বিদায়-আরতি/দাবীর চিঠি



দাবীর চিঠি

রাজার উপর রাজা যিনি প্রণাম ক’রে তাঁর শ্রীপদে,—
দাবীর চিঠি পেশ করি আজ বিশ্বজনের পঞ্চায়তে।
কায়দা-কানুন্‌ জানিনে ভাই, বল্‌ছি সবার করে ধ’বে,
ও বিদেশী! গোরার জাতি! তোমরা শোনো বিশেষ ক’রে,
চক্রধরের চক্র যখন ঘুর্‌ছে বেগে মর্ত্ত্যলোকে,—
অধঃপাতের তলার মানুষ উঠ্‌ছে উদ্ধে সূর্য্যালোকে,—
পোল্যাণ্ড, হচ্চে স্বয়ম্প্রভু,—পাচ্চে ইরিন্‌ পাক্কা পাটা,
তখন যে হোম্‌রুল চেয়েছে খুব বেশী কি তার চাওয়াটা?
রাজা সুখে বিরাজ করুন, আমরা তাঁরে মান্য করি,
কালা গোরা দুই প্রজা তাঁর ছয়ে চালায় রাজ্যতরী;
এক্‌লা গোরায় সব করেছে যে কয় সে কয় গল্প-কথা,
কালার গোরার স্বেদ-শোণিতে সাম্রাজ্যোরি বনেদ পোঁতা;
আমরা দিছি গাঁটের পয়সা, আমরা দিছি দেহের রক্ত,
কর্‌তে মোদের অভেদ রাজার সিংহাসনের ভিত্তি শক্ত;
এম্পায়ারের চার-পায় আজ চার মহাদেশ ব্যাপ্ত করে,
কালার গোরার বল যুগপৎ যুক্ত আছে তার ভিতরে।
সাক্ষী ক্লাইভ-কালা-ফৌজ সাম্রাজ্যে্রি পত্তনেতে,
প্রথম যে ইট বসিয়েছে তা নিজের বুকের পাঁজর পেতে;
মিউটিনিতে আমরা ছিলাম তোমাদের পক্ষপাতী,
গোরার হয়ে অনেক গোলা নিহছি মোরা বক্ষ পাতি’;
অনেক যুদ্ধ জয় করেছি চীন কাবুল ও আফ্রিকাতে,
ধূলায় সোন ফলিয়ে দিছি সাগরপারের দ্বীপগুলাতে;
চৌকী দিছি শাংহায়ে আর মগের দেশে দিইছি মাথা;
তিববতেরও সন্ধি সুলুক্‌—যাক্ সে কথা তুলব না তা।

সে দিনেও যেই ডাক্‌ দিয়েছ অম্‌নি গেছি বেল্‌জিয়মে,
বোগদাদে দাদ তুল্‌তে তোমার ভয় করিনি জ্যান্ত যমে,
ভয় করিনি উড়ো-জাহাজ জহর-ধোয় হাউইট্‌জারে,
গোরার সঙ্গে গুর্খাও ও শিখ জান দেছে হাজার হাজারে।
যুদ্ধে যেমন দুঃসাহসী মন্ত্রণাতে তেম্‌নি সুধী,
শাসন-কাজে সমান পটু, কোন্‌ দরোজা রাখ্‌বে রুধি?
বাগ্বী মোরা, শিল্পী মোরা, কার্য্যে মোরা বিশ্বজয়ী,
বিজ্ঞানেতেও নইক তুচ্ছ, কারো চেয়েই ক্ষুদ্র নহি!
রাজ্যতরীর দাঁড় টানি রোজ, তোমরা রোজই হালে থাক,
পশ্চিমে ঝড় উঠছে, মাঝি আমাদেরও শিখিয়ে রাখ;
আমাদেরও দাও অধিকার, নাও তোমাদের সমান ক’রে,
সময়-মত লাগ্‌ব কাজে, শেখাও যদি হাতে ধ’রে।
অযোগ্য নই একেবারেই বল্‌ছি মোরা জোর গলাতে,
যদিও কালা-আদ্‌মী তবু—ইয়াদ রেখে দিনে রাতে—
মোদের ত্যাগে মোদের দানে পুষ্ট বিরাট্ রাষ্ট্র-হৃদি,
চার মহাদেশ চৌ-পায়া যার তোমার একার নয় সে নিধি।
ন্যায়ের দাঁড়িপাল্লা দিয়ে কর্‌লে ওজন দেখ্‌তে পাবে
আমরা নেহাৎ কম যাব না, যদিও আছি পরের তাঁবে?
কালার গোরার সমান দাবী—মহারাণীর ভাষায় কহি,
রাজার উক্তি উড়িয়ে দেবে?—তোমরা হবে রাজদ্রোহী!
 * * *
যোগ্যতা নেই?...দেখ চেয়ে মানব-ইতিবৃত্তময়
কালার দানের অঙ্ক গুলি গোরার চাইতে মলিন নয়!
কালা দেছে বাল্মীকি ব্যাস; গোরা দেছে মিল্টনে!
কালা দেছে বুদ্ধ আশোক; গোরা দেছে? কিং জনে?

