বিদ্যাসাগর-প্রসঙ্গ/সংস্কৃত শিক্ষার সংস্কার
বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গ
সংস্কৃত শিক্ষার সংস্কার
খৃষ্টীয় অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর ঘটনা-বিপর্যয়ের ফলে বাংলার পুরাতন ধারা একেবারে বদলাইয়া গিয়াছে। অষ্টাদশ শতাব্দী রাষ্ট্রনৈতিক পরিবর্ত্তনের যুগ, আর উনবিংশ শতাব্দী চিন্তারাজ্যের বিবর্ত্তনের যুগ। এই শেষোক্ত যুগকে ‘রেনেসাঁস্’ বা ‘ভারতের নবজীবন’ আখ্যা দেওয়া যাইতে পারে। ইংরেজ যখন ভারতবর্ষে দখল আরম্ভ করে, তখন দেশীয় রাজ্যগুলির শুধু যে ভগ্নাবস্থা ছিল তাহা নহে,—সমাজ এবং ভারতীয় মধ্যযুগের সভ্যতাও তখন জীর্ণ, মৃত। পুরাতন ভাঙিয়া পড়িয়াছে, কিন্তু নূতন তখনও গড়িয়া উঠে নাই। এইরূপ অবস্থায় কিছুদিন কাটিয়া গেল। পলাশীর যুদ্ধের ৭৫ বৎসর পরে, লর্ড উইলিয়ম বেণ্টিঙ্কের আমলে নবযুগের আরম্ভ।
রাজা রামমোহন রায় এই নবযুগের প্রবর্ত্তক। তিনি যে বিপ্লবের সূচনা করেন, তাহা চিন্তারাজ্যের বিপ্লব। সে আন্দোলন ক্রমে শক্তিসঞ্চয় করিয়া এদেশে আমূল পরিবর্তন আনিয়াছে। সেই পরিবর্তনের ফল-নূতন সাহিত্য, মনের নূতন বিশ্বাস, সমাজের নূতন গঠন, রাষ্ট্রনৈতিক ক্ষেত্রে নুতন জীবন,—এক কথায় ভারতবর্ষের আধুনিক সভ্যতা।
এই পরিবর্তন দুই ধারায় বহিয়া গিয়াছে। পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞানের আলোচনা ইহার এক ধারা; অপর ধারা—ভারতের সেই বিস্মৃত বিশুদ্ধ প্রাচীন সাহিত্য, জ্ঞান ও চিন্তার পুনরুদ্ধার। এই উভয় ক্ষেত্রেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নেতা। এককে তিনি প্রাচীন সংস্কৃতশাস্ত্রে সূক্ষ্মবিচারশীল পণ্ডিত; অপর দিকে তিনি বঙ্গ ভাষায় সম্পূর্ণ আধুনিক ধরণের শিক্ষাপদ্ধতির প্রতিষ্ঠাতা এবং সম্পূর্ণ ভারতীয় কাশ্মীর দ্বারা পরিচালিত উচ্চশ্রেণীর ইংরেজী বিদ্যালয়ের স্রষ্টা। একদিকে তিনি যেমন মানবহিতৈষী সহৃদয় সমাজ-সংস্কারক, অন্যদিকে তেমনি অগ্রগণ্য শিক্ষারথী,—ঐ দ্বি-ধারায় প্রবাহিত আধুনিক শিক্ষাপদ্ধতির অগ্রদূত। সরকারী দপ্তরখানায় আবিষ্কৃত অপ্রকাশিত চিঠিত্রের সাহায্যে, শিক্ষাবিস্তারে বিদ্যাসাগরের অতুলনীয় কার্য্যাবলীর যে পরিচয় পাওয়া যায়, তাহার আলোচনায় শুধু আমাদের কৌতূহল নিবৃত্ত হইবে না, জ্ঞানবৃদ্ধিরও সহায়তা করিবে।
মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত বীরসিংহ গ্রামে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে ঈশ্বরচন্দ্র জন্মগ্রহণ করেন (২৬ সেপ্টেম্বর, ১৮২০)। অল্প বয়স হইতেই তাঁহার প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। বংশগত প্রথামত তাঁহার পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় বালক ঈশ্বরচন্দ্রকে প্রথমে সংস্কৃত-সাহিত্য