটিয়াছিল, তাহা সকলেই অবগত আছেন। তিনি মীরণের আদেশানুসারে মহম্মদীবেগ কর্ত্তৃক নিহত হইয়া খোসবাগে চিরদিনের জন্য সমাহিত হন।
সিরাজের মৃত্যুর পর লুৎফুন্নিসার ন্যায়[৮] আলিবর্দ্দী-বেগম,
লুৎফুন্নিসা বেগম।
তাঁহার দুই কন্যা ঘসিটী ও আমিনার সহিত ঢাকায় নির্ব্বাসিতা হন। পরে মীরণের আদেশক্রমে ঘসিটী[৯] ও আমিনাকে জলমগ্ন করিয়া বিনষ্ট করা হয়।
লুৎফুন্নিসা কিছুকাল পরে ইংরাজদের যত্নচেষ্টায় ঢাকা হইতে মুর্শিদাবাদে আনীত হইয়া খােসবাগে আলিবর্দ্দী ও স্বামীর সমাধির তত্ত্বাবধানে নিযুক্ত হ’ন। তাঁহার ভরণপােষণের জন্য ১০০০৲ টাকা মাসহারা বন্দোবস্ত হইল[১০] এবং ইহা ব্যতীত আলিবর্দ্দী, সিরাজ প্রভৃতির সমাধিস্থল খােসবাগের তত্ত্বাবধানের ভার তাঁহার হস্তে ন্যস্ত থাকায়, তিনি তাহার জন্য আরও ৩০৫৲ টাকা অধিক পাইতেন।[১১] এই অর্থের তিনি অসদ্ব্যবহার করেন নাই। আপনার গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য যৎসামান্য রাখিয়া, দীনদরিদ্রের দুঃখমােচনে ব্যয় করিতেন।
মন্থরগতি কলনাদিনী ভাগীরথীর পশ্চিমতীরবর্ত্তী কুসুমিত-তরুলতাসমাকীর্ণ-ছায়াস্নিগ্ধ-শােকমৌন-খােসবাগে স্বামীর সমাধিবক্ষে লুণ্ঠিত হইয়া তিনি অশ্রুবিসর্জ্জন করিতেন। প্রতিদিবস প্রভাতে স্বহস্তে পতির সমাধিভবন সদ্য-প্রস্ফুটিত কুসুমদামে সুসজ্জিত এবং প্রতি সন্ধ্যায় সুরভিত দীপমালায় উজ্জ্বলীকৃত করিতেন—ইহা:ই তাঁহার নিত্যকার্য্য ছিল।
লুৎফুন্নিসা সিরাজের মৃত্যুর পর কতদিন পর্য্যন্ত জীবিত ছিলেন, তাহার সঠিক বৃত্তান্ত আমরা অবগত নহি। Forster সাহেব বলেন যে, ১৭৮১ খৃষ্টাব্দে তিনি লুৎফুন্নিসাকে খোসবাগে সিরাজের সমাধির উপর পড়িয়া থাকিতে দেখিয়াছিলেন।[১২] যদি তাঁহার উক্তি সত্য হয়, তাহা হইলে সিরাজের মৃত্যুর ২৪ বৎসর পরেও লুৎফুন্নিসা জীবিত ছিলেন।
দ্বিতীয়তঃ, মুতাক্ষরীণ-অনুবাদক মুস্তাফা লিখিয়াছেন যে, ১৭৮৯ খৃঃ অব্দে তিনি লুৎফুন্নিসাকে মুর্শিদাবাদে অবস্থিতি করিতে দেখিয়াছিলেন।[১৩] তাহা হইলে সিরাজের মৃত্যুর ৩২ বৎসর পরেও লুৎফুন্নিসা জীবিত ছিলেন।
তৃতীয়তঃ, বেভারিজ সাহেব বলেন যে, তিনি নিজামৎ রেকর্ডে ওমদাৎ
লুৎফুন্নিসার কবর। উন্নিসা নামে সিরাজের এক পত্নীর উল্লেখ দেখিয়াছেন এবং তাঁহার মতে ওমদাৎই লুৎফুন্নিসা।[১৪] এই ওমদাৎ-উন্নিসা ১৭৯১ খৃঃ অব্দে আগষ্ট মাসে গবর্ণমেণ্টের নিকট মাসহারা বৃদ্ধির জন্য প্রার্থনা করেন। বেভারিজের এই উক্তি হইতে দেখা যাইতেছে যে, সিরাজের মৃত্যুর ৩৭ বৎসর পরেও লুৎফুন্নিসা জীবিত ছিলেন।
