তিলক

অটল যে-জন দাঁড়ায়ে ছিল অনেক নির্য্যাতনে
মর্য্যাদারি মৌন ধ্বজা তুলে,
প্রতিষ্ঠা যার লক্ষ লোকের নিষ্ঠাপূত মনে,
চিতায় শুয়ে আজ সে সিন্ধুকূলে।

মারাঠা যার চরণ-পীঁড়ি,— কীর্ত্তি দিগ্বিদিকে,
দৃষ্টিতে যার উঠ্‌তে কমল ফুটে,
বাংলা-মুলুক সত্যি ভালোবাস্‌ত যে বর্গীকে,
নেই রে সে আর হৃদয় নিতে লুটে!

তীর্থ হ’ল কয়েদখানা যাহার ইন্দ্রজালে,
নির্ব্বাসনে কাঁপত না যার হিয়া,
দিল যে-জন দীপ্তি-তিলক দৃপ্ত দেশের ভালে
বজ্র-মেঘের বিহ্ব্যুতে নিছিয়া;—

‘কেশরী’ যার বাহন ছিল— দোসর দেশের শুভ,
স্বাতন্ত্র্যে যে ছিল রাজার মত,
‘স্বরাজ’ ছিল স্বপ্ন যাহার, স্বদেশ-প্রীতি ধ্রুব,
সেই মহাপ্রাণ আজকে মরণ-হত।

সাঁচ্চা পুরুষ-বাচ্চা সে যে মর্দ্দ তেজের ছবি—
নয় কোনোদিন ত্রস্ত জুজুর ভয়ে;
ভিক্ষ-পন্থী নয় ভিখারী, নয় সে প্রসাদ-লোভী,
স্পষ্ট কথা বল্‌ত ঋজু হ’য়ে।

খোসামোদের তোষাখানায় ছিল না তার ঠাঁই,
আড়াই-কড়ার অনারেবল্‌ নয়,
সে ছিল লোক-মান্য তিলক, তুলনা তার নাই,
জাতীয়তার তিলক সে অক্ষয়।

হৃদয়ে তার নিত্য-উদয় শক্তিরূপা মাতা;
ললাটে তার বেদের সরস্বতী,
ভারত-রথের রথী ক’রে গড়েছিলেন ধাতা—
ছত্র-চামর-বিহীন ছত্রপতি!

ভূল-সময়ে এসেছিল হঠাৎ কেমন ক’রে
বিদায় নিল তেম্‌নি আচম্বিতে,—
খুঁজ্‌ছে যখন দেশের হৃদয় খুঁজ্‌ছে সকাতরে
যুগের যজ্ঞে পৌরোহিত্য নিতে।

কারার শেষে ঘরে এসে পায়নি সে যার দ্যাখা,
সেই সতী আজি ডাক দিয়েছে বুঝি,
বৈতরণীর তরণীতে তাই পাড়ি দ্যায় একা
তারার আলোয় পায়ের অঙ্ক খুঁজি।

চ’লে গেল ডুবিয়ে মশাল ভরা ঘিয়ের ঘটে
স্বদেশ-প্রেমের সজীব মন্ত্র দিয়ে।
চলে গেল কর্ম্মী ত্যাগী, অস্ত-সাগর-তটে
শরীর রেখে হঠাৎ ছুটি নিয়ে।

চ’লে গেল মৃত্য-পারে, রেখে অমর-স্মৃতি,
যম জয়ী যে তার জীবনের ভাতি-—
ভবিষ্যতের অন্ধকারে তার সে ভারত-প্রীতি
জাগবে যেমন বাতি-ঘরের বাতি।

তার সে চিতার ভস্ম-কণা উড়ে হাওয়ার ভরে
পড়বে যেথা নূতন তিলক হবে,
শ্মশান-শিবা যতই বলুক, সত্য-শিবের বরে
কীর্ত্তি তাহার অমর হ’য়ে রবে।