শিখাইতে মনস্থ করেন। নয় বৎসর বয়সে ঈশ্বরচন্দ্রকে কলিকাতার গভর্ন্মেণ্ট সংস্কৃত কলেজে ভর্ত্তি করিয়া দেওয়া হয় (১ জুন, ১৮২৯)। প্রায় সাড়ে বার বৎসর কলেজে অধ্যয়নের ফলে তিনি ব্যাকরণ, সাহিত্য, অলঙ্কার, গণিত, ন্যায়, দর্শন ও ধর্ম্মশাস্ত্রে অনন্যসাধারণ ব্যুৎপত্তিলাভ করেন। তাঁহার সমগ্র ছাত্রজীবন অপূর্ব কৃতিত্বে সমুজ্জ্বল। একুশ বৎসর বয়সে পাঠ সমাপন করিয়া তিনি কলেজ হইতে বাহির হইলেন। অসাধারণ মেধা ও পাণ্ডিত্যের মর্য্যাদা-স্বরূপ অধ্যাপকবর্গ তাঁহাকে “বিদ্যাসাগর” উপাধিতে বিভূষিত করিলেন (ডিসেম্বর, ১৮৫১)।
সংস্কৃত কলেজ হইতে বাহির হইয়া সৌভাগ্যক্রমে শিক্ষা বিভাগেই বিদ্যাসাগরের চাকরি জুটিল। ১৮৪১ খৃষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে মধুসূদন তর্কালঙ্কারের মৃত্যু হইলে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা বিভাগের সেরেস্তাদারের পদ খালি হয়। ঈশ্বরচন্দ্র সেই পদের প্রার্থী হইলেন। সংস্কৃত কলেজের কার্য্যের সহিত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সেক্রেটারি —কাপ্তেন মার্শালের ঘনিষ্ঠ যোগ ছিল! সেই সূত্রে ঈশ্বরচন্দ্রের ছাত্রজীবনের কৃতিত্বের সহিত তিনি পুর্ব্ব হইতেই পরিচিত ছিলেন। মার্শাল ঈশ্বরচন্দ্রের উচ্চ প্রশংসা করিয়া বঙ্গীয় গভর্ন্মেণ্টের নিকট এক সুপারিশ-পত্র পাঠাইলেন। সেই পত্র হইতে জানা যায়, দ্যিাসাগর একদিকে যেমন সাহিত্যের সর্ব্ববিভাগে বুৎপত্তিলাভ করিয়াছিলেন, তেমনি স্মৃতিশাস্ত্রেও তাঁর জ্ঞান অল্প ছিল না। ইংরেজী তখন তিনি সামান্যই জানিতেন! সেই বৎসরের ২৯এ ডিসেম্বর বিদ্যাসাগর মাসিক ৫০৲ টাকা বেতনে সেরেস্তাদারের পদে বাহাল হইলেন। বর্ত্তমান বাংলার সর্ব্বপ্রধান শিক্ষাগুরুর ইহাই কর্ম্মজীবনের আরম্ভ।
কাপ্তেন মার্শাল সেরেস্তাদারের কাজে খুশী হইয়া উঠিলেন। পণ্ডিতের সংশ্রবে আসিয়া তিনি ক্রমেই তাঁহার বুদ্ধির সূক্ষ্মতা, জ্ঞানের গভীরতা, কর্ম্মের ক্ষমতা এবং স্থৈর্য, তেজস্বিতা ও চরিত্রবলে মুগ্ধ হইয়া পড়িতে লাগিলেন। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে থাকিবার কালে অনেক উচ্চশ্রেণীর ইংরেজ ও গণ্যমান্য দেশীয় বড়লোকের সহিত বিদ্যাসাগরের আলাপ-পরিচয় হয়। কাপ্তেন মার্শাল কাউন্সিল অফ এডুকেশন বা শিক্ষা-পরিষদের সম্পাদক ডাঃ ময়েটের সহিত বিদ্যাসাগরকে পরিচিত করাইয়া দেন। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের চাকরি বিদ্যাসাগরের জীবনের গতি নির্দ্দেশ করিল। এই চাকরি- গ্রহণের ফলে তাঁহাকে ভাল করিয়া ইংরেজী শিখিতে হইল; শেষে এই চটি-পরা পণ্ডিতের ইংরেজীর দখল দেখিয়া নব্য শিক্ষিতেরাও বিস্ময়াবিষ্ট হইয়াছিলেন।