শুনা যায়, স্বামীর সমাধি পূজা করিতে করিতে তাঁহার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর তিনিও খােসবাগে স্বামীর দক্ষিণভাগে, তাঁহারই পদতলে চিরনিদ্রিতা হন।
যাও সাধ্বী, স্বামীর সকাশে যাও—যাও সতী তােমার পতি-ধ্যান শেষ হইয়াছে—জগতে তুমি দেখাইয়াছ, সহস্র দোষে দোষী হইলেও পতি দেবতা। যদিও তুমি অধিক দিন স্বামীর নশ্বর দেহের সেবা করিতে পাও নাই, তবুও তুমি অবিগলিত নেত্রে বহুদিন স্বামীর কবরপার্শ্বে বসিয়া উন্মাদিনীর ন্যায় কখন ব্যজন করিয়াছ—কখনও পুষ্পমাল্য সাজাইয়াছ— কখনও প্রেমভরে কবরের উপর চুম্বন করিয়া প্রেমাস্পদকে চুম্বন করিতেছ ভাবিয়া, অশান্ত হৃদয়কে শান্ত করিয়াছ। জগতে তুমি দেখাইয়াছ, জীবনে মরণে পতির সহিত পত্নীর অচ্ছেদ্য সম্বন্ধ—সর্ব্বসংহারক ‘কাল’ তাহা ছেদন করিতে পারে না—আইনকানুন তাহা ছেদ করিতে পারে না। চুক্তি করিয়া দেহের সম্বন্ধ স্থাপিত হইতে পারে—আত্মার সম্বন্ধ স্থাপিত হইতে পারে না।
ভারত-রমণীর পদতলে বসিয়া এখনও পাশ্চাত্য জগৎ বহুকাল ধরিয়া ‘নারীত্ব’ ও ‘পতীত্ব’ শিক্ষা করুক।
অতীতের সাক্ষীস্বরূপ সেই সুরম্য খোসবাগ অদ্যাপি বিদ্যমান থাকিয়া, জগতে লুৎফুন্নিসার এই অপূর্ব্ব পতিভক্তির কথা ঘোষণা করিতেছে।
- ↑ মূল মুতাক্ষরীণে (১৮২ পৃঃ) লুৎফুন্নিসাকে সিরাজের “জারিয়া” বলিয়া অভিহিত করা হইয়াছে। “জারিয়া” শব্দের অর্থ—ক্রীতদাসী; কিন্তু নিতান্ত হীনভাবের দাসী নহে।
- ↑ “সিরাজের কয় পত্নী ছিলেন, তাহা স্থির করা যায় না। কেবল তিনজনেরই উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। (১) তাঁহার, বিবাহিতা পত্নী (ইরাজ খাঁর কন্যা), (২) লুৎফুন্নিসা, (৩) ফৈজী (মােহনলালের ভগিনী)”—মুর্শিদাবাদ কাহিনী, পৃঃ ১৯২।
See also Calcutta Review, 1892—“Old places in Murshidabad”-H Beveridge— P. 340-341.
বেভারিজ সাহেবের মতে লুৎফুন্নিসাই মােহনলালের ভগিনী। তিনি লিখিয়াছেন:— “He was accompanied in his flight by this favourite concubine Lutf-unnissa. I am informed that this lady was originally a Hindu _____ other than the ______” - ↑ “Parochial Annals of Bengal”—H. B. Hyde. P. 158.
- ↑ “It was his intention to escape to M. Law, and with him to Patna, the Governor of which province was a faithful servant of his family.” Orme-ii-179.