কালার—জনক যজ্ঞবল্ক্য; গোরার?—আছেন মার্টিনো;
কালার-রঘু রাজেন্দ্র চোল; গোরার—ক্লাইভ মার্‌লব্রো।
কালা দেছে আর্য্যভট, গোরা দেছে নিউটনে,
কালা কৃতী জীবের সেবায়, গোবা vivisectionএ।
কালার ছিল বৌদ্ধ মিশন, গোরাব মিশন খৃষ্টীয়,
সবাই জানে কালার দেখেই নকল করে সৃষ্টি ও।
একদিকে ওই কণাদ কপিল, অন্য দিকে হিউম মিল্‌,
একদিকে অমৃতপ্রাশ, অন্য দিকে বীচাম্‌স্‌ পিল।
কালার ছিল চাণক্য; আর গোরার ছিল? ডিজ্‌রেলি!
তুলনা ছাই যাক চুলোতে মিছাই নামের ভিড় ঠেলি।
গোরার আছে ম্যাগ্‌না-কাটা, কালার না হয় নেইক তা,
Bill of Rights নয় কখনো নয় জীবনের শেষ কথা।
তা’ বলে নয় তুচ্ছ কালা, তার পলিটিক্‌স্‌ নয় আঁধার,
গোরার আছে পার্লামেণ্ট আর কালার ছিল সন্তাগার।
কালার কীর্ত্তি মিশর-দ্রাবিড় অবব-চীনেব সভ্যতা,
গোর র কীর্ত্তি? ডাইনামাইট-—সভ্য করার দ্রব্য তা!
গোরা যারে ভব্যতা কয় তিন্‌শো বছর বয়স তার,
কালার যা’ গৌরবের জিনিস—তার অন্তত তিন হাজার।
ব্রিটন দেছে ক্রমোয়েল, আর ভারত জামদগ্ন্য-রাম,
কার্ত্তবীর্য্য— চাল্‌স্‌ষ্টুয়ার্ট -কালায় গোরায় মিল তামাম।
 * * *
জাতির পাঁতির কল্‌মী-দামে আজকে না হয় বদ্ধ হাতী,
তই ব’লে কি ডুব্‌তে দেবে তোমরা না সব সভ্য জাতি?
জ্ঞানের বাতি আফ্রিকাতে জ্বাল্‌ছ নাকি? শুন্‌তে পাই।
মানুষ বিক্রী উঠিয়ে দেছ নিত্যি শোনাও এই কথাই।