১৮৪৬ সালের মার্চ মাসে রামমাণিক্য বিদ্যালঙ্কারের পরলোকগমনে কলিকাতা সংস্কৃত কলেজে সহকারী সম্পাদকের পদ শূন্য হয়। ডাঃ ময়েট এই পদে একজন সুযোগ্য লোক নির্ব্বাচনের জন্য কাপ্তেন মার্শালের সহিত পরামর্শ করিতে যান। মার্শাল দেখিলেন, ইংরেজীও জানে, সংস্কৃতেও অভিজ্ঞ এমন পণ্ডিত আছে এক বিদ্যাসাগর। তিনি ময়েটের কাছে বিদ্যাসাগরের কথাই বলিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র মাসিক ৫০৲ টাকা মাহিনায় সংস্কৃত কলেজের সহকারী সম্পাদকের পদে নিযুক্ত হইলেন। (এপ্রিল, ১৮৪৬)। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বিদ্যাসাগরের স্থানে লওয়া হইল—তাঁহার ভ্রাতা দীনবন্ধু ন্যায়রত্নকে। দীনবন্ধুও সংস্কৃত কলেজের কৃতী ছাত্র।
ঠিক এই সময় পণ্ডিত জয়গোপাল তর্কালঙ্কারের মৃত্যুতে সংস্কৃত কলেজে সাহিত্য-শাস্ত্রের অধ্যাপকের পদ খালি হইল। কলেজের সম্পাদক রসময় দত্ত বিদ্যাসাগরকেই শূন্যপদে বসাইবেন স্থির করিয়াছিলেন। এই পদ গ্রহণ করিলে বিদ্যাসাগরের মাসিক আয় আরও ৪০৲ টাকা বাড়িত। কিন্তু এ কাজ তিনি তাঁহার সতীর্থ মদনমোহন তর্কালঙ্কারকেই ছাড়িয়া দিলেন। তর্কালঙ্কার তখন ৫০৲ টাকা বেতনে কৃষ্ণনগর কলেজের হেড-পণ্ডিত।
বিদ্যাসাগর উৎসাহের সহিত সংস্কৃত কলেজে নূতন নীতি চালাইতে প্রবৃত্ত হইলেন। তিনি এক উন্নত প্রণালীর পঠন-ব্যবস্থার রিপোর্ট প্রস্তুত করিলেন। কলেজের সম্পাদক বিদ্যাসাগরের রিপোর্টের প্রধান প্রস্তাবগুলি শিক্ষা-পরিষদে পেশ করিলেন। সেগুলি গৃহীতও হইল। সংস্কৃত কলেজের পাঠ্যবিষয় ও রুটিন প্রভৃতি অনেকটা বদলাইয়া গেল।
এ কার্য্য কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্রকে বেশী দিন করিতে হইল না। সম্পাদক রসময় দত্ত সংস্কারের বহর দেখিয়া শঙ্কিত হইয়া উঠিলেন। বিদ্যাসাগরের কতকগুলি প্রস্তাব তিনি একেবারে নাকচ করিলেন। সেই বাধায় বিদ্যাসাগরের জ্বলন্ত উৎসাহ নিমেষে শীতল হইয়া গেল। স্বাধীনচেতা পণ্ডিত চটিয়া কার্য্যে ইস্তফা দিলেন (এপ্রিল, ১৮৪৭)। বন্ধুদের সহস্র অনুরোধ তাঁহাকে এ কার্য্য হইতে নিবৃত্ত করিতে পারিল না। বিদ্যাসাগর-চরিত্রের ইহা এক বিশেষত্ব।
মার্শাল ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্রের গুণমুগ্ধ ও হিতৈষী। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে হেড-রাইটার ও কোষাধ্যক্ষের কাজ খালি হওয়ায় তিনি তখনই সেই পদে বিদ্যাসাগরকে বাহাল করিলেন। এই পদ শূন্য হওয়ার ইতিহাসটুকু চিত্তাকর্ষক। দেশ-বিখ্যাত সুরেন্দ্রনাথের পিতা, তালতলার দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে কাজ করিয়াও অতিরিক্ত ছাত্র হিসাবে মেডিক্যাল কলেজে লেকচার শুনিতে যাইতেন। অবশেষে তিনি ডাক্তারি করাই শ্রেয় বলিয়া স্থির করিলেন। ১৮৪৯, ১৬ই জানুয়ারি মেজর মার্শালের হাতে দুর্গাচরণ পদত্যাগপত্র দাখিল করিলে, তাঁহার স্থানে পাঁচ হাজার টাকার জামিনে মাসিক ৮০৲ টাকা বেতনে বিদ্যাসাগর নিযুক্ত হইলেন।