- ↑ “সিরাজুদ্দৌলা”—শ্রীঅক্ষয়কুমার মৈত্রেয়। পৃঃ ৩৭৫-৭৬।
- ↑ হণ্টার সাহেব তাঁহার Statistical Account of Bengal (Vol. VII, 84) নামক পুস্তকে লিখিয়াছেন যে,—“দান শাহ্ সিরাজকে ধরাইয়া দিয়া মীরজাফরের নিকট হইতে বহুমূল্য জায়গীর লাভ করিয়া স্বদেশে “সুভামার” খাতিলাভ করিয়াছিলেন; তাঁহার বংশধরগণ অদ্যাপি সেই জায়গীর উপভােগ করিতেছেন।” কিন্তু মালদহের ভূতপূর্ব্ব কালেক্টর শ্রীযুক্ত উমেশচন্দ্র বটব্যাল মহাশয়, মালদহ কালেক্টরীর সেরেস্তা সবিশেষ তদন্ত করিয়াও এইরূপ কোন জায়গীরের সন্ধান পান নাই। অধিকন্তু শ্রীযুক্ত অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় মহাশয়, দান শাহ্ র সমাধি-মন্দিরের ফলকলিপির সাহায্যে এবং তাঁহার বংশধরদিগের নিকট প্রমাণাদি সংগ্রহ করিয়া প্রকাশ করিয়াছেন যে, দান শাহ্ এই সময়ে আদৌ জীবিত ছিলেন না।
রিয়াজ-উস-সলাতিন (৩৬০ পৃঃ) নামক গ্রন্থে দান শাহর সিরাজ কর্ত্তৃক লাঞ্ছিত হইবার কথা লিপিবদ্ধ আছে। তারিখ-ই-মনসুরী লেখক কাহারও নামােল্লেখ করেন নাই। তিনি কেবলমাত্র লিখিয়াছেন যে, সিরাজ একজন দরবেশের দাড়ি গোঁপ মুড়াইয়া দিয়া অপমান করিয়াছিলেন, সেই ব্যক্তিই তাঁহাকে ধরাইয়া দেয়। ইংরাজ ঐতিহাসিকগণ দান শাহ্ র সিরাজ কর্ত্তৃক নাসাকর্ণ ছেদনের কথা লিখিয়াছেন,—Iveys’ ‘Voyage’-P. 154; Orme's ‘Indostan’—P. 183. - ↑ ষ্টুয়ার্ট সাহেব (পৃঃ ৫৩১) মীরকাশিমকে রাজমহলের ফৌজদার বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন; কিন্তু মুতাক্ষরীণ ও ব্রূমের মতে মীরদাউদই রাজমহলের ফৌজদার।
- ↑ মজঃফরনামা (১০৬ পৃঃ) নামক গ্রন্থে লিখিত আছে যে, সিরাজের মৃত্যুর পর যখন তাঁহার বেগমগণের নিকট স্ব স্ব পাত্র নির্ব্বাচন করিয়া লইবার প্রস্তাব উত্থিত হইয়াছিল, সেই সময়ে লুৎফুন্নিসাকেও অন্যের নিকট আশ্রয় লইতে বলায়, তিনি সগর্ব্বে উত্তর দিয়াছিলেন—“হস্তিপৃষ্ঠে আরোহণে অভ্যস্ত লোকে কোথায় গর্দ্দভ-বাহন বাঞ্ছা করে?”—অষ্টাদশ শতাব্দীর ইতিহাস (নবাবী আমল) ২য় সংস্করণ— পৃঃ ৩৪৬।
- ↑ Holwell's ‘India Tracts’ (P. 41-42) Vansittart's. ‘Narratives (Vol. I-P. 52) নামক পুস্তকদ্বয়ে লিখিত আছে, লুৎফুন্নিসা, তাঁহার কন্যা ও এক্রামুদ্দৌলার পুত্র মুরাদুদ্দৌলাকেও নিহত করা হয়। লং সাহেবের Selection (P. 223) নামক পুস্তকেও ইহা লিখিত আছে, তবে তিনি লুৎফুন্নিসার স্থলে suffen Nissa Begam এর উল্লেখ করিয়াছেন।
- ↑ গ্যাষ্ট্রেল সাহেব লিখিয়াছেন যে, লুৎফুন্নিসা বেগম ভরণপােষণের জন্য মাসিক ১০০০৲ টাকা বৃত্তি পাইতেন; কিন্তু শ্রদ্ধাস্পদ শ্রীযুক্ত নিখিলনাথ রায় মহাশয় এ কথার পােষকতা করেন না। তিনি লুৎফুন্নিসা বেগম সাহেবার কন্যা উম্মত জহুরা বংশীয়দিগের নিকট রক্ষিত কাগজপত্র হইতে জানিতে পারিয়াছেন যে, তাঁহার মাসিক বৃত্তি ১০০৲ টাকা মাত্র ছিল।
- ↑ Capt. J. E. Gastrell's “Statistical Account of Murshidabad”.
- ↑ Forster-"Journey from Bengal to England—1781.” Vol. I. P. 12 and Hunter's “Statistical Account of Murshidabad”-P. 73.
হিল সাহেবও (Hill) সত্য সত্যই লিখিয়াছেন:—
"Hated and despised by his subjects and foreigners alike, he left one faithful mourner in his life, Lutf-unnissa, who for many years employed mullahs to say prayers at his tomb which she used frequently to visit.” (Indian Records Series: Bengal—Vol. I. P. ccviii) - ↑ “This lady is now (1789) living at Murshidabad * * * She must not be confounded with Faizy or Faizen, another favourite of Serajudowlah.”—Mutaqherin—Vol. I. P. 614.
- ↑ “It would be interesting to know whether this lady was the same as Umdatunnissa Begum, who is described in the Nizamut as the widow of Siraj. If so, she did not die till 5 Rabi-us-Sani 1208, i. e. 10th November, 1794.” Calcutta Review—1892—P.204