তবে মোদের সকল দাবী দাবিয়ে কেন রাখ্‌তে চাও?
দাবীর কথা পাড়্‌তে গেলেই কুঁচ্‌কে ভুরু দাব্‌ড়ি দাও?
মানুষ হতে দাও আমাদের, ঘূচাও মনের এ আফ্‌শোষ,
ঘর-শাসনের দাও অধিকার, হোম্‌রুলে কি এতই দোষ?
বোয়ার পেলে, চোয়াড় পেলে, পেলে তাদের দোহারগণ,
মোদের ভাগ্যে খোঁয়াড় শুধু, বুঝ্‌তে নারি এ কেমন।
নিজের ঘরের বন্দেজে আর নিজের দেশের খিদ্‌মতে
ফিলিপিনোর চাইতে অধম ভাব্‌ছ মোদের কোন্‌ মতে?
প্রাপ্য যা তাই চাইছি মোরা—যেটুক মোদের হক্‌ দাবী,
হাঙ্গামা এ নয়কো মোটেই, রুষ্‌ছ মিছে ভুল ভাবি’।
সন্দেহে তো ঢের খাটালে, এবার ছুটি দাও তারে,
সংশয়ে যে বিনাশ করে সাম্রাজ্যেরও আত্মারে;
বিশ্বাসেরে পরখ করো, দ্যাখ নয় বিশ্বাস ক’রে,
চিন্‌লে না লোক দেড়শো বছর একত্রে ভাই বাস ক’রে?
বুঝতে নারি খেল্‌তে ব’সে খেঁড়ির সঙ্গে আড়াআড়ি,
শত্রুরই বুক বাড়্‌ছে এতে মিটিয়ে ফেল তাড়াতাড়ি;
তোমার হচ্ছে ছক্কা পাঞ্জা খেঁড়ির কিছুই হচ্চেনাকো
বল্লে তা’ কেউ কলিকালে মান্‌বে এমন আশা রাখো?
দেড়শো বছর আমরা আছি পাশাপাশি বিশ্বকূলে,
গঙ্গা এবং যমুনা ধায় সঙ্গমে তরঙ্গ তুলে,
কালার গোরার এম্পায়ার এ, ঠেল্‌বে কারে রাখ্‌বে বেছে,
কালার গোরার যুক্তবেণী হরিহরের মূর্ত্তি এ যে!
জ্বলছে তেজে ন্যায়ের চক্ষু, ন্যায়ের কণ্ঠে হয় ঘোষণা,—
আইন তোমার কয় হেঁকে ওই—কেউ ছোটো না কেউ ছোটোনা,
—বল্‌ছে সত্য, বল্‌ছে ধর্ম্ম, মনুষ্যত্ব বল্‌ছে শোনো,
বল্‌ছে তোমার ঘরের লোকও, বল্‌ছে তোমার আপন জনও;

ব্রিটানিয়ার বিবেক-বুদ্ধি প্রবুদ্ধ আজ বেস্যাণ্টরূপে,
ধন্য হবে ব্রিটন,—যদি তাঁর বাণী আজি লয় সে লুফে;
শক্তি হবে সংহত, দুর্জ্জয় হবে গো বিশ্বেরি মাঝ—
তিরিশ কোটির হৃদয় যদি লয় জিনি হোম্‌রুল দিয়ে আজ;
মানুষ মনুষ্যত্বে যদি মান্‌তে পারে হৃদয় খুলে
চল্‌বে তবে যুগে যুগে বাজিয়ে ভেরী নিশান তুলে;
অমর হবে মর্ত্যে, সদাই সাম্‌নে পাবে পুষ্পিত পথ,
গরীব দেশের হক্‌ দাবীতে কান দিলে নাম গাইবে জগৎ।
নইলে পরে লাভের ঘরে অমর হ’য়ে অযশ রবে,
হক দাবী যার তার কি ক্ষতি? পাওন আদায় হবেই হবে।
বিশ্ববিধান বিধির বিধান, ন্যায়ের নিধান নিত্যকালে—
হক দাণী যার বুক তাজা তার ‘হার’ লেখে না তার কপালে