১৮৫০ খৃষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে সংস্কৃত কলেজের সাহিত্য-শাস্ত্রের অধ্যাপক মদনমোহন তর্কালঙ্কার জজপণ্ডিত নিযুক্ত হইয়া মুর্শিদাবাদ চলিয়া গেলেন। শিক্ষা-পরিষদের সেক্রেটারি ডাঃ ময়েট তাঁহার স্থানে বিদ্যাসাগরকে নিযুক্ত করিবার অভিপ্রায় প্রকাশ করেন। কিন্তু নানা কারণে বিদ্যাসাগর এই পদ গ্রহণ করিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করিলেন। শেষে ডাঃ ময়েট বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করায় বিদ্যাসাগর জানাইলেন, শিক্ষা-পরিষদ তাঁহাকে প্রিন্সিপালের ক্ষমতা দিলে তিনি ঐ পদ গ্রহণ করিতে পারেন। ডাঃ ময়েট বিদ্যাসাগরের নিকট হইতে ঐ মর্ম্মে একখানি পত্র লিখাইয়া লইলেন।
১৮৫০, ৪ঠা ডিসেম্বর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ছাড়িয়া বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজে সাহিত্য-শাস্ত্রের অধ্যাপক নিযুক্ত হইলেন। সংস্কৃত কলেজের প্রকৃত অবস্থা কি, এবং কিরূপ ব্যবস্থা করিলে কলেজের উন্নতি হইতে পারে—এ বিষয়ে রিপোর্ট করিবার জন্য বিদ্যাসাগরের উপর ভার পড়িল। ১৬ই ডিসেম্বর বিদ্যাসাগর ‘দীর্ঘচিন্তা ও যথেষ্ট বিবেচন-প্রসূত’ এক বিস্তৃত রিপোর্ট শিক্ষা-পরিষদে দাখিল করিলেন|[১] কলেজ-পরিচালনের বিধি-ব্যবস্থা ও পাঠ্যপ্রণালীর বহুবিধ পরিবর্তন সমর্থন করিয়া এই রিপোর্ট লিখিত। পুনর্গঠিত সংস্কৃত কলেজ যে সংস্কৃত বিদ্যানুশীলনের কেন্দ্র ও মাতৃভাষা-রচিত সাহিত্যের জন্মক্ষেত্র হইবে, এবং এই বিদ্যালয়ের ছাত্ররাই যে শিক্ষকরূপে একদিন জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষা, জ্ঞান ও সাহিত্যরস বিতরণ করিবে,—পরির্ত্তনের ফল যে একান্ত শুভ ও আশাপ্রদ,— রিপোর্ট তিনি এ কথা দৃঢ়তার সহিত জানাইলেন।
শিক্ষা-পরিষদ এমনই একজন কার্য্যপ_, দৃঢ়চিত্ত লোককে চাহিতেছিলেন। সংস্কৃত কলেজ সম্পূর্ণরূপে পুনর্গঠিত করা যায় কি না—এই, কথাই কিছুদিন হইতে তাহারা ভাবিতেছিলেন। ঠিক এই সময়ে সংস্কৃত কলেজের সেক্রেটারি রসময় দত্ত অবসর গহণ করিলে পুরাতনের বাধা সরিয়া গেল। শিক্ষ-পরিষদ বঙ্গীয় গভর্ন্মেণ্টকে লিখিলেন—
‘বাংলায় সাহিত্য-সৃষ্টি ও সাহিত্যের উন্নতিবিধানের যে আন্দোলন সুরু হইয়াছে, কর্ম্মিষ্ঠ লোকের হাতে পড়িলে সংস্কৃত কলেজ সেই আন্দোলনের সহায়করূপে অনেক কাজ করিতে পারে।
‘বাবু, রসময় দত্তের পদত্যাগে এই প্রতিষ্ঠানের পুনর্গঠনের একমাত্র অন্তরায় দূর হইল। কলিকাতা মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ডাঃ স্প্রেঙ্গার আর্ব্বী ভাষায় যেরূপ সুপণ্ডিত, সেইরূপ সংস্কৃত ভাষায় ব্যুৎপন্ন কোনো পাশ্চাত্য পণ্ডিত পাওয়া যাইতেছে না। এক্ষেত্রে শিক্ষা-পরিষদের মতে, পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র শর্ম্মা একমাত্র উপযুক্ত ব্যক্তি। একদিকে তিনি ইংরেজী ভাষায় অভিজ্ঞ, অন্যদিকে সংস্কৃত-শাস্ত্রে প্রথম শ্রেণীর পণ্ডিত। শুধু তাই নহে, তাঁহার মত উদ্যমশীল, কর্ম্মনিপুণ, দৃঢ়চিত্ত লোক বাঙালীর মধ্যে দুর্লভ। তাঁহার রচিত ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’ ও ‘চেম্বার্সের বায়োগ্রাফি’র বঙ্গানুবাদ সমস্ত গভর্ন্মেণ্ট স্কুল-কলেজেই বাংলার পাঠ্যপুস্তক হিসাবে পড়ানো হয়। তিনি অধ্যক্ষ হইলে বর্তমান সহকারী সম্পাদক শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্নকে সাহিত্য-শাস্ত্রের অধ্যাপকের পদ দেওয়া যাইতে পারে। সম্পাদক ও সহ-সম্পাদকের পদ উঠিয়া যাইবে। এই দুই পদের বেতন মোট ১৫০৲ টাকা। অধ্যক্ষকে এই ১৫০৲ টাকা দিলেই চলিবে। সুতরাং এই পরিবর্ত্তনে ব্যয়বৃদ্ধির কোনো আশঙ্কা নাই।
‘গভর্ন্মেণ্টের অনুমোদনের অপেক্ষায় সম্প্রতি অস্থায়িভাবে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্রের উপরই সংস্কৃত কলেজের তত্ত্বাবধানের ভার অর্পিত হইল।” (৪ঠা জানুয়ারি, ১৮৫১)[২]
সরকার শিক্ষা-পরিষদের প্রস্তাব মঞ্জুর করিলেন। বিদ্যাসাগর মাসিক দেড় শত টাকা বেতনে সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপাল হইলেন (২২এ জানুয়ারি, ১৮৫১)। এক কথায়, কলেজের সংস্কার, পুনর্গঠন ও পরিবর্তনের পূর্ণ অধিকার তাঁহার হাতে দেওয়া হইল।
১৮৫১ হইতে ১৮৫৩ খৃষ্টাব্দের সংস্কৃত কলেজের ইতিহাস প্রকৃতপক্ষে ইহার পুনর্গঠনের ইতিহাস। বিদ্যালয়ের শাসনশৃঙ্খলার দিকে বিদ্যাসাগর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখিলেন। নিয়মিত উপস্থিতির দিকে নজর রাখা হইল; সামান্য কারণে শ্রেণীত্যাগ এবং অকারণ গণ্ডগোল ও বিশৃঙ্খলা প্রভৃতি নিবারণ করার দিকেও যথেষ্ট মনোযোগ দেওয়া হইল। প্রতি অষ্টমী ও প্রতিপদে কলেজের ছুটি বন্ধ করিয়া সপ্তাহান্তে রবিবারে ছুটির দিন ধার্য হইল। পূর্বে কেবল ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য ছাত্রই সংস্কৃত কলেজে পড়িবার অধিকারী ছিল। কিন্তু বিদ্যাসাগর ছিলেন—দেশে শিক্ষাবিস্তার ও লোকের জ্ঞানবৃদ্ধির পরম বন্ধু। তিনি ১৮৫১, জুলাই মাসে প্রথমে কায়স্থ, পরে ১৮৫৪, ডিসেম্বর মাসে যে-কোনো সম্ভ্রান্ত ঘরের হিন্দুকে সংস্কৃত কলেজে পড়িবার অবাধ অনুমতি দিলেন।
বিদ্যাসাগর নিজের কলেজের জন্য আর একটি কাজ করিলেন। সংস্কৃত কলেজের সম্মান ও ছাত্রদের ভবিষ্যতের উপরও যে তাঁহার প্রখর দৃষ্টি ছিল, ইহাতে তাহারই পরিচয় পাওয়া যায়। হিন্দুকলেজ ও মাদ্রাসার পাশ-করা কৃতবিদ্য ছাত্রদের ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেটের পদ দেওয়া হইত। বিদ্যাসাগর শিক্ষা-পরিষদের মধ্য দিয়া গভর্ন্মেণ্টের কাছে সংস্কৃত কলেজের সুযোগ্য ছাত্রদিগকে এই বিষয়ে সমান সুযোগ ও সুবিধা দিবার সনির্ব্বন্ধ প্রার্থনা জানাইলেন (১৩ই জানুয়ারি, ১৮৫২)। প্রার্থনা গ্রাহ্য হইয়াছিল। সংস্কৃত কলেজের ছাত্রদিগকে পরে ডেপুটিগিরি দেওয়া হইত।[৩]
১৮২৪ সালে প্রতিষ্ঠা হইতে সংস্কৃত কলেজ অবৈতনিক বিদ্যালয় ছিল। ফলে দাঁড়াইয়াছিল এই, ছাত্রের বিনা প্রতিবন্ধে কলেজে প্রবেশলাভ করিতে পারিত এবং পরে সুবিধা পাইলেই অন্য ইংরেজী বিদ্যালয়ে চলিয়া যাইত। এমনও হইত, ভর্ত্তি হইয়া নাম লিখাইয়া ছেলের আর দেখা নাই, তারপর দীর্ঘ অনুপস্থিতির ফলে যখন হাজিরা খাতা হইতে নাম কাটা গেল, তখন ছাত্র অথবা ছাত্রের অভিভাবক এমন করিয়া আসিয়া কর্ত্তৃপক্ষকে ধরিয়া পড়িল যে, নিবেদন অগ্রাহ্য করা দুরূহ। এইসব অসুবিধা দূর করিবার জন্য বিদ্যাসাগর ১৮৫২ সালের আগষ্ট মাসে প্রথমে দুই টাকা প্রবেশ-দক্ষিণার ব্যবস্থা প্রবর্তন করিলেন। পুনঃপ্রবেশের জন্যও ঐ ব্যবস্থা বাহাল হইল। তারপর ১৮৫৪, জুন মাসের মাঝামাঝি মাসিক এক টাকা বেতনের বন্দোবস্ত হইল। ইহাতে অব্যবস্থিতচিত্ত ছাত্রদের কিঞ্চিৎ চৈতন্যোদয় হইল, বিদ্যালয়ে নিয়মিত উপস্থিতির হারও যথেষ্ট বাড়িয়া গেল।
১৮৫১ সালের নভেম্বর মাসে সংস্কৃত কলেজে এক উন্নত প্রণালীর শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্ত্তিত হইল। ব্যাকরণ-বিভাগ সম্পূর্ণরূপে পুনর্গঠিত হইল। পূর্ব্বে বোপদেবের ‘মুগ্ধবোধ’ ছিল ব্যাকরণের একমাত্র পাঠ্যপুস্তক। সংস্কৃত শিক্ষার গোড়াতেই সংস্কৃতে লেখা এই দুরূহ ব্যাকরণখানি ছেলেদের পড়িতে হইত। এখানি আয়ত্ত করিতে লাগিত—চার-পাঁচ বৎসর; তাও ছেলেরা অর্থ না বুঝিয়াই মুখস্থ করিত। কাজেই সংস্কৃত-সাহিত্য পড়িবার সময় এই মুখস্থ বিদ্যা বিশেষ কাজে লাগিত না; দেখা যাইত, ভাষায় তাহারা আশানুরূপ অধিকার লাভ করে নাই। বিদ্যাসাগর ছেলেদের বাধাটুকু বুঝিতে পারিলেন। তিনি দেখিলেন, বাঙালী ছাত্রকে সংস্কৃত শিখাইতে হইলে বাংলায় ব্যাকরণ পড়াইতে হইবে। তিনি ‘মুগ্ধবোধ’ পড়ানো বন্ধ করিলেন এবং তাহার পরিবর্ত্তে বাংলায় লেখা স্বরচিত ‘সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা’ ও ‘ব্যাকরণ কৌমুদী’ ধরাইলেন। এই সঙ্গে ‘ঋজুপাঠ’ও পড়ানো হইতে লাগিল। সংস্কৃত গদ্য ও কাব্য হইতে কতকগুলি নির্ব্বাচিত অংশ ঋজুপাঠে সন্নিবেশিত হইয়াছে। এই নব ব্যবস্থার ফল ভালই হইল। সাধারণ ছাত্রদের পক্ষে এই ব্যবস্থায় সংস্কৃতে মোটামুটিরূপে ব্যুৎপত্তি লাভ করিতে তিন বৎসরের বেশী সময় লাগে না।
বিদ্যাসাগর সংস্কৃত শিক্ষার বাধাবিপত্তি এমনি করিয়া দূর করিলেন। কিন্তু তাঁহার সামনে এখনও সংস্কৃত কলেজের ইংরেজী-বিভাগ পুনর্গঠিত করিবার কাজ পড়িয়া রহিল।